বুধবার | ২৫শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১০ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ১১:৩৮
Logo
এই মুহূর্তে ::
নোবেল বিজয়ী কথাসাহিত্যিক উইলিয়াম ফকনার : মনোজিৎকুমার দাস কার্ল মার্কসের পরিজন, পরিকর (তৃতীয় পর্ব) : দিলীপ মজুমদার সফলা একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত সুবিমল মিশ্র-র ছোটগল্প ‘বাব্বি’ হাইনরিখ হাইনে ও তাঁর ইতিহাসবোধ : মিনহাজুল ইসলাম আবার মহাভারত : শশী থারুর ভিয়েতনামের গল্প (দ্বিতীয় পর্ব) : বিজয়া দেব মহারানী ভিক্টোরিয়া ও মুন্সী আব্দুল করিম-এর অমর প্রেম : মাহবুব আলম শাড়িদিবসে এক শাড়িবিলাসিনীর ভালোবাসা : নন্দিনী অধিকারী আম্বেদকর প্রসঙ্গে বিজেপি দলিত বিরোধী তথা মনুবাদী রূপ প্রকাশ করে ফেলেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী যে আখ্যানে অভিজ্ঞতার উত্তরণ ঘটেছে দার্শনিকতায় : ড. পুরুষোত্তম সিংহ যেভাবে লেখা হলো ‘কবি’ উপন্যাস : জাকির তালুকদার শ্যামাপ্রসাদ ঘোষের ছোটোদের লেখা কবিতা — শব্দে-বর্ণে নির্মিত শৈশবের চালচিত্র : অমৃতাভ দে ভিয়েতনামের গল্প (প্রথম পর্ব) : বিজয়া দেব লেখা যেন কোনভাবেই মহত্ না হয়ে যায় : অমর মিত্র আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্ত : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন চাল চকচকে করতে বিষ, সবজিতেও বিষাক্ত হরমোন প্রয়োগ, চিন্তায় বিশেষজ্ঞরা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় কার্ল মার্কসের পরিজন, পরিকর (দ্বিতীয় পর্ব) : দিলীপ মজুমদার স্মিতা পাতিল — অকালে ঝরে পড়া এক উজ্জ্বল নক্ষত্র : রিঙ্কি সামন্ত কীভাবে রবীন্দ্রনাথ ‘ঠাকুর’ হলেন : অসিত দাস সর্ব ধর্ম সমন্বয় — ক্ষীর ভবানী ও শঙ্করাচার্যের মন্দির : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী কার্ল মার্কসের পরিজন, পরিকর (প্রথম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার হরিপদ দত্ত-র ছোটগল্প ‘আত্মজা ও পিতা’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় : আবদুল মান্নান সৈয়দ নবেন্দু ঘোষ-এর ছোটগল্প ‘ত্রাণ-কর্ত্তা’ অরণি বসু সরণিতে কিছুক্ষণ : ড. পুরুষোত্তম সিংহ অন্য এক ইলিয়াস : আহমাদ মোস্তফা কামাল খেজুর গাছের সংখ্যা কমছে, গাছিরা চিন্তায়, আসল সুস্বাদু খেজুরগুড় ও রস বাজারে কমছে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় কেকা অধিকারী-র ছোটগল্প ‘গাছমানুষ’ মনোজিৎকুমার দাস-এর ছোটগল্প ‘বিকেলে ভোরের ফুল’
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে বড়দিনের বিশেষ দিনে জানাই Merry Christmas! আন্তরিক শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

হাইনরিখ হাইনে ও তাঁর ইতিহাসবোধ : মিনহাজুল ইসলাম

মিনহাজুল ইসলাম / ৩৬ জন পড়েছেন
আপডেট সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

ফ্রয়েডের চিঠিপত্রে পড়তে গিয়ে হাইনরিখ হাইনের নাম প্রথম শুনি, তারপর অন্যান্য সব বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকদের মতোই তাকে শ্রদ্ধার নজরে দেখেছি যদিও তার অতি অল্প কবিতাই পড়া হয়েছিলো বিশেষ করে কিছু গীতিকবিতা। ফ্রয়েডের চিঠি পড়ে যেরকমটা মনে হয়েছিলো উনিশ শতকের জার্মান যেকোনো যুবকের প্রথম হোক দ্বিতীয় বা তৃতীয়, প্রেম মানেই সেটা অতি মোহ প্রকাশ হিসেবে গ্যোতের উপন্যাস এবং হাইনের কবিতা, এক কথায় বলতে গেলে সে সময়ের জার্মান যুবকদের প্রেমসত্তা সৃষ্টির পূর্বশর্ত হলো হাইনের একেকটি কবিতা হোক তা মধুর সুনীল কিংবা বিষাদের আতঙ্কে আতঙ্কিত।

বেশ কয়েকদিন যাবত হাইনের কিছু কবিতা পড়ার প্রবল ইচ্ছা জাগ্রত হলো (উনিশ শতকের জার্মান যুবক না হতে পারি, বিথোফেন কিংবা ব্রাহামস দের সুরে গড়া জার্মান কর্কশ মাটির অতি নান্দনিক শহরের অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অপরিহার্য সুরের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার না হতে পারি) তাতে কি হাইনের দুটো কবিতা পড়ার অধিকার কি আমার কমে যায়? অবশ্যই না। কিন্তু হাইনের কবিতা কিছু খুজতে গিয়ে যে বিষয়টি আমি আবিষ্কার করলাম তার জন্য হয়তো আমি চিরকাল প্রত্যাশা করে আসছিলাম কিংবা বিধাতার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ হওয়ার চির আকাঙ্খা আমার চিরদিনই ছিলো কিন্তু সেটা হওয়ার সুযোগ যে আদৌ এই ভাবে হবে তা আমি কোনো স্বপ্নীল সুপ্ত তারা ভরা মিঠে রাত্রিতে নিস্তব্ধ কোনো তন্দ্রার স্বপ্নেও ভাবিনি!

তা হলো হাইনের লিখা একটি বই, যা আমার মতে খুবই অজনপ্রিয় (এই অর্থে যে এখনো পর্যন্ত এই বইয়ের রেফারেন্স আমি বিশ শতকের কোনো বড় দার্শনিকের লেখা বা সাক্ষাৎকারে পাইনি, তার মানে এই না যে আমি সব দার্শনিকের লেখা বই বা সাক্ষাৎকারের সাথে পরিচিত কিন্তু সাধারণ অর্থে আর কি) কিন্তু অতি আশ্চর্যজনক!  হাইনের লেখা একটি বই “Zur Geschichte der Religion und Philosophie in Deutschland” (On the History of Religion and Philosophy in Germany) , বাংলায় অনুবাদ করলে অনেকটা এরকম শোনায় “জার্মান দেশের ধর্ম ও দর্শনের ইতিহাস প্রসঙ্গে ” (জার্মান দেশ বললাম কারণ Deutschland শব্দের সরাসরি অর্থ জার্মান দেশ যা এখন জার্মান জাতিরাষ্ট্র কে বোঝায় সেদিকে ইঙ্গিত করে)

প্রথমে অবাক হচ্ছিলাম এই ভেবে যে আমি আসলে অবাক হবো কোন বিষয়ে, কারণ অবাক হওয়ার বিষয় দুটো, প্রথমত এরকম বই আমি তন্ন তন্ন করে খুজেছি, নেহাৎ একাডেমিক বই ছাড়া আর কিছুই পাইনি, আর যা পেয়েছি তা অনেক বিচ্ছিন্ন সেখানে “জার্মান দেশের ধর্ম” অর্থাৎ হাইনের মতে জার্মান দেশে মধ্য যুগে যে ক্যাথলিসিজম ছিলো কিংবা পরে যে প্রটেস্ট্যান্টিজমের আবির্ভাব হয় সেটা ইউরোপ কি, বিশ্বের সকল ক্যাথলিসিজম এবং প্রটেস্ট্যান্টিজম থেকে অনেক ভিন্ন কারণ সেখানে ছিলো শত বছরের জার্মান মিথলজি এবং জার্মান পুরোনো রহস্যবাদের মিশ্রণ।  দ্বিতীয়ত, এরকম একটা মহামূল্যবান বিষয়ের ইতিহাস এবং ঐতিহাসিক দার্শনিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন একজন কবি! যিনি ছিলেন বিষাদ বেদনার দেবীর একনিষ্ঠ পূজারী, যার কবিতায় বিষাদের শরীরের নতুন বিষাদের জন্ম, যন্ত্রণার দেবতারা পর্যন্ত হুঙ্কার দিতে বাধ্য হয়েছেন মানুষের অন্তিম অথচ অর্থহীন বিষাক্ত অথচ বীরত্বপূর্ণ নিয়তির কথা ভেবে! সেই কবি কিনা লিখেছে জার্মান দেশের ধর্মের ও দর্শনের ইতিহাস! আর জার্মান দর্শন অর্থাৎ মার্কসের মতে যা হলো “German Ideology ” অর্থাৎ বাংলায় করলে হতে পারে “জার্মান ভাবাদর্শ” তার ইতিহাস লিখেছেন! আমি অবাক ছিলাম এই ভেবে যে ঠিক কোন বিষয়ে আমি অবাক হবো!

বইটা পড়া শুরু করলাম, আজ, প্রায় শেষ, মাত্র ১১৭ পৃষ্ঠার একটি বই, যাতে আছে জার্মান জাতির সংস্কৃতি, মিথলজি, দর্শন, রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব, সাহিত্য এবং জার্মান ভাষা, এই সকল বিষয়ের উৎসগত এবং ঐতিহাসিক আলোচনা।  যতই পড়ছিলাম ততই অবাক হচ্ছিলাম এবং এক পর্যায়ে স্পিনোজার পুরোনো অথচ নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল উক্তির কথা ভাবছিলাম যে “নবী এবং কবির আদি অর্থ একই, তবে কবির শক্তির শেষ টা কোথায় তা কবি নিজে জানেনা, যেটা নবী জানতো যে তার শেষ কোথায়, কবিরা পার্থিব এবং এক ধরনের অমানবিক বিচ্ছেদের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীতে আবির্ভূত হোন, বিচ্ছেদ কার সাথে, হয়তো ইশ্বরের সাথে, হয়তো বা প্রকৃতির সাথে, কিন্তু তার সৃষ্টিশীলতা তাকে মানুষ নয় কবিতে পরিণত করেছে”

হাইনে কবি ছিলেন, বড় কবি ছিলেন তাই তার পক্ষে এরকম হাজার পৃষ্ঠার রচনার দাবিদার একটি বৃহৎ বই, মাত্র একশো সতেরো পৃষ্ঠায় লেখা সম্ভব হয়েছে এবং সম্ভবত নীটশের কথা বার বার বলতে হয়, যিনি বলেছিলেন — “There is always some madness in love. But there is also always some reason in madness.” হাইনে তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ।

জার্মান দর্শন এবং জার্মান রোমান্টিক দের নিয়ে আমার আগ্রহ সারাজীবনের, এবং বলা যায় বেচে থাকার অন্যতম বড় কারণ, ফরাসি ভাষায় যাকে বলে “Raison D’etre ” (Justification of the existence), সেই জার্মান দর্শনের ইতিহাসের উপর অসংখ্য বই এবং প্রবন্ধ পড়েছি, কিন্তু হাইনের এই বইয়ের আলোচনা আমার কাছে একদম নতুন, জার্মান দর্শন, তার আগে জার্মান ধর্ম, তার আগে জার্মান ক্যাথলিসিজম, তার আগে জার্মান মিথলজি, এই যে একধরণের বিবর্তনীয় আবির্ভাব এটা আমি  জার্মান দর্শনের বিশেষজ্ঞ, ইমানুয়েল কান্ট এবং হেগেলের বিখ্যাত অনুবাদক এবং তাদের জীবনীকার ও ভাষ্যকার টেরি পিংকার্ডের লেখাতেও পাইনি। (যদিও হাইনের এই বইটির সম্পাদনায় এই মাহন লোকের অবদান আছে, অর্থাৎ কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসের অনুবাদ আর কি), বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ভন রাঙ্কের হিস্টোরি অব ফ্রেডেরিক প্রাশিয়াতেও পাইনি, পেলাম এক জার্মান কবি, যিনি হয়তো কবিতা না লিখলে খ্যাতি দূরে থাক তার নাম কেউ মনে রাখতো কিনা কে জানে কারণ উনিশ শতকটা গোটা ইউরোপের জন্য বিশেষ করে জার্মানদেশের জন্য একটা “নামের শতক”, সেই নামের মধ্যে প্রথম তালিকায় থাকবে হাইনরিখ হাইনে অন্তত এই বইটি এবং সেই বিষাদ গাঁথা, স্মৃতিকাতর এবং রক্তিম প্রেমের আভাস অথচ ভ্রমাত্মক মহিমার অর্থহীন গন্তব্যের জাদুমন্ত্রের সুর যার কবিতায় উপস্থিত।

প্রথমে বইটা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিলো হাইনে শুধু জার্মান দেশের মিথলজি, ধর্ম ও পরবর্তী কালে বিকশিত দর্শনে আলোচনা সীমিত রেখেছেন, কিন্তু দ্বিতীয়ে অধ্যায়ে যে আমার জন্য দেকার্তে থেকে শুরু ইংরেজ, ফরাসি এবং আধুনিক ইউরোপীয় দর্শনের সংক্ষিপ্ত অথচ উৎকৃষ্ট ধারাবাহিক আলোচনা অপেক্ষা করছে  সেটাও আমি কখনই রবীন্দ্রনাথের কোনো নতুন দিনের নতুন আলোয় নতুন দৃষ্টির সহিত নতুন ভাবে জেগে উঠার মতো কোনো স্বর্গীয় সংগীতের তীব্র আকাঙ্খা পাওয়ার স্বপ্নে কখনই ভাবিনি! কখনই সেরকমটি ভাবিনি!

ধর্ম ও দর্শনের ইতিহাস লিখেছেন কিন্তু তাতেও কাব্যিকতা যে থাকবেই সেই শপথ তো স্বপ্নে হাইনে অসংখ্যবার নিশ্চয় কবিতার দেবীর নিকট করেছেন।

বছর ফুরিয়ে এলো, পূর্ববর্তী বছর গুলোর তুলনায় এ বছর বেশি বই পড়া হয়েছে, কিন্তু এই বছরে পড়া শ্রেষ্ঠ বই হাইনের এই বইটি। বইটির একেকটা পৃষ্ঠা পড়ে মনে হচ্ছিলো, হাইনের এক পাতায় যা আছে একই তথ্য, বিশ্লেষণ এবং বিশেষণের প্রকাশ অন্য কোনো গবেষক কিংবা লেখক লিখতে গেলে তার আট থেকে দশ পৃষ্ঠা করে লিখতে হবে। নীটশে অনেক বড় চিন্তাবিদ, রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক দের তুলোধুনো করেছেন, খারিজ করেছেন নির্দ্বিধায়, হেগেলের মতো দার্শনিক কে নীটশে বিবেচনা করতেন “Old Sordid Seducer of the youth emerging Germans”  হিসেবে, সেই নীটশে হাইনে কে বলেছিলেন “Jewish Dionysus ”

নীটশের দ্বারা খারিজ হওয়া দার্শনিক দের তালিকা নিয়ে আমার আপত্তির শেষ নেই, কিন্তু নীটশের পছন্দের যে তালিকা তা নিয়ে পৃথিবীতে  অন্তত Aesthetics বলতে যা বুঝায় সেই বুঝের মানুষের আপত্তি এবং সন্দেহ থাকা আর অমরত্বে বিশ্বাস করা একই কথা! বইটা হাইনের শুরু করেছেন “খ্রিষ্ট ধর্মের” সারকথা আসলে কি, অর্থাৎ “The essence of the Christianity ” আসলে কি সেই ব্যাখ্যার মধ্যে দিয়ে, অথচ হাইনে ছিলেন ইহুদি যার সম্পর্কে হান্নাহ আরেন্ডট বলেছিলেন “the only German Jew who could truthfully describe himself as both a German and a Jew”.

হাইনরিখ হাইনে তার বই “Zur Geschichte der Religion und Philosophie in Deutschland” যার ইংরেজি অনুবাদ কেমব্রিজ এডিশনে “On the History of Religion and philosophy in Germany “. বাংলা ভাষায় অনুবাদ করার চেষ্টা করলে অনেকটা হয়তো এরকম শোনায় ” জার্মান দেশের ধর্ম ও দর্শনের ইতিহাস প্রসঙ্গে ”

বইটি হাইনে তিনটি অধ্যায়ে ভাগ করেছেন, প্রথম অধ্যায়ে সে জার্মান দেশের ধর্ম, ধর্মতত্ত্ব এবং জার্মান সমাজের শত বছরের মিথলজি ও ভূতপ্রেত বিশ্বাস সংক্রান্ত আলোচনা করেছেন এবং শেষে প্রটেস্ট্যান্টিজমের যে উত্থান এবং তার পরবর্তী বিকাশ ও তার রাজনৈতিক এবং দার্শনিক ফলাফল নিয়ে আলোচনা করেছেন। দ্বিতীয় অধ্যায় টি এক প্রকার বলা যায় অত্যন্ত শৈল্পিক, সাবলীল, সুনিপুণ ভাষায় ইউরোপীয় দর্শনের সংক্ষিপ্ত অথচ সুশৃঙ্খল আলোচনা এবং জার্মান দেশে দর্শনের বিকাশ অর্থাৎ লাইবনিৎসদের সকল লেখার অনুবাদের (দার্শনিক খ্রিস্টিয়ান উলফ করেছেন) ভেতর দিয়ে শুরু করে একদম ইমানুয়েল কান্টের আগ পর্যন্ত জার্মান দেশের দর্শনের হালচাল এবং সেই সম্পর্কিত সামাজিক ব্যাখ্যা এবং তাতে জার্মান সমাজের প্রতিক্রিয়া। কান্টের আগ পর্যন্ত বলতে হাইনে বোঝাতে চেয়েছেন কান্টের “Kritik der reinen Vernunft” (Critique of Pure Reason) তা লেখা ও প্রকাশিত হওয়ার আগ পর্যন্ত।

তৃতীয় অধ্যায়টি হাইনে শুরু করেছেন ইমানুয়েল কান্টের উপর আলোচনা দিয়ে অর্থাৎ তার উক্ত বিশেষ বই যা হাইনের মতে “জার্মান দার্শনিক মুভমেন্টের” রোবসপিয়ারিয়ান দলিল (কান্টকে হাইনে রোবসপিয়্যেরের সাথে তুলনা করেছেন) এবং শেষ করেছেন হেগেলের উপর অতি সংক্ষিপ্ত আলোচনা দিয়ে।

কান্টের উপর আলোচনায় এক জায়গায় হাইনে বলেছেন কান্টের প্রথম বই অর্থাৎ “Kritik der reinen Vernunft” (Critique of Pure reason)  নিঃসন্দেহে দর্শনের জগতে একটি কোপার্নিকান বিপ্লব (কান্ট নিজেও এটা বলতেন)। কিন্তু কান্ট পরবতী তে একটি বই লিখেছেন যেটা ও বিখ্যাত হয়েছিলো, যার নাম “Kritik der praktischen Vernunft” (Critique of Practical Reason)

হাইনের মতে এই বইটি লেখার কারণ দর্শনের প্রগতি এবং যেই যুক্তিবিদ্যা কে কান্ট নতুন আগমনী সভ্যতার প্রধান নিয়ামক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন সেই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নয়।

হাইনের মতে কান্টের দেওয়া ক্যাটাগরিকাল ইম্পারেটিভ (বাংলায় অনুবাদ করছি না এই শব্দগুলোর বিশেষ কারণে) গুলো এবং যতধরণের যুক্তির ধারা ও যুক্তির পর্যালোচনা দিয়েছেন তা সম্পূর্ণ ই যাকে বলে তাত্ত্বিক যুক্তি (Theoretical Reason) অর্থাৎ যাকেই আমরা আসল “যুক্তি” হিসেবে জানি তা, কিন্তু পরবর্তী তে কান্টের Critique of practical Reason লেখাটাকে হাইনে সুনজরে না হোক অন্তত ভবিষ্যতের জ্ঞানতত্ত্ব ও রাজনীতির জন্য যে তা ভালো ফল বয়ে আনবেনা তা বুঝতে পেরেছিলেন।

হাইনের মতে, এটা কান্টের এক ধরণের ভর্তুকি ছিলো কিংবা অনেকটা ক্ষতিপূরণ (Compensation) ছিলো ধর্মতত্ত্ব, খ্রিস্টীয় নৈতিকতা, ইশ্বরতত্ত্ব, পাণ্ডিত্যবাদ, গোড়া চিন্তার প্রতি, কারণ এই মতবাদগুলোর যেই ধরণের ধ্বংসাত্মক এবং ভয়ানক ধস নামিয়েছিলেন কান্ট তার “Critique of Pure Reason”  বইয়ের শেষ অধ্যায়ে, যেখানে কান্ট “Antinomy of Reason” নিয়ে আলোচনা করেছেন। হাইনের মতে এটা ছিলো এক ধরণের দাতব্য অর্থাৎ Charity এর মতো। কান্টের মতে সকল তাত্ত্বিক যুক্তি আসলে প্রায়োগিক নয়, তাই দরকার ব্যবহারিক যুক্তির, অর্থাৎ মার্কিন দেশের লোকজনেরা যাকে এখন বলে “Situational Ethics” সেটা। অর্থাৎ, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিশেষ সাপেক্ষে চিরাচরিত যুক্তির প্রয়োগ সম্ভব নয় তাই ব্যবহারিক যুক্তি (Practical Reason) এর প্রয়োজন আছে। হাইনের মতে কান্টের এটাই ছিলো সবচেয়ে বড় ভুল, কিন্তু হাইনে এটাও বলেছেন কান্ট এটা ইচ্ছা করে করেছেন যাতে মরার সময় একজন নাস্তিক যদি ইশ্বরের বিশ্বাসী হয়ে উঠতে চান তাহলে সেটা যৌক্তিক হবে অনেকটা এরকম। সেক্ষেত্রে কান্ট শেষ পর্যন্ত নৈতিকতার জায়গা থেকে যুক্তি কে দুই ভাগ করলেন, একটা তাত্ত্বিক যুক্তি এবং আরেকটা ব্যবহারিক যুক্তি। হাইনের মতে রাজনীতিবিদ রা ইউরোপে এখন তথাকথিত “ব্যবহারিক যুক্তির” নামে যা ইচ্ছে তা করছেন (মানে তার সময়ে) এবং হাইনে এটাও জানতেন সামনে যে জামানা আসছে তাতে তাত্ত্বিক যুক্তির চেয়ে ব্যবহারিক যুক্তির জয়জয়কার বেশি হবে এবং এই ব্যবহারিক যুক্তির জোরে যেকোনো ধরণের কর্ম তা নৈতিক কিংবা অনৈতিক, নীতিমূলক কিংবা নীতিবহির্ভূত হোক সবকিছুই সমর্থনযোগ্য (Justified) এজন্য হাইনে কান্টের এতো উচ্চ প্রশংসা করার সত্ত্বেও শেষে কান্টের এই যে যুক্তির বিভাজন এটাকে নেহাৎ ভবিষ্যতের জ্ঞানতত্ত্বের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাড়াবে সেই জায়গা থেকে চিন্তা করে কান্টের কঠোর সমালোচনা ও করতে অপারগ হোননি। রোবসপিয়্যেরের সাথে কান্টের তুলনাটা হাইনে তখনই করলেন এবং বললেন জ্ঞানের রাজ্যে কান্ট ও রোবসপিয়্যেরের মতো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছেন। হেগেলের প্রথম প্রকাশিত বই  “Glaube und Wissen” (Faith and Knowledge), সেখানেও হেগেল কান্টের অনেক প্রশংসা করেছেন বিশেষ করে তার, পুরোনো যে যুক্তিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের মধ্যকার তর্ক যা সেই প্লেটো-এরিস্টটলের সময় থেকে চলে এসছে, পরবর্তী তে দেকার্তে-স্পিনোজা-লাইবনিৎস এবং লক-হিউম-বার্কলি দের মধ্যে চলছিলো সেই তর্কের একটা অসাধারণ দার্শনিক মিমাংসা দেওয়ার চেষ্টা কে হেগেল প্রশংসা করেছেন কিন্তু হেগেলের মতে এক ধরনের জ্ঞানতাত্ত্বিক দ্বৈতবাদ (Dualism) এর মীমাংসা করতে গিয়ে কান্ট আরেকটি অনাকাঙ্ক্ষিত দ্বৈতবাদ সৃষ্টি করে ফেলেছে এবং সেই যুক্তির বিভাজনের কথাই হেগেলে বলেছেন, যেখানে হেগেলের মতে Glaube (Faith) এবং Wissan (Knowledge) এর একটা বিশাল পার্থক্য রেখা টানতে গিয়েও টানতে পারা যায়নি শেষ পর্যন্ত।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন