একটি উপন্যাস মহৎ হয়ে ওঠে লেখকের অভিজ্ঞতা, জীবনদর্শন, সমাজবাস্তব, উপস্থাপন, ভাষার বিচিত্র প্রয়োগের উপর। সময়-সমাজ-ভূগোল-রাষ্ট্র-রাজনীতি-রাজনীতির রং-বহির্বাস্তব-অন্তর্বাস্তব-মানুষের অন্তর্নীল রহস্য-অস্তিত্বের নিগূঢ় প্রকারভেদ দর্শনের তরঙ্গে কেমনভাবে বাজছে, কেমন সুর তুলছে সেটাই আমার মতো আনকোরা পাঠকের কাছে প্রধান বিচার্য হয়ে হয়ে দাঁড়ায়। সেই মানদণ্ডে হিরণ্ময় গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘আশমানি কথা’ উপন্যাসকে Full marks দেওয়া যায়, সচেতন পাঠক হিসেবে আপনি দিতে বাধ্য হবেন বলেই মনে হয়! ভাষার এত বিচিত্র প্রয়োগ, আখ্যানমাঠে একাধিক তরঙ্গ, অভিজ্ঞতার সুনিপুণ ব্যবহার ও রাজনীতির বহুস্তরীয় বিন্যাস উপন্যাসের মাধুর্যকে কয়েকগুণ বৃদ্ধি করেছে। আঞ্চলিক চিত্র, শুষ্ক দেশের তাপমাত্রা, দাবদাহ, ক্ষুধা, আর্তসংকটে ব্যক্তিমানুষ যখন যন্ত্রণাতুর তখনই কাব্যময় পরিচ্ছেদ এনে আখ্যানের স্বাদ বদলে দেন। শুষ্কতা, রুক্ষতা, যন্ত্রণাময় জীবনের ভাষ্য এমন কাব্যমেদুর ঐশ্বরিক ব্যঞ্জনায় ভেসে যায় যার সৌরভ বড় সুমধুর।
প্রথম পরিচ্ছেদেই হিরন্ময় গঙ্গোপাধ্যায় স্বতন্ত্র গদ্যগঠন গড়ে তোলেন। প্রচলিত গদ্য সরণিতে না গিয়ে রীতিমতো পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নিজের মননচেতনার একটি সচেতন ভাষা গঠন গড়ে তোলেন। ভৌগোলিক চিহ্নায়ন, প্রান্তিকতার সুর এবং সেই স্বরকে নিজস্ব ভঙ্গিতে জানান দেবার কায়দা প্রথম থেকেই উপন্যাসকে আলাদা পরিমণ্ডলে নিয়ে যায়। ভাষার গঠনকাঠামো ভেঙে নতুন ভাষা কাঠামো গড়ে তোলাই হিরণ্ময়ের প্রকৃত দক্ষতা। গদ্যের একটা প্রচ্ছন্ন সুর আছে। যা বাস্তবকে ভাঙে আবার আড়াল করে। কখনো ভয়ানক বাক্যে সময়ের রাজনীতি, শ্রেণিবৈষম্যকে জানান দেয় আবার আঞ্চলিক সংলাপে জীবনের অন্তর্বাস্তবকে নিশানা করে। ১৯৭৭ পরবর্তী সিপিএম উত্থান, গ্রামে পরিবর্তনের ধাক্কা, নব স্বপ্ন বুনন, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, বিপ্লবের তত্ত্ব, গ্রামীণ বাস্তবতার ভিন্ন প্রকার মিলিয়ে আখ্যান রাজনীতির জরুরি বীক্ষণ নিয়ে উপস্থিত হয়। পুরুলিয়া, মানভূমের রুক্ষ বাস্তবতা, আঞ্চলিক রং-ঢঙ, কথ্যভাষা পরিবর্তনের নতুন স্রোত, মানুষের গ্রহণ-বর্জনের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে নিচু তলার প্রকৃত বাস্তবকে বড় তীব্র আকারে ব্যক্ত করে চলেন। গভীর পর্যবেক্ষণ, রাজনৈতিক বোধ, সমাজের নিচু প্রদেশের জীবনচিত্র সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা ব্যতিত এই আখ্যানের জন্ম অসম্ভব। বয়ানে ভেসে আসে —
“রাস্তার উড়ন্ত ধুলোয় বিকেল, সন্ধের দিকে লাট খাচ্ছে, ভিড় কম বলে ছোট ছোট দলগুলো একজায়গায় জড়ো হয়ে ইতিহাস আর ইতিহাস হতে-যাচ্ছে-পশ্চিমবঙ্গে মশগুল। ইতিহাস কখনো ইতিহাস থেকে বেরিয়ে পড়ে প্লাবিত করছে জনশ্রুতি, জনশ্রুতি কখনো ইতিহাসের ভেতরে ইতিহাসোপতি ইতিহাস, ইতিহাসকে হাইরোড পার করে দিয়ে মনে করাচ্ছে পথ দুর্ঘটনা, আহতনিহতর অতৃপ্তির আকাঙ্ক্ষা, অবোধ্য অক্ষর।” (আশমানি কথা, হিরণ্ময় গঙ্গোপাধ্যায়, প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০২২, বাংলার মুখ প্রকাশন, পৃ. ০৯)
রাজনৈতিক বোধের সঙ্গে গভীর দার্শনিক প্রত্যয় মিলে এমন আখ্যানের জন্ম সম্ভব। সাহিত্যের আধুনিক প্রকরণ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা, জনগণতান্ত্রিক প্রদেশের গভীরের ইতিহাস, জনশ্রুতি, লোকাচার, আবহমানকালের উড়ো সংবাদ, অস্তিত্ব অবসাদের নিগূঢ় সত্যকে এমন বয়ানে মিলিয়ে দিয়েছেন যা তারিফযোগ্য। ১৯৭৭ পরবর্তী সিপিএমের চিত্রনাট্য, জমিদার বা বিচ্যুত কংগ্রেসকর্মীর সিপিএম সেজে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের অভিনয়, সমাজমুক্তির বাসনা, ভিতরে প্রতাপ-আধিপত্য, রক্তচক্ষু শাসন — সমস্ত মিলিয়ে আখ্যান রাজনীতিকে পাশে বসিয়ে গভীর তলদেশে নেমে যায়।
আঞ্চলিক সংলাপে আখ্যান চলতে চলতে, জনপদজীবনের প্রত্যাশা-সংকট বস্তুতান্ত্রিকতার কথা বলতে বলতেই তির্যক মন্তব্য ভেসে আসে। এই তির্যক মন্তব্যই আখ্যানের প্রসাদগুণ। সময়-সমাজ-পরিসরের কথা নির্মিত হচ্ছে কিন্তু সেই কথাকে বীক্ষণপ্রবণ তির্যক মন্তব্যে পাঠককে স্তব্ধ করে দিচ্ছেন। এ আখ্যান সরণি শুধু কথাজাল নির্মাণ করছে না গভীর বিশ্লেষণে পাঠককে সময়ের রহস্য নিকেতনে নিয়ে বোঝাচ্ছে ঘটনার পশ্চাতের ঘটনা, সত্য এমন। ঐতিহ্য, ইতিহাস, জমিদারতন্ত্র, উচ্ছেদ অভিযান, নব্য পার্টি সমস্তকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে আখ্যান সেই জনপদ প্রদেশের তীব্র বিশ্লেষক ও ব্যবচ্ছেদক। আখ্যানের উপস্থাপনটি বড় নান্দনিকতায় ভরপুর। জনগণতান্ত্রিক প্রদেশের নামাবলি গড়তে গড়তেই ক্ষমতার তত্ত্ব যে বয়ানে, বিশ্লেষণে উদ্ভাসিত হয় তা আখ্যানের ছাঁচকে উচ্চসুরে বেঁধে দেয় —
“ক্ষমতা শক্তি নিয়মকানুনের কামারশালা হলো আদালত যেখানে শৃঙ্খল পরানো হয়। জেতা-হারা দুটোই অনিঃশেষ শৃঙ্খল, কত কত মামলায় হেরে জিতে অভয়পদ তা জানে। উকিলবাবু তাকে হতাশ করলেও পথ বাৎলে দিলেন সারভাইভের। সে তুমি যে তন্ত্রই চালাও ধনের তন্ত্রে সব শালাই বস। অসীম অনন্ত চতুর্দিক ব্যাপ্ত অন্ধকারে একটি দেশলাই কাঠির সৌন্দর্য নিয়ে আপাতত আনন্দিত অভয়পদ ইন্দ্রবিল স্টেশন বাঁয়ে রেখে মহুলকোঁকার দিকে যেতেই সারি সারি বকের মতো দাঁড়িয়ে গেলো এক গামছায় পঁদপাছাবুক-ঢাকা বাঁধবসা মেয়েবউরা।” (তদেব, পৃ. ১২)
শুধু তত্ত্ব নয় আখ্যানমাঠ কাব্যিকতায় ভরপুর। রাজনীতি, ক্ষমতাতত্ত্ব, প্রান্তিক প্রদেশের চরম বাস্তবকেই প্রতিপন্ন করছে বটে, জনশ্রুতি-লোক ঐতিহ্যকে ধরে বর্তমানে চলছে বটে কিন্তু পথঘাট, মাঠ ফসলের যে উপমা, আভরণ আনেন তা রীতিমতো কাব্যিক আস্বাদনে প্লাবিত। সিপিএমের উত্থান, গ্রামে কৃষিভিত্তিক উন্নয়নের জোয়ার, খুনাখুনি, বর্গা, জমিদার অভয়পদের আর্তনাদ, আইনি সত্য, পুলিশের উঠে পড়ে লাগা, মার্কসবাদের প্রতিক্রিয়াশীল প্রয়োগ, জমিহারা ও জমিদারের উত্তর পুরুষের দ্বন্দ্ব সমস্ত মিলিয়ে আখ্যান যেমন সময়ের প্রতিক্রিয়াশীলস্বর তেমনি সমাজ প্রগতির অংশ হয়েও সমাজতান্ত্রিক ভাষ্য। শুধু বহমান জীবন নয় সেই জীবনকে লেখক দেখছেন ক্ষমতাতান্ত্রিক, রাজনৈতিক, ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক সত্যে। প্রবাহমান ক্রিয়ায় উঠে আসা সত্য, সেই সত্যকে বিশ্লেষণ করে সমাজতান্ত্রিক সত্য — যার গায়ে রাজনীতি ও ক্ষমতার গন্ধ আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে — সেই বস্তুতান্ত্রিক নিকেতন এই আখ্যানের ছন্দ।
মানভূম, মণিহারা, বিহার-বেঙ্গল, বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার মধ্যবর্তী অঞ্চল, মণিহারা কীভাবে পুরুলিয়ার সঙ্গে যুক্ত হল, সিপিএমের কায়দাকানুন, বাঁধ প্রকল্প, কৃষি উন্নয়ন, বর্গা প্রথা, জমিদার উচ্ছেদ, বামুন-বাগদি বিবাদ, জাতিতত্ত্ব, ব্রাহ্মণের পদমর্যাদা হৃাস, সিপিএম-কংগ্রেস দ্বন্দ্বমানস, পার্টিনীতি, তলদেশ দিয়ে গোপন আঁতাত সমস্ত মিলিয়ে মণিহারা সভ্যতার আদি-অকৃত্রিম স্বরকে দ্ব্যার্থবোধক বয়ানে চিহ্নিত করে চলেন হিরণ্ময় গঙ্গোপাধ্যায়। আখ্যানে নির্মাণে লেখক প্রথম থেকেই সচেতনভাবে প্রবল প্রতিক্রিয়াশীল। সমাজ-সময়ের প্রগতিশীল অগ্রসর, দূষণ, চক্রান্ত, রাজনৈতিক পদাবলি ও ঘটমান বর্তমানের পিছনের সত্যকে টেনে আনতে সক্ষম। এ আখ্যান একই সঙ্গে প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল। সেই বয়ান বহুমুখী বিশ্লেষণে এগিয়ে গেছে। শুধু বিশ্লেষণই নয় তা জনপদ জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত করে বাস্তবকে যেমন প্রবলমাত্রায় আক্রমণ করেছে তেমনি বাস্তবকে অতিক্রম করে আর্টের সত্যে ধবমান হয়েছে। আঞ্চলিক পটভূমিকে প্রেক্ষাপটে রেখেও তা সাহিত্যের নন্দনকাননে কীভাবে সুঘ্রাণ ছড়াতে সক্ষম তা লেখক স্পষ্টভাবে জানেন বলেই ‘আশমানি কথা’ আজকের বাংলা উপন্যাসভুবনে জরুরি আয়োজন।
বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর আগ্রাসন, ছোট ছোট কাজে পার্টি নেতৃত্বের প্রাধান্য, বর্গা প্রথাকে কেন্দ্র করে গ্রামের সাধারণ মানুষের ভুলভুলাইয়া, পক্ষ-বিপক্ষ, বামফ্রন্ট সম্পর্কে আস্থাহীনতা, বাদবিবাদ নিয়ে প্রান্তিক পরিসরের একাধিক সত্য উঠে আসে। এ আখ্যান বহুরৈখিক বিন্যাসে, অণুচিন্তনে, খণ্ড খণ্ড সত্য ধরে সামগ্রিক সত্যে ভেসে গেছে। জনপদ জীবন একটি নতুন রাষ্ট্র ক্ষমতার প্রত্যাবর্তনে কীভাবে জেগে উঠল, রাজনৈতিক কার্যাবলি, ভূমি সংস্কার গ্রামকে কীভাবে আলোচনার কেন্দ্রে এনে দিল, গ্রামীণ স্তিমিত মানুষ কীভাবে অস্থিরতায় মত্ত হল সেই পরিসরের যাবতীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব আখ্যানকে এগিয়ে নিয়ে চলে। জমিদার-ভাগচাষির বাগ্বিতণ্ডা, শ্রদ্ধা-প্রীতি, বর্গা করা না করার দ্বন্দ্ব, আবহমানকালের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ভাবনা, পঞ্চায়েতের বক্রচক্ষু, চাষিবাসিদের বর্গা প্রথা বোঝা না বোঝার সমস্যা, জমি হলেও, জল হলেও চাষের বাকি উপাদান জমিদার ছাড়া কোথায় পাবে সেই সমস্যার নামাবলি নিয়ে আখ্যান পশ্চিমবঙ্গের ভূমিসংস্কারের প্রাথমিক পর্বের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছে যায়। পক্ষ-বিপক্ষ নয় একটি জনপদজীবনকে কেন্দ্রে রেখে সময়ের একাধিক নথিনামাকে সামনে রেখে আখ্যান নৃতাত্ত্বিক ভাষ্য গড়ে তোলে। নিছক কাহিনি বা আঞ্চলিক বিন্যাস নয় বীক্ষণপ্রবণ মনন নিয়ে সময়ের উপর দিয়ে লেখক জমিদার-ভাগচাষির দ্বন্দ্বকে নানা কৌণিক বিন্দুতে নিরীক্ষণ করেন। বামফ্রন্ট উন্নতর সমাজ গঠনের চিন্তায় নানা প্রকল্প নিয়ে এসেছিল। সেই প্রকল্পগুলি গ্রামীণ সমাজ মানসে কীভাবে প্রভাব ফেলল, তা নিয়ে জমিদার অভয়পদ, সাধারণ নিতাই, গোকুলরা কীভাবে নতুন সময়ের স্রোতে ভেসে গেল তার বিন্যাস এই আখ্যান। পুরাতন সত্যকে ফেলে নতুন সত্যকে গ্রহণ করার যে দ্বন্দ্ব, তার অর্থনৈতিক কাঠামো, আপাত উড়ো সংবাদ, গ্রামে উন্নয়নের আশায় আকাশবাণীর মাধ্যমে নাগরিক চিন্তা, পরামর্শ ভেসে আসা — সমস্ত মিলিয়ে আখ্যানে একটা সুর আছে। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে আধা জমিদারি মহাজনের শাসনে থাকা জমিনির্ভর গ্রামবাংলা কীভাবে বদলে যাচ্ছে তার গূঢ়ার্থ তত্ত্ব ভেসে আসে।
একটি জনপদকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক পালাবদলের নানামাত্রিক সত্যকে ধরে পরিবর্তন ও জমিদার-কৃষকশ্রেণির চাপানউতর এর কেন্দ্রবিন্দু। চোর নিতাই কারখানার শ্রমিক হয়ে কিছুকাল কাটিয়ে, কারখানা বন্ধ হতে আন্দোলন করে ব্যর্থ হয়ে গ্রামে ফিরে কমরেড হয়েছে। সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয়ী জমিদারতন্ত্রের শেষ প্রতিনিধি অভয়পদর আত্মসংকট, অস্তিত্ব সমস্যা, আবহমানকালের ধ্যান ধারণা থেকে চ্যুত হবার সংকটে ভুক্তোভোগী হয়ে যে মানসিক অস্থিরতায় ভুগছে তার দ্বন্দ্বময় চিত্র আখ্যানের অন্যতম সুর। ভাগচাষিরা জমিদারকে যতটা না আঘাত করেছে, বর্গা করা নিয়ে যতটা না ভাবিত, অভয়চরণের ভাবনা-চিন্তা দ্বিগুণ বেশি। ক্ষমতার আস্ফালন, অক্ষম আর্তনাদ নিয়ে সে বাতিল নিশ্বাসের স্বর হয়ে আখ্যানে ভেসে যায়। জনপদ জীবনের আখ্যান এটি, সময়পর্বও ১৯৭৭ এর পরবর্তী কাল। কিন্তু তিনি উত্তর আধুনিক সময় থেকে সেই সময়কে দেখছেন। ফলস্বরূপ একাধিক তত্ত্ব, চাহিদা-জোগান, বাণিজ্য, অর্থনৈতিক কাঠামো, কৃষি বিন্যাস, রাজনৈতিক কাঠামো, ক্ষমতা তত্ত্ব দ্বারা আখ্যানকে মননচর্চার কেন্দ্রভূমি গড়ে তোলেন। পটভূমি জনপদ, মানুষজন ভাগচাষি, জমিদার, রাজনৈতিক কর্মী কিন্তু দর্শনগত অধিবিদ্যার প্রয়োগ, দৃষ্টিকোণ, তত্ত্বের মধ্য দিয়ে ব্যাখ্যা করার অভিপ্রায়, কার্যকারণ খুঁজে দেখা ও অবস্থা রূপান্তরের দ্বান্দ্বিক বিন্যাস আখ্যানকে উচ্চসুরে বেঁধে দেয়।
স্তিমিত জীবনে ১৯৭৭ পরবর্তী বামফ্রন্ট কীভাবে প্রভাব বিস্তার করল, গতি আনল সেই সুদীর্ঘ পথচলা নিয়ে এই আখ্যান। তবে বামফ্রন্টের গুণগান গাওয়া নয় পার্টি পলিটিক্সে কীভাবে পুঁজিবাদ বিকাশ পেল, বিপ্লবের নামে পার্টি বেনোজলে ভেসে গেল তার সূচনাবিন্দুকে স্পর্শ করা। শুষ্ক দেশে কীভাবে কৃষিতে প্লাবন এল, বাজার অর্থনীতির বিকাশ সম্ভব হল, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের গোপন পথ দিয়ে কমরেডের পুঁজি বৃদ্ধি পেল সেই জটিল বিন্দুকে লেখক বড় তির্যকভাবে ব্যক্ত করেছেন। চাষের বদলে উৎপাদন, গ্রিন হাউস ফার্মে বিভিন্ন সবজি চাষ, সরকার নির্ধারিত মজুরি প্রদান ও জমিদার বৃত্তের অস্তায়মান সূর্য অভয়পদ কীভাবে জমিদারি হালচাল ছেড়ে কৃষকে রূপান্তরিত হল সেই বৃহৎ বৃত্ত এই আখ্যান। আবার অভয়পদই কখনো বন্দুক তুলে নয়ে বর্গা নিধনে। প্রতিপদক্ষেপে দ্বন্দ্বের জন্ম হচ্ছে। নতুনকে গ্রহণ করার দ্বন্দ্ব, এতকালের জমিদারতন্ত্র থেকে বিচ্যুত হবার দ্বন্দ্ব, নব্যতন্ত্রের গোপন দুয়ার দিয়ে শ্রেণিশত্রুকে খতম করার দ্বন্দ্ব। কংগ্রেসি জমিদার অভয়পদ তো এই নতুন ব্যবস্থায় বেমানান। তবুও টিকে থাকতে চেয়েছে। কিন্তু মাঝেমাঝেই ক্ষমতার আস্ফালন বেরিয়ে পরে। বয়ানে ভেসে আসে —
“সমাজতান্ত্রের প্রাথমিক স্তর জনগণতন্ত্র, তাতেই বন্দুকবাজি, এখনই, বামফ্রন্ট সরকার থাকা সত্ত্বেও, ততোদিনে পুরুলিয়ায় অস্ত্র বৃষ্টি হয়ে গেছে আনন্দমার্গে, আসু বিপ্লবের স্বার্থে অভয়পদর মতো শ্রেণিশত্রুর বিনাশ চাই!” (তদেব, পৃ. ৪৯)
আছে আত্মপরিচয়ের সংকট, দ্বন্দ্বমানস। যে অভয়পদ সাধারণ মানুষের জন্য রাস্তায় মাটি ফেলতে দিতে অনিচ্ছুক সেই অভয়পদই পঞ্চায়েত অফিস নির্মাণে জমি দিয়েছে। জমিদার তার নিজস্ব অস্তিত্ব গোপনে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যে রেখে যাচ্ছে। হিরণ্ময় গঙ্গোপাধ্যায়ের কৃতিত্ব এখানেই যে তিনি একরৈখিক কাহিনি দাঁড় কারাননি। জমিদার-বর্গাদার-রাজনীতি-আধিপত্যবাদ-নতুন সময়কে ধরে একটা জটিল বিন্যাস দাঁড় করিয়েছেন। সেই উপস্থাপন গভীর বিশ্লেষণে, সমাজের তলদেশের জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বচ্ছ ধারণায় এমনভাবে ব্যক্ত হয়েছে যার নান্দনিক মূল্য বড় সুতীব্র। কথ্য সংলাপ, মুখের ভাষার জীবন্ত রূপ, লোকায়ত বিন্যাস, ভূগোলের সঠিক বিবরণের মধ্যেও কাব্যময়তা আখ্যানকে জীবন্ত করে তুলেছে।
এ আখ্যান রাজনৈতিক ধারাভাষ্য। বামফ্রন্টের নিচু তলার রাজনীতি কোন খাদ থেকে কোন খাদে বাঁক নিল তার আগাপাশতলা সংবাদ। জরুরি বীক্ষণে, বিশ্লেষণে, সমাজের নিচু তলার সমগ্র চিত্রণে লেখক রাজনীতির উত্থানকে দেখিয়েছেন। পার্টি কীভাবে প্রলেতারিয়েত থেকে বুর্জোয়া স্রোতে ভেসে গেল, জাতি দ্বন্দ্ব, শ্রেণি সমস্যা, আত্মপরিচয়ের সংকট কীভাবে ভোট যুদ্ধে তলিয়ে গেল তার নথিনামা। ‘আশমানি কথা’ আখ্যান লেখকের সচেতন রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ফসল। রাজনীতি নিয়ে আলগা সমীকরণ নয়, রাজনীতির তত্ত্ব, ক্ষমতার তত্ত্ব ও পার্টি কীভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে মার্কসবাদকে বিসর্জন দেয় তার গূঢ়ার্থ অভিপ্রায় কেমন এবং কতপ্রকার তার সংকেতমালা চিত্রিত হয়ে চেল। শ্রেণি সংগ্রাম, শ্রেণিমুক্তির পার্টিতে কীভাবে জমিদারবর্গ স্থান পেল, বুর্জোয়ারাজ প্রাধান্য পেল, বহির্বিশ্বের সংবাদ দ্বারা প্রান্ত উত্তাল হল, কৃষক, বর্গাদাররা ব্যবহৃত হতে শুরু করল—সমস্ত মিলিয়ে এই আখ্যান বাম রাজনীতির শুরুর দিনগুলির ধারবাহিক ইতিহাস বজায় রাখে। পক্ষ-বিপক্ষ নয় এ আখ্যান রাজনৈতিক সমীকরণের তত্ত্বতালাশ।
একটি প্রান্তিক জনপদে কীভাবে সামগ্রিক বদলের হাওয়া লাগল, বহির্বিশ্বের সংবাদ, কর্ম, তথ্য দ্বারা স্তিমিত জনপদ কীভাবে নড়েচড়ে বসল তার সামগ্রিক ইতিবৃত্ত লেখক নির্মাণ করেছেন। সবুজ বিপ্লব, কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি, জৈব সারের বদলে রসায়নিক সারের আমদানি, দেশি বীজের আবলুপ্তি ঘটিয়ে হাইব্রিড বীজের আমদানি, শিক্ষা বিস্তার, জরুরি অবস্থা, এক্সচেঞ্জ অফিসে নাম লেখানো, রেডিও তে বামফ্রন্ট সরকারের কার্যকলাপ ভেসে আসা, সংস্কৃতি উপর ফ্যাসিবাদী আক্রমণ, পার্টি বিস্তার—সমস্ত মিলিয়ে লেখক একটি দ্বান্দ্বিক পটভূমি নির্মাণ করেন। সবুজ বিপ্লবের প্রাধান্যে কৃষির উৎপাদন কীভাবে বৃদ্ধি এবং দেশীয় চাষবাস কীভাবে বিদায় নিল, প্রযুক্তির জয় কীভাবে গ্রাম্য জীবনে গতি নিয়ে এল তার পটভূমি নির্মিত হয়ে চলে। শুধু পটভূমি নিয়ে তাত্ত্বিক ভূমিও ব্যক্ত হয়। কেন তৃতীয় বিশ্বে চাষাবাদ ঠেলে দিল প্রথম বিশ্ব। জমির কর্ষণ শক্তি, নারীর উপমা, ব্যঞ্জনা, নারী-পুরুষের স্বাভাবিক আকর্ষণ, কৃষির রূপান্তর সমস্ত মিলিয়ে এ আখ্যান বহুমুখী সংকেতমালার পাঠ আবিষ্কারক।
জমিদারি ব্যবস্থার পতন, পতনশীল জমিদারের আর্তনাদ, শ্রেণিশত্রু নিধন, শ্রেণি সংগ্রাম থেকে ভোটের অছিলায় শ্রেণিসমন্বয় মন্ত্র, কংগ্রেসি জমিদার অভয়পদকে নানা অছিলায় সিপিএম পার্টিতে টেনে আনার চেষ্টা, গ্রহণ-বর্জনের দ্বন্দ্ব, চাষাবাদকে কেন্দ্র করে আভয়পদর জমিদারি বিভীষিকা, অক্ষম ক্ষমতা প্রদর্শন ও চাষের পদ্ধতি পরিবর্তন সমস্ত মিলিয়ে এ আখ্যান আদ্যন্ত রাজনৈতিক। দ্বন্দ্বময় বিরোধাভাসই এই আখ্যানের চালিকাশক্তি। সর্বস্বহারা মানুষের সিপিএম হয়ে যাওয়া, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত হওয়া, মিথ্যা মায়ায় ভুলে যাওয়া, বর্গা-ভেস্টের মধ্য দিয়ে নতুন দিন আনা, কৃষির পরিবর্তন ও উচ্চবিত্তদের কংগ্রেসি মানসিকতায় ডুবে থাকা অথচ জনপদ দুই সত্যকে কেন্দ্র করে এগিয়ে চলছে — এই দ্বান্দ্বিক পটভূমি নির্মাণ করে লেখক মস্তিষ্কের বীক্ষণজাত রাজনীতির তত্ত্বকে এখানে প্রয়োগ করেছেন। সংখ্যালঘু কংগ্রেস, সংখ্যাগুরু কংগ্রেসের সংঘাত, শ্রেণিশত্রু নিধন, বিপ্লব, সাম্যবাদের স্বপ্ন দেখানো সিপিএমের ক্ষমতায় ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র, উচ্চবিত্ত, নদী-ড্যাম প্রকল্প নিয়ে বিবাদ, গ্রামীণ নির্বাচনে সিপিএমের পতন, কংগ্রেসকে দোষারোপ, অভয়পদর দেশি পদ্ধতিতে সবজি চাষ, খাজনা আদায় সমস্ত মিলে পতনশীল জমিদারতন্ত্রের রন্ধ্র দিয়ে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের পার্টি চেতনার জাগরণ কীভাবে ঘটল তার সময়তান্ত্রিক পাঠ আবিষ্কারক এই আখ্যান।
আখ্যানে একটা মানবিক বোধ জাগরণকারী শুভ প্রয়াস আছে। আছে জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিসর। মহাকালের চলমানতার সঙ্গে লেখক মুক্তির পথটিও এঁকে দিয়েছেন। দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, আর্তনাদ, শ্রেণি সংগ্রামের পাশাপাশি খাদ্যদ্রব্যের সুষম বণ্ঠন, শুভচেতনা, সাম্য অবস্থা নিয়ে লেখক পাঠককে একটা ধারণায় পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু বাস্তবের চিত্র তো ভিন্ন। অভয়পদের পরিবর্তন ঘটে না—“অভয়পদর ঘরে বাইরে কিছুই রেডিক্যাল চেঞ্জ ঘটেনি প্রভূত ধনাগমের চিহ্নসমূহ ছাড়া।” (তদেব, পৃ. ১১৭) তত্ত্ব, আদর্শ, নীতিবাদ পরিবর্তিত যুগ কাঠামোয় ঠিক খাপ খাচ্ছে না। তবে শ্রেণির রূপান্তর ঘটেছে। ভাগচাষি থেকে বর্গাদার, জমিদার থেকে কৃষকে রূপান্তর। যুগ সংকট, উৎপাদন বৃদ্ধি, বহির্বিশ্বের টান, নিজের অস্তিত্ব ধরে ক্রমান্নয়ে রূপান্তর আখ্যানের ধারাভাষ্য। যে সংকট, অস্তিত্ব সমস্যা প্লাবিত হচ্ছে বামফ্রন্টের রাজনীতিতে। রাষ্ট্র কর্তৃক ধর্মের উৎপাটন, জনজীবনে প্রচলিত কীর্তন, ধর্মঠাকুরের সুর, জমিকে লক্ষ্মী হিসেবে পূজা, যোনি-যৌনতা, কর্ষণ-সন্তান জন্মের সঙ্গে বলদ-জমি-ফসল উৎপাদনকে যেমন বিপুলভাবে নাড়া দিয়েছিল তেমনি শ্রেণিমুক্তির স্বপ্ন দেখানো পার্টিতে বুর্জোয়ারাজ কীভাবে মাথা তুলে দাঁড়াল সেই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আখ্যানকে বিশেষ লাবণ্য দান করেছে।
সমাজতন্ত্র, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব, শ্রেণিশত্রু নিধনের কথা বললেও উন্নয়নে তো পুঁজিবাদের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। স্থায়ী উন্নয়নের ভূমিকায় পুঁজিপতিদের টেক্সই তো বড় ভূমিকা পালন করে। ফলস্বরূপ অভয়পদরা নিজস্ব এক্তিয়ায় নিয়ে থেকে যায়। ‘লাঙল যার জমি তার’ ঘোষিত হলেও বর্গাদারের ফসল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ছিল না। সরকার কৃষি ঋণের কথা বললেও তার সুষমবণ্ঠন হয়নি। অক্ষম বর্গাদার কঙ্কা জমিদার অভয়পদকে জমি ফিরিয়ে দিচ্ছে। অভয়পদর সুদের কারবার দিব্যি চলছে। আছে নানা অব্যর্থ যুক্তি। আভ্রান্ত যুক্তির সিঁড়ি দিয়ে গ্রামীণ সমস্যার আন্দরমহল দিয়ে লেখক প্রবাহিত কালের রেখাচিত্র এঁকে নিয়েছেন। সামান্য টেন্ডার ঠিকেদারির জন্যও তো পুঁজি চাই। প্রান্তিক চাষিবাসী কামরেডের পুঁজি কোথায়? শেষ ভরসা সেই অভয়পদই। যার হাত ধরে আন্যরা কিছু করে খেতে পারবে। ফলস্বরূপ কংগ্রেসি অভয়পদকে টেনে আনা হল সিপিএমে। আজ পার্টি শিল্পের বিরোধিতা করছে না, শ্রমিক ধর্মঘট বাতিল করে দিচ্ছে। অভয়পদ ধীরে ধীরে শিল্পপতি হয়ে উঠেছে। পাথর সাপ্লাইয়ের জন্য পাহাড় টেন্ডার নিচ্ছে। বিপ্লব, পুঁজিবাদ নিধনের তত্ত্ব ধ্বসে গেল। যেতে বাধ্য হল। নব্য কমরেডদের বিপথে চালনা কর হল। যে পথে ভোট সে পথেই পার্টির জয়। কমিউনিস্ট মতাদর্শ, ভোগবাদ থেকে পার্টি ভোটতন্ত্র, শিল্প, পুঁজিবাদের দিকে ঝুঁকে গেল।
যে কৃষক কঙ্কা জমিদার অভয়পদর কাছ থেকে জমি বর্গা করতে উদ্যোত হয়েছিল সেই একদিন জমি ফিরিয়ে দিতে চাইল। সেদিন রূপান্তরিত বিত্তবান কৃষক অভয়পদর জমি ফিরিয়ে নেবার ইচ্ছা ছিল। আবার সেই আভয়পদই কংগ্রেস থেকে সিপিএম পার্টিতে এসে শিল্পপতি হয়ে কঙ্কার জমি ফিরিয়ে নিতে অনিচ্ছুক হল। মহত্ব না অন্য কিছু? দ্বন্দ্বটা কোথায়? বৃহত্তর লাভের জন্য মানুষ ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন দেয়। বৃহত্তর লাভের জন্য নিজেকে মহৎ করতে হয়, চরিত্রকে শুদ্ধ করতে হয়, জীবনকে পবিত্র করতে হয়। সবটাই মেকি। আবার বৃহত্তর অর্থের ইশারা এলেই পুরুষের নারী লালসা জাগে। অভয়পদই দৃষ্টান্ত। পার্টি প্রসারিত হচ্ছে। পার্টি পত্রিকা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানে পুঁজিবাদি শিল্পের বিজ্ঞাপনে ভরে যাচ্ছে। এ আখ্যান পার্টির প্রতিক্রিয়াশালী পুঁজিবাদি বিকাশের কৈশোরকালের নথিনামা। ১৯৭৭ পরবর্তী পার্টির বিকাশ, কৃষি-শিল্পের দ্বন্দ্ব, গ্রামোন্নয়ন, পার্টিতন্ত্র নিয়ে যুগান্তরের নথিনামা। পক্ষ-বিপক্ষ নয় অভিজ্ঞতা সঞ্চিত বোধ, দার্শনিক মনন ও জীবনচেতনার সুগভীর স্তর থেকে উঠে আসা মননলব্ধ জ্ঞানই এর নিয়ন্ত্রিত আয়ুধ।
আখ্যান যত পরিণতির দিকে এগিয়েছে প্রান্তিক জনপদে জীবনের সংকট, চালচিত্র, লাবণ্য থেকে তা সমগ্র দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো, উন্নয়নের বিকাশ, পুঁজিবাদের প্রসারের চিত্রকে ধরতে চেয়েছে। বামফ্রন্ট পুঁজির বিরোধিতা করেছে, অথচ পুঁজির সর্বগ্রাসী শক্তি মানতে বাধ্য হয়েছে। মার্কস, লেনিনের তত্ত্ব অচল হয়ে গেছে, রাশিয়া ভেঙে গেছে, উদার অর্থনীতি, মুক্ত বাণিজ্য, সম্পদের লুণ্ঠন, পরিবেশ সমস্যা, দরিদ্র মানুষকে আরো ভেঙে দেওয়ার মধ্য দিয়ে বিকল্প শক্তির বদলে নয়া সাম্রাজ্যবাদের মুখোশ খুলে গেছে। যারা সমাজমুক্তির স্বপ্ন দেখাবে বলে জনগণকে পার্টিতে ডেকে এনেছিল তারাই ভোগবাদে ভেসে গেছে। বিপ্লব, দেশপ্রেম, সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে পার্টির নিয়ন্ত্রা হয়ে উঠেছে ভোটে জিতে ক্ষমতালাভ। কমিউনিস্ট তত্ত্ব ধর্ম বর্জনের কথা বললেও নেতাদের মধ্যে ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে যায়। যে গোঁড়ামি জামরুদ্দিন ও কৃষ্ণার প্রেমকে মেনে নিতে পারে না। কমিউনিস্ট তত্ত্ব যে জীবনচেতনা, উদারতাবোধ, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব ও শ্রেণি সংগ্রামের ডাক দিয়েছিল তা আদৌও হয়নি। লোভ, ক্ষমতা, ভোগবাদ, ভোট সমস্ত ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। সেইসব তত্ত্বকে যে ঝেড়েমুছে ফেলা হয়েছিল তাও নয়, কিছুটা ছিল। ছিল গ্রহণ-প্রয়োগের দ্বন্দ্ব। ক্ষমতাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ, বুর্জোয়ারাজ ও নিচুতলার কমরেডদের সেই দ্বন্দ্ব আখ্যানের চাবিকাঠি। প্রতি টার্মে বামফ্রন্ট নতুন নতুন তত্ত্ব নিয়ে এসেছে। নেতাদের সন্তানরা মিছিলে হাঁটেনি, অথচ সব গুছিয়ে নিয়েছে। আবার অভয়পদ প্রতীক আপেক্ষা বস্তু চেনে। পার্টির মতো অভয়পদরাও যেন ছায়া, কলরব নিয়ে বিদায় বেলায় উপস্থিত। সেই জীবনসত্য ভেসে গেছে কাব্যময়তায় —
“আলোও এখন বক্ররেখা ধরেই পতিত হয়, পতঞ্জল একেই বলেছেন অভিনিবেশ। প্রাণ ভরিয়ে তৃষ্ণা হরিয়ে আসলে আরো আরো প্রাণ চাওয়া। কামনা করতে গেলে কল্পনা করতে হয়, তোমার ছায়ায় রোপিত পদচিহ্নটিই তুমি, অথচ তোমার পা-ই ছিল না কোনোকালে। তুমি বিদায়ী, ছায়াপ্রদায়ী। ছায়াটুকুই তুমি। ঘুম যখন ভেঙেই গেল, মানে একটি দিবস, মানে পুনরায় বেঁচে যাওয়া কিম্বা পূর্ণমৃত্যুর দিকে একদিন এগিয়ে যাওয়া অর্থাৎ ফলাফল-বিবেচনাবিহীন আরব্ধে কাজ কিছুটা এগিয়ে রাখা। অনিচ্ছায়, বিমুখতার হাত ধরাধরি করে চলা, যাকে অভয়পদ জেনে এসেছে কৃতকর্তব্য বলে; অনুভব করতে পারছে, বার্ধক্যের সাথে সাথে কৃতকর্তব্য আর ব্যর্থতা কেবলই বাড়ছে, যুগপৎ বেড়েই চলেছে।” (তদেব, পৃ. ১৬৩)
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থান, পরিবেশবিদদের আন্দোলন, পাহাড় বিক্রির বিরোধিতা, সিপিএমের সংকট, নগনের আত্মচিন্তা, অভয়পদর বণিক সুলভ মনোবৃত্তির মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রের যুগান্তরের সংবাদকে বহন করে উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটেছে। আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে রাজনৈতিক তত্ত্ব, প্রয়োগ, মানুষের জাগরণ, পার্টির বিকাশ থেকে একটি জনপদের উত্থানকে লেখক এমন নির্মাণে সাজিয়েছেন যার নান্দনিক মূল্য সুগভীর তাৎপর্যপূর্ণ। একটি পিছিয়ে থাকা প্রান্তিক জনপদ কীভাবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এল, তার মধ্য দিয়ে সময়ের সত্যকে যে বীক্ষণে তিনি মহাকালের বীণায় বাজিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।
লেখক : অধ্যাপক, রায়গঞ্জ সুরেন্দ্রনাথ মহাবিদ্যালয়।