শিবনাথ শাস্ত্রীর উপর্যুক্ত ভাষ্যে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে আলোচ্য গ্রন্থের মৌল চারিত্র্য। রামতনু লাহিড়ীর জীবন এবং তৎকালীন বাংলার জাগরণ যে অভিন্ন-সূত্রে গ্রথিত, এই অভিজ্ঞানই গ্রন্থটিকে দিয়েছে স্বতন্ত্র মর্যাদা। একজন আলোকিত মানুষের জীবনেতিহাস লিখতে গিয়ে সময়ের পূর্ণাঙ্গ ও বস্ত্তনিষ্ঠ বিবরণ এই গ্রন্থে যেভাবে উঠে এসেছে, তেমন দৃষ্টান্ত বাংলা সাহিত্যে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ-গ্রন্থে ধরা পড়েছে উনিশ শতকের বিভিন্ন মনীষীর কর্মের বিবরণ, বিশেষ করে ব্রাহ্মধর্মের উদ্ভব ও বিকাশকাহিনি। রামতনু লাহিড়ীর জীবনেতিহাস বর্ণনাসূত্রে উনিশ শতকের সামাজিক ইতিহাস বয়ানের যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী, আজ শতবর্ষ পরে সেজন্যে তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। মানসিকতার পরিবর্তন না ঘটলে আমরা হয়তো গতানুগতিক এক জীবনগ্রন্থ পেতাম, সামাজিক ইতিহাসের অনুপম এক আকরগ্রন্থ পেতাম না। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায় বরুণকুমার চক্রবর্তীর এই বিবেচনা :
ধন্যবাদ জানাতে হয় শিবনাথ শাস্ত্রীর পরিবর্তিত মানসিকতাকে। সত্য সত্যই যদি তিনি তাঁর পরম শ্রদ্ধেয় রামতনু লাহিড়ীর জীবনচরিত রচনায় গতানুগতিক পথকে অবলম্বন করতেন, নিছক লাহিড়ী মহাশয়ের অনুরক্তদের খুশি করার মতো একটি ক্ষুদ্রাকার জীবনচরিতে লাহিড়ী মহাশয়ের জন্ম, তাঁর কুল-পরিচয়, তাঁর চারিত্রিক স্বাতন্ত্র্য, শিক্ষাদানের জন্য তাঁর অনুসৃত রীতি, ছাত্র বাৎসল্য, আপন আদর্শের জন্য প্রবল প্রতিপক্ষের প্রতিকূলতার সম্মুখীন হওয়ার আনুপূর্বিক বিবরণ, তাঁর পারিবারিক তথা সাংসারিক জীবন, বিশেষ ধর্মাদর্শে বিশ্বাস স্থাপন, বন্ধুপ্রীতি ইত্যাদির পরিচয় দানেই কর্তব্য সীমাবদ্ধ রাখতেন, তাহলে বাংলা সাহিত্য একটি অনন্যসাধারণ জীবনচরিত লাভের সৌভাগ্য লাভে বঞ্চিত হতো, যেমন বঞ্চিত হয়েছে অদ্বিতীয় বিদ্যাসাগরের আত্মচরিত খন্ডিত থাকার কারণে। ৪
উনিশ শতকে হিন্দু কলেজকে (১৮১৭) কেন্দ্র করে দেখা দিয়েছিল নবজাগরণের উত্তুঙ্গ এক রূপ। পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শনের আলোয় স্নাত হয়ে হিন্দু কলেজে প্রতিষ্ঠিত অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের (১৮২৬) সদস্যবৃন্দ কলকাতার রক্ষণশীল সমাজে প্রবল অভিঘাত সৃষ্টি করেন। অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন বা ইয়ং বেঙ্গলের অভিঘাতে কলকাতার সমাজজীবনে সৃষ্টি হয় যে নবতরঙ্গ, তার মুখ্য প্রেরণা-উৎস ছিলেন হিন্দু কলেজের তরুণ শিক্ষক হেনরি ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-৩১)। রেনেসাঁস ম্যান বা আলোকিত মানুষ বলতে যা বোঝায়, ডিরোজিও ছিলেন তার উজ্জ্বল উদাহরণ। রামতনু লাহিড়ী ছিলেন এই ডিরোজিওর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাবশিষ্য। এই গ্রন্থের ভূমিকায় শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন – ‘ডিরোজিওর ছাত্রবৃন্দের মধ্যে যদি কেহ গুরুর সমগ্র-ভাব পাইয়া থাকেন, যদি কেহ চিরদিন গুরুকে হৃদয়াসনে প্রতিষ্ঠিত রাখিয়া পূজা করিতে থাকেন, তবে তাহা রামতনু লাহিড়ী।’৫ যেহেতু ইয়ং বেঙ্গলদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল সমাজে প্রচলিত সনাতন কুসংস্কার ও জগদ্দল রক্ষণশীলতা, তাই রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ তাদের বিরুদ্ধে নানাপ্রকার কুৎসা ও অপবাদ ছড়াতে থাকে, তাদের চরিত্রে লেপন করতে থাকে নানা ধরনের কালিমা। তৎকালীন ডামাডোল, তর্ক-বিতর্ক ও বিপরীতমুখী প্রচারণা থেকে প্রকৃত সত্য বের করে আনা ছিল এক কঠিন কাজ। এ কাজেই ব্রতী হলেন শিবনাথ শাস্ত্রী।৬ রামতনু লাহিড়ীর জীবনচরিত লিখতে গিয়ে সে-সময়ের প্রকৃত সত্য উপস্থাপন করাই হয়ে উঠলো তাঁর মৌল লক্ষ্য। সে-লক্ষ্য পূরণে একজন লেখক যে কী পরিমাণে সিদ্ধি লাভ করতে পারেন তার উজ্জ্বল ও ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হয়ে আছে আলোচ্য গ্রন্থ। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায় লেখকের এই বক্তব্য :
আমার পূবর্ববর্তী কোনও কোনও লেখক ডিরোজিও ও তাহার শিষ্য-দলের প্রতি বিশেষ অবিচার করিয়াছেন। তাঁহারা ইহাদিগকে নাস্তিক ও সমাজ-বিপ্লবেচ্ছু যথেচ্ছচারী লোক বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন। এরূপ অমূলক অপবাদ আর হইতে পারে না। ডিরোজিওর ছাত্রবৃন্দের মধ্যে যদি কেহ গুরুর সমগ্র-ভাব পাইয়া থাকেন, যদি কেহ চিরদিন গুরুকে হৃদয়াসনে প্রতিষ্ঠিত রাখিয়া পূজা করিতে থাকেন, তবে তাহা রামতনু লাহিড়ী। পাঠক! এই গ্রন্থে দেখিবেন ঈশ্বরে তাঁহার কি বিমল ভক্তি ছিল। আমাদের গৃহে যখন তিনি বাস করিতেন, তখন সর্বদা দেখিতাম যে, অতি প্রত্যুষে তিনি উঠিয়াছেন, এটি ওটি করিতেছেন এবং গুন্গুন্ স্বরে গান গাইতেছেন, ‘মন সদা কর তাঁর সাধনা’। আমার বিশ্বাস এই সাধনা তাঁর নিরন্তর চলিত। এই কি নাস্তিক গুরুর নাস্তিক শিষ্য ? অতএব প্রকৃত অবস্থা কি, তাহা দেখাইয়া ইঁহাদিগকে অকারণ অপবাদ হইতে রক্ষা করাও আমার অন্যতর উদ্দেশ্য। কিন্তু তাহার ফল চরমে যাহা দাঁড়াইয়াছে তাহা সকলেই অনুভব করিবেন। স্থানে স্থানে বাহিরের কথা প্রকৃত বিষয় অপেক্ষা অধিক হইয়া পড়িয়াছে। ৭
শিবনাথ শাস্ত্রীর উপর্যুক্ত ভাষ্য থেকে দুটো তথ্য পাওয়া যায়। প্রথমত, তিনি ডিরোজিও ও তাঁর শিষ্যদের সৃষ্ট ভাব-আন্দোলনের প্রকৃত তথ্য অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন এবং দূর করার প্রয়াস পেয়েছেন ইয়ং বেঙ্গল সদস্যদের চরিত্র সম্পর্কে রক্ষণশীল সমাজের নানামাত্রিক অপবাদ। দ্বিতীয়ত, রক্ষণশীল সমাজের অপবাদ দূর করতে গিয়ে সামাজিক ইতিহাসকে বিশদ বিশ্লেষণ করতে হয়েছে। তিনি লিখেছেন — ‘স্থানে স্থানে বাহিরের কথা প্রকৃত বিষয় অপেক্ষা অধিক হইয়া পড়িয়াছে।’ বস্ত্তত, প্রকৃত বিষয় অর্থাৎ রামতনু লাহিড়ী অপেক্ষা তৎকালীন সমাজ ও সংস্কৃতি যে অধিক হয়ে পড়েছে, এখানেই নিহিত গ্রন্থটির অসামান্য সার্থকতা। ‘বাহিরের কথা’ অধিক না হলে, গ্রন্থটি বিপুল সার্থকতা ও কালোত্তীর্ণ পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করতে পারতো না বলেই মনে করি।
এই গ্রন্থের দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য, বর্ণিত প্রায় সব ঘটনাই শিবনাথ শাস্ত্রীর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার জগৎ থেকে গৃহীত হয়েছে। কোনো বানানো বা কল্পকাহিনি এ-গ্রন্থে স্থান পায়নি। রামতনু লাহিড়ীর শিষ্য হিসেবে শিবনাথ শাস্ত্রী সে-সময়ের প্রতিটি আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এই গ্রন্থের অধিকাংশ চরিত্রের সঙ্গে শিবনাথের ছিল প্রত্যক্ষ পরিচয়, অনেক ঘটনার সঙ্গে তিনি ছিলেন সরাসরি যুক্ত। নিজের চোখে দেখা বলে সকল ঘটনার খুঁটিনাটি বিষয় শিবনাথ শাস্ত্রী এতো চিত্তাকর্ষকভাবে বর্ণনা করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি ছিলেন উত্তম সাংবাদিক, কুশলী বক্তা। পাঠকের চিত্তলোকে কীভাবে পৌঁছতে হয়, তা তাঁর ভালো করেই জানা ছিল। এ-কারণেই শতবর্ষের সীমানা পেরিয়েও এই গ্রন্থটি বাঙালি পাঠকের কাছে এখনো এতো জনপ্রিয়। কেবল শিক্ষক-শিক্ষার্থী-গবেষক নন, সাধারণ পাঠকও এ-বই পাঠ করেন উপন্যাস-পাঠের সমান আনন্দ নিয়ে। বস্ত্তত, উনিশ শতকের বাংলাদেশ সম্পর্কে কৌতূহলী যে-কেউ এ-গ্রন্থ পাঠেই সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন — এ-গ্রন্থ পাঠ করেই একালের তরুণ শিক্ষার্থী জানতে পারে উনিশ শতকের সেই গৌরবোজ্জ্বল সময়ের কথা — জানতে পারে তার অতীত ঐশ্বর্যের কথা, ঋদ্ধ ঐতিহ্যের কথা। (ক্রমশ)