এলেনর মার্কস (Eleanor Marx) (১৮৫৫-১৮৯৮) // কার্ল মার্কসের মেয়ে
এলেনর কার্ল মার্কসের ষষ্ঠ সন্তান ও চতুর্থ কন্যা। তাঁর জন্ম লণ্ডনে। তিনি মার্কসের প্রিয় টুসি। চমৎকার ফুটফুটে মে্য়ে। গভীর কালো চোখ, মাথায় কালো চুলের গুচ্ছে। সপ্রতিভ, সংবেদনশীল, যুক্তিবাদী। সাহিত্য ভালোবাসেন, ভালোবাসেন সংগীত আর নাটক। ভালোবাসেন বাবার মুখে গল্প শুনতে। শেক্সপীয়ার বলে যেতেন মুখস্থ। তাই যেতেন ‘ডগবেরি ক্লাবে’।
সেই সঙ্গে তাঁর রক্তে প্রবাহিত রাজনীতির চেতনা, সমাজতন্ত্রের প্রতি আগ্রহ। ম্যাঞ্চেস্টার শহিদদের ফাঁসিতে তিনি উদ্বেলিত হন, ফেনিয়ানদের প্রতি জানান সহানুভূতি। মাত্র ষোল বছর বয়েসে তিনি তাঁর বাবার সহকারী হলেন। বাবার সঙ্গে বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনে যেতে শুরু করলেন। এই সময়ে তিনি প্রেমে পড়লেন সাংবাদিক অলিভিয়ার লিসাগারের (Olivier Lissagaray)। অলিভিয়ার অনেকাংশে মার্কসপন্থী। কিন্তু মেয়ের সঙ্গে লিসাগারের বিয়ের ব্যাপারে মার্কসের আপত্তি ছিল বয়েসের ব্যাপারে, কারণ বয়েসে তিনি এলেনরের চেয়ে অনেকটাই বড় ছিলেন।
জোর করেন নি লিসাগার। মার্কসের বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলেন তিনি। তারপরেও এলেনরের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তাঁর। এলেনর তাঁকে সাহায্য করেছিলেন প্যারি কমিউনের ইতিহাস (History of Parry Commune) লিখতে। পরে, ১৮৮০ সাল নাগাদ লিসাগার সম্পর্কে মত পরিবর্তন করেন কার্ল মার্কস, মেয়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিতে সম্মত হন। ততদিনে অবশ্য এলেনর নিজেই তাঁর মত পরিবর্তন করেছিলেন লিসাগার সম্বন্ধে।
১৮৮০ সালে। মা-বাবা দুজনেই অসুস্থ। এলেনরকে দেখাশুনো করতে হচ্ছে। ১৮৮১ সালে মারা গেলেন মা। এদিকে আবার ছোট্ট ভাগনে জিন লাংগুয়েট (Jean Longuet) মাতৃহারা হয়েছে। এলেনরকে তার যত্ন নিতে হচ্ছে। জিনের মা মারা গেছেন মুত্রাশয়ের ক্যানসারে। বিপদের উপর বিপদ। ১৮৮৩ সালের মার্চ মাসে মারা গেলেন বাবা। বাবার সেই বিখ্যাত বই ‘ডাস ক্যাপিটাল’ প্রকাশ করতে হবে ইংরেজি ভাষায়। এঙ্গেলসের সঙ্গে এলেনর নেমে পড়লেন কাজে। ১৮৮৪ সালে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক ফেডারেশন নতুন করে গঠিত হয়েছে। প্রথম থেকে তার সঙ্গে আছেন এলেনর। বক্তৃতা দিচ্ছেন, কাগজে প্রবন্ধ লিখছেন, ধর্মঘট সংগঠিত করছেন, নির্বাচনের প্রচার করছেন।
যখন তাঁর ২৭ বছর বয়েস তখন দেখা হল এডওয়ার্ড অ্যাভেলিং-এর সঙ্গে। জীববিজ্ঞানের শিক্ষক, ডারউইনের শিষ্য, মুক্তচিন্তক অ্যাভেলিং। দুজনের দেখা হল ব্রিটিশ মিউজিয়ামের রিডিং রুমে। প্রথম দর্শনেই প্রেম। দুজনে একসঙ্গে থাকতে শুরু করলেন। এলেনর অ্যাভেলিং (Eleanor Aveling)-এর পরিচয় করিয়ে দিলেন তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীদের সঙ্গে। এলেনরের ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ অ্যাভেলিং। কিন্তু বিয়ে? না, এখনই এলেনরকে বিয়ে করতে পারবেন না অ্যাভেলিং। কারণ তিনি আগেই বিয়ে করেছেন, এখনও বিবাহ বিচ্ছেদ হয় নি। বিবাহ বিচ্ছেদ না হওয়ার ব্যাপারটা আদপে মিথ্যে। বিশ্বাস করে নিলেন এলেনর। ততদিনে এলেনরের মন জয় করে নিয়েছেন অ্যাভেলিং। এলেনর দেখছেন সমাজতন্ত্রের প্রতি অ্যাভেলিং-এর অনুরাগ। মঞ্চে উঠে চমৎকার বক্তৃতা করেন তিনি, মন জয় করেন শ্রোতার, কথা শুনে চলেন এলেনরের। এলেনর দেখেও যা দেখেন নি তা হল নারীর প্রতি অ্যাভেলিং-এর আসক্তি, নিত্য নতুন পোশাকের প্রতি আসক্তি, ভালো খাদ্যদ্রব্যের প্রতি আসক্তি, অর্থের প্রতি আসক্তি।
১৮৮৪ সালে এলেনর হেনরি হাইণ্ডন্ডম্যানের (Henry Hyndman) নেতৃত্বে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক ফেডারেশনে যোগদান করলেন, কিন্তু পরের বছরে সেই সংগঠন থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। কারণ হাইণ্ডম্যানের স্বৈরাচারী কর্মপদ্ধতি। এলেনর প্রতিষ্ঠা করলেন সোশ্যালিসট লিগ। এই লিগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আর্নেস্ট বেলফোর্ট ব্যাক্স, স্যাম মাইনওয়ারিং, টম মান, লরা ও তাঁর স্বামী পল লাফার্গ, অ্যানি বেসান্ত। এই লিগের মাসিকপত্রের নাম ‘কমনওয়েল’। এতে এলেনর যে নিয়মিত কলাম লিখতেন তার নাম ‘রেকর্ড অব দ্য রেভলিউশনারি ইন্টারন্যাশনাল মুভমেন্ট’।
এলেনর ১৮৮৫ সালে প্যারিসে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক কংগ্রেস গঠনে সাহায্য করেন। ১৮৮৬ সালে তিনি অ্যাভেলিং ও লাইবনেখটের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। ১৮৮৭ সালের ১৩ নভেম্বর তিনি লণ্ডনে এক বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করেন। এই সমাবেশ ‘রক্তাক্ত রবিবার’ নামে পরিচিত। পুলিশ নৃশংসভাবে এই বিক্ষোভ দমন করেছিল। ১৮৯৩ সালে কেয়ার হার্ডি যে স্বাধীন লেবার পার্টি গঠন করেন, এলেনর ছিলেন তার পর্যবেক্ষক।
রাজনৈতিক কাজকর্মের সঙ্গে এলেনর নাটকাভিনয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁর মনে হয় সমাজতন্ত্র প্রচারের কাজে নাটক সহায়ক হতে পারে। ইবসেনের নাটক ইংরেজিতে অনুবাদ করার জন্য তিনি নরওয়েজিয়ান ভাষা শিক্ষা করেন।
১৮৯৮ সাল। এলেনর একদিন আবিষ্কার করলেন যে তাঁর স্বামী এডওয়ার্ড অ্যাভেলিং একজন বিশ্বাসঘাতক। এক তরুণ অভিনেত্রীর সঙ্গে তাঁর গোপন সম্পর্ক আছে। হাইড্রোজেন সায়ানাইড (প্রুসিক অ্যাসিড) খেয়ে আত্মহত্যা করেন এলেনর। তখন তাঁর বয়েস মাত্র ৪৩। (ক্রমশ)