“ওলং কেমুকবাস্তুকং সার্ষপঞ্চ নিম্বং জয়াং। শালিঞ্চিং হিলমোচিকাঞ্চ পটুকং শেলুকং গুড়ুচীন্তথা। ভন্টাকীং সুনিষণ্ণকং শিবদিনে যদন্তি যে মানবাঃ প্রেতত্বং না যান্তি কার্তিকদিনে কৃষ্ণে চ ভূতে তিথৌ।’’ — কৃত্যকৃত্ব/রঘুনন্দন
শ্লোকটি মূলত চোদ্দ শাকের নাম ও তার তাত্ত্বিক আলোচনা। শ্লোকে উল্লেখিত চোদ্দ শাক হল –
১. ওল ডাঁটা, ২. কেউ, ৩. বথুয়া, ৪. কালকাসুন্দ, ৫. সরষে, ৬. নিম, ৭. জয়ন্তী, ৮. শালিঞ্চে বা শিঞ্চে, ৯. গুলঞ্চ, ১০. পটল বা পলতা, ১১. শেলুকা, ১২. হিলমোচিকা বা হেলেঞ্চা, ১৩. ভাঁট বা ঘেঁটু, ১৪. সুনিষণ্ণক বা শুষনি।
চাষের দিকটি মাথায় রেখে ও দুর্লভতার কারণে বঙ্গের অনাবাদি অন্যান্য শাকগুলিও অবশ্য খাওয়া যেতে পারে। যেমন — আমরুল, কলমি, কুলেখাড়া, খারকোন বা ঘাটকোল, ব্রাহ্মী, ঢেঁকিশাক, নুনিয়া বা নুন খুড়িয়া, তেলাকুচা, দণ্ডকলস, গিমা, থানকুনি, কাঁটানটে বা খৈরাকাটা, কচু, ঘাগরা বা হাগড়া (বিষাক্ত), মালঞ্চ, কালমেঘ বা আলুই, বাসক, চুকোর বা টক ভেন্ডি, কস্তরী, মোরগফুল।
ভূতচতুর্দশীর রাত ঝলমল করবে চোদ্দ পিদিমের আলোয়। সে দিনটাই কিন্তু চোদ্দ শাক খাওয়ারও দিন।
সকলেই বিভিন্ন মিডিয়ায় ও ফেসবুকের পেজে চোদ্দ শাক খাওয়া ও ধন্বন্তরির সঙ্গে একটি সম্পর্ক আছে বলে লিখছেন। লক্ষণীয় এই ব্যাখ্যাটি কিন্তু পনেরো-কুড়ি বছর আগেও কেউ দিতেন না। তখন অবশ্য ধন্বন্তরির সঙ্গে ধনতেরাসকেও জড়ানো হয়নি। ধনত্রয়োদশী থেকেই ধনতেরাস এসেছে বলে সর্বজনগ্রাহ্য মত একটি ছিল অবশ্য।
পরে বিভিন্ন লেখায় ধনের দেবতা কুবের বা ধনদ যে ধনতেরাস নামটির উৎপত্তির নেপথ্যে, সেটা আমি লিখি।
যক্ষ (রাক্ষস) কুবের ছিলেন রাজা। তিনি দক্ষিণ সাগরের মাঝখানে সোনার শহর লঙ্কা তৈরি করেন৷ বলা হয় যে, তিনি সাধারণত তাঁর পুষ্পক বিমানে করে ভ্রমণ করতেন, সেটি এক প্রাসাদতুল্য উড়ন্ত যান ছিল৷ তবে, কুবেরের লঙ্কার গৌরবময় দিন শেষ হয়ে যায় যখন কুবেরের সৎ ভাই রাবণ, ব্রহ্মার বরে বলীয়ান হয়ে তাঁকে উচ্ছেদ করে৷ উৎপীড়িত ও বিতাড়িত কুবের লঙ্কা ছেড়ে কৈলাসের কাছে অলকাপুরীতে থাকতে শুরু করেন।
বৈদিক পাঠে কুবেরকে রাক্ষস আখ্যা দেওয়া হয়৷ যদিও, রামায়ণ এবং মহাভারতের মত অন্যান্য হিন্দু পুরাণে, তিনি ধনের দেবতা এবং সবথেকে ধনবান দেব (হিন্দু ভগবান)৷ মজার বিষয় হল, কুবের শব্দের অর্থ হল — সংস্কৃততে ‘বিকলাঙ্গ’ বা ‘ভয়ঙ্কর’৷ হিন্দু লিপি এবং ভাষ্কর্যে কুবেরের চিত্রায়ণ করা হয় বিরাট বপু এবং পদ্ম পাতার গাত্রবর্ণ সমেত খর্বাকৃতি ব্যক্তি হিসাবে৷
হিন্দু পুরাণে, ‘কুবেরের ভাণ্ডার’ বা ‘কুবেরের ধন’ প্রচলিত শব্দ যা ধনী ব্যক্তিদের সোনার ভাণ্ডার বা সম্পত্তির জন্য ব্যবহৃত হয়৷ বর্তমানে কুবেরের শিল্পকলা এবং ছবি বলতে মূলত সোনা সমেত দেবী লক্ষ্মীকে বোঝায়৷ ‘সোনার দাতা’ হিসাবে পরিগণিত হওয়ার পর, কুবের প্রায়ই সমৃদ্ধি ও সাফল্যের জন্য লক্ষ্মীর সাথে পূজিত হন, বিশেষত বাড়ির সাথে সাথে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দীপাবলীর সময়৷ এটা প্রচলিত বিশ্বাস যে কুবেরের যে ভক্তরা তাঁর ‘ওম শাম কুবেরায় নমঃ’ মন্ত্রটি একশ আটবার জপ করে তাদের তিনি তাঁর ভাণ্ডার থেকে সোনা এবং অন্যান্য মূল্যবান ধাতু দান করেন।
তবে জানা দরকার কুবের শুধু ধনের দেবতাই নন, তিনি সম্পদ ও সমৃদ্ধিরও দেবতা। তিনি লোকপাল ও দিকপাল। উত্তর দিক তাঁর দখলে। কুবেরাদ্রি বলে কৈলাস পর্বতকে। তাঁকে অষ্টদিকপাল বলেও কোথাও কোথাও অভিহিত করা হয়। শস্য ও শাক যে সব দিকেই উৎপন্ন হয়, তা বলাই বাহুল্য।
নবপত্রিকার মতই চোদ্দ শাকও শস্যসম্ভার ও সমৃদ্ধির দ্যোতক।
উত্তর দিকের অধিপতিকে লোকপালও বলে। তিনিই যে মানবজাতির খাওয়াপরার দায়িত্ব নেবেন, তা বলাই বাহুল্য।ভাত-কাপড়ের ভাবনা তাঁর হাতেই।
শুধু আয়ুর্বেদের জনক ধন্বন্তরি নন, ধনদ অর্থাৎ কুবেরের মাহাত্ম্যও চোদ্দ শাক খাওয়ার কারণ হতে পারে।