মঙ্গলবার | ৩রা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১০:৫০
Logo
এই মুহূর্তে ::
মমতার স্পষ্ট বার্তা — আগে বাংলার মানুষ আলু খাবে, তারপর বাইরে পাঠানো হবে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় অদ্বৈত মল্লবর্মণ — প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য-সমালোচক (দ্বিতীয় পর্ব) : রহমান হাবিব লঙ্কা চাষ বাড়ছে, লাভবান চাষিরা, রপ্তানি বাড়াতে রাজ্য সরকারের উদ্যোগ : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় পাশাপাশি, তবে প্রাণ নেই, চিহ্ন বইছে ভেলুগোন্ডা, রবিবার জল সরার পরে : অশোক মজুমদার নলিনী বেরার কবিতা — স্বভূমি, স্বদেশ, স্বজন : ড. পুরুষোত্তম সিংহ অদ্বৈত মল্লবর্মণ — প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য-সমালোচক (প্রথম পর্ব) : রহমান হাবিব রংবাহারি ক্যাপসিকাম : রিঙ্কি সামন্ত রাজ্যের কৃষকমান্ডিতে কৃষকদের ধান বিক্রিতে দালাল মুক্ত করার নির্দেশ সরকারের : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘উচ্ছেদ’ আমাদের সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং নানা মত : তপন মল্লিক চৌধুরী বেঙ্গল গোট গ্রামীণ অর্থনীতিতে এনে দিতে পারে স্বচ্ছলতা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় পিটার নাজারেথ-এর ছোটগল্প ‘মালদার’ অনুবাদ মাসুদ খান আমরা নারী-আমরাও পারি : প্রসেনজিৎ দাস ঝুম্পা লাহিড়ীর ছোট গল্প “একটি সাময়িক ব্যাপার”-এ অস্তিত্ববাদ : সহদেব রায় ঝুম্পা লাহিড়ী-র ছোটগল্প ‘একটি সাময়িক বিষয়’ অনুবাদ মনোজিৎকুমার দাস ঠাকুর আমার মতাে চিরকালের গৃহীর চিরগুরু : সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় ভাবাদিঘির জট এখনও কাটেনি, বিষ্ণুপুর থেকে জয়রামবাটি রেল চলাচল শীঘ্রই : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (শেষ পর্ব) : অভিজিৎ রায় উৎপন্না একাদশী মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত মারাঠাভুমে লাডকি বহিন থেকে জয়, ঝাড়খণ্ডে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী প্রচারে হার : তপন মল্লিক চৌধুরী কিন্নর-কৈলাসের পথে : বিদিশা বসু হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (চতুর্থ পর্ব) : অভিজিৎ রায় ভনিতাহীন চলন, সাইফুর রহমানের গল্প : অমর মিত্র সাইফুর রহমান-এর বড়োগল্প ‘করোনা ও কফিন’ হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (তৃতীয় পর্ব) : অভিজিৎ রায় নানা পরিচয়ে গৌরী আইয়ুব : গোলাম মুরশিদ হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (দ্বিতীয় পর্ব) : অভিজিৎ রায় কেন বারবার মণিপুরে আগুন জ্বলে আর রক্ত ঝড়ে : তপন মল্লিক চৌধুরী শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (শেষ পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (প্রথম পর্ব) : অভিজিৎ রায়
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই দীপাবলি এবং কালীপুজোর আন্তরিক শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

মার্ক্সবাদ, মনোবিশ্লেষণ এবং বাস্তবতা : এরিক ফ্রম, অনুবাদ ফাতিন ইশরাক

ফাতিন ইশরাক / ৪০৬ জন পড়েছেন
আপডেট শনিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৪

বিগত ৩৫ বছরে আমি এমন অনেক বই লিখেছি, যেখানে আমি দেখিয়েছি যে কেবল কয়েকটা জায়গায় যে মার্ক্সবাদ আর মনোবিশ্লেষণ এক হয়ে যায় এমন টা না। বরং এই দুইয়ের মধ্যে একটা গভীর মিল ও রয়েছে। এর মানে হচ্ছে, আমি সিন্থেসিস কে কেবল একটা সম্ভাবনাই মনে করি না, বরং একে অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত একটা প্রয়োজন হিসেবে দেখি। [অনুবাদকথিসিস হচ্ছে সূচনা বিন্দু, এন্টি থিসিস হচ্ছে থিসিসের প্রতিক্রিয়া এবং সিন্থেসিস হচ্ছে এই দুইয়ের সমন্বিত ফলাফল। উদাহরণস্বরূপঃ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বুর্জোয়ারা উৎপাদনের উপাদান (ভূমি, মূলধন, শ্রম, সংগঠন) এর মালিক এবং প্রলেতারিয়েত শোষিত হয়। এটা হচ্ছে থিসিস। এভাবে সমাজের একদিকে শোষক বুর্জোয়া গোষ্ঠী ও আরেকদিকে শোষিত প্রলেতারিয়েত গোষ্ঠী জমা হওয়ার কারণে পুঁজিবাদ এমন একটা অবস্থার দিকে আগায় যায়, যখন বুর্জোয়া এবং প্রলেতারিয়েত এর মধ্যে সংঘাত তৈরি হয়। প্রলেতারিয়েত এই শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠে। এটা হচ্ছে এন্টি থিসিস। এর ফলাফল হচ্ছে শ্রেণিহীন নতুন সমাজ ব্যবস্থা, তথা কমিউনিজম। এটা হচ্ছে সিন্থেসিস। মার্ক্স তার ঐতিহাসিক বস্তুবাদের তত্ত্বে দেখিয়েছেন যে মানব সভ্যতার ইতিহাস কোন বস্তুনিরপেক্ষ আদর্শের দ্বারা তৈরি না, বরং উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে মানুষের সম্পর্ক তথা মানব শ্রমের দ্বারা মানুষের তৈরি। মানুষ এবং সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থা পরস্পর বিচ্ছিন্ন কোন বিষয় না। মানুষ এই উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার সাথে সাথেই নির্দিষ্ট কিছু সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে এবং এই সম্পর্কই তার সামাজিক, রাজনৈতিক জীবন এবং চিন্তা চেতনা নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষ যেমন তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা তৈরি করে, একই ভাবে পারিপার্শ্বিক অবস্থাও মানুষ কে তৈরি করে। উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তন ছাড়া কোন সমাজ ব্যবস্থার কোন পরিবর্তন হয় না এবং উৎপাদন ব্যবস্থার এই পরিবর্তন মানুষের মৌলিক কোন সৃষ্টি না, বরং এই পরিবর্তন পুরনো ব্যবস্থার গর্ভেই সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ, যখন পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত সমাজে উপস্থিত থাকে অথবা পরিবর্তন প্রক্রিয়াধীন অবস্থায় থাকে, তখনই সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসে। এভাবে মার্ক্স দেখিয়েছেন যে, মানব সভ্যতা প্রিমিটিভ কমিউনিজম থেকে শুরু করে যথাক্রমে দাসপ্রথা, সামন্ততন্ত্র, পুঁজিবাদের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করেছে এবং মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎ হচ্ছে কমিউনিজম।]

ফ্রয়েড এবং মার্ক্সের মধ্যে প্রাক মার্ক্সীয় সমাজবিদ্যা এবং আদিম মনোবিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক অবস্থানের দিক থেকে মিল পাওয়া যায়। এই মিল টা হচ্ছে, তারা কেউই অতিপ্রাকৃত ঘটনার বিশ্লেষণে আগ্রহী নন, বরং সমাজের চালিকা শক্তির বিশ্লেষণে আগ্রহী। এই চালিকা শক্তি একটা নির্দিষ্ট দিকে ক্রিয়াশীল এবং এর ফলেই সমাজে বিভিন্ন ঘটনা ঘটে। এই চালিকা শক্তিও ক্রমশ পরিবর্তনশীল এবং চিরন্তন কিছু না। মার্ক্সবাদ যেমন সমাজবিদ্যার একমাত্র বৈজ্ঞানিক রূপ, একই ভাবে মনোবিশ্লেষণও মনোবিজ্ঞানের একমাত্র বৈজ্ঞানিক রূপ। কেবল এই দুই সিস্টেমেই আমরা বিভিন্ন ঘটনার পিছনের চালিকা শক্তি খুঁজে পেতে পারি। একই সাথে, এই চালিকা শক্তির প্রভাবে ঘটা সমাজের কোন ঘটনা যদি মানব প্রকৃতির প্রতিকূলে থাকে, তখন মানুষের মধ্যে কি ঘটে, তাও আমরা অনুমান করতে পারি। গভীর প্রভাব বিশিষ্ট, অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত কোন পরিবর্তন যখন ঘটে, সবকিছু কে স্থির দেখার দর্শন তখন এর কোন ব্যাখ্যা দিতে পারে না। কিন্তু, সবকিছু কে গতিশীল দেখার দর্শন ঘটনাস্থল থেকে অনুপস্থিত চালিকা শক্তি সমূহ চিনে ফেলতে পারে এবং সম্ভাব্য পরিবর্তন অনুমান করতে পারে।

এর মানে এই না যে, মার্ক্স বা ফ্রয়েড নিয়তিবাদে বিশ্বাস করতেন। [অনুবাদকযে কোন ঘটনা, মানুষের যে কোন স্বাধীন সিদ্ধান্ত কেবলমাত্র পূর্ববর্তী ঘটনার ফলাফল মনে করা হচ্ছে নিয়তিবাদ। উদাহরণস্বরূপঃ নিয়তিবাদীরা মনে করেন যে, মানব প্রকৃতি মানুষের জিনগত এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার (অতীত এবং বর্তমান) একটা ফলাফল ছাড়া কিছুই না। মানব প্রকৃতি ধ্রুবক।] আমি মনে করি একটা দার্শনিক অবস্থান থেকে স্পিনোজার সাথে তাদের মিল রয়েছে। স্পিনোযা মনে করতেন যে, (সমাজের) চালিকা শক্তির দ্বারা যদি মানুষ নিয়ন্ত্রিত হয় এবং এই চালিকা শক্তিই যদি মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে, তাহলে মানুষের পক্ষে স্বাধীন হওয়া সম্ভব না। স্পিনোজার মতে, এই দর্শন হচ্ছে নৈতিকতার একটা কেন্দ্রীয় সমস্যা। মার্ক্সের মতে, এই দর্শন শ্রেণি সচেতনতা এবং বিপ্লবী আচরণের শেকড়। [অনুবাদকসমাজে নিজ শ্রেণির অবস্থান, চরিত্র এবং ঐতিহাসিক পটভূমি সম্পর্কে অবগত হওয়া হচ্ছে শ্রেণি সচেতনতা। উদাহরণস্বরূপঃ প্রলেতারিয়েতরা উৎপাদন ব্যবস্থা তথা সমাজের মূল চালিকা শক্তি হয়েও যে তারা উৎপাদনের উপাদানের মালিক না এবং এর মালিক বুর্জোয়ার কাছে যে তারা পণ্য ছাড়া কিছুই না — প্রলেতারিয়েতদের এই সম্পর্কে অবগত হওয়া এবং বিপ্লবী চরিত্র ধারণ করা হচ্ছে শ্রেণি সচেতনতা।] ফ্রয়েডের মতে, এই দর্শন মানুষের অবচেতন মনের বিভিন্ন দ্বন্দ্ব সম্পর্কে মানুষের সংজ্ঞাপ্রাপ্ত হওয়ায় মূল ভূমিকা পালন করে। এমনকি, রোজা লুক্সেমবার্গ ও অবচেতনতার ধারণা ব্যবহার করেছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন যে, মানুষ অন্ধভাবেই ঐতিহাসিক বিভিন্ন চালিকা শক্তির দ্বারা পরিচালিত হয়। আবার, ফ্রয়েড দেখিয়েছিলেন যে, এই চালিকা শক্তির উৎস হচ্ছে অবচেতন মনের বিভিন্ন দৈব চিন্তা চেতনা।

মানুষ যে বিভিন্ন শক্তির দ্বারা পরিচালিত — এই জায়গায় মার্ক্স এবং ফ্রয়েডের একটা মিল রয়েছে। এই শক্তি চিনতে পারা এবং সচেতন হওয়ার মাধ্যমে মুক্তি আসবে, যদিও এই মুক্তি সমাজ এবং মানব প্রকৃতির সীমারেখার দ্বারা আবদ্ধ।

আমি একটা বিষয় যোগ করবো যে, ফ্রয়েডের সিস্টেম ১৯ শতাব্দীর যান্ত্রিক বস্তুবাদের অধীনে তৈরি করা হয়েছে। [অনুবাদকযান্ত্রিক বস্তুবাদ মূলত প্রকৃতির বিভিন্ন ঘটনাকে স্থির এবং পরস্পর থেকে স্বাধীন ঘটনা হিসেবে দেখে।] কিন্তু মার্ক্স এই দর্শন কে ছাড়ায় গেছেন। [অনুবাদকযান্ত্রিক বস্তুবাদের বিপরীতে মার্ক্স দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে বিশ্বাস করতেন। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ মূলত প্রকৃতির বিভিন্ন ঘটনাকে গতিশীল-পরিবর্তনশীল এবং পরস্পরের সাথে সংযুক্ত ঘটনা হিসেবে দেখে।] এর ফলাফল হিসেবে, ফ্রয়েড মানুষ কে বিচ্ছিন্ন যান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন, যা কিছু শারীরিক চাহিদার দ্বারা পরিচালিত। আমরা যদি মনোবিশ্লেষণকে সামাজিক গবেষণার সাথে খাপ খাওয়াতে চাই, আমাদের কে যান্ত্রিক বস্তুবাদের এই সীমিত কাঠামো থেকে বের হয়ে আসতে হবে এবং ফ্রয়েডকে ইতিহাসের মানবতাবাদী দর্শনে রূপান্তর করতে হবে। [অনুবাদকমানবতাবাদ মূলত মানুষকে অতিপ্রাকৃত ধ্যান- ধারণা, বিশ্বাস প্রভৃতির ওপর স্থান দেয়।] এরপর, যেই তাড়না মানুষকে পশুপাখি থেকে আলাদা করে, সেই তাড়না নিয়ে বিশ্লেষণ করা আর মূল লক্ষ্য না। বরং, পৃথিবীর সাথে মানুষের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করাই হচ্ছে মূল লক্ষ্য।

এখানে মার্ক্স আর ফ্রয়েডের মূল পার্থক্য আমাদের চোখে ধরা পড়ে। ফ্রয়েডের মতে, মানুষ হচ্ছে বিচ্ছিন্ন সত্ত্বা, যার নিজের শারীরবৃত্তীয় চাহিদা মেটানোর জন্য অন্য মানুষের প্রয়োজন হয়। এর মানে হচ্ছে, ফ্রয়েডের মতে মানুষের চরিত্র পণ্য বিনিময়ের বাজারে বুর্জোয়ার চরিত্রের বাইরে কিছু না। [অনুবাদকআধুনিক শিল্পায়নের সময়ে সমাজে বুর্জোয়া শ্রেণির সৃষ্টি হয়, যারা উৎপাদনের উপাদানের মালিক। এই শ্রেণির চরিত্র হচ্ছে ব্যক্তিগত সম্পত্তি টিকিয়ে রাখার মাধ্যমে সমাজে নিজের শ্রেণি অবস্থান বজায় রাখা এবং নিজের ভোগের উদ্দেশ্যে প্রলেতারিয়েত কে শোষণ করা।] মার্ক্স মানুষের সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্র দাড়া করাইসেন। তিনি দেখিয়েছেন, মানুষের আসলে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যই পৃথিবী কে প্রয়োজন এবং মানুষের বাসনা তার সম্ভাবনাময় শক্তির ওপর নির্ভরশীল।

আমি মনে করি, এই প্রেক্ষাপটে যখন মনোবিশ্লেষণকে নিয়ে যাওয়া যায়, তখন বিভিন্ন ঘটনা ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়। এসব ঘটনার ব্যাখ্যায় পরিপূরক হচ্ছে মার্ক্সবাদী দর্শন। এগুলা হচ্ছে মানুষের স্বাধীন শক্তির বিভিন্ন রূপ, যা একটা নির্দিষ্ট সমাজ কাঠামোর উদ্দেশ্য এবং চাহিদার জন্য প্রয়োজন। আমি সামাজিক চরিত্রকে সামাজিক পরিস্থিতির একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো ও এর বিভিন্ন ধারণার মধ্যে একটা সেতুবন্ধন বলে মনে করি। অন্য যে কোন প্রাকৃতিক শক্তির মতই মানব শক্তি একটা উৎপাদনশীল শক্তি। [অনুবাদকউৎপাদনশীল শক্তি হচ্ছে মানুষের শ্রম শক্তি, উৎপাদনের উপাদান।] কিন্তু, মানব শক্তি সম্পূর্ণরূপে প্রাকৃতিক শক্তির মত না। মানব শক্তি একটা নির্দিষ্ট সমাজ কাঠামোর অধীনে একটা সামাজিক রূপ ধারণ করে। এই মানব শক্তি হচ্ছে মানুষের গতিশীল সামাজিক চরিত্র।

আমি বিশ্বাস করি, এভাবেই মানুষের সামাজিক সংজ্ঞা (চিন্তা-চেতনা) নির্ধারণের প্রক্রিয়া, সমাজ কাঠামোর দ্বারা মানব সংজ্ঞা নির্ধারণের প্রক্রিয়া, সমাজে টিকে থাকার প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করা সম্ভব। একই সাথে, কিভাবে নির্দিষ্ট কিছু উপাদানই সচেতন সত্ত্বায় পৌঁছায় এবং অন্য সব সত্ত্বায় পৌঁছায় না, তাও ব্যাখ্যা করা সম্ভব। এর মানে হচ্ছে, সামাজিক সংজ্ঞার পাশাপাশি সামাজিক অবচেতনতাও আছে। [অনুবাদকইতিহাসের নির্দিষ্ট পর্যায়ে উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে মানুষের সম্পর্কের দ্বারা মানুষের সামগ্রিক যে চিন্তা চেতনা তৈরি হয়, তাই হচ্ছে সামাজিক সংজ্ঞা। এই সামাজিক সংজ্ঞা ও প্রত্যেকের স্বতন্ত্র সংজ্ঞা পরস্পর নির্ভরশীল। কেননা মানুষ ইতিহাসের সাথে বদলায়। উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে সে নিজেকে উন্নত করে; সে নিজেকে রূপান্তর করে। সে ইতিহাসের একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে সমাজে বিদ্যমান উৎপাদন ব্যবস্থার একটা পণ্য। যেহেতু সে ইতিহাস সৃষ্টি করে, সে নিজের সৃষ্ট পণ্য।] এই দুইয়ের সমন্বয়ে সবকিছু নির্ধারিত হয়, যা সমাজে বিদ্যমান কাঠামোর সাথে সাংঘরষিক ও হতে পারে। মানুষের যা করার কথা না, তা সে না করলেই সমাজ সন্তুষ্ট হয় না। বরং, সমাজ চায়, মানুষের যা চিন্তা করার কথা না, তা সে যেন চিন্তা না করে। কেননা চিন্তাই হচ্ছে কোন কাজের সূচনা বিন্দু।

এজন্যই মনোবিশ্লেষণে মার্ক্সবাদী ধারণার সংযোজন প্রয়োজন। মার্ক্সবাদ নিয়ে আলোচনায়ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন। অন্যথায় মার্ক্সবাদের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু মানুষ নিয়ে আলোচনা কেবল কিছু দার্শনিক শব্দেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

বিচ্ছিন্নতাবোধের সমস্যা

গতিশীল মনস্তত্ত্ববিদ্যায় (বা, মানবতাবাদী মনস্তত্ত্ববিদ্যা) এবং মার্ক্সবাদী চিন্তায় প্রবেশ করা যে দরকার, তার জন্য একটা ভালো উদাহরণ হচ্ছে বিচ্ছিন্নতাবোধ। ইতোমধ্যে ওল্ড টেস্টামেন্টের নবীরা অন্ধভক্তির সমস্যা ভোগ করেছে। এখানে, এই ধারণা এই বিষয়ে গুরুত্ব দেয় যে, এই উপাস্য বস্তুগুলো মূলত মানুষের সৃষ্টি। মানুষ যদি এই বস্তুর পূজা করে, সে হারায় যায় এবং নিজেই নিছক বস্তুতে পরিণত হয়। আমি মনে করি, শিল্পোৎপাদন এই বিচ্ছিন্নতাবোধ কে আরও সম্প্রসারণ করে। কেননা, মানুষ এমন দৈত্যাকার সংগঠন এবং পণ্য তৈরি করে যে, সে যখন এগুলোকে মোকাবেলা করে, সে নিজেকে দুর্বল এবং ক্ষমতাহীন মনে করে। সে এগুলোকে পরিচালনা করতে যেয়ে এগুলোর কাছে মাথা নত করে। পারমাণবিক অস্ত্রের চেয়ে সুন্দর কোন উদাহরণ নাই বিচ্ছিন্নতাবোধের। তারা কেবল মানুষের হাতের সৃষ্টি না, তারা মানুষের প্রতিভার সৃষ্টি। কিন্তু এই সৃষ্টিই মানব প্রজাতির অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।

মার্ক্স যখন বলেছিলেন যে মানুষ বিভিন্ন বস্তু এবং তার পারিপার্শ্বিক প্রেক্ষাপটকে নিজের ওপরে এবং নিজের বিরুদ্ধে অবস্থান দেয়, তার মাথায় এই বিষয়টাই ছিল। আমেরিকান দার্শনিক রালফ ওয়ালডো এমারসন বলেছিলেন, “বিভিন্ন বস্তুই মানুষের কাঁধে চড়ে বসেছে এবং মানুষকে পরিচালনা করছে।”

মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণও এখানে প্রয়োজন। আমরা যদি বিচ্ছিন্নতাবোধ বুঝতে চাই, আমাদের এটা কে দর্শনেরও বাইরে নিয়ে যেতে হবে। একজন বিচ্ছিন্ন মানুষের সাথে কি হয় — এটা মনস্তাত্ত্বিক এবং গবেষণালব্ধ পদ্ধতিতে দেখতে হবে। আমাদের দেখতে হবে সে কিভাবে নিজেকে দুর্বল এবং ক্ষমতাহীন মনে করে, তার মধ্যে কিরকম ভয় কাজ করে এবং বিভিন্ন চালিকা শক্তির উপাসনা করার মাধ্যমে সে নিজেকে কিরকম নিরাপদ মনে করে যে তার অসহায়ত্ব কাটে। এই সবগুলোই দর্শন দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। কিন্তু এর কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা যদি মনস্তাত্ত্বিকভাবে বিচ্ছিন্নতাবোধকে ব্যাখ্যা করতে না পারি এবং এর মানে বুঝতে না পারি, বিচ্ছিন্নতাবোধের ধারণা নিজেও একটা বিচ্ছিন্ন ধারণা হয়ে যায়।

মনোবিশ্লেষণ এবং শিল্প

মনোবিশ্লেষণ শিল্পের সাথে গভীরভাবে জড়িত। কিন্তু মনোবিশ্লেষণের মূল কাজ কি? এর মূল কাজ হচ্ছে কমন সেন্স অনুযায়ী যেটা সত্য বলে মনে হয়, এর বাইরে থাকা প্রকৃত সত্য উদঘাটন করা। সত্যের বেশিরভাগ অংশই আমাদের সংজ্ঞার বাইরে এবং আমাদের সংজ্ঞা যা কিছুর সমন্বয়ে তৈরি হয়, তা নিছক কল্পকাহিনী। উদাহরণস্বরূপ, এই বিশ্লেষণ স্বপ্ন নিয়ে কাজ করে। স্বপ্নের সংজ্ঞা নিয়ে কাজ করে। এই সংজ্ঞা মানুষের সজাগ অবস্থার সংজ্ঞা থেকে আলাদা এবং সমাজে এই সংজ্ঞার কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই। ঘুমের মধ্যে মানুষ জাগ্রত অবস্থার তুলনায় একই সাথে অধিক বুদ্ধিমান এবং অধিক অযৌক্তিক। যেমন, আমরা দেখতে পাই, মানুষ স্বপ্নে অনেক প্রতিভাসম্পন্ন হয়। তারা প্রায়ই ছোট, মহান এবং সত্যিকার ড্রামা স্বপ্নে দেখে। এই একই মানুষেরা আবার জাগ্রত অবস্থায় আবার কেবল অসংলগ্ন চিন্তায় মত্ত থাকে।

এটা থেকে আমরা বুঝতে পারি, “মানুষ যা জানে না বলে মনে করে, তার অনেক টুকুই সে জানে।” সমাজের সাথে খাপ খাওয়ানোর ফলে মানুষ কিছু নির্দিষ্ট ঘটনার প্রতি অন্ধ হয়ে যায়, যা সে অনুভব করে কিন্তু এই অনুভূতি সম্পর্কে সংজ্ঞাপ্রাপ্ত হয় না। উপরন্তু, দেখা যায় যে সমাজ মানুষ কে যত টুকু সৃষ্টিশীল হতে দেয়, মানুষ তার চেয়েও বেশি সৃষ্টিশীল। সে আরও মৌলবাদী। সমাজের ভালো মন্দ মানুষের স্বাধীন উন্নয়নের ওপর নির্ভরশীল না। কিন্তু, অতীত এবং বর্তমানের সকল সমাজে, (সমাজের) এই ভালো-মন্দের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকে সমাজের জন্য দরকারি এবং সহজলভ্য বানানো, যাতে সমাজের উদ্দেশ্যে তার শক্তির সর্বোচ্চ পরিমাণ শোষণ করা যায়।

ফ্রয়েডিয়ান মনোবিশ্লেষণের একটা সংশোধন হচ্ছে মানবতাবাদী মনোবিশ্লেষণ। মানবতাবাদী মনোবিশ্লেষণ মানুষের তাড়না- বাসনার বাইরেও মানুষের সামগ্রিক অভিজ্ঞতা নিয়ে কাজ করে। এই মনোবিশ্লেষণ স্পষ্টভাবে দেখাতে সক্ষম হয় যে, অতীত এবং বর্তমানের সকল সমাজে মানুষ আংশিকভাবে জাগ্রত ছিল এবং সে সচেতনভাবে যা চিন্তা করে, তা মূলত কল্পকাহিনী, যা সমাজ তাকে কেবল নিপীড়ন করতে দিয়েছে এমন না, মতাদর্শ হিসেবেও দিয়েছে।

শিল্পের কাজ একই। এর কাজ হচ্ছে বাস্তবতার সন্ধান পাওয়া। একজন মহান আর্টিস্ট বা একজন মহান ড্রামাটিস্ট আমাদের কে দেখাতে সক্ষম হয় যে “সত্যিকারের সত্য” কি জিনিস, যা প্রচলিত, গ্রহণযোগ্য বা সুখকর নাও হতে পারে। মহান শিল্পীরা সবসময়ই সমাজের চোখে নিছক সার্কাস ছিল, যারা মানব সভ্যতাকে সত্যের সন্ধান দিয়ে এসেছেন। সত্য বলার অর্থ হচ্ছে, অন্ধ না হয়ে বাস্তবতা দেখতে পাড়া। ইতিহাসে শিল্পের ভূমিকা হচ্ছে মানব সভ্যতা কে নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়া এবং তার সংজ্ঞার কল্পকাহিনীর দাস হওয়া থেকে বাঁচানো। মহান ড্রামা এবং শিল্পকর্ম সবসময়ই মানুষ কে দেখিয়েছে যে, মানুষের সংজ্ঞার ঊর্ধ্বে বাস্তবতা থাকে এবং শিল্পীর চোখে কয়েক মিনিট বা কয়েক ঘণ্টার জন্য মানুষ এই অভিজ্ঞতা ভোগ করতে পারে।

হেমলেট যদি মনোবিশ্লেষকের কাছে যেতেন, তিনি হয়ত বলতেনঃ আমার সৎবাবা একজন নিরীহ মানুষ এবং আমার মা ও নিখুঁত। তারপরেও আমার একটা বাজে অনুভূতি হচ্ছে। তার মা আর সৎবাবা যে খুনি, এটা এত টাই অকল্পনীয় যে এটা তার সংজ্ঞার ঊর্ধ্বে। কিন্তু, কেবল তার বাবার আত্মা তাকে বুঝাতে পারবে যে তার সন্দেহ ঠিক আছে। কমন সেন্স থেকে যে সত্য জানা যায় না, সেই সত্য জানতে হলে একজন ব্যক্তি কে যে পাগলের চরিত্রে যেতে হয়, এই প্যারাডক্স (প্রচলিত মতের বিরুদ্ধে মত) আমরা এখানে দেখতে পাচ্ছি।

কাফকার “প্রসেস” এর জোসেফ কে যদি মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যেতেন, তিনি হয়ত বলতেনঃ আমি ঠিক আছি, আমার ভালো একটা চাকরি আছে, আমি একটা সাধারণ যৌন জীবন উপভোগ করি। কিন্তু শেষ রাতের একটা স্বপ্ন আমাকে পীড়া দিচ্ছে। এরপর, কাফকা “ট্রায়াল” এ যেই বর্ণনা দেয়, সেটা হয়ত তিনি দিতেন। কিন্তু কাফকা নোভেলে যা লিখছেন, তা হচ্ছে জোসেফ এর বাস্তবতা। জোসেফ একজন স্বাভাবিক ব্যক্তি, যিনি “স্বাভাবিক” হওয়ার কারণে সত্য দেখতে পাচ্ছেন না। আর, কাফকা আসলেই একজন মহান শিল্পী, যিনি আমাদের কে এই “স্বাভাবিক” ব্যক্তির (যিনি আসলে অনেক অসুস্থ) বাস্তবতা, শারীরতত্ত্ব দেখান। স্বাভাবিকতার রোগবিদ্যায় এখানে মূলত ফোকাস করা হয়েছে।

শিল্পী আর মনোবিশ্লেষকের মধ্যকার মিল হচ্ছে, তারা ব্যক্তি কে ড্রামার নায়ক হিসেবে দেখে। প্রত্যেকটা ব্যক্তিই একেকটা ড্রামার নায়ক। সে একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি, যে পৃথিবীর মত জায়গায় এসে পড়েছে এবং ভয়ংকর ভয়ংকর সব শক্তি আর বাধার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে সে তার জীবন অনুভব করতে চাচ্ছে। এই চেষ্টার একটা নাটকীয় ফলাফল আছে। সমগ্র ইতিহাসে, মানুষ একজন ড্রামাটিক নায়কের ভূমিকায় ছিল। এই নায়ক অনেক আকর্ষণপূর্ণ। এর কারণ এটা না যে, সে অনেক জটিল। বরং, এর কারণ হচ্ছে, সে একটা স্বতন্ত্র মানব ড্রামার প্রতিনিধিত্ব করে। মনোবিশ্লেষক কোন শিল্পী বা ড্রামাটিস্ট না, সে শেক্সপিয়ার ও না। কিন্তু যদি সে মানুষের বাস্তবতা ধরতে চায়, তাকে একজন ড্রামাটিস্ট এর চোখ রাখতে হবে। একজন শিল্পী যেভাবে একটা বিষয় ফুটিয়ে তোলে, ঠিক সেভাবে একজন বিশ্লেষককে মানুষের “সত্যিকারের সত্য” দেখতে পারতে হবে।

ফাতিন ইশরাক, শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Source : https://www.marxists.org/archive/fromm/works/1966/psychoanalysis.htm


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন