কোটি কোটি ডলারের অস্ট্রেলীয় পশম শিল্প বাংলা থেকে আমদানি করা ভেড়ার উপর নির্ভরশীল ছিল। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও বর্ণে বর্ণে সত্যি। অস্ট্রেলীয় কৃষিমন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী অস্ট্রেলিয়া ২০১৭-এ পশম উৎপাদনে বিশ্বের এক নম্বর দেশ ছিল। মোট ব্যবসার পরিমাণ ছিল ২.৬ বিলিয়ান ডলার। বিস্তীর্ণ কৃষিজমি- বিচরণ ক্ষেত্র, উন্নত পশুপালন প্রযুক্তি, পরিশ্রমী কৃষিশ্রমিকের কল্যাণে অস্ট্রেলিয়া নিউ সাউথ ওয়েলস, ভিক্টোরিয়া আর তাসমানিয়ায় গড়ে তুলেছে মেষ প্রতিপালনের বিরাট সাম্রাজ্য। বর্তমানে চীনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অস্ট্রেলীয় মেরিনো উল পশম বস্ত্র শিল্পে বিপুল সম্ভাবনার সৃষ্টি করে উৎপাদনের নব দিগন্ত উন্মোচন করেছে। ২০০৯ সালে ‘New pasture for sheep trait from Bengal’ শীর্ষক প্রবন্ধে এখানকার বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন যে অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে থেকে বাংলা থেকে গাড়ল প্রজাতির মেষ অস্ট্রেলিয়ায় রপ্তানি করা হয়েছিল কলকাতা থেকে। ১৭৯২ আর ১৭৯৩ সালে এই অবিশ্বাস্য ব্যাপারটি ঘটেছিল। আমদানিকৃত বাংলার ভেড়ারা ঝাঁকের কই হয়ে অস্ট্রেলীয় ভেড়ার পালে মিশে যেত, মেষশাবকের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটাত।
১৭৯১-এর শেষদিকে কলকাতার গার্ডেনরিচ বন্দরে আটলান্টিক নামে একটি জাহাজ নোঙর করে। কুড়িটি ভেড়া নিয়ে তারা অস্ট্রেলিয়ায় ফেরে। এর মধ্যে দুটি ছিল মেষ, আঠেরোটি মেষী। ১৭৯২, ১৭৯৩, ১৭৯৪ এ সংখ্যাটি বেড়ে ১০০ ও ততোধিক হয়ে দাঁড়ায়।
বিস্ময়কর হলেও এটা সত্য যে বিশ্ববিখ্যাত অস্ট্রেলীয় পশমশিল্প কলকাতা তথা বাংলার ভেড়ার উপর নির্ভরশীল ছিল কয়েক শতাব্দী আগে।
মূলত কলকাতার গড়ের মাঠ, গড়িয়াহাটা, গড়িয়া, খিদিরপুর ও মেটিয়াবুরুজ ও পার্ক সার্কাস অঞ্চলে প্রতিপালিত মেষগুলিই অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে পাড়ি দিত জাহাজে করে।
কলকাতার স্থাননামেও থাবা গেড়েছে ভেড়া। ভেড়ার শুদ্ধ নাম গড়ের। এসেছে সংস্কৃত গড্ডর শব্দ থেকে। গড্ডর থেকেই গড্ডরিকাপ্রবাহ তথা গড্ডলিকাপ্রবাহ কথাগুলি এসেছে। কলকাতার গড়ের মাঠ আসলে ছিল ভেড়া চরার মাঠ।
সল্টলেকের আগে বইমেলা কোথায় হত? না, কলকাতা ময়দানে৷ ময়দানটা কোথায়? তাও বোঝেন না, ওই যে ব্রিগেডে৷ ওই, ওই যে গড়ের মাঠ! হ্যাঁ, হ্যাঁ এবার সব বোঝা গেছে৷ ওই তো ফোর্ট উইলিয়ামের মাঠ, সেখানেই৷ অর্থাৎ কেল্লা বা ‘গড়’-এর সঙ্গে গড়ের মাঠকে একাকার করে নেওয়া হয়েছে৷ গড় যেখানে তৈরি হয়েছে, সেটাই হচ্ছে গিয়ে গড়ের মাঠ৷
আসলে কিন্তু ব্যাপারটা অত সোজা নয়৷ ইংরেজদের পুরনো কেল্লাটার সামনে অনেক বড়ো বড়ো বাড়ি থাকায় যুদ্ধ-শাস্ত্র অনুযায়ী শত্রুপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করতে অসুবিধা হত৷ তাই পলাশির যুদ্ধের পরে ইংরেজ তথা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গোবিন্দপুরের ‘গড়ের মাঠে’ নতুন কেল্লা বানাতে শুরু করল৷ যে মাঠে ‘গড়ের’ বা ভেড়া চরে বেড়ায়, সেটাই ‘গড়ের মাঠ’৷ কলকাতার ওই অঞ্চলে তখন গোচারণভূমি ছিল, ছিল নবীন ঘাসে পূর্ণ উন্মুক্ত প্রাঙ্গন৷ রাশি রাশি ভেড়ার পাল ঘুরে বেড়াত, সঙ্গে গোরু-বাছুরও থাকত নিশ্চয়ই৷ সেই থেকেই ‘গড়ের মাঠ’ বলে পরিচিতি লাভ করে এই তল্লাটটা৷ এখানেই গড়ে উঠল ইংরেজ বাহাদুরের নতুন কেল্লা৷ ফোর্ট উইলিয়ামের নতুন বিল্ডিং৷ কলকাতায় ‘গড়ের মাঠ’ যেমন আছে, তেমনি গড়ের ঘাটও আছে। খিদিরপুরের দিকে এর দেখা মিলবে৷ উত্তর কলকাতায় গরানহাটা বলে যে জায়গা, তারও পুরোনো ইতিহাস ঘাঁটলে গড়ের হাটের চিহ্ন পাওয়া যাবে৷
গরানহাটা অঞ্চলটির ভূগোল-ইতিহাস আমাদের জানাচ্ছে, এই অঞ্চলে বটতলা-সাহিত্য তার ডানা মেলেছিল৷ বস্তুত শোভাবাজারসন্নিহিত বটতলার সঙ্গে সঙ্গে গরানহাটার চৌরাস্তাও বটতলাসাহিত্যের বিস্তারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল৷ মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার ও প্রাথমিক বিকাশ, লিথো ফটোগ্রাফ, কাঠখোদাই সবই সমানে চলত গরানহাটায়৷ গহনাশিল্প তুলনায় নবীনতর৷ গরানহাটায় বহুযুগ ধরেই রমরম করে চলছে বড়োবড়ো মাংসবিপণি৷ বস্তুতপক্ষে, রেওয়াজি খাসির মাংস গরানহাটায় এখনও অতি উত্তম মেলে, দামও বেশি৷
এ বঙ্গে মাটন বলতে এখন আমরা পাঁঠার মাংস বুঝলেও, আগে মাটন বলতে বোঝানো হত ভেড়ার মাংসকে৷ মোগল ও ইংরেজরা খাসির মাংস যে পছন্দ করত না, বলাই বাহুল্য৷ উভয়ের কাছে পরম তৃপ্তিকর ছিল ভেড়ার মাংস৷ দু-তিন শতাব্দী ধরে গরানহাটার মাংসের দোকানগুলো চলছে।
‘গড়েরহাটা’ই অপভ্রংশে ‘গড়েরহাটা’ হয়৷ তারপর ‘গরেনহাটা’ হয়ে গরানহাটায় উপনীত হয়৷
এর স্বপক্ষে আরও তথ্য আছে৷ গরানহাটী ধুতির আর-এক নাম গড়েনহাটী বা গরেনহাটী ধুতি৷ এটি বিশেষ ধরনের খাটো ধুতি৷ গড়েনহাটী ধুতি আজকাল কেউ পরে কিনা জানি না, তবে গড়েনহাটী যে ‘গড়েরহাটী’ নামেরই উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে, সেটা পরিষ্কার বোঝা যায়৷ গরানহাটায় যে এক সময় ভেড়া (সঙ্গে অন্য পশুও) বিক্রি হত, তার পারিপার্শ্বিক প্রমাণ আরও আছে৷ গরানহাটার একপাশে চিৎপুর, অন্যপাশে সোনাগাছি৷ ভেড়ার ছেঁটে ফেলা বাতিল লোম বা পশম থেকে পরচুলো বা উইগ তৈরি হত৷ এর ব্যবসা জমজমাট হল পাশের চিৎপুরের যাত্রাপাড়ায়৷ সোনাগাছির সনপাটের আঁশ থেকেও তন্তুজ উইগ হত, এখনও হয়৷ ভেড়া ও অন্যান্য পশু বাঁধার জন্যে সনের মজবুত দড়িও মিলত সোনাগাছিতে৷ চিৎপুরের যাত্রাশিল্পও গরানহাটার গড়ের হাট তথা ভেড়ার হাটের কাছে ঋণী৷ গরানহাটার পেল্লাই পেল্লাই মাংসের দোকানের পাশ দিয়ে ঘ্রাণ নিতে নিতে হাঁটলে বোঝা যাবে, দেড়শো-দুশো বছর আগে রেওয়াজি খাসির পাশে লোভনীয় ভেড়ার মাংসও ঝুলত৷ প্রসঙ্গত, পূর্ণবয়স্ক ভেড়ার মাংসকে মাটন বলে ও কচি নধর মেষশাবককে বলে ল্যাম্ব (Lamb)৷ মাটনই বলুন আর ল্যাম্বই বলুন, মাংস কেনার জন্যে কিউ পড়ত লম্বা৷
আসলে ‘গড়ের’ শব্দটি বাঙালিকে বহু বছর ধরেই লেজে খেলাচ্ছে৷ গড়ের মাঠ যে ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লার প্রতিষ্ঠার আগেই ছিল, তা প্রমাণিত৷ বস্তুত আবহমানকাল ধরেই এখানে মেষ চরছে৷ তেমনি গড়েরহাট মেটিয়াবুরুজের দিকে এখনও একটি আছে৷ যেমন ছিল ‘গরানহাটা’য়৷ গরানহাটী যে দু-তিনশো বছর আগে ‘গড়েরহাটী’ ছিল তা একপ্রকার নিশ্চিত৷ গরানহাটাও তিন-চারশো বছর আগে ছিল গড়েরহাট৷
ভেড়া থাবা গেড়েছে বাংলা প্রবাদেও। এক এক করে বলা যাক —
ভেড়া করে রাখা/ ভেড়াকান্ত | ভেড়া অতি নিরীহ প্রাণী; তাকে যে দিকে চালাও সে সেইদিকে চলে; এই লক্ষণায়- বশীভূত করে রাখা; একান্ত বশংবদ। |
ভেড়া দিয়ে যব মাড়া | সক্ষমলোকের কাজ অক্ষমলোক দিয়ে করানো; সমতুল্য — ‘ছাগল দিয়ে চাষ করা’; ‘ছাগল দিয়ে হাল টানা’। |
ভেড়ার গোয়ালে আগুন লাগা | গোয়ালে আগুন লাগলে ভেড়ার দল বিন্দুমাত্র পালাবার চেষ্টা করে না, কেবল চিৎকার করতে থাকে, লক্ষণায় — বিপদে প্রতিকারের চেষ্টা না করে কেবল কোলাহল করা। |
ভেড়ার গোয়ালে বাছুর মোড়ল | মুর্খের দলে অল্পজ্ঞানীরা গুরুত্ব পায়; যেখানে বিজ্ঞ লোক নেই সেখানে অল্পজ্ঞানীরা মাতাব্বরি করার সুযোগ পায়; সমতুল্য — ‘উলুবনে খটাশ বাঘ’; ‘বাঁশবনে শিয়াল রাজা’; ‘বৃক্ষহীনদেশে এড়েণ্ডাও বৃক্ষ’। |
ভেড়ার পাল | অন্ধভাবে অনুসরণকারী গোষ্ঠী; ব্যক্তিত্বহীন একদল লোক; যাদের স্বাতন্ত্র্যবোধ নেই, যাদের একজন যেদিকে যায় না বুঝে সবাই সেদিকে যায়। |
ভেড়ার বেশে নেকড়ে বাঘ | প্রচ্ছন্ন শয়তান; ছদ্মবেশী শত্রু; |
কলকাতার ভেড়ার কথা আমার উর্বরমস্তিষ্কপ্রসূত নয়, তার তথ্যনিষ্ঠ বিবরণ আছে আর্কাইভে। আমাদের গবেষকরা এদিকটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গেছেন। চর্বিতচর্বণের গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসিয়েছেন। সাবঅল্টার্ন কলকাতার ইতিহাসে ভেড়াদের কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ভেড়া নিয়ে প্রবাদগুলিও তাই স্মর্তব্য।