জেলখাটাদের দুর্গাপুজো। শুরু ১৯৪২-এ। আজও থমকে নেই। বর্তমান প্রজন্ম সেই পুজোকে ইতিহাসের পাতায় ধরে রাখতে প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ সেই মহান বিপ্লবীদের রক্তে রাঙা দিনগুলি আজও ভুলতে পারেনি। আর পারেনি সেই সমস্ত বিপ্লবীদের যাদের চেষ্টায় সমাজে জাত-পাত নির্মূল হয়েছিল। একমাত্র দুর্গাপুজোর সূচনাকে কেন্দ্র করে। এই জেলখাটারা আর কেউ নন। এঁরা স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্রতী কিছু উজ্জ্বল মুখ। এঁরা সমাজে প্রণম্য। শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় আজও অমর। এই অমর শহিদদের পুজোকে ঘিরে আরামবাগের মাটিতে আলাদা উন্মাদনা।
উল্লেখ্য, ১৯৪২-এর পর থেকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যখন ভাটা পড়ে এল, তখন গান্ধীজির পরামর্শে ‘হরিজন’ আন্দোলনের উপর ব্যাপক জোর দেন স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। সে সময় সমাজে জাতিভেদ প্রথার ব্যাপক প্রচলন ছিল। মুচি, ম্যাথর, বর্গক্ষেত্রীয়দের সঙ্গে সমাজে উচ্চশ্রেণির মানুষের ‘জলচল’ ছিল না। এমনকী ওই সমস্ত জাতের মানুষের ছায়া পর্যন্ত মারাত না সমাজে গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। সমাজে ব্রাহ্মণ পন্ডিতরা অস্পৃশ্য মানুষদের সঙ্গ এড়িয়ে চলতো। তাদের গ্রামের এককোণে স্থান করে দিয়েছিল। সেই সময় ‘হরিজন’ আন্দোলন শুরু করেছিলেন জেলখাটা স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। আরামবাগের মাটিতে প্রফুল্ল চন্দ্র সেনের নেতৃত্বে শুরু হল ‘হরিজন আন্দোলন’। প্রথমেই স্থির হয় সমাজে জাত-পাত ভুলতে গেলে এমন এক পদক্ষেপ নিতে হবে-যেখানে সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষ যেন এক ছাতার তলায় আসেন। মস্তিষ্কপ্রসূত বের হয় দুর্গাপুজোর।
যা ভাবা তাই কাজ। প্রফুল্ল চন্দ্র সেনের উদ্যোগে জেলখাটা স্বাধীনতা সংগ্রামীরা আরামবাগের হরাদিত্য গ্রামকে বেছে নিলেন। এখানে ঠিক হল দুর্গাপুজো করা হবে। সমাজের মুচি, মেথর, শূদ্র, ক্ষত্রিয়, কায়স্থ, ব্রাহ্মণ সকল শ্রেণির মানুষের সঙ্গে কথা বলে জেলখাটারা স্থির করলেন দুর্গাপুজোর। সালটা ১৯৪২-এর অক্টোবর। পুজোর আয়োজন শুরু হল। হরাদিত্য গ্রামের কোনও ব্রাহ্মণ রাজি হলেন না দুর্গাপুজোর পুরোহিত হতে। আরামবাগেরই দূরান্তের গ্রাম মাণিকপাট থেকে এক পুরোহিত ঠিক হল। বাইরের গ্রাম থেকে এলেন দুর্গাপুজো করতে। সমাজে যাদের অস্পৃশ্য বলে ডাকা হয়, সেই মুচি, মেথর, শূদ্রদের ঘর থেকে মানুষ এলেন পুজোর আয়োজন করতে। প্রফুল্ল চন্দ্র সেন, বিভূতিভূষণ রায়দের মতো বিপ্লবীরা ‘হরিজনদের’ এক পঙক্তিতে বসালেন। কেবল গ্রামের মানুষ নন, আরামবাগের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ দেখতে এলেন সেই পুজো।
প্রফুল্ল চন্দ্র সেন, শান্তিমোহন রায়, মহাদেব মুখোপাধ্যায়, দুর্গাচরণ চক্রবর্তী, জীবনকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়দের মতো মহান বিপ্লবীদের হাত ধরে শুরু হয়ে গেল দুর্গার আরাধনা। যার পিছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল হরিজনদের সঙ্গে সমাজের পন্ডিতদের এক আসনে বসানো। অর্থাৎ সমস্ত জাতের মানুষকে ঐক্যসূত্রে বাঁধতে চেয়েছিলেন। পুজো এবং সেই সঙ্গে হরিজন আন্দোলন। আরামবাগের বুকে এক ‘ঐতিহাসিক’ দিন বলে যা আজও চিহ্নিত। তা ইতিহাসের পাতায় উঠেও এসেছে। সেদিনের সাক্ষী বিপ্লবী বিভূতিভূষণ রায়ের স্মৃতিকথায় জানতে পারা যায় সেদিনের পুজোয় গ্রামের মানুষের সে কি আনন্দ! কলেরগান এল কলকাতা থেকে। প্রফুল্লদা ব্যবস্থা করেছিলেন। চাঁপাডাঙ্গা থেকে মার্টিন বার্ণ কোম্পানির ট্রেন হয়ে যখন কলের গানের চোঙ নিয়ে গ্রামে ঢুকছে, মানুষ সারি সারি দিয়ে তা দেখার জন্য ছুটে আসছে। মেঠো আল দিয়ে ঘোমটা দেওয়া লাজুক গ্রামের বধূ, আদলগায়ে বাচ্চা ছেলেমেয়েরা মাইক দেখতে ভিড় জমিয়েছে। দুর্গাপুজোয় মাইক বাজবে। কলকাতা থেকে মাইক আসছে মাইক! পুজো চারদিন সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও দশমী-তে সকল সম্প্রদায়ের মানুষ উপস্থিত থেকে একসঙ্গে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ। আর মিষ্টি মুখ। দশমীতে এয়োস্ত্রীদের মা দুর্গাকে বরণ, সেইসঙ্গে সিঁদুর খেলা। এই ছিল সেদিনের পুজো।
এবারেও হরাদিত্য গ্রামে একই জায়গায় পুজো হবে। সেখানে পাকা মন্ডপ হয়েছে। শহিদবেদী হয়েছে। শহিদদের আবক্ষ মূর্তি বসেছে। সেদিনের পুজোয় গ্রামের পুকুর থেকেই শাপলা, পদ্ম তুলেছিল জেলখাটারা। গ্রামের বধূরাই ঢেঁকিতে ধান ভেঙে নৈবেদ্যর চাল যুগিয়েছিল। বাড়িতে নারকেল নারু, ক্ষীর বানিয়ে মা দুর্গাকে নিবেদন করেছিল। আর গ্রামেরই প্রতিমা শিল্পী মা দুর্গার মুর্তি গড়ে ছিলেন। গ্রাম্য বালিকারা ভোরের শিউলি ফুল কুড়িয়ে কচি হাতে মা দুর্গার পায়ে নিবেদন করেছিল। এসবের রূপ, রস, গন্ধ এখন নেই। এখন সেই পুজো আছে। পুজোয় শহর থেকে পদ্মফুল, রাইসমিল থেকে নৈবেদ্যর চাল, নামি দোকান থেকে মিষ্টি ও নানান বাহারি ফলের আয়োজন। আর প্রযুক্তির যুগে অনলাইনে এসে যাচ্ছে মা দুর্গার পুজোর উপঢৌকন।
কিন্তু একটা ফারাক এর রয়েই গেছে। তা হল গ্রামের পরশ। নেই রূপ, রস ও গন্ধ। নেই আগের শ্রদ্ধা। নেই ভালবাসা। মানুষ জাত-পাত ভুলে গিয়ে ঐক্যবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। তবুও কোথায় তা যেন একটা বিভেদ রয়ে গিয়েছে। মুখে বলতে না পারলেও অন্তরে কাঁটার মতো বিঁধছে। পুজো আসছে। এ শহিদদের পুজো। শহিদদের কথা ভুলে গিয়ে আজকের প্রজন্ম আরও অত্যাধুনিক হতে চায়। তাই হরাদিত্য গ্রামের জেলখাটাদের পুজোটা আস্তে আস্তে কোথায় যেন ভাটা পড়ে যাচ্ছে। আসলে ইতিহাস মনে রাখে। সেটাই বোধহয় রয়ে যাবে।