আকাশের চাঁদ ধীরে ধীরে হাঁসিয়ার মত একফালি সরু হয়ে যাচ্ছে। ভোরবেলা ঘাসের আগায় শিশিরের হীরককুঁচি। আদুল গায়ে লুগড়ার আঁচলটা ভালো করে জড়িয়ে নেয় পার্বতী। বুড়ো হাড়ে আজকাল একটু শীত লাগে। বয়স কত হল তার? কে জানে? তিনকুড়ি, চারকুড়ি!
দাঈ বলত, “কুঁআর নবরাত অষ্টমী কি রাতমা তুঁহার জনম নোনী। ওকর বর তোর নাম রাখে পার্বতী”!
দাঈয়ের এ’কথা মনে করলে হাসি পায় পার্বতীর। লোলচর্মসার বৃদ্ধা পার্বতী এখন শুধুই ডোকরী দাঈ। তবে নামের কি মহিমা! তার গোটা জীবন পাহাড়ময়। চৈতুরগড়ের জংলি, পাহাড়ি বাতাসের সঙ্গে তার বেঁচে থাকার লড়াই। ছত্তীশগঢ়ের কাঠঘোরা তহশিলে, সমুদ্র তল থেকে প্রায় তিনহাজার ষাট ফুট উঁচুতে চৈতুরগড় বা লাফাগড়ের মহিষমর্দিনী মন্দিরের এককোণে পড়ে থাকে পার্বতী।
মন্দিরের ভেতরে একখণ্ড পাথরে গড়া মহিষমর্দিনী। কত যুগযুগ ধরে সিঁদুর লেপে লেপে তার চেহারা আর আলাদা করে কিচ্ছু বোঝা যায় না। অন্তত বৃদ্ধা পার্বতী তো কিচ্ছুটি ঠাওর করতে পারে না। দিন দিন তার নজর কমছে।
পাহাড়ী ঘিরে শাল-মহুয়ার জঙ্গল। তারও নীচে গাঁও। রাতে পার্বতী জংলী জানোয়ারদের ডাক শুনতে পায়। এই পাহাড়-জঙ্গল আর নীচে তাদের ছোট্ট গাঁওয়ের বাইরের দুনিয়াটা কেমন তা পার্বতী কোনদিনও দেখেনি। তবে পণ্ডিতজীর কাছে সে শুনেছে এ মন্দির বহুকাল আগের। কোনো একসময়ে রাজামহারাজার গঢ় ছিল এখানে। এখনো ইতস্তত ছড়িয়ে, ভেঙে পড়ে আছে তার টুকরো পাথরের চিহ্ন। কোনো মুসলমান বাদশাও নাকি জয় করেছিল এই গঢ়। তার কব্জায় ছিল তখন এই মন্দির। একসময় প্রাচীন এ মন্দির প্রায় ভেঙে পড়ে যাবার উপক্রম হয়েছিল। কোনোক্রমে একটি পাথরের গায়ে একটি পাথর যেন লেগে ছিল।পার্বতী ভয় পেত, মন্দির মিট্টিতে মিলিয়ে গেলে কোথায় যাবে সে! তবে কয়েকবছর আগে শহরী সাহাবমন এসে দেখভাল করেছে। মন্দিরের গায়ে লোহার খাঁচা পড়িয়ে তার মেরামতী চলছে। মন্দিরে পৌঁছনর পাকা রাস্তা হয়েছে। তাই ভক্তরা দেবী সন্দর্শনে আসে। নবরাত্রিতে ভক্তদের ঢল নামে। ভক্তমন্ডলীকে পন্ডিতজী পার্বতীকথা শোনায়, —
“দেবী পার্বতী হলেন স্বয়ং পর্বতস্বরূপা। তিনি জন্ম নিলেন পাহাড়ের কোলে। স্বামীর সঙ্গে সংসার পাতলেন কৈলাসপর্বতে। মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করলেন পাহাড়চূড়ায়। ছত্তীশগঢ়ে বিমলেশ্বরী, মাড়োয়ারাণী, জটামাঈ ঘটারাণী দেবীমাঈদের পাহাড়েই অধিষ্ঠান। তাঁদের দর্শন পেতে ভক্তদের পাহাড়িপথে কৃচ্ছসাধন। জটামাঈয়ের চরণ ধুয়ে দেয় ঝর্ণার স্রোত। চৈতুরগড় পাহাড়ে পুরানা কিলাকেও স্বয়ং রক্ষা করেন দুর্গেশনন্দিনী।”
পন্ডিতজীর মুখে এসব কথা শুনে গায়ে কাঁটা দেয় পার্বতীর। হাতজোড় করে সে কপালে ঠেকায়। মনপ্রাণ দিয়ে সেবা করে দেবীমায়ের। দু-বেলা নিয়ম করে ঝাড়ু লাগায় মায়ের অঙ্গনে। নবরাত্রির আগে জঙ্গল থেকে কুড়িয়ে জড়ো করে শালপাতা। পাতায় কাঠি গুঁজে যত্ন করে দোনা বানায় শ’য়ে শ’য়ে। সেই দোনায় ভক্তরা দুই হাত পেতে লাইবুন্দি, নারকেলের পরসাদ নেয়। শহরের শেঠের ভান্ডারায় দোনা ভরে ওঠে হালুয়া-পুরিতে, ভোগে। মাতারামের দয়ায় কেউ অভুক্ত থাকেনা ন-দিন। জনমতিথি অষ্টমীতে পেটপুরে খায় পার্বতী।
ভক্তরা মা-কে চড়ায় লাল পীলা লুগরা, লালচুনরি, গুরহেল (জবা ফুল) কাঁচ কি চুড়িয়াঁ, নারিয়েল। ঝুড়িতে থাকে আয়না, কাজল, সিঁদুর, আলতা, টিপ আরো কত শৃঙ্গার। পন্ডিতজীর দয়ায় মায়ের দুটো প্রসাদী শাড়ি পায় পার্বতী। তা দিয়েই তার গোটা বছরের লজ্জা নিবারণ।
পার্বতীর মনে হয় তার প্রসাদী লুগরার লাল-পীলা রঙের উজ্জ্বল আনন্দ ছেয়ে থাকে নবরাত্রিতে। মন্দিরের গায়ে রঙিন ধ্বজা ওড়ে। ফুলমালা, মেটে সিঁদুরে সেজে ওঠে পাথরপ্রতিমা। কোন দূর গাঁও থেকে কুমোর পৌঁছে দেয় মাটির সরা, প্রদীপ। সেই সরাতে মাটি আর সার মিশিয়ে যবের বীজ পোঁতা হয়। ঢোল, মঞ্জীরা, ঝাঁঝর বেজে ওঠে। জঁবারা গীত গায় ভজনমন্ডলী। মনোকামনা কলসের ওপর প্রদীপের শিখা অনির্বাণ থাকে ন-দিন, ন-রাত। সামান্য জল পেয়ে লকলকিয়ে বেড়ে ওঠে যবের চারা।
পন্ডিতজী ব্যাখ্যা করেন, —
“যব এ পৃথিবীর প্রথম শস্য। এ অন্ন অর্থাৎ আহার হল ব্রহ্মের স্বরূপ। মা অন্নপূর্ণার অন্ন যেন ভরা থাকে পৃথিবীর ভান্ডারে। যদি দেবী রুষ্ট হন, তবে যবের চারা অপুষ্ট হবে। এবছর ফসলে পড়বে টান। তাই সবাই প্রার্থনা করো যেন, লহরায়ে হরাভরা জঁবারা দাঈ তোর ভুবন মা। মোর দোষ মত লেনা মা।
দন্ডী খাটে উপবাসী ভক্তের দল। দেবী ভর করে মানবীকে। ভয় পায় নাদান বাচ্চে। দিনের বেলা যশগীত, রাতে মাতা জাগ্রাতা সংগীত প্রতিধ্বনিত হয় পাহাড়ের গায়ে। কুমড়োর বলি হয়। পাতিলেবু সাজানো হয় অশুভ শক্তিকে দূরে রাখতে। ব্রতীরা একবেলা ফলমূল খেয়ে ন-দিনের দিন কন্যাভোজন করায়। তারপরে বহতা জলে জঁবারা বিসর্জন। চোখের জলে শাকম্ভরী দুর্গাকে বিসর্জন দিতে দিতে মেয়েরা গলা মিলিয়ে গায়, —
“ভর গে মাতা খেত অউ খার
ভুঁইয়া মে ছা’গে সুগ্ঘর বহার
চারো কোণে হরিয়ালী
শাকম্ভরী বো শাকম্ভরী
তোর মহিমা হাবে সবলে ভারী “
পার্বতীও তাদের সঙ্গে প্রার্থনা করে, “হে মোর দাঈ তোর মহিমায় পৃথিবীতে যেন সদা বসন্ত বিরাজমান হয়। তোর কৃপায় খেতখলিহান, নদীনালা পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। দয়াময়ী তোর প্রতিটি সন্তান যেন আজীবন প্রসন্ন থাকে দুধেভাতে”।
কান্নাভেজা এ বিদায়গীত গাইতে গাইতে বৃদ্ধা পার্বতী আবার সেই পর্বতস্বরূপার পুনরাগমনের প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে থাকে।
পেজফোর-এর শারদোৎসব বিশেষ সংখ্যা ২০২৩-এ প্রকাশিত