শনিবার | ১৬ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১লা অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৮:২৪
Logo
এই মুহূর্তে ::
শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (দ্বিতীয় পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (দশম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার বুদ্ধদেব গুহ-র ছোটগল্প ‘পহেলি পেয়ার’ ‘দক্ষিণী’ সংবর্ধনা জানাল সাইকেলদাদা ক্যানসারজয়ীকে : দিলীপ মজুমদার শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (প্রথম পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (নবম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত-র ছোটগল্প ‘তোমার নাম’ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (অষ্টম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত-র ছোটগল্প ‘হাওয়া-বদল’ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (সপ্তম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার প্রবোধিনী একাদশী ও হলদিয়ায় ইসকন মন্দির : রিঙ্কি সামন্ত সেনিয়া-মাইহার ঘরানার শুদ্ধতম প্রতিনিধি অন্নপূর্ণা খাঁ : আবদুশ শাকুর নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘শুভ লাভ’ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (ষষ্ঠ পর্ব) : দিলীপ মজুমদার কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (পঞ্চম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার ভোটের আগে মহারাষ্ট্রের রাজনীতি নানাদিকে মোড় ঘুরছে : তপন মল্লিক চৌধুরী সরকারি নিষেধাজ্ঞা, জমির চরম ক্ষতি ও জরিমানা জেনেও নাড়া পোড়ানো বন্ধে সচেতন নন চাষিরা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (চতুর্থ পর্ব) : দিলীপ মজুমদার আবুল বাশার-এর ছোটগল্প ‘কাফননামা’ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (তৃতীয় পর্ব) : দিলীপ মজুমদার ব্লকবাস্টার ‘আরাধনা’-র ৫৫ বছর — রাজেশ-শর্মিলা হিট-এর নেপথ্যে… : রিঙ্কি সামন্ত কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (দ্বিতীয় পর্ব) : দিলীপ মজুমদার কখনও কারও সমালোচনা না করার দুর্লভ গুণ ছিল শ্যামলবাবুর : সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (প্রথম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার কাত্যায়নী ব্রত : রিঙ্কি সামন্ত নটখট ছট : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী কেবল নৈহাটি, নাকি ‘কংশাল’দের বন্ধু হতে চাইছে সিপিএম : তপন মল্লিক চৌধুরী অমৃতা প্রীতম — প্রেম, প্রগতি ও বিদ্রোহের এক অনন্য কবি : রুবায়েৎ আমিন তবু মনে রেখো… : সন্দীপন বিশ্বাস অন্নকূট পূজা হল গোবর্ধন পূজার আরেকটি নাম : আলোক চ্যাটার্জী
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই দীপাবলি এবং কালীপুজোর আন্তরিক শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

পুজোর পরিবর্তন, পরিবর্তনের পুজো : সন্দীপন বিশ্বাস

সন্দীপন বিশ্বাস / ১৪১ জন পড়েছেন
আপডেট শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

কথাটা এভাবেও বলা যায়। সেটা হল পলাশির যুদ্ধ না হলে বোধ হয় কলকাতার পুজো ঘিরে এত জাঁকজমক হতো না। কেন? পলাশির যুদ্ধের সঙ্গে কলকাতার পুজোর জাঁকজমকের কী সম্পর্ক? আছে। কেননা সেই পুজোটা হয়েছিল মা দুর্গাকে নয়, সাহেব লর্ড ক্লাইভকে তুষ্ট করার জন্যই। সে কারণে পুজো ঘিরে উৎসবকে অন্যমাত্রায় নিয়ে যাওয়া হল। তাই বলা যায়, কলকাতায় পুজোয় নতুন করে রং চড়ল সিরাজদৌল্লার পরাজয়ের পর।

ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার করা যাক। রবার্ট ক্লাইভের জয়ের পর তাঁর মোসায়েবরা ক্ষমতাবান হয়ে উঠলেন।  বাংলার শেষ নবাবের ভাণ্ডার লুট করে সাহেবরা অনেক ধনী হয়ে গিয়েছিলেন। সেই লুণ্ঠনে তাঁদের সাহায্য করেছিলেন মিরজাফর, নবকৃষ্ণ দেব, রামচাঁদ রায় প্রমুখ ব্যক্তিরা। সেই সম্পদের ভাগ পেয়েছিলেন ইংরেজদের বশংবদরা। অর্থাৎ সিরাজদৌল্লার অপসারণের যে গোপন মন্ত্রণা হয়েছিল, সেই মন্ত্রণায় যাঁরা সক্রিয়ভাবে ইংরেজদের সাহায্য করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন হলেন রাজা নবকৃষ্ণ দেব এবং অন্যজন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। সিরাজদৌল্লার কোষাগার লুণ্ঠনের পারিতোষিক পেয়ে রাতারাতি নবকৃষ্ণ দেব রাজা হয়ে গেলেন। নবকৃষ্ণ দেব বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করলেন। ওদিকে কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের দুর্গাপুজোতেও বেড়ে গেল জৌলুস।

তবে পুজো শুরুর কারণটা ছিল অন্যরকম। সিরাজকে হারানোর পর ইংরেজদের হাতে যে রাজনৈতিক ক্ষমতা চলে গেল, তাকে কেন্দ্র করে লর্ড ক্লাইভ একটু সেলিব্রেশন চেয়েছিলেন। অর্থাৎ চেয়েছিলেন সপার্ষদ ফূর্তি করতে। সেই কথাটা কানে যেতেই বুদ্ধিমান রাজা নবকৃষ্ণ দেব বুঝে গেলেন কী করা দরকার। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, দুর্গাপুজো করবেন। তাকে কেন্দ্র করেই বসবে ফূর্তির আসর। সেখানে ক্লাইভকে আনতে পারলে তাঁর কৌলিন্য অনেক বেড়ে যাবে এবং ক্লাইভ খুশি হলে তাঁর আশীর্বাদ রাজকোষেও পড়বে।

পলাশির যুদ্ধের আগে কী করতেন নবকৃষ্ণ? তিনি তখন ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন মুন্সি। তারপর সুতানুটির তালুকদার। পলাশির যুদ্ধের পর কোটি কোটি টাকা নিজের কোষাগারে ভরে ফুলে ফেঁপে উঠলেন নবকৃষ্ণ। উপাধি পেলেন রাজার।

ইংরেজদের সেই জয়ের সেলিব্রেশন করতেই শুরু হয়েছিল শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো। ক্লাইভও বুঝলেন, হিন্দুদের মন ভোলাতে তাঁকে একটু হিন্দু সাজতে হবে। তাই তিনি কলকাতার বাঙালিদের মন মজাতে নবকৃষ্ণের দুর্গাপুজোয় উপস্থিত হয়ে ১০১ টাকা দক্ষিণা দিলেন। মায়ের কাছে বলি চড়িয়ে অঞ্জলিও দিয়েছিলেন। বিশাল সেই আড়ম্ভরে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল পুজোর ভক্তি, শ্রদ্ধা। কেননা পুজো ছিল ফুর্তির উপলক্ষ্য। তাই ঠাকুরদালানের উল্টোদিকে নাচঘরে সর্বক্ষণ মৌতাতের আয়োজন করা হয়েছিল। লখনউ, বেনারস থেকে বাঈজি এনে ক্লাইভের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ঠাকুরদালানে সন্ধিপুজোর ঢাক আর ঘণ্টার ধ্বনির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল নাচঘরের বাঈজিদের ঘুঙুরের শব্দ। ভোগের রান্নার গন্ধের সঙ্গে বাতাসে মিশে গিয়েছিল সুরার গন্ধ।

সেই পুজো দেখে সাহেবদের কী উল্লাস। হলওয়েল সাহেব লিখলেন, ‘Doorgah pujah is the grand general feast of the Gentoos’। সেকালে শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো দেখে কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখলেন, ‘পূজাস্থলে কালিকৃষ্ণ শিবকৃষ্ণ যথা / যিশুকৃষ্ণ নিবেদিত মদ্য কেন তথা?/ রাখ মতি রাধাকান্ত রাধাকান্ত পদে / দেবীপূজা করি কেন টাকা ছাড় মদে। / পূজা করি মনে মনে ভাব এই ভাবে / সাহেব খাইলে মদ মুক্তিপদ পাবে?’ কলকাতার ইতিবৃত্ত গ্রন্থে প্রাণকৃষ্ণ দত্ত  নবকৃষ্ণ দেবের পুজো নিয়ে লিখেছিলেন, ‘তাঁহার দুর্গোৎসবের উদ্বোধন হইতে বাইনাচ আরম্ভ হইত, তাহা দেখিবার জন্য শহরের বড় বড় সাহেব নিমন্ত্রিত হইতেন এবং এখনও হন। সাহেবরা এই নৃত্যোৎসবকে পলাশি যুদ্ধজয়ের স্মৃতি উৎসব বলিয়া সাদরে যোগদান করিতেন এবং আজিও করেন।’

নবকৃষ্ণ তাঁর দুর্গাপুজোকে ঘিরে যে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির পরিচয় দিয়েছিলেন, তা কলকাতার অন্য জমিদাররাও অনুসরণ করতে থাকেন। সেই সময় কলকাতার বনেদি বাড়ির বহু পুজোর মূল লক্ষ্যই ছিল সাহেব তোষণ। এঁরা হলেন প্রাণকৃষ্ণ সিংহ, নারায়ণ মিত্র, রামহরি ঠাকুর, কেষ্টচাঁদ মিত্র, দর্পনারায়ণ ঠাকুর প্রমুখ। বিভিন্ন বাড়িতে দুর্গাপুজোয় মুজরো করতে আসতেন অনেক বাঈজি। তাঁরা হলেন নিকি, সুপনজান, হিঙ্গল, আশরম প্রমুখ। তখনকার দিনে এঁদের এক রাত্রি নাচগানের মুজরো ছিল দু’হাজার টাকা এবং অন্যান্য উপহার।

অর্থাৎ কলকাতায় যে জাঁকজমকের প্রথম দিকের পুজো, তার সঙ্গে কোনও ভক্তির যোগ ছিল না, ছিল রাজনীতির। কলকাতায় অবশ্য তার আগে একটি বাড়িতেই দুর্গাপুজো হতো। সেটা হল বড়িশার সাবর্ণ চৌধুরীদের বাড়ির পুজো। সেই আটচালার পুজো ছিল নিষ্ঠার পুজো।

যে পুজো একদিন ইংরেজ তোষণের জন্য রাজবাড়িতে শুরু করেছিলেন নবকৃষ্ণ দেব। সেই পুজোই পরবর্তীকালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে দেশাত্মবোধের বার্তা ছড়াতে নেমে এল বারোয়ারির আঙিনায়। এর উদ্যোক্তা ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। তাঁর কাছে দেবী দুর্গা ছিলেন ভারতমাতার প্রতীক। তিনি সিমলা ব্যায়াম সমিতির পুজোর প্রতিষ্ঠাতা ও উদ্যোক্তা ছিলেন। দেখা গিয়েছে যেসব জেলে নেতাজি ছিলেন, সেখানেই তিনি দুর্গাপুজোর আয়োজন করেছিলেন। আসলে দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে তিনি দেশের তরুণ সমাজকে নতুন মন্ত্রে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। দেবী দুর্গার মহাশক্তিকে আরাধনার মধ্য দিয়ে শক্তিমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। দেখা গিয়েছে, নেতাজির উদ্দেশ্য একশো শতাংশ কার্যকরী হয়েছিল। সেই পুজোকে কেন্দ্র করে বহু বিপ্লবী কাছাকাছি এসেছিলেন এবং প্রত্যেকের মধ্যে একটা নিবিড় যোগসূত্র গড়ে উঠেছিল। তাঁদের নানা ধরনের অস্ত্রশিক্ষা দেওয়ার কাজটাও সহজ হয়েছিল। সেই ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে অনেকখানি সহায়তা দান করেছিল।

সিমলা ব্যায়াম সমিতি ছাড়াও বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গাপুজো বিপ্লবীদের মিলিত হতে সহায়তা করেছিল। ১৯২৬ সালে এই পুজোর সভাপতি ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ।   ১৯৩৮ এবং ১৯৩৯ এই দু’বছর সুভাষচন্দ্র বাগবাজার পুজো কমিটির সভাপতির পদে ছিলেন। বাগবাজারের পুজোয় অষ্টমীর দিন পালিত হতো বীরাষ্টমী। পরাধীন দেশের মানুষের আত্মগ্লানি দূর করে তাঁদের বীরত্বের আবেগে জাগিয়ে তোলাই ছিল এই অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য। এখানে লাঠিখেলা, ছুরিখেলা, কুস্তি, মুষ্ঠিযুদ্ধ এসব হতো। প্রচুর মানুষ ভিড় করতেন এই অনুষ্ঠানে।

স্বাধীনতার পর থেকে একটু একটু করে বদল আসতে থাকে আঙ্গিকে। স্বাধীনতার কয়েক বছর পরে সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের পুজোয় প্রতিমা গড়লেন মনুজচন্দ্র সর্বাধিকারী। তিনি ছিলেন আর্ট কলেজের ছাত্র।  মনুজচন্দ্র সেবার অজন্তা, এলিফ্যান্টার গুহাচিত্র ইত্যাদি শিল্প ভাবনার সমন্বয়ে গড়লেন দুর্গাপ্রতিমা। তাঁকে সাহায্য করেছিলেন তরুণ শিল্পী রমেশচন্দ্র পাল।

সেই প্রতিমা দেখতে এসেছিলেন তৎকালীন রাজ্যপাল কৈলাসনাথ কাটজু। তিনি তাঁর মন্তব্যে লিখে যান, ‘এমন সুন্দর দুর্গামূর্তি আমি আগে দেখিনি।’ কিন্তু সেই প্রতিমা যে খুব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল, তা নয়। অনেকেই তখন সাবেকি ঘরানার ঠাকুর ভাঙার খেলা দেখে গেল গেল রব তুলেছিলেন। তা সত্ত্বেও পরের বছর সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার নতুন ভাবনা থেকে সরে এল না। লোকশিল্প এবং তিব্বতীয় শিল্পের সম্মিশ্রণ ঘটল প্রতিমার আদলে। এরপর থেকে তা ক্রমেই অন্যদের প্রভাবিত করতে লাগল। ভবানীপুর মিলন সাথী ক্লাবের পুজোয় প্রতিমা হল গান্ধার শিল্পের অনুকরণে। সেটি তৈরি করেছিলেন শিল্পী গৌর পাল।

সাতের দশক থেকে দেখা গেল প্রতিমা নির্মাণে আরও একটা বাঁক।  কলকাতা ঝুঁকল পুজোকে কেন্দ্র করে একটু শিল্পের দিকে। শিল্প মানে একটু অন্য ধরনের প্রতিমা তৈরির করার আগ্রহ দেখা দিয়েছিল। যেমন ডালের প্রতিমা, সুপুরির প্রতিমা, পাটকাঠির প্রতিমা, সুতলি দড়ির প্রতিমা ইত্যাদি। অর্থাৎ শিল্পচর্চার মধ্যে বিনোদনের আভাসকে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে লাগলেন শিল্পীরা। কুমোরটুলির প্রথাগত প্রতিমার বাইরে গিয়ে এই অন্যভাবনাকে প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছেটা ক্রমেই ছড়িয়ে পড়তে লাগল।  প্যান্ডেলে যাঁরা ঠাকুর দেখতে আসবেন, তাঁরা প্রতিমা দর্শন করে একটু চমৎকৃত হোন। একটু অবাক হোন। ভক্তির সঙ্গে মিশে যাক শিল্পের প্রকাশ, তাই দেখে সকলে মুগ্ধ হোন, এটাই চেয়েছিলেন উদ্যোক্তারা। আগেই ভেঙে গিয়েছিল একচালার সীমাবদ্ধতা। এবার মূর্তির মধ্যে আরোপিত হল ‘স্টাইল’। তখন এগুলিকে লোকেরা মুখে মুখে বলতেন আর্টের ঠাকুর। নব বিভঙ্গের সেই প্রতিমা দেখার ঢল নেমেছিল কলকাতায়।

ভাস্কর রমেশ পাল ছিলেন এক অসাধারণ শিল্পী। বহুদিন আগে অর্থাৎ গত শতকের সেই নয়ের দশকের গোড়ায় তিনি এক সাক্ষাৎকারে আমাকে বলেছিলেন, ‘মাটির মূর্তির মধ্যে যে থ্রি ডাইমেনশন আনা হয়, সেটা আসলে মানুষের অবয়ব। তাহলে মাতৃমূর্তি দেখে মানুষের মধ্যে ভক্তি জন্মাবে কেন? তা দেবীর ওই তৃতীয় নয়নের মতো। সমস্ত কিছুর মধ্য থেকে শিল্পী যদি দৈবী আভাসটার প্রকাশ ঘটাতে না পারেন, তাহলে সেই মূর্তি দেখে মানুষের মধ্যে ভক্তি আসতে পারে না। হৃদয়ও তৃপ্ত হয় না। এটা সকলের পক্ষে সহজ নয়।’

সেই সময়কার শিল্পীরা বিশ্বাস করতেন, এই অনুচ্চারিত দৈবী ভাবের প্রকাশটুকুই হল শিল্পীর কৃতিত্ব। সেই সময় বেশ কিছু মণ্ডপে এই ধরনের প্রতিমা আসতে শুরু করে। সেগুলি আলাদা আকর্ষণ তৈরি করেছিল। যেমন উত্তর কলকাতার বিবেকানন্দ রোডের প্রতিমা। তার রূপকার ছিলেন গোরাচাঁদ পাল। এছাড়া গিরিশ পার্ক, জোড়াবাগান পার্ক, কুমোরটুলি, সঙ্ঘশ্রী, সঙ্ঘমিত্র ইত্যাদি। কলকাতার পুজো মানে তখন ছিল উত্তর আর দক্ষিণের। তার সীমাবদ্ধতা ছিল শ্যামবাজার থেকে টালিগঞ্জ। কলকাতা যত আয়তনে বেড়েছে, বিখ্যাত সর্বজনীন পুজোর সংখ্যাও ততই বেড়েছে।

তখন কুমোরটুলির শিল্পীদের মধ্যে অসাধারণ নজর টানতেন রমেশচন্দ্র পাল, রাখাল পাল, গোরাচাঁদ পাল, মোহনবাঁশি রুদ্র পাল, সনাতন রুদ্র পাল, কৃষ্ণ পাল, কালিপদ পাল। এঁদের অনেকেই এসেছিলেন ঢাকা, বিক্রমপুর, ফরিদপুর থেকে। পাশাপাশি নবদ্বীপ ও শান্তিপুর ও কৃষ্ণনগরের বহু শিল্পীও কলকাতায় এসে ডেরা বাঁধলেন।  শেষ দিকে প্রতিমার এই পরিবর্তন দেখে গিয়েছিলেন রমেশ পাল। কুমোটুলির শিল্পীরা সেভাবে শিল্পীর মর্যাদা না পাওয়ায় তিনি অভিমানাহত হয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘এখানকার শিল্পীরা মৃৎশিল্পী। কিন্তু তাঁদের শিল্পী হিসাবে স্বীকৃতি মেলেনি। সবাই যেন ঠাকুর গড়ার কারিগর।’

আজ যখন চারিদিকে দুর্গাকেন্দ্রিক ঝুলন উৎসব দেখি, যখন দেখি পুজোটা আসলে প্রদর্শনী, যখন দেখি পুজো উপলক্ষ্য, প্রাধান্য পাচ্ছে প্যান্ডেলের কারুকার্য, আলোর চমৎকারিত্ব আর থিমের বজ্রগর্ভ ঘোষণা, তখন মনে হয় এই আড়ম্বরের মধ্যে কোথাও নেই দেবীর অস্ত্বিত্ব কিংবা মায়ের উপস্থিতি।

এই বাহ্যিক আড়ম্বরের সূচনা সেই সাতের দশক থেকে। মনে রাখা দরকার সেই সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটকে। যেকোনও ধরনের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আসে কোনও বড় বদল। রাজনৈতিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক সেই বদল যেন হাত ধারাধরি করে চলে। অর্থাৎ ছয়ের দশকের মধ্যবর্তী পর্যায় থেকে আমাদের জীবনে যে নানা ধরনের পরিবর্তন এবং ফের একটা অনিশ্চয়তার দোলাচল তৈরি হয়েছিল, শিল্প ও সাহিত্যে তার প্রভাব পড়েছিল। একদিকে পশ্চিমবাংলার বুকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বাংলাদেশ যুদ্ধ, শরণার্থীদের ঢল আমাদের জীবনে নানাভাবে ছাপ ফেলল, তেমনই এল নকশাল আন্দোলন। ঘরের ছেলের হাতে বন্দুক, পাইপগান উঠে এল। তার লক্ষ্য, ভাই ও বন্ধু। তার কাছে একটাই লক্ষ্য, শ্রেণিশত্রুদের খতম করতে হবে। রাজপথে মুখ থুবড়ে পড়ে রইল রক্তাক্ত যুবকের লাশ। ক্রমেই আমাদের জীবনকে গ্রাস করল অনিশ্চয়তার এক বিবর্ণ বাতাবরণ। আমরা ক্রমেই সঙ্কুচিত, ভীত এবং স্বার্থপর হয়ে গেলাম। জীবনের ছন্দ গেল ভেঙে। আত্মসুখের বেপরোয়া ভাব আমাদের টেনে নিয়ে গেল অন্য এক বিপ্রতীপ বৃত্তের ভিতরে।

বিভিন্ন বারোয়ারি পুজোয় তার অল্প অল্প ছাপ পড়তে লাগল। পুজো ঘিরে ভক্তি নিষ্ঠার ভাব কমতে লাগল। পুজো হয়ে উঠতে লাগল এক বেপরোয়া মননের সাময়িক উল্লাস। সেই সাহেবদের আমলের পুজোর মতো ঘটতে লাগল স্ফূর্তির দিগভ্রান্ত স্ফূরণ।

ফলে দৃষ্টিভঙ্গী বদলাতে লাগল বিভিন্ন পুজো কমিটির। তাই যাঁরা প্রতিমা দেখতে আসবেন, তাঁদের শুধু ভক্তিকে প্রশ্রয় দিলে চলবে না। সেই সঙ্গে একটু দৃষ্টিনন্দন, একটু চমক দেওয়ার বাসনাও উদ্যোক্তাদের মধ্যে আরও বেশি করে প্রকাশ পেতে লাগল। এদিকে কলকাতাও বাড়তে লাগল আড়ে বহরে। বাড়তে লাগল লোকসংখ্যা। একই সঙ্গে বেড়ে গেল  সর্বজনীন পুজোর সংখ্যা। পুরস্কার দেওয়া শুরু করল এশিয়ান পেন্টস। পুরস্কার ঘোষণা করা হতো নবমীর দিন। পুরস্কার ঘোষণার পর থেকে মণ্ডপ যেন ভিড়ে ফেটে পড়ত। এখান থেকেই এগিয়ে এল কর্পোরেট সংস্থাগুলি। তারা পুজো স্পনশরশিপের দিকে ঝুঁকল। অর্থাৎ পুজো হয়ে উঠল একটা পণ্য। পুরস্কার দিতে এগিয়ে এল অনেকেই। আর নবমী নয়, পুজোর পুরস্কার ঘোষণা হয়ে যেতে লাগল মানুষ ঠাকুর দেখতে বেরনোর আগেই। অর্থাৎ পুরস্কার প্রাপ্ত প্রতিমাকে পণ্য করে চার-পাঁচদিন ধরে কোম্পানিগুলি ব্যবসা করতে মরিয়া হয়ে উঠল।

সেই লড়াইয়ে কোথায় হারিয়ে গেল এশিয়ান পেন্টস। একসময় যা শিল্পকে উৎসাহ দিতে এগিয়ে এসেছিল, আদতে সেটা পরিণত হয়ে গেল প্রতিযোগিতার টানাপোড়েনে। পুজো আর পুজো রইল না। হয়ে উঠল ঝুলন বা গিমিকবাজির খেলা। থিমের জোয়ারে ভাসাও দুর্গারে। বাঁধন ছেঁড়ার এই সাধন খেলায় জৌলুসে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। সেই তত্ত্বই ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত হল যে, শিল্পের চমকেই পুজোর সার্থকতা। কিন্তু ভক্তি, শুদ্ধতা, সাবেকিয়ানার প্রাধান্য কমতে শুরু করল।

তাহলে? সবই কি সমালোচনা করার মতো? সদর্থক কিছুই নেই? অবশ্যই আছে। এখনকার পুজোর দিকে তাকালে দেখি এক একটা মণ্ডপ যেন এক একটি শিল্পগ্রাম। মন্দ লাগে না দেখতে। আবার এইসব পুজোকে ঘিরে বাংলায় হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসাও হয়। সেটাকেও তো অস্বীকার করা যায় না। সরকার নিজেই এগিয়ে এসেছে পুজোকে আরও জাঁকজমক করে তুলতে এবং মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে। বিসর্জনকে ঘিরেও তৈরি হয়েছে এক কার্নিভাল। বাংলার দুর্গাপুজো সারা বিশ্বের সম্মান আদায় করে নিয়ে এসেছে। এও তো এক প্রাপ্তি। আমাদের নিজস্ব চণ্ডীমণ্ডপের আঙিনা অতিক্রম করে পুজোর বিশ্বায়ন ঘটেছে। আমাদের গর্ব তো সেজন্য কম নয়।

এখন বিভিন্ন পুজোকে ঘিরে তাই বিরাট প্রতিযোগিতা। পুজোর প্রস্তুতি এখন সারা বছরের। একটা পুজো শেষ হলেই শুরু হয়ে যায় পরের বছরের পুজোর প্রস্তুতি। থিম, শিল্পী নির্বাচন, বাজেট, পুজোর থিম সং কত কাজ! সেই সঙ্গে থাকে থিম গোপন রাখার খেলা। অন্য কেউ যাতে জানতে না পারে। এখন তো বহু পুরস্কার চালু হয়েছে। সে প্রতিমা থেকে শুরু করে শ্রেষ্ঠ সিংহ, শ্রেষ্ঠ মহিষাসুর, সেরা পেঁচা, কিংবা ইঁদুরের জন্যও বরাদ্দ থাকে পুরস্কার। তাই চলে চাপা কম্পিটিশন।

এই যে বারোয়ারি পুজো কমিটিগুলির মধ্যে কম্পিটিশন, সেকালেও কিন্তু তা ছিল। হুতোম প্যাঁচার নকশাতেই আমরা পাই, ‘গুপ্তিপাড়া, কাঁচড়াপাড়া, শান্তিপুর, উলো প্রভৃতি কলকেতার নিকটবর্তী পল্লীগ্রামে ক’বার বড় ধুম করে বারোইয়ারি পুজো হয়েছিল। এতে টক্করাটক্করিও বিলক্ষণ চলেছিল।’

সব মিলিয়ে মনে হয় পরিবর্তন, তার পরিবর্তন, তারও পরিবর্তন, এভাবেই সময় এগিয়ে চলেছে। জাগতিক নিয়মই তো তাই, কোনও কিছুকেই আটকে রাখা যায় না। সময় তার নিজের নিয়মেই বদলে দেয় সবকিছু। পুরনো শুকনো ডালে আবার গজায় নতুন পাতা। আমাদের জীবনে উৎসব হল ওই সরস সবুজ পাতার মতো। তবু যেন মনে হয়, উপলক্ষ্য থেকে আড়ম্বর বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। তাই মাঝেমাঝেই মনে গুনগুন করে ওঠে কবিগুরুর সেই গানের কলি, ‘তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি’।

পেজফোর-এর শারদোৎসব বিশেষ সংখ্যা ২০২৩-এ প্রকাশিত


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন