শুক্রবার | ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ২:৪২
Logo
এই মুহূর্তে ::
ফলের নামটি পাকা কলা : রিঙ্কি সামন্ত বই-বাই : নবনীতা দেব সেন হেমচন্দ্র বাগচীর ১২০তম জন্মবর্ষ : দীপাঞ্জন দে নিম্ন চাপের অতিবৃষ্টি ও ডিভিসির ছাড়া জলে প্লাবিত আরামবাগ : দেবাশিস শেঠ আরামবাগে ভয়াবহ বন্যা, দুর্যোগের পদধ্বনি, ক্ষোভ জনমানসে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন মেয়েদের ক্ষমতায়নের পক্ষেও আওয়াজ তুলেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী কবি দেবদাস আচার্য-র কবিতাজগৎ — বহমান পৃথিবীর জীবনপ্রবাহ, চেতনাপ্রবাহ : অমৃতাভ দে মনসার নাম কেন ঢেলাফেলা : অসিত দাস ভোও.. ও ..ও.. কাট্টা…! ভো… কাট্টা…! : বিজয় চৌধুরী দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা : সন্দীপন বিশ্বাস নারীবেশী পুরুষ অভিনেতা শঙ্করকে সামাজিক ট্যাবুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয় না : বিশ্বেন্দু নন্দ সাসারামের রোহতাসগড়, বৃহতের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ : নন্দিনী অধিকারী জমিদার রবীন্দ্রনাথ : আহমাদ ইশতিয়াক আন্দোলনরত জুনিয়র চিকিৎসকদের আবেদন মুখ্যমন্ত্রীর, এবারও অধরা রইলো আলোচনা : সুমিত ভট্টাচার্য জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (ষষ্ঠ পর্ব) : বিজয়া দেব চাষির দুঃখের ঘরে সাপের বাসা, আজও রেহাই নেই ছোবলের হাত থেকে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় সল্টলেক তথা লবণহ্রদই কি কুচিনান : অসিত দাস পদ্মা বা পার্শ্বপরিবর্তনী একাদশী ব্রতকথা : রিঙ্কি সামন্ত জয়া মিত্র-র ছোটগল্প ‘ছক ভাঙার ছক’ কত দিন বিনা চিকিৎসায় চলে যাবে অসুস্থ মানুষের প্রাণ? প্রশ্ন দেশ বাঁচাও গণমঞ্চের : সুমিত ভট্টাচার্য দেবী করন্দেশ্বরীর পূজো ঘিরে উৎসবের আমেজ মন্তেশ্বরের করন্দা : প্রবীর কুমার সামন্ত প্রেতবৈঠকে (প্ল্যানচেট) আত্মার আগমন : দিলীপ মজুমদার সংগীত সাধক ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য : রিঙ্কি সামন্ত শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্যের অন্দরে বাহিরে বিরাজমান সিণ্ডিকেট : তপন মল্লিক চৌধুরী কবিতা সিংহ-এর ছোটগল্প ‘পশ্চিম রণাঙ্গন আজ শান্ত’ কলকাতার আর্মেনিয়ান জনগোষ্ঠী : অসিত দাস মঙ্গলবারের মধ্যে কাজে ফিরুন — সুপ্রিম ধমক, উৎসবে ফিরুন — মমতা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (পঞ্চম পর্ব) : বিজয়া দেব বিবিসির ইয়ংগেস্ট হেডমাস্টার বাবর আলী (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত হাঁসের ডিমের উৎপাদন বাড়াতে এগিয়ে এল রাজ্যের প্রাণীসম্পদ বিকাশ দফতর : মোহন গঙ্গোপাধ্যায়
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ কৌশিকী অমাবস্যার-র আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

কবি দেবদাস আচার্য-র কবিতাজগৎ — বহমান পৃথিবীর জীবনপ্রবাহ, চেতনাপ্রবাহ : অমৃতাভ দে

অমৃতাভ দে / ৬৬ জন পড়েছেন
আপডেট বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

‘কথার ঘর’-এর আনাচে-কানাচে কবিতারা উঁকি দেয়, দেওয়াল জুড়ে কবিতার বই — আচার্যের কবিতা। দেবদাস, কবিতার আচার্য। দিনরাত শব্দেরা আমাকে দেয় শস্যবীজ,আমি রোপণ করি পৃথিবীর পথে। মনে হয়, ‘পৃথিবী ভাসছে মধুর রসে’, তাল, লয়, ছন্দে ভাসছে আমার পৃথিবী। আমিও দেখতে পাই একজন বিকিনি গান গাই একজন ভিখারী হারমোনিয়াম বাজাই ওরা চলেও যায়, দেখে চোখ জুড়ায় আমারও। স্মৃতি আগলেই তো বসে থাকতে ইচ্ছে করে। ফড়িং-এর পিছনে ছোটাতেও আনন্দ ছিল আজ বুঝতে পারি। অনন্ত প্রবাহমানতার ওপর ভেসে-চলা খড়কুটো আমি ক্ষণিক ঝলক-মাত্র।ফুরিয়ে যাবার আগে তাই আমিও অনন্ত মোহ সৃষ্টি করতে চাই, যেমন করে রামধনু মোহ সৃষ্টি করে ফুরিয়ে যায়, বউলের গন্ধভরা বাতাস এই এলো তো এই চলে গেল। কবির মতো আমারও হৃদয় নিয়ন্ত্রণহীন ছড়ানো ভুবনে ছুটছে, আমিও বুঝি মতিভ্রম জীবনকে ছেনে ছেনে করেছে মধুর। কবি দেবদাস আমাকে চিনিয়েছেন জীবন। জীবনের নানা রং তিনি দেখেছেন। তাঁর উচ্চারিত শ্লোক আমাকে বুঝিয়ে দেয়, “বিশ্ব থেকে সংগ্রহ করা ঈশ্বরকণাদের সঞ্চিত উল্লাস ও উপলব্ধির মধ্যে/ আমার অব্যক্ত কথাগুলির উষ্ণতাও মিশে যায়/ সেই মহান সংযোগ-সূত্রে অর্জিত উপলব্ধি/ আমাকে, মাঝে মাঝে/ ব্রহ্মাণ্ডের গান শুনিয়ে যায়।”দেবদাসের ‘ফটিক জল’ মোহ সৃষ্টি করেছিল। স্বতঃস্ফূর্ত সহজ এক চলনে লিখে ফেলেছিলেন তাঁর জীবনের আলোর রেখাগুলি। রচনা করেছিলেন অন্তহীন রাগ-রাগিনী আলাপ। স্মৃতি-বিস্মৃতির বাইরে চলে গিয়ে প্রশ্নহীনতার মধ্যে মগ্ন থাকতে দেখলাম কবিকে। নিজেকে বিবর্তিত করে করে উদ্দীপিত করে রেখে সৃষ্টি করলেন কবিতার পঙক্তিমালা।

ভালোবাসা ছড়িয়েছেন যেতে যেতে জীবনের পথে। কবি বলেছেন বেদনাও একপ্রকার আলো। হৃদয় বড় মুগ্ধ কথা বলে বলেই বোধহয় ‘নাস্তিকের জপতপ’-এর মতো কাব্যগ্রন্থ উপহার পাই আমরা। কবির মনে হয়, ‘মানব জীবন বড় মধুময়, বড় মধুময়। চারিদিকের আলো আমাদের ভালোবাসে, বাতাস নম্র কথা কয়, পাতার মর্মর ধ্বনি আমাদের চেনে।

‘নাস্তিকের জপতপ’ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতায় কবি লিখছেন —

শব্দ যা উচ্চারিত হয় তার বহুগুণই অনুচ্চারিত থাকে,

ভাষার সামান্যই প্রকাশ পায়, গভীর ভাষা মূলত নীরবতাই

নীরব সে শব্দতরঙ্গের কিছু কিছু

হারাতে না দিয়ে আমি সংগ্রহ করি, এবং তাদের

যথাসাধ্য হৃদয়ের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে রাখি।

হৃদয়েরও আছে বেশ আদুরে স্বভাব,যখন প্রশ্রয় পায়

একটু খোলে,তখন ওই খোলা হৃদয়ের ভাঁজ থেকে

অল্প অল্প গুপ্ত ভাষা বেরিয়ে আসে,যা আমি

কোনো কোনো মুহূর্তে প্রকাশ করতে চেয়েও পারিনি।

 

এভাবে আমার হৃদয় অব্যক্ত ভাষার স্বরলিপি হয়ে গেল।

ভাষার সেই স্বরলিপি আঁকড়ে ধরি আমি। চোখ রাখি দেবদাসের কবিতাপাতায়। ‘কালক্রম ও প্রতিধ্বনি’তে আছে আলোড়িত সময়ের প্রভাব, এতে উঠে এসেছে সামাজিক স্পন্দন। ‘মৃৎশকট’-এ আছে মহাজাগতিক বোধ সমকালীন জীবনচিত্র, আবহমান ভারতীয় বোধ, সামগ্রিকভাবে একটা বহমান পৃথিবীর জীবনপ্রবাহ, চৈতন্যপ্রবাহ। ‘আচার্যর ভদ্রাসন’ কাব্যে একটা বহমান বাঙালি-সত্তা আছে — সেকাল ও একালের মিশ্রণ ঘটে গেছে এই কাব্যে। ‘তৰ্পণ’-এ আছে শোকানুভূতি — পিতৃবিয়োগের শোকানুভূতি। ব্যক্তিশোক নৈব্যক্তিক শোক হয়ে উঠেছে। ‘রসাতল থেকে ফিরে’ কাব্যগ্রন্থটিও তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে লেখা। ২০০০ সালের বন্যায় গোটা মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, নদিয়া ও উত্তর ২৪ পরগণা জুড়ে প্রলয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। তাঁর বাড়িতেও প্রায় একতলার ছাদ অবধি জল উঠে গেছিল। বইপত্র, সমস্তকিছু নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেই নারকীয় ঘটনার অভিজ্ঞতা থেকে কাব্যগ্রন্থটি লেখা। ‘ঠুটো জগন্নাথ’-এ আছে এক অন্তর্জগতের প্রবাহ। বহুমুখী অন্তৰ্জীবন প্রবাহ। আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রেম-ভালোবাসা, অস্তিত্ব অনস্তিত্ববোধ এসব নিয়ে বিচিত্রমুখী অন্তঃস্রোত। তাঁর মনের অন্তপ্রবাহ, নানামুখী জীবনানুভূতি এতে ধরা পড়েছে। ‘অনুসূচিত কবিতা’র কবিতাগুলি নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষকে নিয়ে লেখা। এদের তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। এদের মধ্যেই তিনি বড়ো হয়েছেন। তাই এদের অকৃত্রিমভাবেই তিনি কবিতায় স্থান দিতে চেয়েছেন। ‘সুভাষিতম’ কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে দেবদাস লিখেছিলেন, ‘প্রতি নিয়ত আমরা সত্য নির্মাণ করছি আর ধ্বংস করছি। ‘সুভাষিতম’-এ আমাদের চিন্তার সূত্রগুলি বিবর্তিত হয়েছে। একটা হাইস্পিচকে ধরবার চেষ্টা করেছি এখানে।’ একের পর এক অসংখ্য কাব্যগ্রন্থ লিখে গেছেন। বিষয় বদলেছে, ভাষা বদলেছে, ভাবনারও বদল ঘটেছে। আমরাও রোমাঞ্চিত হই, যখন কবি দেবদাস আচার্যের কাব্যের গগনে ডুবে যাই, মগ্ন হই ধ্যানে। বুঝতে পারি মরণোত্তর হলে এ-জীবন কোনো জীবনাতীত ধ্যানে আত্মশ্লাঘা পায়।

কবি দেবদাস আচার্যের ‘ধুলোপথ’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ফেব্রুয়ারি ২০২২-এ। গভীর এক উপলব্ধির ভাষ্য এই কাব্যগ্রন্থ।তাঁর মনে হয় “এ জীবন/স্বপ্নের মতো/ ঘাত-প্রতিঘাতময়/কয়েকটি ঢেউ/ সাঁতার/একটা ছবি দেখার পর/একটা গান শোনার পর/একটা কবিতা পড়ার পর/যেরকম/অনির্বচনীয়।”মরণোত্তর হতে চান কবি। এ ভুবন ছেড়ে প্রাণের ভিতরেই আঁখি নিবেদন করেন তিনি। সারা অঙ্গে চরণধূলি লেগে থাকে, গ্রামবাংলার ধুলোট। প্রেম তাঁর চাপা পড়ে রয় ধুলোয়, পুণ্যার্থীদের মারিয়ে যাওয়ার পথে।

কবি দেবদাস আচার্য তাঁর দীর্ঘদিনের কাব্যচর্চায় চারপাশের প্রত্যক্ষ জীবনকেই তুলে ধরেছেন। জীবন তাকে যা দিয়েছে তাই কেবল তিনি জীবনকে ফিরিয়ে দিতে পারেন। এর বেশি শিল্প তিনি পারেন না — কিংবা এর বেশি অঙ্গীকারও তিনি করেন না — এই বোধই সব সময় কবি দেবদাসকে চালনা করেছে, প্রাণিত করেছে। আর তাই বোধহয় সহজ ভাষায় গভীর অনুভব-উপলব্ধির কথা, গভীর এক বোধের কথা তাঁর কবিতার মধ্যে আমরা খুঁজে পাই। কবিতার আঙ্গিক তাঁর মতে একজন কবির কাছে কোনো ব্যাপারই নয়। কবি দেবদাস মনে করেন তাঁর অনুভব, তাঁর মর্মবস্তু কবিতায় রূপ দিতে তাঁর পক্ষে যখন যেরকম আঙ্গিক প্রয়োজন হবে একজন কবি তাই গ্রহণ করবেন। কবিতার মর্মবস্তুর সঙ্গে-ই একজন কবির সম্পর্ক, আলাদাভাবে আঙ্গিক কোনো কবিতা নয়। কবি দেবদাসের কবিতা পড়তে গিয়েও এই কথা আমাদের বার বার মনে হয়। কোনো জটিলতা সেখানে নেই, নেই কোনো দুর্বোধ্যতা, নেই শব্দের দুরূহতা। জীবনের স্বাভাবিক এক চলমানতা তাঁর কবিতার মধ্যে উপলব্ধি করি আমরা। তাঁর কবিতা আসলে উসকে দেয় মানুষের মনের আলো। তাই যখন ‘তিলকমাটি’র কবিতাগুলি পড়ি তখন আমাদের মনে আলো জ্বলে ওঠে — নতুনভাবে আবার বাঁচতে ইচ্ছে করে — প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে খুঁজে পাই নতুন প্রাণকণা — আমাদের চেতনায় জাগ্রত হয় বোধ — স্নায়ুযুদ্ধ থেমে যায়। ওষুধ খেয়ে বাঁচার ইচ্ছে নষ্ট হয়। গাছে গাছ, ফুলে ফুল, নদী মুখ দেখে নদীজলে — আর আমরাও কবি দেবদাসের সঙ্গে সেই সব দৃশ্য দেখে তরতাজা থাকি — প্রাণমন জুড়ে বাঁচি। বাগান উন্মন করে উড়ে যায় যে উড়ো হাওয়া, বালক-বালিকারা যে গান গায়, ওপারে কলতানময় যে গ্রাম — সেসবের মধ্যেই কবি ভ্রমে সম্ভ্রমে রয়ে যান। আমরাও অস্থিরতার মধ্যে যন্ত্রণার মধ্যে আমাদের প্রাণহীন, দিশাহীন, বোধহীন নির্জীব চেতনাকে সঙ্গে নিয়ে হেঁটে যাই কবির সাথে।

“জন্মস্থান বন্ডবিলের হাঁস পায়রা গোরু

আসাম-মেলা চৈত্র-গাজন রাতচোরা সজারু

দর্শণা পেরিয়ে আসা উলুর ধ্বনি ঝড়

রানাঘাট প্লাটফর্মে শুরু বাস্তুহারার ঘর

দশ-বাই-দশ খড়ির গণ্ডি আটকানো সংসার

এপার বাংলা ওপার বাংলা মধ্যে হাহাকার।”

কবি দেবদাস আচার্য, আমাদের কাছে যিনি বাংলা কবিতার আচার্যস্বরূপ তাঁর ‘এই যে থাকা’ কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গে এই পঙক্তিগুলি লিখেছিলেন। ২০১৬ সালে প্রকাশিত এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি অন্ধকারের মধ্যে এক চিলতে আলো। তাঁর কবিতা আমাকে জড়িয়ে রাখে ভাষাহীন স্পন্দনে। জীবনের খন্ড খন্ড অনুভূতি এক অখন্ড সত্তা হয়ে ধরা দেয় কবিতাপাতায়। যিনি এক সময় লিখেছিলেন ‘মানুষের মূর্তি’, নির্মাণ করেছিলেন ‘নেই শব্দে কথা’ তিনিও তো আমাদের উপহার দেবেন বর্ণময় শত বাসনার ঢেউ। পৃথিবীতে জন্মের মতো জন্ম আর নেই — এই উপলব্ধি তো আমারও। উঠোনের আলো, গোলার ফসল, গোয়ালার দুগ্ধবতী গাই দরবেশের গান হয়ে ওঠে। দীর্ঘ জীবন-অভিজ্ঞতা কবিকে দিয়েছে কত না শব্দ, কত না ছবি, অখন্ড স্ফূর্তির প্রবাহ। ক্ষণকালকে চিরকাল হয়ে উঠতে দেখেন কবি।

দেবদাস আচার্য-র কাব্যগ্রন্থ ‘নেই শব্দে কথা’ অসুখের সময় স্নিগ্ধ বাতাস বইয়ে দেয় শরীরে-মনে। তাঁর কবিতার কাছে আমি বারবার ফিরে যাই। অনুভূতি দেশ থেকে ছুটে আসা রশ্মিকণায় স্নাত হই, ভাষার শরীরে অবগাহন করে সিক্ত হই। ক্ষুদ্র জীবনের মোড়কে একবিন্দু আলো তাঁর কবিতা। মানি, ‘প্রাণ একদিন মহাপ্রাণে আত্মস্থ হবে।’ আর তাই তাঁর মতো আমিও উচ্চারণ করে উঠি, ‘এসো গান গায় জীবনের/ আনন্দধারায় মিশে যাই।’ (প্রাপ্তি)

আমারও মনে হয় এ ক্ষণজীবনে যা পেলাম তা অতুলনীয়। কিন্তু পূর্ণ হওয়ার আগেই স্রোতে ভেসে যাওয়া কলস হাত ফসকে দূরে চলে যায়। তাঁর উচ্চারিত স্বর-

‘জগৎ যতটা মূর্ত, তার বেশি/ অগোচর, অবগুন্ঠিত/কতজন্ম লাগবে আমার/জগতের পূর্ণতা দেখতে পাওয়ার/ কে-বা জানে।’ (কবে দেখব)

ছোট্ট ছোট্ট শব্দে কত সহজ ভাষায় তিনি আমাদের নিয়ে যান মায়াময় পৃথিবীর পথে। যুগ যুগ ধরে মানুষের অনধিগম্য কত পথ অনাবিষ্কৃত পড়ে আছে। পথ না চিনে পথ ফুরিয়ে ফেলি আমিও।পাতাঝরা গাছ নিঃস্ব কিন্তু চমৎকার দিগন্তের প্রেক্ষাপটে নিঃশব্দ সংগীত হয়ে ছড়িয়ে থাকে তাঁর কবিতায়-পত্র পুষ্পহীন নিঃস্বতাও এক শিল্প যেন। কবির ইচ্ছে করে তার পাশে বসে ধুন গাইতে। আবার কখনো নিজেকে শেষ শীতের পাতাঝরা গাছের মতোই মনে হয়। পাতাঝরা গাছ যেমন পত্র পুষ্পময় অনন্য দিনগুলি পেরিয়ে এসে নিরহংকার হয়ে ওঠে, তেমনি আমাদের মধ্যেও ঝর ঝর ঝরে পড়ে পাতার রাশি।অন্তহীন কোন উদ্দেশে উড়ে যান কবি ফুরিয়ে আসে গোধূল পথ,ক্ষীণ আলো।এ আকাশে প্রান্ত নেই, অন্ত নেই, শুধু ওড়া আছে। আসলে আমরাও পাখির মত উড়ি অন্তহীন। নোনা গল্পগুলি বাষ্প হয়ে যায়, ধান ফুরায়, পান ফুরায়, এলোমেলো মনগড়া সুখ, প্রবঞ্চনা পড়ে থাকে। হাওয়ার ডানায় ওড়ে কবির গোধূল-রঙের নিশান।

জীবনের প্রান্ত বেলায় এসে কবি আমাদের শোনান মর্ম-মধুর জীবনের ভাষা।

এসেছিলাম

চলে যাব

এর বেশি

সত্য হয় না কিছু

রোদ নেমে নদীর ওপারে

দিন সরছে ও-দিকেই

আবছা আঁধারে সাঁকোর ওপর

হালকা আলোর আভায়

আমার এপার-ওপার সমান। (সাঁকোর ওপর)

‘আলোপৃথিবী’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে দেবদাস আচার্যের এক ফর্মার একটি কবিতাগ্রন্থ ‘দখিন-হাওয়া’। সকালবেলায় শীতের রোদ্দুর এসে পড়েছে ‘কথার ঘর’-এ। মাঝেমাঝেই সকালবেলা আমার মন কেমন করে ওঠে। কিছুই ভালো লাগে না। পড়ে ফেলি ‘দখিন-হাওয়া’। কবিতা পড়তে পড়তে মনে হলো আজও প্রেম আছে… “হৃদয়ে হৃদয় হয়ে আছো/বিন্দু-বিন্দু/ সকালের নির্মল শিশির যেমন। “হৃদয়ের গভীরে ঢুকিয়ে বাক্-রুদ্ধ হয়ে মগ্ন চেতনায় তাকে রাখি, ভাবি হারিয়ে-ফুরিয়ে না-যায়। কিছু মায়া থেকে যায় যেমন হাওয়ায় বাউলের গন্ধ থাকে। জীবনের বহুস্বর কবিতার পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে। আঁধার দিন অতিক্রম করে মানবজন্মের উৎসবে হেঁটে যেতে ইচ্ছে করে আমারও…. পরস্পরের হাত ধরে আলোয় আলোয় প্রস্ফুটিত হতে ইচ্ছে করে। মরমী দিনগুলো আবছা হয়ে আসলেও ইচ্ছে হয় নত হয়ে বসি এই ভূমিতলে, ফাঁকা মাঠে হাওয়ার মতন শন-শন, নদীর ঢেউয়ের মতন ছল-ছল হয়ে বেঁচে থাকি। দ্বন্দ্ব-মধুর এ জীবনে তরঙ্গ হয়ে সবই ভেসে যায়, কবিও আচ্ছন্ন হন মোহে, একটুখানি প্রেমে।

“আতঙ্কে ভাসছে দুনিয়া/বিমূঢ় এ পৃথিবীর মন ভালো নেই/অস্পৃশ্য হয়ে গেল পরস্পর/ মানুষ।” দেবদাস আচার্যের কথায় ‘কালের প্রহার সইতে হচ্ছে আমাদের’। বাংলা কবিতার আচার্য দেবদাসের ডায়েরির পাতা ভরে উঠলো নতুন অভিজ্ঞতার ফসলে। করোনাকালে দেবদাস লিখে ফেললেন একগুচ্ছ কবিতা। ইতিহাসের দলিল হয়ে উঠলো এইসব কবিতা। ২০টি কবিতা প্রকাশ পেয়েছিল ‘জীবনকুচি’ পত্রিকায়। বাকি ২২টি কবিতা ‘কবিতীর্থ’, ‘নিরন্তর’, ‘কোরক’ এবং ‘দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকায় প্রকাশিত। কবিতাগুলি একত্রিত করে ‘জীবনকুচি’ প্রকাশ করল দেবদাসের নতুন কাব্যগ্রন্থ ‘করোনা ডায়েরি’। আমার মনে হয় বাংলা কবিতায় এই কাব্যগ্রন্থ বিশেষ সংযোজন।

“সভ্যতা কি ফুরিয়ে আসছে?

অদৃশ্য এ কোন শত্রু

মানুষের সাজিয়ে-রাখা অস্ত্রভাণ্ডার পরোয়াই করে না

 

আমার স্ত্রী আজও

বাগান থেকে পুজোর ফুল তুলেছে

কাল তুলতে পারবে তো?

 

ভয় হয় ভুল করে

আমার স্ত্রী যদি

ঈশ্বরের পা ছুঁয়ে দেয়”

‘ওউম’ কাব্যগ্রন্থে দেখি জীবনের প্রান্তসীমাতে এসে কবি দেবদাস অনুভব করেন ‘ফুরিয়েছে সব হাতছানি নেশা’, নেশা তো পদ্যলেখা কিন্তু এই কর্মে ভেজে না সংসার। কোথাও ফাঁকি থেকে গেল কি? তবুও তো ফুল ফোটে আলো হয়ে, নদী গান গায়, পাতা ঝরে অলস বাতাসে — কবি এসব দেখেন। ‘কালখন্ড অতিক্রম করে নিত্য/ক্ষণ সুন্দর’। কবির গভীর উপলব্ধি — সারাদিন রৌদ্রকরোজ্জ্বল মৃন্ময় সবুজ পৃথিবী যেন কোনো সাধনার মধ্যে সমাহিত। তাইতো ভালোবাসার জন্য অপেক্ষা করে- যাওয়া। নাগরদোলায় চড়ে ঘুরতে ঘুরতে ভাবা ভালোবাসা পাশে এসে বসবে নিশ্চয়ই।মহাজগৎ পরস্পর আসক্তিময়। পরস্পর মিলনের ঘোর আসক্তি নিয়েই তো চাঁদ-সূর্য-তারকাসমূহ শূন্যে ভাসে অনন্তকাল।আর এই জীবনের প্রতি তীব্র আসক্তি থেকেই মনে হয় মন ভালো করার জন্য কাপ-ডিশে আঁকা নক্সিটুকুই যথেষ্ট, চা খাওয়ার অধিক সেটাই।প্রাণ এই অধিকটুকুকেই চায়। আত্মাকে স্নিগ্ধ শিশিরে শুইয়ে দিলেন তিনি। বললেন সিক্ত হতে, তৃপ্ত হতে। আত্মাকে প্রতিনিয়ত আমরা ব্যথা দিই। স্নিগ্ধ শিশিরে তাকে শুইয়ে দিয়ে ব্যথাতুর আত্মার ব্যথা প্রশমিত করার চেষ্টা করেন। কবি জানেন অতৃপ্ত আত্মা নিয়ে জীবন কাটিয়ে চলে যাওয়ার ফল নরকবাস। তাই লেখেন — “তৃপ্ত হও, অতৃপ্ত হও, দয়া করো/ আত্মা আমার।”

২০২৪-এর শীতের দুপুরে আমি পাতা উল্টে চলেছি দেবদাস আচার্য-র কবিতা গ্রন্থের — নাম তার ‘কে ডাকে’। ‘আদিবর্ণ’ প্রকাশ করেছে এই কাব্যগ্রন্থ। ২৮টি কবিতার সংকলন। উৎসর্গ পত্রে লেখা ‘জনপদের মিশ্রগান’। ছোট্ট ছোট্ট কবিতা যেন অলিখিত মহা উপন্যাস। কত মানুষের কত কথা, নিত্যদিন ফুরিয়ে যেতে থাকে। না-বলা থাকে সবই। গভীর হৃদয়ের অব্যক্ত অনুভূতি আমাকে দিয়েছে বেঁচে থাকার অক্ষর।

কবি উচ্চারণ করেন — “পৃথিবী আমার,ভাবি/অশ্রুত গান কত রয়ে গেল/রয়ে গেল নানা বর্ণে বোনা কত/স্বপ্নের দিন”। মন স্বপ্ন দেখে — মনের গোপনে কিছুক্ষণ থাকাটুকুই তো বিলাসিতা। দেবদাসই বলতে পারেন —”আর সবই দৈনন্দিন/ আর সবই জীবন-যাপন”।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন