দূর-দূরান্ত থেকে উচ্চস্বরে ভেসে আসা এই আওয়াজ’টা শুনতে পেলে এখনো ক্ষণিকের জন্য হলেও যেন চমকে উঠি। হ্যাঁ, এই বয়সে এসেও!
সাইকেল চালানো বা ঘরের ভেতরে যে কোন কাজ নিয়েই থাকি না কেন, নিজের অজান্তেই আকাশের দিকে চোখ চলে যায়।
পর মুহূর্তেই আবার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নিজের কাজে মন দিই।
আমাদের এই জায়গাটা পঞ্চায়েত এলাকার মধ্যে পড়ে। সেই সুবাদে এখনো একটা আধা গ্রামের মতো পরিবেশ আছে। রাস্তায় এখনো গরু ছাগল নিজের মনে ঘুরে বেড়ায়। সন্ধের দিকে ওদের ছোট মালিক স্মার্ট ফোনে গান শুনতে শুনতে এসে এদেরকে আবার গোয়ালে নিয়ে যায়।
প্রতি বছরই এই সময়টায় আমাদের এলাকায় একটা ব্যস্ততা চোখে পড়তে থাকে।
এই বিশ্বকর্মা পুজোর ক’দিন আগে থেকেই ছেলে ছোকরাদের দৌড় ঝাঁপ, চিৎকার, হল্লা শুরু হয়ে যায় — এই ঘুড়ি’র পেছনে।
তবে বিগত ক’বছর থেকেই দেখছি, আগের থেকে উন্মাদনাটা অনেকটাই যেন কমে এসেছে! — সবই মনে হয় মোবাইল বাবার কৃপা!
বিশ্বকর্মা’য় ঘুড়ি আর কালীপুজোয় বাজি — এই দুটো মেগা ইভেন্টের জন্য আমরা সবাই সারা বছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। এটাই তখন স্বাভাবিক ছিল।
ডিজিটাল অক্টোপাস যে আমাদের এভাবে আষ্ঠেপৃষ্ঠে গিলে খাবে, সেই সময় তা কল্পনাতেও ছিল না!
বিশ্বকর্মা পুজো আসার মাসখানেক আগে থেকেই শুরু হয়ে যেত আমাদের তোড়জোড়। তখন মাঞ্জা দেওয়া সুতো বিক্রিবাট্টার চল সে ভাবে ছিল না। এখন তো শুনি কোন এক চিনা মাঞ্জা নাকি বাজার কাঁপাচ্ছে। মানুষজনও এই মাঞ্জার দৌলতে মাঝে মধ্যে কেঁপে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে।
আমাদের সময়ে নিজেদের হাতে করে সুতোয় মাঞ্জা দেবার প্রস্তুতিটা ছিল ব্যাপক। অনেকটা উৎসবের মতো। সাজো সাজো রব। বিশাল কিছু যেন একটা করতে চলেছি! পড়াশোনার বিষয়টি অন্যদের ওপরে চোখ বুজে ভরসা করলেও এই ঘুড়ি, বাজি’র মতো গুরুত্বপূর্ণ জিনিস গুলোর জন্য বাকীদের ওপর বিন্দুমাত্র ভরসা করা যেত না!
আর কিছু একটা করে দেখানোর এটাই তো সুযোগ। — কেননা প্রায় প্রতিবারই লালকালি শোভিত মার্কশিট হাতে পাওয়ার পর আমাদের বেশ কয়েকজনকেই ক’দিনের জন্য আত্মগোপন করতে হতো।
যদিও কিছুদিন বাদেই, ‘লজ্জা-ঘৃণা-ভয় — এই তিন থাকতে নয়’ বলে গা-হাত-পা ঝাড়া দিয়ে উঠে আবার স্বমূর্তি ধারণ করতাম।
সুতোয় মাঞ্জা দেবার জন্য আঠা ও মিহি কাচের গুড়ো একসঙ্গে জ্বাল দিয়ে এক ধরনের কাই তৈরি করা হতো। সাবুর আঠা ছাড়াও গাবফল ও বেলের আঠাও ব্যবহার করা হতো এই কাই তৈরির জন্য।
এই কাচ গুঁড়োর জন্য বাতিল হওয়া বাল্ব ও বিশেষ করে চোখ মারতে মারতে একেবারে অন্ধ হয়ে যাওয়া টিউব লাইটের ছিল খুবই চাহিদা। তবে সেই সময়ে আমাদের এলাকায় হাতে গোনা দু’একটা বাড়িতেই বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল। সেই জন্য ঐসব না পেলে অগত্যা নিজের বাড়ির হ্যারিকেনের ভাঙ্গা চিমনি দিয়েই কাজ চালাতে হতো।
তবে হামান দিস্তা দিয়ে কাচ গুঁড়ো করার পর্বটা ছিল খুবই চমকপ্রদ। কাচের গুঁড়ো যেন ছিটকে এসে চোখে না লাগে, সেই কারণেই একটা খবরের কাগজ ফুটো করে হাতলের ভেতরে ঢুকিয়ে দিতাম। তারপর সেই কাচের গুড়ো কাপড়ে ঢেলে চেলে নিয়ে, মাঞ্জা দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হতো।
মাঞ্জা দেবার জন্য রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট বা ফুটবল মাঠের বারপোষ্ট-এর দখল কে আগে পাবে সেই নিয়ে শুরু হয়ে যেত ঝগড়াঝাটি — কখন আবার হাতাহাতিও। কিছু সময় বাদে, আবার সেই গলাগলি ভাব!
আমাদের বাড়ির সীমানা’র শেষ থেকেই শুরু হয়েছে এক বিস্তীর্ণ মাঠ। অনেকটা ছোট বেলার সেই ছবি আঁকার দৃশ্যের মতো — সামনে ধু ধু করা মাঠ আর সেই দূরে সরু সরু তাল ও নারকেল গাছ চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে, আর মন ভালো করে দেওয়া এক বিশাল নীল আকাশ।
আমাদের জন্য এই বিশাল মাঠ ও ধানক্ষেত ছিল ঘুড়ি ওড়াবার জন্য ও কেটে আসা ঘুড়ি ধরবার জন্য এক মনের মত উন্মুক্ত প্রান্তর। সবুজ ধানক্ষেতের মধ্যে সবাই দৌড়ে বেড়াতাম, আর বিশ্বকর্মা পুজোর সময়ে ক্ষেতের ধানগাছ গুলোও বেশ ভরপুর হয়ে উঠতো। যেন বিশাল এক সবুজ কার্পেট! তবে চাষীভাইয়েরা দেখতে পেলে তেড়ে গালিগালাজ করতো। যদিও আমরা আবার ওসব ফালতু ব্যাপার গায়েই মাখতাম না।
কোন একটা ঘুড়ি প্যাঁচ খেলে কেটে গেলেই হলো। চারদিক দিয়ে ভো… কাট্টা… বলে সে কী চিৎকার। দু-একজন তো আবার অতি উৎসাহিত হয়ে টিন বা টালির চালে উঠে কাঁসর ঘন্টা বাজাতে শুরু করে দিত।
সে সব ছিল যেন এক অন্য ছোটবেলা!
এমনও হয়েছে, বিশ্বকর্মা পুজোর আগে আমার ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও, মা খাইয়েদাইয়ে প্রায় বাবা সোনা বলে স্কুলে যাবার জন্য তৈরি করে দিল। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের একমাত্র বিদ্যাসাগর হতে চলেছি, এই ভেবে!
এদিকে আমি হাতে দু-একটা চটির মতো বই খাতা ধরে নিয়ে ব্যাজার মুখ করে ঘর থেকে বেরিয়ে সবে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছি। — ‘সাবধানে যাস’ এই বলে মা ভেতরে চলে গেল।
এদিকে আমি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, কোন শয়তানেরা — এই পড়াশোনা, স্কুলে যাওয়া নামক জঘন্য প্রথাটা চালু করেছিল! এইসব ভাবতে ভাবতে একবার উদাস ভাবে আকাশের দিকে তাকালাম।
হটাৎই চমকে গেলাম! আরে কী দেখছি ওটা! ওই উঁচুতে? — চিল, শকুন নয় তো? আবার ভালো করে দেখলাম…নাহ! একেবারে ঠিক — দেখেই মনের ভেতরে যেন ফুলঝুরি জ্বলে উঠলো! — সেই উঁচুতে হাওয়ার বেগে ঢেউ খেলতে খেলতে একটা লাল রঙের মুখপোড়া ঘুড়ি এগিয়ে আসছে ক্রমশ…!
প্রথমেই কোন উচ্ছ্বাস দেখালাম না। শুধু শান্তভাবে আশেপাশের দিকে তাকিয়ে দেখে নিলাম এই ঘুড়ি ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য আমার অন্য কোন বন্ধু তথা এখনকার জন্য শত্রুপক্ষের কেউ হাজির আছে কী না! নাঃ কেউ নেই। এবার শুধু কিছু সময়ের অপেক্ষা — এরপর নিজেকে শুধু ভাসিয়ে দিতে হবে এই সবুজ ধানক্ষেতে!
শুধু একটা জিনিষই খুব খারাপ লাগছিল। গতকালই মা’র কেচে দেওয়া স্কুলের খাকি রঙের প্যান্ট ও সাদা জামাটা আজকে পরেছি। সেই জন্য মনটা কেমন যেন কিন্তু কিন্তু করছিল।
ধুর! বাঙালি মরেছে এই সব পাতি সেন্টু আঁকড়ে ধরে! — একটা মহৎ কাজে যাবার সময় এই সব সাতপাঁচ ভাবলে চলে…! আর পড়াশোনার জন্য তো সারা জীবন থেকে যাবে।
— উঁকি মেরে দেখে নিলাম, মা রান্নাঘরের ভেতরে কাজেকর্মে ব্যস্ত হয়ে আছে। হাতের বইখাতা গুলো হালকা করে জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে চৌকির উপরে রেখে দিলাম।
বাঁশের বেড়ার গেটটা আবার লাগিয়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, হাওয়ার স্রোতে নাচতে নাচতে ঘুড়িটা আমার মাথা বরাবর বেশ উঁচুতে ভেসে চলেছে। আরেকবার চারদিকে তাকিয়ে নিয়েই সবুজ ঢেউয়ের মধ্যেই নিজেকে প্রায় সঁপে দিলাম।
ধানক্ষেতের কাদামাটিতে প্রথম পা দেওয়া মাত্রই বেশ হড়কে গেলাম। যদিও তৎক্ষণাৎ সামলে নিয়েই — দৌড়… দৌড়… দে দৌড়…!
কখনো ক্ষেতের আল ধরে, কখনো বা ধানক্ষেতের ওপর দিয়েই ছুটে চলেছি। আমি একা। চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। ফুরফুরে হাওয়া বইছে। মাঝেমধ্যে শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখছি। লক্ষ্য ঠিক রাখতে হবে তো!
অনেক সময় পা দুটো হাঁটু অবধিও ঢুকে যাচ্ছে ক্ষেতের জল কাদায়। ছাগলকে আটকানোর জন্য চাষীভাইদের জমির আলের ওপরে রেখে যাওয়া কুল ও খেজুরের কাঁটা পায়ে ফুটে যাচ্ছে। তবে সেদিকে বিন্দুমাত্র হুঁশ নেই আমার। আমি কেবল লক্ষ্যভেদে ছুটে চলেছি। এদিকে হাওয়াও বইছে খুব। ধান গাছের মাথাগুলো প্রবল বেগে এদিক সেদিকে দুলে চলেছে ক্রমশ। আমার শরীরে এসেও ঝাপটা মেরে যাচ্ছে।
যাই হোক, এই ঘুড়িকে তো আমাকে পেতেই হবে! কেমন একটা গোঁ চেপে গেছে যেন।
এর মধ্যেই যে ভাবে ঘুড়িটার নীচে নেমে আসার কথা ছিল, সেটা যেন হচ্ছে না! তবে একবার দোল খেতে খেতে অনেকটা নেমে এলো। এবার পেয়ে যাবোই বলে মনে হলো।
কোথায় কী, হটাৎই এক দমকা হাওয়ার টানে এক লহমায় আরো যেন উঁচুতে উঠে গেল! হাওয়ার তেজ বাড়ে, ঘুড়িও যেন আরো ওপরে উঠে গিয়ে ক্রমশ ছোট হতে থাকে!
এদিকে অনেকটা সময় হয়ে গেছে। আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। জল কাদায় দৌড়তে গিয়ে বুকে প্রায় হাঁফ ধরে গেছে। প্যান্ট জামা জলকাদায় ভিজে পেছনের দিকে গায়ে লেপ্টে আছে। আমার পা’দুটোও যেন আর চলছে না।
না! আর বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই — এই ঘুড়িটা পাওয়ার।
চোখে সামনে দেখলাম অন্ধকার, আমার সব আশা চুরমার করে দিয়ে — মুখপোড়া লাল ঘুড়ি’টা ক্রমশ ছোট হয়ে চলেছে — সেটা দেখে আমার চোখ ফেটে যেন জল বেরিয়ে আসতে চাইছে। গলা বুজে আসছে…।
সব হারিয়ে ধানক্ষেতের সেই ভেজা আলের মধ্যেই বসে ছিলাম দীর্ঘ সময়…!
তবে সেদিনের ছোট্ট একটি না পাওয়ার বেদনা — আজকের দিনে যেন শতগুণ ভালোলাগায় পরিণত হয়ে আছে!
প্রায় বছর ১৫ আগে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন এই ধানক্ষেতেই ছবিগুলো তুলেছিলাম।
যদিও আজ সেই ধানক্ষেতও আর নেই… নেই সেইসব দামাল ছেলেপুলেদের দলও!
ছবি : বিজয় চৌধুরী/১৬-০৯-২০২২।