চাষিদের একটা নেশা আছে। তাহল সূর্য ওঠার আগে খেতের মাঠে ঘুরে আসা। পা ভেজা শিশিরে আলপথে চলতে গিয়ে খেতের ফসল পর্যবেক্ষণ করা। চোখ এড়ায় না খেতের ফসলে রোগ-পোকা, কিংবা কাঁকড়া বা ইঁদুরের গর্ত। লক্ষ্য অন্য খেতে জল চলে না যাওয়া। নিত্যদিনের অভ্যাস। এটা অভ্যাসে পরিণত করেছেন গ্রামেরই সন্দীপ, জয়দেব, আবু তাহেরদের মতো মধ্যবিত্ত চাষিরা। দুটি ঘটনা উল্লেখ করলেই বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। কী সেই ঘটনা? ঘটনাটি আজও মনের ভিতর নাড়া দেয়। যেদিন সন্দীপ গ্রামের মানুষের থেকে অনেক দূরে চলে গেলেন। কিন্তু তাঁর নিত্য চাষের খুঁটিনাটি কাজ, আজও ভুলতে পারিনি। দিনটা ছিল রবিবার। ছুটির দিন। সন্দীপকে সূর্য ওঠার আগেই বিশুদ্ধ বাতাস ডেকে নিয়েছিল। সন্দীপও বিছানা থেকে উঠেই সেই ডাকে সাড়া দিয়েছিল। চোখে সবুজের ছোঁয়া। খালি পায়ে টাটকা শিশিরের প্রলেপ। সুস্থ ও সবল মন। সতেজ চিন্তাভাবনা নিয়ে খেতের ফসল দেখতে সন্দীপ পা বাড়িয়েছে। এদিনটা ছিল তার কাছে অন্য দিনের চেয়ে একটু আলাদা। কারণ আশ্বিনের সংক্রান্তি। মাঠে যেতেই হবে নল পুঁততে। এটা বাপ-ঠাকুরদার আমল থেকে চলে আসছে। তাই পুরনো আচার-প্রথাকে মেনে কাঁধে নলগাছ নিয়ে মাঠে হাজির হয়েছিল। জমির ঈষাণ কোণে দাঁড়িয়ে সন্দীপ একবার ধনলক্ষ্মীকে স্মরণ করে নিল। তারপর নল পুঁততে যাবে। তার আগে বাপের শেখানো বুলি ‘আকাশের জল, পাতালের নল, ধান ফলে গলগল।’ তিনবার বলার পর গর্ত দেখে নলপুঁততে গেল।
হঠাৎ গর্তের ভিতর থেকে একটি বিষধর সাপ সজোরে সন্দীপের বুড়ো আঙুল কামড়ে ধরল। সাপ সমেত ধরে তাকে আছাড় দিল। সাপের কামড়ে যন্ত্রণায় বসে পড়ল সন্দীপ। কাতরাচ্ছে। কী করবে! ভেবে পাচ্ছে না। মাথায় তার এক বুদ্ধি এসে গেল। ভাবল, বুড়ো আঙুলটা গোড়া থেকে কেটে ফেললে কেমন হয়! তাহলে আর সারা শরীরে বিষ ছড়াতে পারবে না। যেমন ভাবা তেমন কাজ। কোমরে গোঁজা ধারালো কাস্তে দিয়ে পুরো বুড়ো আঙুলটাই কেটে ফেলল। ঘাসের উপর আঙুলটা পড়ে দু-একবার যেন নড়ে উঠল। ঘাসের উপর রক্ত পড়ে সবুজ রঙটা বদলে গেল। নীলাভ হয়ে যাচ্ছে ঘাসের রঙ যেন। আর বুড়ো আঙুলটা তখনও ঘাসের উপর পড়ে আছে। সন্দীপ দ্রুত বাড়ির দিকে পা বাড়াল। তখন ডানহাত দিয়ে বাঁ-হাত শক্ত করে চেপে ধরে আছে। নিজের গামছা দিয়ে শক্ত করে বাঁধলেও রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। সন্দীপকে দেখে বাড়ির লোকজন অবাক! এ কী কাণ্ড সাতসকালে! বাড়ির লোকেরা তাকে বোঝালো হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য। সন্দীপ রাজি হয়নি। সে বোঝাতে চেয়েছিল, যে আঙুলে সাপ কামড় দিয়েছে, তা বাদ দেওয়া হয়েছে। ভয় নেই। বাড়ির লোক একথায় আশ্বস্ত হয়নি। পরদিন সন্দীপ ভোর হতেই মাঠে রওনা দিয়েছিল। সারা রাত ঘুমোতে পারেনি। চিন্তা করেছে কেটে ফেলে দিয়ে আসা আঙুলের কথা। অকুস্থলে পৌঁছেই আঙুলটাকে খুঁজেছে। আঙুলের চেহারা বদলেছে, ভ্রু কুঁচকে অনেক্ষণ দেখছে। সতেজ নেই। কিছুটা নীলাভ। সন্দীপের মাথায় তখন এক বুদ্ধি এসেছে। সে ভেবেছে ওই আঙুল আবার জোড়া দিলে কেমন হয়! যা ভাবা তাই কাজ। সেই আঙুল মাটি থেকে তুলে স্বস্থানে শক্ত করে ধরে বেঁধে নিয়েছে। আর ভাবতে ভাবতে চলেছে সে বাড়িতে, দেখাবে তার আঙুল ঠিক হয়ে গেছে।
সন্দীপের কাণ্ডকারখানা দেখে বাড়ির লোক তাজ্জব। গামছা খুলে যখন আঙুলটা দেখছে, দেখে গোটা আঙুল তো বটেই শরীরের একপাশ নীলাভ হয়ে গেছে। চোখে-মুখে নীল ছাপ। বুঝতে অসুবিধা হয়নি বাড়ির লোকজনের। সঙ্গে সঙ্গে সন্দীপকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিল বাড়ির লোকজন। আস্তে আস্তে যেন গোটা শরীর নীল হয়ে আসছে। শরীরে রক্তের লাল রঙটুকু বুঝি হারিয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালে যখন সন্দীপকে ভর্তি করা হল, ততক্ষণে সে বিড়বিড় করে কথা বলছে। চোখে-মুখে কষ্টের ছাপ। কাঁপছে, খিঁচুনি হচ্ছে। ডাক্তার এসে দেখলেন অনেক্ষণ ধরে। গম্ভীর মুখে জানালেন কিছু করার নেই। দেখেছিলাম সেই অসহনীয় কষ্ট। একমাত্র ছেলে ও মেয়েকে জড়িয়ে ধরে সন্দীপের বউয়ের কান্না। সেই কান্না আজও ভোর হলেই এখনও গ্রামের এক প্রান্ত থেকে ভেসে আসে। ভোরের আজানও চাপা দিতে পারে না সেই কান্নাকে। জানি না আর কতদিন শুনে যেতে হবে।
আর একটি ঘটনার কথা না বললেই নয়। এমন কিছু ঘটনা থাকে যা মনকে কুড়ে কুড়ে খায়, যতক্ষণ না তা প্রকাশ পায়। অজানা অনেক ঘটনা অথচ সেটা দুঃখের আবার সুখেরও। গ্রামীণ সমাজে খেটে খাওয়া মানুষের জীবনে ঘাত-প্রতিঘাত আছে। সেটা বুকের মাঝে জমা হতে হতে অতীত হয়ে যায়। যখন সেই অতীত ঘটনা কোনও সহৃদয় মানুষের কাছে খুলে বলা যায়, তখন মনে হয় হৃদয়ের বোঝা নামল বুঝি। সুখ-দুঃখ শেয়ার বোধহয় এমনি করেই হয়। না বলা গোপন কথাগুলি খেটে খাওয়া মানুষের দলিল না হোক, অন্তত জীবনটা যে একটা নাটক তা যেন সমাজের মানুষ উপলব্ধি করে। সমাজে রামা কৈবর্ত যেমন আছেন, তেমনি হাসিম শেখও আছেন। এঁদের মতো মানুষের যখন শিরদাঁড়া অর্থনৈতিক দিক থেকে মজবুত হয়, তখন তা হয় সুখের। আর যখন এঁদের মতো মানুষকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয় তখন তা হয় দুঃখের। বর্তমানে উন্নয়ণশীল দেশ ভারতবর্ষ। সেইদিক থেকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য একই পথের পথিক। সমগ্র দেশে যেখানে এখনও শতকরা ৭০ ভাগ কৃষিজীবী। যাদের নির্ভর করতে হয় খেতের ফসলের ওপর। আর এই ফসল উৎপাদন করতে গিয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম আর ঘাম ঝরা আভিজ্ঞতা আজও মুছে যায়নি।
গফুর মিঞা এখনও সমাজে শত শত। এঁদের কথা ভাববার ফুরসৎ নেই কারও। সমাজব্যবস্থায় আজও এরা অবহেলিত।কেবল অবহেলিত নয়, জীবনটাই দুঃখের। মাঠে আজও সাপের সঙ্গে লড়াই করে বাঁচতে হচ্ছে এদের। সমাজের সকলস্তরের মানুষ জানুক এই গফুর মিঞারা কীভাবে লড়াই করে বেঁচে আছেন। ছোট্ট একটা ঘটনা। সেদিন জুম্মাবার। পবিত্র শুক্রবার। ভোরের আজান শোনা যাচ্ছে। গরু দুটোকে সবেমাত্র খর-জল দিয়েছে। এই খাবার খেয়েই গরুদুটোকে যেতে হবে মাঠে চাষ করতে। সূর্য ওঠার আগেই তৈরি হতে হবে। সঙ্গে গফুর মিঞাকেও যেতে হবে। সকাল সকাল নমাজ পড়ে তৈরি হচ্ছে। হঠাৎ শুনতে পেল রাম ঘোষের ডাক। বাইরে দলিজের গায়ে রাম বার বার ডাকছে। বেরিয়ে এসে রামকে বলল, কী ভাই, কী খবর? রাম বলল, ‘কাল রাতে মাটির দাওয়ায় বউকে সাপে কামড়েছে। ওঝারা এসেছে ঝাড়ফুঁক করছে। একবার চলো। কারণ গ্রামের সব খেটে-খাওয়া মানুষ জানে গফুর মিঞা এলে কিছু একটা উপায় বের হবে। ছুটেছিল রামের বাড়ি। ততক্ষণে বউটার মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বের হচ্ছে। পাড়ার লোকজন জড়ো হয়ে কাছের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিল।
ডাক্তারবাবুরা এসে ভাল করে দেখলেন। কোনও সাড় নেই। ঘাড় নেড়ে জানিয়ে দিলেন কিছু করার নেই। রাম তখন তার ছ’বছরের একমাত্র মেয়েটাকে ধরে কেঁদে চলেছে। কে দিয়ে আসবে মাঠে জলখাবার? কে দেবে হালের দুটো বলদের খড় কেটে? কাঁদতে কাঁদতে রাম চিৎকার করছে। বাচ্চা মেয়েটিকে জড়িয়ে রামের সেই আকুতি ভোলার নয়। রাম জানে তার বউ না থাকলে, গায়ে-গতরে খেটে তিন বিঘা জমি চাষ করা সম্ভবপর হত না। এখন বাচ্চাটাকে কে দেখবে! আর বলদ দুটোকেই বা কে দেখবে! গফুর শুধু দেখেছিল সেদিন একটা চাষির ঘরে বউয়ের কতটা দায়িত্ব। কারণ তারা ছিল প্রান্তিক চাষি। চাষ না করলে খেতে পাবে না। বাচ্চার লেখাপড়ার খরচ জুটবে না। সেই মৃত্যুর দিনে পাড়ার লোকেরা এসেছিল। রামের পাশে থেকে সৎকার করেছিল। নেতারা এসেছিল। সহানুভূতি দেখিয়েছিল মুখে। আজও রাম বেঁচে আছে। জীর্ণ-শীর্ণ চেহারায় ভাঙা টালির ঘরে জ্যোৎস্নার আলো দেখে। কিন্তু পরিবর্তন হয়নি ঘরের। তিনবিঘে জমির সবটাই বিক্রি হয়ে গিয়েছে। কারণ একমাত্র মেয়েকে সুখী করতে গিয়ে বিয়ে দিয়েছে। সে কতটা সুখী হয়েছে জানা নেই, তবে ঘরের দাওয়ায় রাম বসে কেবলই বিড়বিড় করে মুখে। সে এখন ‘প্রান্তিক’ থেকে ‘ভূমিহীন চাষি’ — এই তকমা পেয়েছে। চাষির দুঃখের ঘরে দিনের দিন সাপের বাসা বাড়ছে। সেই ছোবলের হাত থেকে আজও রেহাই নেই এই সমস্ত চাষিদের।