গ্রামের নাম করন্দা, পূর্ব বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বর ব্লকের একটি সাধারণ গ্রাম। এই গ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী করন্দেশ্বরী। এই দেবীর পূজা হয় শ্রাবণ মাসের শুক্লা চতুর্দশী তিথিতে (রাখী পূর্ণিমার আগের দিন)।
এই পূজা কবে কখন থেকে শুরু হয়েছে তা জানা যায় না। বলার মত কোন মানুষ নেই। এখন সবটুকুই জনশ্রুতি।
এই দেবীর মূর্তি নিকষ কালো পাথরের। উচ্চতা প্রায় দুই ফুট, চওড়া (প্রস্থ) এক ফুটের বেশি।
এটি মহিষাসুরমর্দিনীর রূপ(চন্ডী)। দেবীর দশটি হাত, প্রত্যেক হাতে বিভিন্ন অস্ত্র। প্রধান দুই হাতের এক হাতে বর্শার মত অস্ত্রের সাহায্যে, পায়ের নিচে ছিন্নমস্তক মহিষের গলা থেকে বার হয়ে আসা মহিষাসুরকে বিদ্ধ করছেন, অপর হাতে মহিষাসুরের চুলের মুঠি ধরে আছেন। এখানে লক্ষী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক অনুপস্থিত। কিন্তু দেবী মূর্তির দুই পাশে দুইটি পৃথক মূর্তি। দেবীর বামদিকে খড়্গ হাতে ভঙ্গিমায় পুরুষ মূর্তি, দেবীর ডানদিকে ভঙ্গিমায় এক নারী মূর্তি। দেবীর মুখের দিকে চেয়ে থাকা মহিষাসুরের হাতে বড় খড়্গ। মহিষাসুরের সামনে মহিষের ছিন্ন মস্তক।
এই সমস্ত মূর্তিগুলি একটি প্রস্ফুটিত বৃহৎ পদ্মের উপর অবস্থিত। পদ্মের নিচে সূক্ষ্ম নকসা, কারুকার্যের মধ্যে আরও কয়েকটি বিভিন্ন ভঙ্গিমার মূর্তি।
মূর্তির গঠন অতি সূক্ষ্ম এমনকি হাত পায়ের আঙুলের নখ পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়।
মূর্তি এবং নকসার কারুকার্য খুবই সূক্ষ্ম এবং স্পষ্ট। সচরাচর এত সূক্ষ্ম এবং স্পষ্ট, সুন্দর কারুকার্য করা দেবীমূর্তি সচরাচর দেখা যায় না।
এই দেবীমূর্তির উৎপত্তি সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু জানা যায় না। এইটুকু জানা গেছে এই অতি সুন্দর চমৎকার মূর্তিটি পাওয়া গিয়েছিল একটি পুকুরে। যে পুকুরটি বর্তমানে দেবীর নামে “করন্দেশ্বরী পুকুর” বলেই পরিচিত। প্রচলিত আছে গ্রামের “বাগদি” সম্প্রদায়ের মানুষরা ঐ দেবীমূর্তি পুকুর হতে উদ্ধার করেন। গ্রামের মানুষজন চাষজমির মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করতে বিভিন্ন পুকুরের পাঁককাদা তুলে চাষের জমিতে ছড়াত। এই পাঁককাদা তুলতে গিয়ে কাদা পাঁকের মধ্য থেকে দেবীমূর্তি উদ্ধার করতে পারেন। অথবা ঐ পুকুরে মাছ ধরতে গিয়ে মাছের জালের মধ্যে এই দেবীমূর্তি উদ্ধার হতে পারে। এই দুই ঘটনার কোন একটি সম্ভব।
এখন এই দেবীমূর্তি পুকুরের জলে এল কিভাবে তা স্পষ্টভাবে জানা না গেলেও এ সম্পর্কে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা অনুমান করা যায়।
“কালাপাহাড় (১৫৩৪-১৫৮৩)” সম্পর্কে কিছু সত্য গল্প কথা প্রচলিত আছে। কোন তথ্যে পাওয়া যায় তিনি ছিলেন আফগান মুসলমান আবার কোন বহুল প্রচারিত তথ্যে পাওয়া যায় তিনি প্রথম জীবনে ছিলেন হিন্দু ব্রাহ্মণ পরবর্তী কালে সুলতান দাউদ খান করনানীর অধীনে সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত হন এবং সুলতান কন্যাকে বিবাহ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। পরে প্রায়শ্চিত্ত করে হিন্দু ধর্মে ফিরতে চাইলেও তাঁকে হিন্দু ধর্ম সে সুযোগ দেয় নি। তারই প্রতিহিংসায় তিনি পরের পর হিন্দু ধর্মের দেব দেবী মূর্তি, মন্দির ধ্বংস করতে শুরু করেন। এইভাবে তিনি পুরীর জগন্নাথদেবের মূর্তি, কোনারক এর মন্দির, আসামে কামরূপে কামাখ্যা দেবীর মন্দিরের প্রচুর ক্ষতি করেছিলেন। সেই সময় প্রচুর রব উঠেছিল বাঙলাতেও যে কোন দিন কালাপাহাড় এসে মূর্তি এবং মন্দির ধ্বংস করতে পারে। সেই সময় বিভিন্ন রাজা, জমিদার বা স্থানীয় ধনীরা বিভিন্ন মন্দির তৈরি করে বিভিন্ন দেবদেবীর পূজাঅনুষ্ঠান ও উৎসবের আয়োজন করতেন। কালাপাহাড়ের নামে এমন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে তারজন্য বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি রক্ষা করার উদ্দেশ্যে দেবদেবীর মূর্তিগুলি পুকুরের জলে ডুবিয়ে রেখেছিলেন। পরবর্তী সময়ে ঐসব মুর্তি পুকুরের জল থেকে উদ্ধার হয়। এমন বহু মূর্তি বিভিন্ন স্থানীয় পুকুরের জল থেকেই উদ্ধার হয়েছে।
অনেক আগে আমাদের গ্রামের এক ধনী উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন “রায়” উপাধিধারী পরিবার (রাজা বা বৃহৎ জমিদার হতে পারেন)। তাঁরা বাস করতেন গ্রামের এক উচ্চস্থানে, যে স্থান গোলাকার চতুর্দিকে জল পূর্ণ বিরাট পরিখা দ্বারা বেষ্টিত। বর্তমানে সেই স্থানে কোন কিছু চিহ্ন নেই, চাষের জমি। কিন্তু এই স্থানে জমি চাষ করলে প্রচুর পুরানো দিনের ইঁটের টুকরো, মাটির পাত্রের ছোট ছোট ভাঙা টুকরো, খোলাম কুচি উঠে আসে। এ থেকে বোঝা যায় অনেক আগে এখানে কোন বৃহৎ বাড়ি, অট্টালিকা ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য হলে হয়তো কিছু প্রাচীন নিদর্শন কিছু পাওয়া যেতে পারে। বর্তমানে এই স্থানকে “গড়ের বেড়” বলে। দেবী করন্দেশ্বরী মাতার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন এই ধনী “রায়” পরিবার।
বর্তমানে আমাদের গ্রামে এই দেবী করন্দেশ্বরী মাতার পূজা হয় চারদিন।
অধিবাস (পূজার আগের দিন) এই দিন, দিনের বেলা স্বাভাবিক নিত্য পূজা হয়, ভোগ হয়। সন্ধ্যায় পূজা হবার পর দেবীর গাত্রমার্জনা হয়। গাত্রমার্জনার পূর্বে ওই “গড়ের রায়”-দের অনুমতি নিতে হয়। বর্তমানে গড়ের রায়দের কেউ না থাকায় রায়দের উত্তরাধিকার বলে প্রচলিত গ্রামের “সামন্ত পরিবার” এর কোন একজন “অনুমতি দিলাম” বলে সম্মতি জানালে দেবীর গাত্রমার্জনা শুরু হয়। খুব যত্ন সহকারে দেবীমূর্তি পরিস্কার করা হয়। দেবীমূর্তি পরিস্কার করার অধিকারী শুধুমাত্র ব্রাহ্মণরা। মূর্তি পরিস্কার করার পর মন্দিরে স্থাপন করার পর পুনরায় পূজার্চনা, আরতি ইত্যাদি অনুষ্ঠান হয়।
পরদিন পূজা। এইদিন একটু বেলার পর দেবীমূর্তি ছাড়া দেবীর শুধু ফাঁকা চতুর্দোলা গ্রাম প্রদক্ষিণ করে। গ্রাম প্রদক্ষিণ শেষে ঐ চতুর্দোলা দেবীর মন্দিরে পৌঁছালে তারপর ঐ চতুর্দোলায় বসিয়ে দেবীকে, দেবীর নিজস্ব পুকুরে (যে পুকুর হতে দেবীকে উদ্ধার করা হয়েছিল) নিয়ে যাওয়া হয় স্নানের উদ্দেশ্যে।
এসব যা কথা লিখলাম তা শুধুই দেবীর কথা। এই পূজা আমাদের গ্রামের সর্বাপেক্ষা বড় উৎসব। দুর্গা পূজা, কালী পূজা, সরস্বতী পূজা অন্যান্য স্থানে যেমন হয়, আমার গ্রামেও তেমনই হয়। কিন্তু এই মাতা করন্দেশ্বরীর পূজা আমাদের গ্রামের সর্বাপেক্ষা বড় উৎসব, সর্বাপেক্ষা আনন্দদায়ক উৎসব। প্রত্যেক বাড়িতে আত্মীয় স্বজনেরা আসেন, গ্রামের মানুষ যারা কাজের জন্য বাইরে থাকেন তারা আসেন, গ্রামের বিবাহিত মেয়েরা জামাইরা সকলে উপস্থিত থাকেন। প্রচুর ঢাক, অন্যান্য নানা ধরনের বাজনা আসে, বর্তমানে প্রচুর মাইকের উপদ্রব, একসঙ্গে ২০-২৫টা চোঙা লাগিয়ে বাজছে। সে কি ভয়ংকর শব্দ দানবের উৎপাত। কোথায় শব্দবিধি, কোথায় নিয়ম, কোথায় শৃঙ্খলা।
গ্রামের মানুষের সে কি আনন্দ, সে না দেখলে বোঝা যাবে না।
এই যে দেবী পুকুর ঘাটে স্নানের উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন তার সঙ্গে সব বয়সী মানুষের নাচ। আগে রাস্তায় প্রচুর কাদা ছিল সেই কাদা মাখামাখি করে নাচ। সে কি আনন্দ সে কি উল্লাস সে আমার গ্রামের মানুষেরা জানেন। এখন আগের তুলনায় কাদা মাখামাখির উল্লাস কমেছে।
স্নান শেষে দেবী পুকুরের পাড়ে এক পাড়াতে প্রথম পুজো হয়, সেখানে শূকর বলি হয়। তারপর দেবীকে ব্রাহ্মণরা কোলে করে নাচাতে নাচাতে এগিয়ে নিয়ে চলে। আর দেবীর সামনে সামনে প্রচুর মানুষ দন্ডী কাটতে কাটতে (স্নান করে ভিজে কাপড়ে রাস্তায় দুহাত বাড়িয়ে শুয়ে পড়েন, উঠে হাত যতদূর পৌঁছেছিল তারপর আবার হাত বাড়িয়ে শুয়ে পড়বেন, পুনরায় সেই একই পদ্ধতিতে চলবে। অর্থাৎ শুয়ে শুয়ে রাস্তা এগিয়ে যাবেন) চলেছেন। এই দন্ডীকাটা রাস্তার দুপাশে প্রচুর মানুষ দাঁড়িয়ে দেখছেন।
এইভাবে দেবী নাচতে নাচতে গ্রামের বাড়োয়ারি তলায় উপস্থিত হবেন। সেখানে গ্রামের সব বাড়ি থেকে পুজো আসবে। বাড়োয়ারি তলার বিরাট উঠান, সেখানে নৈবেদ্যের থালায় গোটা উঠান ভর্তি। তারপর পুজো, শেষ হতে বিকাল চারটা, সাড়ে চারটা। তারপর বলিদান পর্ব। পূজা শেষে বাড়োয়ারি তলায় অস্থায়ী মন্দিরে দেবীকে রাখা হয়, এখানে দেবী পূজার তিন দিন থাকবেন।
পরদিন বাসিপূজা (প্রচলিত কথায় ‘বাসপুজো’)। খুব সকাল সকাল দেবীমূর্তিকে চতুর্দোলায় (আগে ছিল কাঠের, বর্তমানে স্টীলের) করে গ্রাম প্রদক্ষিণ করাতে বার করা হয়। ব্রাহ্মণরা সঙ্গে থাকেন। চতুর্দোলার বাহক হবার অধিকারী বাগদিরা (যারা পুকুর থেকে দেবদেবীমূর্তি উদ্ধার করেছিল)।
গ্রামের সমস্ত পাড়ায় ঘুরবেন, পাড়ার মানুষজন পূজা দেবেন। এই গ্রাম ঘোরা শেষ হতে হতে বেলা দুটো আড়াইটা। তারপর দেবীকে শেষের দিকে এক স্থানে চতুর্দোলা থেকে নামিয়ে ব্রাহ্মণরা নাচাতে নাচাতে বাড়োয়ারি তলার অস্থায়ী মন্দিরে নিয়ে যাবেন। দেবীকে যখন নাচানো হয় তখন দেবীর মাথার উপর চাঁদোয়া দোলানো হয় এবং সেই চাঁদোয়া দোলানোর অধিকারী গ্রামের বিশেষ এক পরিবার (মন্ডল পরিবার)। মন্দিরে গিয়ে আবার স্বাভাবিক পূজার্চনা হয়।
তৃতীয় দিন- দ্বিতীয় দিনের মতোই গ্রাম প্রদক্ষিণ, পাড়ায় পাড়ায় পূজা।
আবার দ্বিতীয় দিন যেখান থেকে দেবীকে নাচানো শুরু হয়েছিল সেখান থেকেই তৃতীয় দিন নাচতে নাচতে মূল মন্দিরে যাবেন।
মূল মন্দিরে প্রবেশের আগে একটি নকল খন্ড ঠেলাঠেলি ধাক্কাধাক্কি হবে। একদিকে গ্রামের সাধারণ মানুষ তাঁরা দেবীকে মন্দিরে ঢুকতে দেবেন না কারণ দেবী শূকর,পাঁঠা ইত্যাদি খেয়েছেন তাই দেবী অশুচি অশুদ্ধ। বিপরীতে ব্রাহ্মণরা দেবীকে মন্দিরে তুলবেন। কিছু সময় একটু ঠেলাঠেলি ধাক্কাধাক্কি হবে শেষে দেবীকে মূল মন্দিরে স্থাপন করা হবে। আবার পূজার্চনা নানা ক্রিয়াকর্মের শেষে পূজা সমাপন।
এই কয়দিন আমাদের গ্রামের মানুষের সর্বাপেক্ষা বড় আনন্দানুষ্ঠান।
বর্তমানে আধুনিক মানসিকতায় পূজার আচার অনুষ্ঠান হয়তো পূর্বের মতো নিষ্ঠাভরে হয় কিনা জানিনা।
কাজের চাপে, নানা অসুবিধার জন্য বাইরে থাকা মানুষজন বা আত্মীয় স্বজনেরাও অনেকেই আসতে পারেন না। যাঁরাই উপস্থিত আছেন আনন্দের কোন ঘাটতি নেই।
প্রবীর কুমার সামন্ত, গ্রাম ও ডাকঘর – করন্দা, থানা — মন্তেশ্বর, জেলা- পূর্ব বর্ধমান।
খুব সুন্দর
এই গ্রামে জন্ম গ্রহণ করে আমিও গর্বিত 🙏🙏
দারুণ ব্যাখ্যা দিলে দাদা… সত্যি আমাদের এই পুজো সব কিছুর থেকে আলাদা… আনন্দের শেষ নেই… আন্তরিকতার ও বটে… কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা সংস্কৃতি ও সংস্কার ছাড়া আমাদের “মা-Karandeswari” কিন্তু আমাদেরই… বহু যন্ত্রণা এবং কর্ম ব্যস্ততা উপেক্ষা করে বসে থাকি, প্রতীক্ষায় থাকি পরের বছর আবার ওই দিনটা কবে আসবে… সময়ের সাথে, সমাজের আধুনিকতার সাথে তাল মেলাতে গিয়ে কিছু পরিবর্তন তো হয়েছেই… তা সত্ত্বেও মেলবন্ধন এবং মিলন উৎসব-এর কোনো খামতি নেই বললেই চলে…
পরিশেষে অবশ্যই বলবো:- তোমার সুন্দর প্রতিস্থাপনা এবং দৃষ্টি আকর্ষণ আমাকে ও আমাদের কে সমৃদ্ধ করল…
Reserve the history of Karandeshari and tri to further in details.
Description is too much good and exactly.