১৯৭৯ সালে প্রথম পাকিস্তানি বিজ্ঞানী আবদুস সালাম পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন। বস্তুত এটিই ২০১২ সালের ‘হিগস বোসন’ কণা আবিষ্কারের ভিত্তি রচনা করেছিলো। এই কৃতিত্বের জন্য মি. সালামকে মনে রাখা উচিত ছিল। কিন্তু মনে রাখার বদলে মাত্র ৪০ বছরের মধ্যে নিজ জন্মভূমিই মি. সালামকে ভুলে গেছে। আর এভাবে ভুলে যাওয়ার প্রধান কারণ তার ধর্ম বিশ্বাস। কয়েক বছর আগে তার উপর নির্মিত একটি ডকুমেন্টারি নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেলে ডঃ সালামকে নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়৷ কে ছিলেন এই বিখ্যাত বিজ্ঞানী যিনি তার গুরুকে সম্মান জানাতে পাকিস্তান থেকে ছুটে আসেন কলকাতায়, যাকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান জানাতে চেয়ে ছিলেন? আসুন জেনে নিই।
অবিভক্ত পূর্ব পাঞ্জাবের ঝাং প্রদেশে এক শিক্ষিত সাধারণ পরিবারে জন্মেছিলেন সালাম। ধর্মীয় পন্ডিত ঠাকুরদা গুল মুহম্মদ ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী। বাবা ছিলেন অবিভক্ত পূর্ব পাঞ্জাবের শিক্ষা বিভাগের এক কর্তা। ছোট বয়স থেকেই সালামের প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই সালাম পাঞ্জাবী ইউনিভার্সিটি থেকে ম্যাট্রিক (প্রবেশিকা) পরীক্ষায় সর্বোচ্চ (রেকর্ড করা) নাম্বার পান। তিনি ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের লাহোর সরকারি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ বৃত্তি লাভ করেন। ইংরেজি উর্দু এবং গণিতে তার সমান আগ্রহ ছিল। ১৮ বছর বয়সেই প্রকাশ হয়েছিল তার প্রথম গবেষণা পত্র।
সালামের প্রথম গবেষণা পত্রের শিরোনাম ছিল ‘রামানুজনের একটি সমস্যা’। এটি মূলত রামানুজনের একটি গাণিতিক অত্যন্ত শ্রমসাধ্য সমস্যা যেটি সালাম অনেক সহজ পদ্ধতিতে সেটি সমাধান করেছিলেন।
এরপর সালাম পাড়ি দেন কেমব্রিজে। সেখানে গিয়ে কিছু অধ্যাপকের সাহায্য তিনি পেয়েছিলেন। তাদের সকলের সর্বাত্মক প্রচেষ্টাতেই একটি বৃত্তিও তিনি পেয়ে যান। এটি না হলে তার পক্ষে বিলেত যাওয়া এত সহজ ছিল না।
এর কয়েক বছর পরেই দেশে ফিরলেন সালাম। চোখে স্বপ্ন ছিল দেশকে বিজ্ঞান শেখাবেন। লাহোরে সরকারি কলেজে গণিত পড়াতে শুরু করেন। কিন্তু সেখানে শিক্ষা পরিকাঠামো ছিল অত্যন্ত দুর্বল, বিশেষ করে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে। এখানে বিজ্ঞানের তুলনায় ধর্মের প্রাধান্য বেশি ছিলো। শোনা যায়, কলেজে তাকে একটি ফুটবল দল চালাতে বাধ্য করেছিল। সালামের কাজটি পছন্দ না হলেও বেশ কয়েক বছর সেখানেই ছিলেন। এরপর পিএইচডি করতে ফের বিদেশ পাড়ি দেন।
সালটা ১৯৭৯, ‘ইলেক্ট্রোউইক ইউনিফিকেশন থিওরি’ সংক্রান্ত গবেষণার সম্মানস্বরূপ শেলডন গ্ল্যাশো ও স্টিভেন ওয়েনবার্গের সঙ্গে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পেলেন ডঃ আবদুস সালাম। এই প্রথম এক নোবেলজয়ীকে পেল পাকিস্তান। যদিও এই পুরস্কার তিনি অনেক আগেই পেতেন, কিন্তু এক প্রখ্যাত বিজ্ঞানীর ভুলপরামর্শে এই সুযোগ হাতছাড়া হয়েছিলো।
ভেক্টর বোসন কনার অস্তিত্ব সম্পর্কেও ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন সালাম যা পরবর্তী কালে আবিষ্কারও হয়েছিল। পাকিস্তানের বিজ্ঞানের ভিত তৈরি করতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন ডক্টর সালাম। দেশে কৃষিবিজ্ঞানে উন্নয়নের সাহায্যার্থে, পাকিস্তানের মহাকাশ ও উচ্চ বায়ুমণ্ডলের গবেষণা কমিশন বা সুপারকো (SUPARCO) গঠন এমনকি পারমাণবিক পরিকাঠামো তৈরির উদ্যোগও নেন। সালাম ১৯৬০ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ছিলেন, যে পদ থেকে তিনি দেশের বিজ্ঞান অবকাঠামোর উন্নয়নে একটি প্রধান এবং প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
এই আলোচনা প্রসঙ্গে তাঁর সমসাময়িক আরেকজন কিংবদন্তি বিজ্ঞানী নাম উল্লেখ করা দরকার — হোমি জাহাঙ্গীর। হোমি ভারতীয়, সালাম পাকিস্তানি। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দু-জনের পরিচয়। একে অপরের কাজের প্রশংসাও করতেন। দেশপ্রেমী দুই বিজ্ঞানীর লক্ষ্য ছিল নিজ নিজ দেশে পারমাণবিক চুল্লি তৈরি করার। দু-জনেই মনে করতেন পারমাণবিক শক্তি দিয়ে অত্যন্ত সস্তার বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। এতটাই সস্তার যে সরকার বিনামূল্যে সকলকে বিদ্যুৎ দিতে পারবে। পাকিস্তানে পরমাণু বোমা তৈরিতেও বড় ভূমিকা হিসেবে ছিলো সালামের।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে এত কিছু করা সত্ত্বেও পাকিস্তান তাকে কেন এত দূরে সরিয়ে দিল? উত্তর একটাই, ধর্মের রাজনীতি। উন্নয়নের জায়গাগুলিতে ধর্মকে প্রাধান্য দিয়েছিল পাকিস্তান। ডঃ আব্দুস সালাম ছিলেন একজন আহমদী।
পাকিস্তানে আহমদিয়াদের সমস্যা শুরু হয় মূলত ১৯৫৩ সালে। তখন লাহোরে বেশ কিছু সহিংস ঘটনা ঘটে। পাঞ্জাব সরকার সেই সময় মাত্র ২০ জন মারা যাওয়ার কথা বললেও সহিংসতায় নিহতের সংখ্যা ছিল আরও অনেক বেশি। ১৯৭৪ সালে তৎকালীন পাক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো আইন করে আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা করেন। কিছু অধিকার থেকেও তাদেরকে বঞ্চিত করা হয়। এই সময় ভুট্টোর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন সালাম কিন্তু সময় দেননি ভুট্টো। জিয়া-উল-হকের শাসনকালে আহমদীয়া সম্প্রদায়ের অবস্থা আরো খারাপ হয়, সেই অশান্ত সময়ে নোবেল জয়ী হয়ে পাকিস্তানের ফিরে আসেন সালাম।
১৯৮০ সালে জিয়াউল হক তাকে আমন্ত্রণ জানান এবং দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার ‘নিশান-ই-পাকিস্তান’ দেওয়া হয় তবে সংসদের বন্ধ অধিবেশনে লোকচক্ষুর আড়ালে। নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী কে অপমান করার কোন সুযোগই ছাড়েনি তার দেশ।
অসীম ধৈর্য ছিলো সালামের। নোবেল পাওয়ার পর ডঃ আবদুস সালাম ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ করেন ভারতে তার গণিত শিক্ষক অধ্যাপক অনিলেন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে একবার দেখা করার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য। ইন্দিরা গান্ধী অনুরোধ রাখলেন। দু’বছর ধরে খোঁজার পর কলকাতায় অধ্যাপকের খোঁজ পাওয়া গেলো। কে ছিলেন এই অনিলেন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়?
গত শতাব্দীর চল্লিশের দশক, অবিভক্ত ভারতের লাহোর কলেজে অঙ্কের অধ্যাপক ছিলেন অনিলেন্দ্রবাবু। অত্যন্ত মেধাবী কিন্তু বড্ড খামখেয়ালি সালামকে অঙ্কের মায়াজালে আবদ্ধ করলেন অধ্যাপক। ক্রমে তীব্র আকর্ষণ বাড়তে লাগলো অংকের প্রতি, অনিলেন্দ্রবাবুর প্রিয় ছাত্র হয়ে উঠলেন সালাম। এরপর বহু বছর কেটে গেছে, হয়েছে দেশভাগ। লাহোর ছেড়ে কলকাতায় চলে গেলেন অধ্যাপক আর বিদেশে গিয়ে পদার্থবিদ্যায় মজলেন ছাত্র।
অবশেষে ১৯৮১ সালের ১৯ জানুয়ারি কলকাতায় এসে সোজা গেলেন গুরুর বাড়িতে। বার্ধক্যের ভারে ন্যুব্জ অনিলেন্দ্রবাবুর হাতে তুলে দেন গুরুদক্ষিণা — নোবেল পদক। প্রিয় অধ্যাপককে প্রণাম করে বললেন, ‘স্যার এই পুরস্কার আপনারই প্রাপ্য’।
এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক সালামকে ‘দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী স্বর্ণপদক’-এ ভূষিত করতে চাইলে তিনি তার শিক্ষক অনিলেন্দ্রনাথের যোগ্য সম্মান প্রদানের আগে পদক গ্রহণ করার অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। ২১ জানুয়ারি, ১৯৮১ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় “এমিনেন্ট টিচার অ্যাওয়ার্ড” অনিলেন্দ্রনাথকে সাউথ চক্রবেড়িয়া রোডে তাঁর বাসভবনে সালামের উপস্থিতিতে প্রথম পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করা হয়। সেই সুখস্মৃতি বহন করেই ১৯৮২ সালে প্রয়াত হয় অনিলেন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়।
আবদুস সালাম ১৯৯৬ সালের ২১ নভেম্বর ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে ৭০ বছর বয়সে মারা যান। তার মৃতদেহ পাকিস্তানে ফিরিয়ে আনা হয় এবং সালামকে কবর দেওয়া হয় তার বাবা-মায়ের কবরের পাশে। তার সমাধির এপিটাফে প্রথমে লেখা ছিল “প্রথম মুসলিম নোবেল বিজয়ী” কিন্ত পাকিস্তান সরকার “মুসলিম” মুছে ফেলে এবং মাথার পাথরে শুধুমাত্র তার নাম রেখেছে।
গুরু হলেন সেই মানুষ যিনি আমাদের শিক্ষার আলো, জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত করেন।গুরু-শিষ্যের সম্পর্কই এমন। এই সম্পর্ককে অবিস্মরণীয় করে রাখলেন ডাক্তার আব্দুস সালাম।
জ্ঞানের আলো সুর্য সম।জ্ঞান বিজ্ঞানের অন্য নাম।যখনই ধর্মের শৃঙ্খলে বিজ্ঞান
অথবা জ্ঞানকে বাঁধবার প্রচেষ্টা হয়েছে তখনই শিক্ষা আর জ্ঞানের আলোক থেকে
চেতনা বিবেকের বিকাশ বাধা প্রাপ্ত হয়ে অন্ধকারময় জগতের সৃষ্টি করেছে।এই
প্রতিবেদন পাঠ অত্যন্ত আবশ্যকীয়।সবাই জানতে বুঝতে পারবে সূর্যের আলোকে
যেমন হাত দিয়ে রোখা যায় না তেমনই জ্ঞান বিজ্ঞানের আলো থেকে কাউকেই
দুরে রাখা বা বঞ্চিত করার অন্য নাম অন্ধকার।
তাই ‘সালাম’ প্রতিবন্ধিত হন নিজ দেশে,কিন্তু তার সৃষ্টি করা বিজ্ঞানের আলোর
প্রভাব দেশ থেকে দেশান্তরেও পুজিত সন্মানিত।তিনি শেখাননি শেখেননি জাত
পাত ধর্মের ক্ষুদ্র বেড়াজালে নিজেকে আবদ্ধ রাখতে তাই ছুটে এসেছেন গুরু ভক্তি গুরু প্রণামে।
ভালোলেখা ভালোলাগা ভালোবাসা।।