“দেওয়ালে কপাল ঠুকে নিজেকেই জন্মাবে আবার
কোনোক্রমে
তোমার এ ইচ্ছা ছিল। পাওনি কোথাও
অভ্যর্থনা। ” (“জগদীশ গুপ্ত ” — মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়)
কবি মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় “জগদীশ গুপ্ত” কবিতার দুটি পংক্তির মধ্য দিয়েই ব্যাখ্যা করে নিয়েছেন জগদীশ গুপ্তের গল্পের বিশেষতা ও তাঁর মনোপ্রকৃতির। জনপ্রিয়তা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা লেখক মাত্রেরই থাকে। কিন্তু কিছু লেখক সমসময়ের থেকে এগিয়ে থাকার কারণে এবং লেখ্য জগতের নানাবিধ গ্রন্থিল জটিলতার কারণে পাঠকপ্রিয়তা পান না।
জগদীশ গুপ্ত “কল্লোল” সমকালীন। কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকরা রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রকেন্দ্রিক পরিমন্ডলে পাঠকের দৃষ্টির আচ্ছন্নতা ভাঙবার জন্যে অভিজাত ও মধ্যবিত্তের ভাবপ্রবণতাকে ভাঙতে শুরু করলেন অনেকটা যেন হাতুড়ির আওয়াজে। তাঁদের লেখায় ব্রাত্যজনেরা ভিন্নতর মূল্যবোধ নিয়ে কোলাহল করতে করতে যেভাবে সাহিত্য জগতে ভিড় জমাতে লাগল, জগদীশ গুপ্ত কিন্তু ঐ পথ দিয়েই গেলেন না, আলাদা হয়ে একা একাই তাঁর নিজস্ব আলো নিয়ে নিজের পথেই চললেন। এ যেন এক সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র প্রবাহ, উৎস থেকে পরিণামে একেবারেই একক। তাঁর সেই চলার পথ সাধারণের জন্যে অবশ্য উন্মুক্ত অবারিত হলো না।
জগদীশ গুপ্তের বাচনভঙ্গি ঝরঝরে, আকর্ষক গদ্যে তা মোহময়, তবু যে তা বৃহত্তর পাঠকশ্রেণীর কাছে সেভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেল না, তা হতে পারে তার চরিত্রের মনোবিশ্লেষক লেখনির দুরূহতার জন্যে, অথবা সময় থেকে অনেকটা অগ্রসর গল্পভাবনার জন্যে।
জগদীশ গুপ্তের দৃষ্টিটাই বুঝিবা বক্র ছিল। তাই সমাজের অন্ধকার, মনের গভীরের অন্ধকারের গোপন কুঠুরিগুলি উন্মোচনে তাঁর কলমের তির্যকতা লক্ষণীয়ভাবে মগ্ন পাঠককে আলোড়িত করে।
তাঁর স্ত্রী চারুবালা গুপ্ত বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেন, — “আমার শ্বশুরবাড়ির খুব কাছেই, মানে বাড়ির জানালা দিয়ে দেখা যেত, একটা ছোট পতিতাপল্লী। পরে আগুন লেগে ওদের ঘরগুলো পুড়ে যায়।…. খুব ছোট বয়সে অন্তত ওঁর ৩/৪ বৎসর বয়স পর্যন্ত এই পতিতাদের কেউ কেউ ওঁকে খুব আদরযত্ন করে সারাদিন কাছে রেখে দিত। একবার ছোটবেলায় উনি ড্রেনের মধ্যে পড়ে যান। ওরাই ওঁকে ড্রেন থেকে তুলে বাঁচায়। (স্ত্রীর চোখে লেখক জগদীশ গুপ্ত)।
অর্থাৎ জগদীশ গুপ্ত এই পতিতাদের অতি কাছ থেকে দেখার সুযোগ ছোটবেলাতেই পেয়েছেন। এইসব হতভাগ্য নারীদের কোমল হৃদয়বৃত্তির উষ্ণতা তাঁকে স্পর্শ করেছে। তিনি এই জিজ্ঞাসায় জর্জরিত হয়েছেন কেন এরা সুস্থ জীবন পেল না! যে সমাজ নারীকে পণ্যে পরিণত করতে বাধ্য করে, সেই সমাজের লেখকের দৃষ্টি তো বাঁকা হবেই, নৈরাশ্য এসে তাঁর লেখনির মুখে দানা বাঁধবেই। তাই কি তাঁর চরিত্ররা এমন সব মনোভাব নিয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়ায়, যে মনোভাব মানুষের মনের নিষ্ঠুর ও নৃশংস অংশটির দিকে দিকনির্দেশ করে। হয়তো ছোটবেলাতেই সামাজিক অন্যায়ের প্রতিচ্ছবি ঘনিষ্ঠভাবে অবলোকন করে তিনি আর সরলরেখায় জীবনকে দেখতে পারেননি। তাই কখনও কখনও নিষ্ঠুরতা ও জান্তব প্রবৃত্তি তাঁর গল্পে কেন্দ্রীয় হয়ে দাঁড়ায়।
সামাজিক অসমবিন্যাসের ফলে উৎপন্ন অন্যায় থেকে সৃষ্টি হয়েছে পতিতাদের। যারা তাদের সৃষ্টি করেছে তারাই তাদের তীব্র ঘৃণা দিয়ে আলাদা করে রাখে, সুস্থ জীবনে ফিরে যেতে দেয় না। সেজন্যে তাঁর গল্পে দাম্পত্য সম্পর্কগুলি চিরন্তন মানবিক মূল্যবোধের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে না। বরং গল্পকার বিশেষ বিশেষ পুরুষ চরিত্রের লালসাতাড়িত অংশকে টেনে বাইরে নিয়ে আসেন আর তাঁর কলমের অগ্রভাগের বঙ্কিমতা দেখায় আসলে বিবাহিত নারীরা পতিতাদের চাইতে কোনও অংশে সঠিক অবস্থানে নয়। (‘বিধবা রতিমঞ্জরী’, ’কলঙ্কিত সম্পর্ক’, ‘চন্দ্রসূর্য যতদিন’)।
তাঁর গল্পের স্তরে স্তরে জড়িয়ে আছে ব্যাধিগ্রস্ততা এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁর সৃষ্ট পুরুষ চরিত্রের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। নারীজীবনের অসহায়তা লেখককে ভাবিয়েছে, লেখককে স্বস্তি দেয়নি, তাই তাঁর সৃষ্ট নারীরা পুরুষের পাশব কামপ্রবৃত্তিরর সাথেই পরিচিত হয়েছে শুধু, তাঁদের ভালবাসার কোমল স্পর্শ কোথাও খুঁজে পায়নি। এরই প্রেক্ষিতে তাদের মনোলোক এক নতুন মাত্রা পেয়েছে, তারা নতুনভাবে ভাবে আর পাঠককে ভাবায়। এখানেই তাঁর গল্পে আজকের যুগের পাঠক এমন কিছু খুঁজে পান যা আজকের জটিল জীবনাবর্তের সঙ্গে অনেকটা সামঞ্জস্যপূর্ণ।
“বিধবা রতিমঞ্জরী” গল্পটির শুরু এইভাবে — “রতিমঞ্জরী শেষ পর্যন্ত বিধবা হবেই, কারণ স্বামীকে যে রোগে ধরেছে- তার শক্তি যেমন প্রচুর, তেমনি দুর্নিবার এবং ওদিকে স্বামীর রক্তকণিকায় আর স্নায়ুতে বিদ্যুৎগর্ভ যে দুরন্ত তেজ বেরোবার কথাই নয়, যে তেজ শম্বুকগতি রোগের এই শোকের পলে পলে জীবনক্ষয়ের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। সুতরাং অক্ষয় মরবে এবং রতিমঞ্জরী বিধবা হবে। ভরসা দিলেন অর্বাচীন কেউ নয়, চিকিৎসকেরা।”
এই-ই লেখকের কথনভঙ্গির নিজস্বতা। যদি লক্ষ করি “ভরসা” শব্দটির অমোঘ প্রয়োগ, তাহলে দেখা যাবে এই একটি শব্দের ব্যঞ্জনা আমাদের অনেক কথাই বলে দিচ্ছে। মৃত্যুর “নিদান” আসে চিকিৎসকের তরফ থেকে “ভরসা” নয়। শব্দটি ব্যঞ্জনার্থে পাঠককে বুঝিয়ে দেয়, রতিমঞ্জরী আসলে স্বামীর হাত থেকে মুক্তি চাইছে।
জীবনের অন্তিম পর্যায়ে অক্ষয় স্ত্রীকে কাছে ডাকে, রতি আসে। অক্ষয় প্রশ্ন করে, “তুমি তো আমার ডাকে ব্যস্ত হয়ে ছুটে এলে না রতি।” রতি তা আসেনি, তাই অসংকোচে বলে, “তাই তো এলাম।” মৃত্যুপথযাত্রী অক্ষয় স্ত্রীকে বলে,” তুমি আমার মুখের দিকে চেয়ে এখানে বসো-আমি তোমার মুখের সুধা পান করি।”
একথা শুনে রতির হাসি পায়, যদিও হাসিকে সে ফুটিয়ে তোলে না। সে জানে, অক্ষয়ের নারীর মুখের সুধা পান করার তৃষ্ণা প্রবল, এতই প্রবল যে তার মৃত সন্তান ভূমিষ্ট হয়েছিল বলে অক্ষয় আনন্দের উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে না পেরে পুলকোচ্ছাস স্ত্রীকে ব্যক্ত করে ফেলেছিল, অব্যাহত সুধাপানের পুলক। সেই অক্ষয়ের চিতাগ্নির ধোঁয়া যখন শূন্যমার্গে কুন্ডলায়িত হয়ে উপরিস্তরকে ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন করে তুলল, অগ্নিশিখা যখন বাতাসকে কম্পিত করে এক মরীচিকার সৃষ্টি করল, রতির মনে হলো মৃত্যুর পর চিতাগ্নির এই মরীচিকা অনেক বেশি নির্লিপ্ত ও নির্দোষ, বাস্তবের মরীচিকার চাইতেও, বাস্তবের মরীচিকার মিথ্যা প্রতারণা এতে নেই।
শয়নকক্ষে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রতির মনে হলো বৈধব্যের এই রূপ যেন তাকে নতুন করে জন্ম দিয়েছে। এতদিন তাকে ঘিরে ছিলো যে সৌভাগ্যের শৃঙ্খল, সেই শৃঙ্খল খসে পড়ায় ফুটে উঠেছে রতিমঞ্জরীর নূতনতর রূপ, এও যেন মন্দ নয়। রতির ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে একচিলতে হাসি, ঠিক এমনি সময়ে ঘরে ঢোকে রতির ছোটবোন মনোমঞ্জরী। সদ্য বিধবা রতির এই হাসি মনোর চোখ এড়িয়ে যায় না। হাসিটি আঘাত করে তাকে তার চিরাচরিত সংস্কারবোধে। সে ভাবতে পারে না কী করে তার দিদি এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে হাসতে পারে!
৷অক্ষয়ের বহুনারী চর্চিত জীবনের ভার রতি যেন ভারাক্রান্ত গর্দভের মত বহন করছিল। তার মনে হয় ঐ লোকটার সাথে বিবাহের পর থেকে শুরু হয়েছিল তাঁর বৈধব্য। এখন সে সেই বৈধব্য থেকে ভারমুক্ত হয়েছে। লেখকের এই সময় থেকে অনেকটা অগ্রসর চিন্তা হয়তো সেভাবে পাঠকেরা মেনে নিতে পারেননি। আমাদের সমাজশাসিত যাপনের জগদ্দল সংস্কার অন্তত এইকথাই বলে।
রতি বিবাহিত জীবন চেয়েছিল, চেয়েছিল যথার্থ জীবনসঙ্গী, যেখানে পাবে সে সঠিক স্ত্রীর মর্যাদা। কিন্তু তা পায় নি সে, তার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল।
এখন অক্ষয়ের মৃত্যুর পর ছাব্বিশ বছরের রতিমঞ্জরীর মন ধর্মের উদ্দেশ্যে চালিত করার উদ্দেশ্যে বোন, পাড়া-প্রতিবেশি, কারোরই ভাবনার আর অন্ত নেই, রামায়ণ পাঠ করে তাকে শোনানো হচ্ছে, রতি অবশ্য এতে কোনও বাধা দেয়নি, তার বৈধব্যবেশও ত্যাগ করেনি, বরং ব্যবহারে তাকে পাওয়া গেছে অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ।
বিপত্নীক পুরুষ ও বিধবা উভয়ের মধ্যে যে সামাজিক অবস্থানগত বিষম পার্থক্য রয়েছে লেখক তা সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে বারংবার বোঝাতে চেয়েছেন-
“পুরুষ বিপত্নীক হলে তাকে বিপত্নীক সেজে থাকতে হবে, এমন কোনো প্রথা নাই, নারী বিধবা হলে তার বিধবা সাজবার একটা তোড়জোড়ই দেখা যায়, পথেঘাটে বিপত্নীক পুরুষকে দেখে মহিমান্বিত ত্যাগের নিদর্শনে বুঝবার উপায় নাই যে লোকটির স্ত্রী নাই.. নারী আর পুরুষের এই যে পার্থক্য, একজনের পক্ষে নেহাৎ হেলাফেলা, এর ভিতর পরাধীনতার বন্ধন আর স্বাধীনতার হামখোদাই খেয়াল আছে, আর আছে অভদ্র একটি ইঙ্গিত।”
এই বদ্ধমূল সামাজিক সংস্কারের মূলে কুঠারাঘাত করেছে চল্লিশের দশকের রতিমঞ্জরী দাসী। সবাই ঈশ্বরের দিকে মনোসংযোগ করতে অনুরোধ করেছে রতিকে, মানুষকে আহ্বান করতে কেউ বলছে না। অক্ষয় নামের ব্যক্তিটিকে সমাজ তার জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছে স্বামী পরিচয়ে, অথচ যাকে সে যথার্থ স্বামী হিসেবে পায়নি, সেই ব্যক্তির মৃত্যুর পর তাকে স্বতই বলা হচ্ছে ব্রহ্মচর্য পালন করো। কী অদ্ভুত আর অন্যায় এই সমাজের নির্দেশ। রতির মনে হয় –
“সবাই বলছে, দেবতাকে ডাকো, দেবতাকে জানো, দেবতাকে ভালবাসো, দেবতাকে ঘরে আনো, দেবকাহিনি বলো আর শ্রবণ করো। মানুষকে ডাকতে কেউ বলছে না।…. কিন্তু মানুষের মতো অপরূপ আর মনোহর কোন দেবতা! কোনো দেবতার মূর্তিকে মানুষের মূর্তির মতো অন্তরে প্লাবিত হয়ে সুশ্রী হতে কেউ দেখে নাই। সুগঠিত আর মর্মবান আর অন্তরচারী মর্মবিদ মানুষ যে হয় আর যদি আত্মদানের উন্মুখতা হৃদয়ঙ্গম করে সে আহ্বানে সাড়া দেয়, তবে তার মতো শান্তিপ্রদ আর কোন দেবতা হতে পারেন!…. দেবতার রূপান্তর নাই, ভাবাবেগ নাই, আবেশ নাই, আগ্রহ নাই — দেবতা দিতে পারেন সীমাবদ্ধতা, বন্দীত্ব আর অচেতন মগ্ন জীবন, কেবল মানুষই দিতে পারে সাড়া পাওয়ার সজীব আনন্দ। দেবতা একঘেয়ে নিজেই নিষ্প্রাণ।”
রতি তাই সমস্ত সংস্কারের নিগড় ভেঙে খোলাখুলি বিদ্রোহ করে। কাগজে বিবাহের জন্যে বিজ্ঞাপন দেয়। সে অন্তর থেকে চেয়েছিল, অথচ পায়নি তাকেই পুনরুদ্ধারের আশায় তার এই নবীন প্রচেষ্টা। স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞাপনটি সাড়া তুলে চারদিকে, বিচিত্র ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ হয় এই রতিমঞ্জরী দাসী সম্বন্ধে। তার বাহ্যিক রূপ, সামাজিক অবস্থান সম্বন্ধে চলতে থাকে সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম আলোচনা। তাই রতির বিজ্ঞাপনের উত্তরে প্রথমেই আসে গালাগালি দেওয়া কুৎসিত চিঠি। এদিকে ছোটবোন মনোমঞ্জরী আসে রতিমঞ্জরীকে দুয়ো দিতে। চিঠি ও ছোটবোনের অভিমত কিন্তু খুব সহজভাবেই গ্রহণ করে রতিমঞ্জরী কারণ এই সমাজ ও তার প্রতিটি তন্তুজালে আটকে থাকা মেয়েদের সে চেনে। এরকমটি যে হবে তা যেন রতির জানাই ছিল, সুতরাং এতে ক্ষুণ্ণ হবার কিছুই নেই।
এবার বিজ্ঞাপনের উত্তরে এগিয়ে যে আসে সে এক মৃতদার ব্যক্তি, ঘরে তার গুটিকয়েক ছেলেমেয়ে আছে, তাদের দেখাশোনার জন্যে এবং নিজের প্রয়োজনেও স্ত্রীলোকের প্রয়োজন। বছর চল্লিশের সেই মোহনবাবু সামান্য বেতনের চাকুরি করেন, অফিসের বড়বাবুর কাছ থেকে তিনি শিখেছেন কীভাবে সামান্য তথ্য থেকে ভিতরের খবরটিকে টেনে বের করে আনা যায়। তাই বিজ্ঞাপন থেকে মোহনবাবুর বিশ্লেষিত তথ্য এইরূপ — রতিমঞ্জরীর টাকা আছে, টাকা না থাকলে কেউ অহেতুক শত্রুসৃষ্টি করতে সাহস পায় না, পেটের দায়ে কোন বিধবা কদাপি বিয়ে করেছে বলে তিনি শোনেননি। সন্তানাদি যে বর্তমানে নেই এটা খুব সুবিধাজনক তার জন্যে।দেখতে নিশ্চয়ই ভালো নয়, কালো হয়তো, মোটা, কিছুটা ট্যারাও হতে পারে। অত:পর বন্ধুবর্গের সাথে আলোচনার পরিসমাপ্তিতে সংক্ষিপ্তসার এই দাঁড়ায় স্বামী যখন রতিমঞ্জরীর ছিল নিশ্চয়ই সেখানে ভালোবাসা জন্মেছিল। সামাজিক সকল সংস্কারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যে আবার বিয়ে করতে চাইছে তার মানে এটা হতেই পারে স্বামী যখন তার বেঁচে ছিল তখনই নিশ্চয় ভালবাসা ফুরিয়ে গিয়েছিল, কেন তার কারণটা খুঁজতে যাওয়া অন্যায়, কেননা তিনি ভদ্রমহিলা। মেয়েরাই পুরুষকে সংস্কারের বন্ধনে বেঁধে রাখে, সেই সংস্কারকে ছিন্ন করতে যে মেয়ে দ্বিধাবোধ করে না, তার কাজকে ঢাকঢোল পিটিয়ে তারিফ করা যায়, তবে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করা যায় না।
রতিমঞ্জরী মোহনকে দেখেই চিনতে পারে। সমস্ত অনুভূতি মথিত করে সৃষ্টি হয় নিরবচ্ছিন্ন যন্ত্রণা এবং বেদনার। সে বুঝতে পারে সমস্ত হৃদয়মথিত আহ্বানের দ্বারা যাকে সে টেনে এনেছে সে মানুষ নয়, কীট। সে আজ যাচাই করতে এসেছে তাকে পণ্য হিসেবে।
লেখক আগেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন মোহনের। আরও সুস্পষ্ট পরিচয় করালেন রতির বৈঠকখানার দেওয়ালে একটি ছবি দেখে মোহনের মানসিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে। ছবিটিতে একটি সাহেব এবং মেমসাহেবের মধ্যে কথা হচ্ছে, সাহেবের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে কোনও গুরুতর কথা সে মেমসাহেবকে বোঝাচ্ছে। মোহনের ছবিটি দেখে ভালো লাগল এবং সে তার ভালোলাগা ব্যক্ত করল এইভাবে — “বেটাছেলের মেয়েটাকে ফুসলে নিয়ে পালাবার চেষ্টা…. ”
মোহনের মত মানুষ, যে নিজের বৃত্তের বাইরের পৃথিবীকে জানে না বা জানবার আগ্রহও নেই, তার পক্ষে রতির বিধবার বেশ ধারণ করে ঘরে ঢোকার অর্থ বুঝতে পারে না। যে বিধবা বিবাহের জন্যে কাগজে বিজ্ঞাপন দেবার সাহস রাখে, তার ব্রহ্মচারিণীর বেশ ধারণ করার তাৎপর্য কি ভেবে ভেবে থই পায় না মোহন।
প্রশ্ন সে করার আগেই রতিমঞ্জরী প্রশ্নোত্তর পর্বের মুখ্য ভূমিকা নেয়। অপরিসীম আক্রোশে রতির প্রশ্নাবলীতে মোহন ভয়, সংশয়, বিস্ময়, হতাশায় দোলায়িত হতে হতে শোনে —
“আপনার স্ত্রীকে খুব ভালবাসতেন?”
“বিয়ে করে স্ত্রীকে দিয়ে সুলভ গণিকাবৃত্তি করিয়েছেন?”
“বিয়ে না করে রক্ষিতা রাখেননি কেন?
মোহন বুঝতে পারে না রতিমঞ্জরী সমগ্র পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আঘাত করতে চাইছে। সে অপমানিত হয়ে ফিরে যায়।
রতির জীবনে আসে না কোনো সজীব বসন্ত, সুস্থ, মাধুর্যময় জীবনের হাতছানি। পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ক্রুরতার যন্ত্রণায় নীল হয়ে রতি নিজের অতীত এবং বর্তমান জীবনের ঘটনাবলীকে পরপর সাজিয়ে ভাবে —
“ক্রুর দুরভিসন্ধি এবং নির্লজ্জ লাম্পট্য নিয়ে স্বামী তাকে চেয়েছিলেন এবং পেয়েছিলেন….. কিন্তু তিনি তাকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করে গেছেন।….এই ব্যক্তি এসেছিল তারই দোসর হয়ে, পাপের দ্বিতীয় দূত হয়ে, তাকে দ্বিতীয়বার গণিকাবৃত্তিতে প্ররোচিত করতে…”
এই সমাজ রতিকে সুস্থ জীবন দিতে রাজি নয়, তার গণিকাবৃত্তিই সে চায়। সুতরাং সে গণিকাই হবে। পাড়াপ্রতিবেশি এইসব ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে রতিকে গণিকার আসনে বসিয়ে দিয়েছে, রতিও নিজেকে তাই ভাবে। এরপর শুরু হয় রতির কৃচ্ছসাধন।
“একদা একটি লোক গণিকাগৃহ থেকে এসে তাকে গণিকা সাজিয়ে অশুচিতা দিয়ে গেছে, সেই অসহ্য অশুচিতা সে অবিরাম পরিত্যাগ করবার কৃচ্ছ্রব্রত পালন করছে…..”
“বিধবা রতিমঞ্জরী” গল্পটি প্রকাশিত হয় “প্রবর্তক” পত্রিকায় ১৩৩৬ বঙ্গাব্দে। সেই সময়ের নিরিখে জগদীশ গুপ্তের এই অগ্রসর ভাবনা এই পাঠককে আজও বিস্মিত করে। তাঁর মানবিক দৃষ্টিকোণ সংস্কারবর্জিত ও জগদ্দল পাথরের মত সমাজের বুকে চেপে থাকা অনমনীয় অপসংস্কারকে দেখার চোখ গল্পভাবনার চিরাচরিত ভিতটাকে নাড়িয়ে দেয়। [ক্রমশ]