শ্যামবাজার যে আদতে নুনের বাজার ছিল এটা কলকাতা বিষয়ক কোনও বইয়েই নেই।
উত্তর কলকাতার এই শ্যামবাজার এক জমজমাট জায়গা। শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় তো এক ঐতিহাসিক স্পট। পাঁচটি রাস্তার সংযোগ স্থলের ঢিল ছোঁড়াদূরত্বে অবস্থিত যে বাজার, তারই নাম শ্যামবাজার। বহুদিনের পুরনো বাজার। কথিত আছে প্রাচীন কলকাতার ধনাঢ্য ব্যক্তি শোভারাম বসাকের গৃহদেবতা শ্যামরায়ের নাম থেকেই নাকি শ্যামবাজার নামটি এসেছে। অনেকে আবার বলেন শোভারাম বসাকের কাকা শ্যাম বসাকের নাম থেকে এসেছে শ্যামবাজার নাম। আবার কলকাতা বিশেষজ্ঞ প্রাণকৃষ্ণ দত্ত বলেছেন, শ্যামলাল মুখোপাধ্যায় নামে এক নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের নাম থেকেই নাকি এই নাম। যাই হোক ইংরেজ প্রশাসন একবার শ্যামবাজারের নাম পাল্টে চার্লসবাজার রেখেছিল। শোভারাম বসাক তখন প্রচুর আইনি লড়াই লড়ে শ্যামবাজার নাম পুনর্বহাল করেন।
শ্যামবাজার নামটি কেন হল, তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে অভিধানগুলি ঘাঁটতেই হয়। বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ ‘শ্যাম’ শব্দটির একটি অর্থ হল সামুদ্রিক লবণ। পুরনো কলকাতার অনেক ব্যবসায়ীই বিলেতি নুনের ব্যবসা করে ফুলেফেঁপে উঠেছিলেন।
সপ্তদশ শতকে শেঠ-বসাক পরিবার কলকাতার জঙ্গল কাটিয়ে সুতানুটির হাটের পত্তন করেছিলেন। বসাক বংশের প্রধান পুরুষ শোভারাম বসাক। তাঁর বাড়ি বড়োবাজার বা কলুটোলায় হলেও তাঁর ব্যবসাসাম্রাজ্য ছড়িয়ে ছিল সমগ্র উত্তর কলকাতা জুড়ে। শুধু সুতা ও কাপড়ের ব্যবসাই নয়, তাঁর ছিল সামুদ্রিক লবণের ব্যবসাও।
শোভারাম ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে মারা যান। তাঁর দুই পুত্র হরিমোহন এবং মদনমোহন ছিলেন তাঁর ব্যবসা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। শোভারাম তার উত্তরাধিকারীদের জন্য একটি বিশাল সম্পত্তি রেখে যান যার মধ্যে একত্রিশটি বাড়ি এবং আটটি বাগান ছিল। তিনি একটি সফল ব্যবসাও রেখে গেছেন। তাঁর ব্যবসায়িক হিসাব থেকে জানা যায়, পঁচিশ হাজার দুইশ কেজি সুতি কাপড়, তেরো হাজার আটশ কেজি সুতা, একশ কেজি সিল্ক, তিন লাখ নিরানব্বই কেজি লবণ, আটানব্বই কেজি মুক্তা, একশো তেরোটি হীরা, পঁয়ত্রিশটি রুবি, অঢেল সোনার মুদ্রা এবং নগদ টাকা। তিনি পাঁচ লাখ সাতাশ হাজার একশ বারো টাকার বন্ডও রেখে গিয়েছিলেন। তখনকার যুগে এটি এক উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ এবং সম্পত্তি।
বউবাজারের বিশ্বনাথ মতিলাল ছিলেন নামকরা লবণব্যবসায়ীদের একজন। যদিও আদতে তিনি জয়নগর-মজিলপুরের লোক। তেমনই হুগলি থেকে উত্তর কলকাতায় আসা বসুপরিবারের ছিল নুনের ব্যবসা। এই পরিবারের কৃষ্ণরাম বসু নুনের ব্যবসা করে বড়লোক বনে যান। ১৭৭১ সালে শ্যামবাজার এলাকায় বিরাট বসতবাড়ি, জোড়াশিবের মন্দির তৈরি করেন। বাড়িসংলগ্ন বিরাট পুকুর কাটান। তাঁর বাড়ি এখন আর নেই। এখন সেখানে শ্যামবাজার ট্রাম ডিপো। শ্যামবাজার অঞ্চলের নুনের আড়তগুলি ছিল বেলগাছিয়ার দিকে। এই অঞ্চলের আরও অনেকে সামুদ্রিক লবণের ব্যবসা করেছেন। বসুপরিবারের আগে থেকেই এই ব্যবসার রমরমা ছিল এখানে। শ্যাম তথা লবণের বাজার ছিল বলেই বাজারের নাম হয়েছিল শ্যামবাজার। পরে পুরো এলাকাটিই শ্যামবাজার নামে পরিচিত হয়।