অনেককেই বলতে শুনেছি পচা ভাদ্রের কথা। বছরের এই একটা মাসকে নিয়ে মানুষের মনের ভিতর ভয়। কেন জানিনা ভাদ্র মাস এলেই মনটা ভালো থাকে না গ্রামবাংলার মানুষের। খেটে-খাওয়া মানুষের কাছে এই মাসে কোনও কাজ থাকে না। আর কাজ নেই বলে লক্ষ্মীর ঝাঁপিও খালি।এই সময় যত ভাইরাস, ভাইরালের দাপট। আর দাপট অভাবী দৈত্যের। ভাদ্র মাসে সব দিকে টান। আসলে ব্যয় হয়ে যায় চাষিদের প্রধান চাষের খরচে। যেটুকু সম্বল থাকে সবই মাঠে চলে যায়। এরপর শূন্যহাতে অপেক্ষা। রসদ থাকে না।
এ সময় খুব সন্তর্পণে দিন কাটাতে হয়। এমনকি এ ধারণাও প্রচলিত আছে যে, ভাদ্রমাসে বাড়ি ছেড়ে কেউ কোথাও যাবে না অন্যত্র। আবার বাড়ির গরু, ছাগল ও অন্যান্য পশুদেরও তাড়াতে নেই। অশুভ মাস বাঙালিদের কাছে। কোনও শুভ কাজ হয় না। অসুখ-বিসুখ, অভাবের তাড়নায় জেরবার মানুষ। কেন এমনটা হয়। জানা নেই। এর জন্য প্রকৃতি দায়ী! নাকি মানুষই তাদের সমস্যা তৈরি করে? এর উত্তর আজও পাই না। তবে এত দুঃখকষ্টের মধ্যে কিছুটা হলেও শাস্তির প্রলেপ দেবার কিছু রীতি প্রথা আজও রয়ে গিয়েছে। বারো মাসে তেরো পার্বণ। এই পচা ভাদ্রে বাঁচার পথও প্রকৃতি কিংবা মানুষের সৃষ্টি আচার-প্রথা আলোর পথ দেখিয়েছে। কী সেই পথ?
পচা ভাদ্র হলেও, এমন কিছু আচার-প্রথা আছে যা দুঃখের মাসেও বাঁচার স্বপ্ন দেখায়। এই মাসেই সারা বছর সুস্থ ও নিরাময় থাকার কিছু পন্থা। মুখ্য পন্থা হল এই মাসে ‘পান্তাভাত’ খাবার প্রথা। আঞ্চলিক ভিত্তিতে এর নামও দেওয়া হয়েছে। কেউ বলছেন ‘ইচ্ছা রান্না’ কেউ বলছেন ‘বুড়ো রান্না’ আবার কারও কাছে ‘আরাঁধা’, বা ‘রোগ নিরাময়ের পান্তা’। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, ভাদ্র মাসে পান্তাভাত গ্ৰামের সকলের কাছে প্রিয়। আগের দিন বাড়ির মা-কাকিমারা গরমভাত করে ঠান্ডা করেন। এরপর সেই ঠান্ডা ডাতে জল দিয়ে তার সঙ্গে গোঁড়ালেবু বা সুগন্ধীলেবুর রস দিয়ে ঢেকে রাখা। আর এক ডজন ভাজা। আলু, পটল, মূলো, করলা, চিচিঙ্গা, কুমড়ো, ওলের ফুলুরি, মাছ, নারকেল ইত্যাদি ভাজা হবে। তবে তা আগের দিন। পরের দিন খাওয়া।
পান্তাভাত সহযোগে বিভিন্ন ধরনের ভাজা ভোগরূপে মা মনসাকে নিবেদন করার প্রথা কোথাও কোথাও আছে। গ্রামে-গঞ্জে এ যেন ‘পান্তাভাতের উৎসব। সারা ভাদ্রমাস ধরে চলে। কেউ সংক্রান্তিতে, কেউবা পছন্দ মতো দিনে ব্যবস্থা করেন। আনন্দের কথা হল এই পচা ভাদ্রেও প্রায় প্রতিটি বাড়িতে পান্তা ভাতের আয়োজন। অতিথিদের পাশাপাশি গরিব, দুঃস্থদেরও আমন্ত্রণ। আবার সম্প্রীতির নজর কাড়ে, যখন দেখি গ্রামের রহমত, আমজাদ, আল্লারাখা, সেলিমাবিবিদের মতো মানুষও হিন্দু পরিবারের সঙ্গে একই পঙক্তিতে পান্তাভাত খাচ্ছেন। এটা খেলে নাকি সারা বছর নীরোগ থাকা যায়। এটা দেখে মনে হয় দুঃখের বা কষ্টের মাসেও এক সঙ্গে মিলন বোধহয় আনন্দের বার্তা বয়ে আনে।
‘পচাভাদ্র’ এই দুর্নাম ঘোচাতেই বোধহয় জোটবন্ধন। আর তা ‘পান্তাভাত’ দিয়েই। অনেককেই বলতে শুনেছি একদিন পান্তাভাত খেলে শরীরের আলাদা স্বাদ ও অনুভূতি এনে দেয়। যেন সুস্থ হয়ে ওঠে শরীর। জানি না সারা বছর সবাই কতটা সুস্থ থাকেন! তবে এটা বুঝেছি অভাব-অনটনে সকল মানুষ যদি পাশাপাশি এসে দাঁড়ান, তাহলে একটা বাঁচার পথ খুঁজে পাওয়া যায়। ‘পান্তাভাত’ সেই পথ দেখিয়েছে। ইদানীং এটাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে যা আগে দেখা যেত না। তা হল গণেশ চতুর্থী পুজো। ধন-দৌলতের অগ্রদূত। ব্যবসা থেকে চাষির ঘরেও আবাহন গণেশের। যে কোনও দেব- দেবীকেও শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে গেলে গণেশকে স্মরণ করতেই হবে। তাই পচা ভাদ্রে গণেশকে মর্তে নামিয়ে ভাদ্রের ‘পচা’ তকমাটা বাঙালি মুছতে চাইছেন। এটা ভাল লাগছে। যাই হোক বাঙালির ছয়ঋতুতে বৈচিত্র্য যতই খামখেয়ালিপনা হোক, এরই মাঝে সৃষ্টির পথ লুকিয়ে আছে। আর কষ্টের মধ্যেই সেই সুন্দর আলোকের খোঁজে মানুষ আজও লড়াই করে বেঁচে আছে। বেঁচে থাকবে।