ভাদ্র মাসে কৃষ্ণপক্ষের একাদশী ‘অজা তিথি’ নামে প্রসিদ্ধ। এই তিথি ‘অন্নদা একাদশী’ নামেও খ্যাত। এই একাদশী তিথিতে দেবী একাদশী তার অনুরক্ত ভক্ত ও সন্তানদের অজা অর্থাৎ আদ্যাশক্তি মহামায়া রূপে বিরাজিত থেকে প্রতিনিয়ত নিত্যধামে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শক্তি প্রদান করে থাকেন। আজ ২৯শে আগস্ট গোটা দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে অজা একাদশী। প্রত্যেক একাদশীতে শ্রীবিষ্ণুর উপাসনা করা হয়। জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুসারে বৃহস্পতিবার শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় দিন। আজ লক্ষ্মীবারও। বৃহস্পতিবার একাদশী পরায় এই দিনটির গুরুত্ব বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
একাদশী পালন করতে ভক্তরা উপবাস করেন এবং শ্রীবিষ্ণু ও মা লক্ষ্মীর উপাসনা করেন সুখ, স্বাস্থ্য, সম্পদ এবং সমৃদ্ধির জন্য। দিনটি নির্দিষ্ট আচার-অনুষ্ঠান এবং জপের মধ্যে দিয়ে পালিত হয়।ভক্তদের বিশ্বাস এই উপবাস পালন করলে অশ্বমেধ যজ্ঞের সমান ফল লাভ হয়। ব্রতের প্রচার করা হয় সকলের কল্যাণের জন্য। অজ একাদশীও পালন করা হয় বিশেষ কিছু কারণে। তবে ব্রত কথাটি জেনে নেওয়া যাক।
পৌরাণিক যুগের কথা। ধর্মরূপে শ্রী ভগবান সত্যনিষ্ঠ রাজা ত্রিশঙ্কুর পুত্র হরিশচন্দ্রকে সামনে রেখে একটি পরিকল্পনা করেছিলেন জগতের মানুষকে সুশিক্ষা দেওয়ার জন্য। রাজা হরিশ্চন্দ্র এমন একজন রাজা ছিলেন যার চরিত্রকে আজও মর্মস্পর্শী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়। তার কষ্ট ও আত্মত্যাগকে আজও অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে মানা হয়। ইক্ষ্বাকু বা সূর্যবংশীয় প্রাচীন ভারতীয় এই রাজার নাম ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, মহাভারত, মার্কণ্ডেয় পুরাণ এবং দেবীভাগবতপুরাণে উল্লেখ আছে।
রাজা হরিশ্চন্দ্র কোন প্রকার ঐশ্বরিক অবতার ছিলেন না, কিন্তু তাঁর গুণাবলী ও ত্যাগ আদর্শ পুরুষ ভগবান রাম এবং অন্যান্য অবতারদের চেয়ে কম ছিল না। আজও তাঁর চেয়ে সত্যবাদী আর কাউকেই মনে করা হয় না। এর পেছনে রয়েছে তার জীবনের মর্মান্তিক কাহিনী। তো চলুন প্রথমে জেনে নিই তার গল্প…
রাজা হরিশচন্দ্রের শৈব্য (তারামতিও বলা হয়) নামে এক রাণী এবং রোহিতশ্ব নামে এক পুত্র ছিল। একবার, শিকার অভিযানে যাওয়ার সময়, তিনি একজন মহিলার সাহায্যের জন্য চিৎকার শুনতে পান। তীর-ধনুক নিয়ে সজ্জিত হয়ে সে শব্দের দিকে চলে গেল। শব্দটি বিঘ্নরাজের দ্বারা নির্মিত একটি বিভ্রম, যা বাধার অধিপতি। বিঘ্নরাজ ঋষি বিশ্বামিত্রের তপস্যা (ধ্যান) বিরক্ত করার চেষ্টা করছিলেন। হরিশ্চন্দ্রকে দেখে তিনি রাজার শরীরে প্রবেশ করলেন এবং বিশ্বামিত্রকে গালি দিতে লাগলেন। এটি বিশ্বামিত্রের তপস্যাকে বিঘ্নিত করে এবং এই তপস্যার সময় ঋষি যে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন তা ধ্বংস করে দেয়।
হরিশ্চন্দ্র যখন জ্ঞানে এলেন, তখন তিনি বুঝতে পারলেন যে ঋষি তার প্রতি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ, এবং ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। তিনি তার অপরাধ থেকে মুক্তি পেতে ঋষির যেকোনো ইচ্ছা পূরণ করার প্রতিশ্রুতি দেন। বিশ্বামিত্র তার রাজসূয় যজ্ঞের জন্য দক্ষিণা (দান) চেয়েছিলেন। রাজা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কি চান? উত্তরে, বিশ্বামিত্র বললেন, “আপনি, আপনার স্ত্রী এবং আপনার সন্তান ছাড়া আপনার যা আছে সব আমাকে দিন।” হরিশ্চন্দ্র তাতেই রাজি হলেন।
রাজা হরিশ্চন্দ্র যখন চলে যেতে চলেছেন, তখন বিশ্বামিত্র বললেন যে, ‘তুমি আমাকে যা দিয়েছ তা তোমার পূর্বপুরুষের এবং তোমার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। আমি একটি অনুদান চাইছি যা তোমার ব্যক্তিগতভাবে অর্জিত।’
এই কথা শুনে রাজা হরিশচন্দ্র বিশ্বামিত্রের কাছে কিছু সময় চাইলেন এবং তারপর অর্থ সংগ্রহের জন্য তিনি তার ছেলে রোহিত এবং তার স্ত্রী তারাকে এক ব্রাহ্মণের কাছে বিক্রি করে দিয়ে নিজেকে একজন চন্ডালের (শ্মশানের তত্ত্বাবধায়ক, প্রকৃতপক্ষে ছদ্মবেশে ধর্মের দেবতা) কাছে বিক্রি করে দিয়ে তার জন্য কাজ শুরু করেন।
একদিন, রাজা হরিশচন্দ্রের ছেলে সর্প দংশনে মারা যায় এবং তার স্ত্রী মৃত পুত্রকে নিয়ে সেই শ্মশানে আসেন যেখানে রাজা হরিশচন্দ্র তাদের ছেলের শেষকৃত্য সম্পাদনের জন্য চন্ডালের অধীনে কাজ করতেন। রানীর কাছে টাকা ছিল না, তাই তিনি রাজা হরিশচন্দ্রের কাছে বিনামূল্যে শেষকৃত্য করার অনুমতি চাইলেন। কিন্তু বিনা পারিশ্রমিকে এবং চন্ডালের অনুমতি ছাড়াই রাজা হরিশচন্দ্র রানীকে শ্মশানে প্রবেশ করতে দিতে অস্বীকার করেন। এমনকি পুত্রের মৃতদেহ নিজের সামনে দেখেও রাজা হরিশ্চন্দ্র তাঁর কর্তব্যে অবিচল থাকেন।
একদিন শ্মশানে পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন গৌতম মুনি। রাজা তাঁকে অনুপূর্বিক সমস্ত দুরবস্থার কথা বললেন, এর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করলেন মুনিবরের কাছে। তখন মুনিবর বললেন, ‘ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশীতে সারা রাত জেগে, উপবাস করে যদি এই ব্রত পালন করো, তাহলে তুমি সব পাপ থেকে মুক্তি পাবে।’
এর সাত দিন পরেই ছিল অজ একাদশী। এই কথা শুনে রাজা হরিশ্চন্দ্র অজ একাদশী পালন করেন। একাদশীর পূণ্যফলে তাঁর সমস্ত দুঃখ দূর হয়, স্ত্রী ও পুত্রকে ফিরে পান এবং নিজের রাজ্য ফিরে পান। তখন আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি হয় ও চারপাশে শঙ্খধ্বনি হতে থাকে। বহু বছর নির্বিঘ্ন রাজত্ব করার পর আত্মীয় বন্ধুদের নিয়ে তিনি স্বর্গে গমন করেন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পঞ্চপান্ডবদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ভক্তি ও নিষ্ঠার সঙ্গে এই একাদশী ব্রত পালন করলে মানুষ মুক্তি লাভ করে থাকেন।
এ বছর অজা একাদশীর দিন কিছু শুভ কাকতালীয় ঘটনা ঘটছে । দৃক পঞ্চং অনুসারে, এই দিনে সিদ্ধি যোগ, আর্দ্রা নক্ষত্র, পুনর্বাসু নক্ষত্র এবং সর্বার্থ সিদ্ধি যোগ গঠিত হচ্ছে। এই যোগ এবং নক্ষত্রগুলিকে শুভ বলে মনে করা হয়, যাতে করা কাজ সফল হয়।
সর্বার্থ সিদ্ধি যোগ – ২৯ অগস্ট, বিকেল ০৪ টে ৩৯ মিনিট থেকে ৩০ অগস্ট সকাল ০৫ টা ৫৮ মিনিট পর্যন্ত। সিদ্ধি যোগ – ২৮ অগস্ট ২০২৪, সন্ধ্যা ০৭ টা ১২ মিনিট থেকে ২৯ অগস্ট ২০২৪, সন্ধ্যা ০৬ টা ১৮ মিনিট পর্যন্ত।
আর্দ্রা নক্ষত্র- 03:53 PM, 28 আগস্ট থেকে 04:39 PM, 29 আগস্ট।পুনর্বাসু নক্ষত্র- শুরু: 04:39 PM, 29 আগস্ট থেকে 05:56 PM, 30 আগস্ট।
পুজার মন্ত্র : পূর্ণ ভক্তি সহকারে ভগবান শ্রীবিষ্ণু ও মা লক্ষ্মীর আরতি করুন।প্রভুকে তুলসী নিবেদন করুন।শেষে ক্ষমা চাইবেন।
মন্ত্র: ওঁম নমো ভগবতে বাসুদেবায়, ওঁম বিষ্ণবে নমঃ।
শুভ রং – হলুদ
ভোগ নিবেদন করুন – জাফরান মিষ্টি, গুড়, ছোলার ডাল, কিশমিশ, কলা
অজা একাদশীর প্রতিকার – এমনটা বিশ্বাস করা হয় যে অজা একাদশীর দিন শ্রী বিষ্ণু চালিসা পাঠ করলে এবং কলা গাছের পুজো করলে ব্যক্তির সমস্ত মনস্কামনা পূরণ হয়।।
Bah
থ্যাঙ্ক ইউ