একদিন ঢাকা থেকে কিছু ভক্ত বারদী গ্রামে এসেছেন লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে দর্শন করতে। ফেরার সময় তারা হেঁটে যাবেন বলেই মনস্থির করেছেন। সেদিন ছিল প্রচণ্ড গরম তার উপর দুপুরে ভয়ঙ্কর গরমে আগুন ঢালা রাস্তা দেখে ভক্তরা যখন ইতস্তত করছেন তখন লোকনাথ বাবা সস্নেহে বললেন, ‘তোমরা রওনা হয়ে যাও, রোদের জন্য ভুগতে হবে না’। ভক্তরা যাত্রা শুরু করলেন। আশ্রমের সীমানা পেরোতেই এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। কোথা থেকে একখন্ড মেঘ এসে সূর্যকে ঢেকে দিল। ভক্তদের মনে কৌতুহল জাগলো তারা আশ্রমে ফিরে প্রশ্ন করলেন, ‘বাবা আমাদের বলে দিন আমরা কোথায় পৌঁছলে মেঘ কেটে যাবে?’
লোকনাথ বাবা হেসে উত্তর দিলেন, ‘তোমরা ঢাকার উপকণ্ঠে দয়াগঞ্জ পৌছিলে মেঘ কেটে করা রোদ উঠবে।’ হলও ঠিক তাই। ভক্তরা দয়াগঞ্জ পৌঁছে গেলেই মেঘের আবরণ সরে গিয়ে কড়া রোদ উঠলো। বাবার যোগশক্তি ও করুণার পরিচয় পেয়ে সেই রোদের মধ্যে আবার বারদী ফিরে বাবার চরণতলে লুটিয়ে পড়লেন ভক্তরা।
ভক্তের সঙ্গে একদিন বসে আছেন বাবা, হঠাৎ করে বলে উঠলেন করুণামাখা কন্ঠে, ‘আহা হা থামো থামো’।
ভক্তেরা অবাক বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো, এমন কথা বলার অর্থ কি কিছুই বোঝা গেল না।
কিছুদিন পরে বাবার পরমভক্ত উকিল বিহারীলাল মুখোপাধ্যায় আশ্রমে এসেছেন। তিনি আসা মাত্রই বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি হে বিহারী, এরমধ্যে তুমি কি আমায় ঘন ঘন ডাকছিলে?’
বিহারীলাল চমকে উঠলেন, তার মনে পরল কয়েকদিন আগেই তিনি যাচ্ছিলেন মেঘনা নদী পেরিয়ে অসমে। রাস্তায় প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টি শুরু হল। স্টিমার ডুবে যাওয়ার উপক্রম হলো। যাত্রীরা ভয়ে কান্নাকাটি জুড়ে দিল। বিহারীলাল তখন এক মনে লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে স্মরণ করে চলেছেন। ওই সময় কয়েকজন ভীতযাত্রী দেখলেন এক অলৌকিক হাত অভয় দিয়ে বলছে ‘আহা-হা থামো থামো’। সঙ্গে সঙ্গে ঝড় থেমে নদী শান্ত হয়ে গেল। এমনই অলৌকিক ক্ষমতা ছিল বাবা লোকনাথের।
লোকনাথ বাবার আধ্যাত্মিক শক্তি নিয়ে অনেক কিংবদন্তি কাহিনি আছে। অনেকেই তাকে জাতিস্মর মনে করেন। অনেকেই মনে করেন তিনি যে কোনও মানুষের অনুভূতি সহজেই জানতে পারতেন। এমনকি যে কোনও দুরারোগ্য ব্যাধি সারাবার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তার। তিনি আর্তের ত্রাণকরি। লোককল্যাণের জন্যই তিনি লোকনাথ।
সম্ভবত সালটি ১১৩৭ বঙ্গাব্দ। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বারাসাত মহাকুমার অন্তর্গত বর্ধিষ্ণু গ্রাম চাকলায় বাস করতেন ধর্মপরায়ণ রামকানাই ঘোষাল এবং তার স্ত্রী কমলাদেবী। রামকানাইয়ের অন্তর আত্মার আকুতি ছিল তার এমন একটি পুত্র সন্তান হবে যিনি হবেন সন্ন্যাসী। ঈশ্বর তার ডাকে সাড়া দিয়ে স্বপ্নাদেশে বললেন,’ তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতেই তোমার পুত্র রূপে আমি তোমার ঘরে জন্ম নেব।’
ঘুম ভেঙে গেল রামকানাইয়ের। চোখে মুখে তার স্বপ্নের আবেশ, মনে অপার্থিব আনন্দ। স্বপ্নের কথাটি তিনি চার কান করলেন না। স্বপ্ন দর্শনের কয়েক দিন পর ঘটে গেল এক আশ্চর্য ঘটনা।
গৃহদেবতা শিবলিঙ্গের পূজায় বিভোর কমলাদেবী, এমন সময় এক দিব্যজ্যোতি এসে প্রবেশ করল তার শরীরে, তিনি অজ্ঞান হয়ে পরলেন। জ্ঞান ফেরার পর স্বামীকে ঘটনাটি বললেন। রামকানাইও তখন তার স্ত্রীকে তার স্বপ্নের গল্পটি জানালেন। যদিও পরে কমলাদেবী স্বপ্নে শিবের দর্শন পেয়েছিলেন।
‘অবশেষে উপস্থিত হইল সেই মহেন্দ্রক্ষণ — ১১৩৭ বঙ্গাব্দের ১৮ই ভাদ্র, ইংরেজির ২৯শে আগস্ট ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দের জন্মাষ্টমীর শেষ রাতে ব্রহ্মমুহূর্তে রামকানাই ঘোষাল ও কমলাদেবীর চতুর্থ সন্তান ভূমিষ্ঠ হলো। বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ভগবান গাঙ্গুলী, রামকানাইয়ের দেবশিশুতুল্য অনিন্দ্য সুন্দর চতুর্থ পুত্রের নাম রাখলেন লোকনাথ। সন্তান প্রেমে আত্মহারা পিতা, পুত্রের জন্মদিন উপলক্ষে গোটা গ্রামকে খাওয়ালেন।
ছোট বয়সে লোকনাথের বিদ্যালাভে ছিল চরম অনীহা। তার সন্ন্যাসী প্রেম ছিল অসীম। শৈশবে নানা ঘটনার মধ্যে তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তি প্রকাশ পেতো।
একবার এক জৈষ্ঠ মাসে সূর্যের প্রবল তেজে ধরিত্রী রসশূন্যা হয়ে বৈরাগিনী কঠিন বেশ ধারণ করেছে। বৃষ্টির দেখা নেই, চাষিরা খরার অশনি সংকেত দেখে হাহাকার করছে। গ্রামবাসীরা দেবতার পূজা করছেন ব্রাহ্মণরা যজ্ঞ করছেন কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। রামকানাইও খুব চিন্তিত। বালক লোকনাথ বাবাকে বললেন, ‘ভাবতে হবে না, আমাদের শিবলিঙ্গকে মহাস্নান করালেই বৃষ্টি হবে, খরা হবে না।’
বাবাকে এ কথা বলার পর তিনি স্বয়ং ‘নমঃ শিবায়’ মন্ত্রে সবার আগে শিবলিঙ্গকে স্নান করাতে লাগলেন। তাই অনুসরণ করল গ্রামবাসীরা। কিছু সময় পরে আকাশ ঘন কালো মেঘেছেয়ে গিয়ে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হল। পরিত্রতা হিসেবে পরিচয় হলো বালক লোকনাথের।
এরপর এগারো বছর বয়সে রামকানাই পুত্রের উপনয়ন সংস্কার করিয়ে পরম নিষ্ঠাবান এবং সর্বশাস্ত্রে সুপণ্ডিত গৃহী সন্ন্যাসী আচার্য ভগবান চন্দ্র গাঙ্গুলীকে লোকনাথের আচার্য রূপে জীবনের গুরুভার গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ জানালেন। একই সঙ্গে লোকনাথের প্রিয় সখা বেণীমাধব চক্রবর্তী ভগবান গাঙ্গুলীর শিষ্যত্ব লাভ করেন। এ সময় আচার্য গাঙ্গুলীর বয়স ৬০। এরপর আচার্য গাঙ্গুলীর সাথে দুজন বালক বেদোক্ত বিধিমত নৈষ্ঠিক-ব্রহ্মচারী হয়ে গৃহস্থাশ্রম ত্যাগ করেন।
গৃহ ত্যাগের পর কোন এক জায়গায় এক পর্ণ কুটিরে ১২ দিন কাটানোর পর গঙ্গার তীর বরাবর তারা আচার্যদের একান্ন পিঠের অন্যতম মহাপীঠ কালীঘাটে উপস্থিত হন। কালীঘাটে আসার পর বাল্য ব্রহ্মচারীদ্বয় আচার্যকে সাধন-ভজন শিক্ষা দেওয়ার কথা বলেন। সাধন-ভজনের জন্য নির্জন স্থানের উদ্দেশ্যে তারা কালীঘাট ত্যাগ করেন। নির্জন স্থানে এসে শিষ্যদ্বয় কঠোর সংযম পালন করেন এবং দীর্ঘ ৩০-৪০ বছর নক্ত-ব্রত (দিনে অনাহারী থেকে রাত্রে আহার) ধারণ করেন। এরপর একান্তরা-ব্রত (একদিন উপবাসের পর দিন আহার), ত্রিরাত্রি, পঞ্চহ, নবরাত্রি ব্রত পালন করেন। আচার্য গাঙ্গুলী তাদের ধ্যান ও যোগ শিক্ষা দেন। এরপর সিদ্ধলাভের জন্য তারা হিমালয়ের বরফাবৃত এক নির্জন স্থানে উপস্থিত হলেন। পঞ্চাশ বছরের অধিক সময় কঠিন তপস্যা দ্বারা লোকনাথ সমাধির উচ্চতম শিখরে পৌছান এবং পরমতত্ত্ব লাভ করেন। তখন তার বয়স ৯০ বছর।
ভগবান গাঙ্গুলি দেহত্যাগ করার আগে যোগীবর হিতলালের কাছে তার দুই প্রিয় শিষ্যের ভার অর্পণ করলেন। হিতলালের আশ্রয়ে ও সাধনোপদেশে লোকনাথ তাঁর আধ্যাত্ম্য জীবনে এক অত্যুচ্চ শিখরে উঠে অসামান্য যোগ ঐশ্বর্য্য অর্জন করেন। সাধনায় সিদ্ধি লাভ করে লোকনাথ জীবনে প্রতিষ্ঠিত হলেন ব্রহ্মাঙ্গ মহাপুরুষ হিসেবে।
অনেকেই মনে করেন হিতলাল ও কাশীর তৈলঙ্গস্বামী একই ব্যক্তি।বহিতলালের সঙ্গে তারা হিমালয় তিব্বতে নানা স্থান পরিভ্রমণ করেন। এরপর কর্ম করার জন্য হিতলালের আদেশে কামাখ্যায় চলে যান বেণীমাধব ও পূর্ববঙ্গের মহাপীঠ চন্দ্রনাথের দিকে এগিয়ে যান লোকনাথ।
সাধক দুই শ্রেণীর — ঈশ্বরকোটি ও জীবকোটি। জীবকোটি সাধক সিদ্ধিলাভ করে পরমাত্মায় লীন হয়ে যান আর ঈশ্বরকোটি সাধক মানবকল্যাণের জন্য লোকশিক্ষা দিতে সাধারণ মানুষের মাঝে ফিরে আসেন। লোকনাথ বাবা হলেন সেই ঈশ্বরকোটি ব্রহ্মবিদপুরুষ যিনি সকলের কল্যাণের জন্য মানুষের মাঝে চলে আসেন।
লোকনাথ বাবার অনন্ত অপার মহিমা বলে শেষ করা যায় না শুধু আমাদের স্বদেশে নয় বিদেশেও তার করুণা পেয়েছেন অনেকেই। এই বিষয়ে সর্বপ্রথম হলেন ডাক্তার নিশিকান্তবসু। যিনি পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর বাবা।
২৬ আগস্ট জন্মাষ্টমীর দিন সারা দেশে উৎসব পালিত হবে। তবে এই দিন জন্মাষ্টমী ছাড়াও শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারীর জন্ম দিবস। এই দিন লোকনাথ বাবার পুজোর শুভ সময় ভোর ৬টা ৪০ মিনিট থেকে পরের দিন সকাল ৯টা ২৫ মিনিট পর্যন্ত।
নীল শাপলা ফুল বাবার পূজার প্রধান উপকরণ, এছাড়া অন্য যেকোনো সাদা ফুল বাবাকে দেওয়া যায়। মিছরি আর কালোজাম তার প্রিয় ভোগ। এছাড়া অন্যান্য সাদা মিষ্টি তার ভোগে দেওয়া হয়ে থাকে। এই দিন লোকনাথ বাবার সঙ্গে দেবাদিদেব মহাদেবেরও পুজো করার বিধান রয়েছে।
লোকনাথ বাবা খুব অল্পতেই ভক্তদের উপর সন্তুষ্ট হন। আজ কিম্বা কাল প্রায় প্রত্যেকের বাড়িতেই লোকনাথ বাবার পুজো করা হবে। গৃহী, সন্ন্যাসী, পশু, পক্ষী এমনকি জঙ্গলের হিংস্র প্রাণী পর্যন্ত তার কৃপাবৃত্তের অধীন। সংসারী মানুষকে তিনি বিপদ আপদ থেকে যেমন উদ্ধার করেন তেমনি মুক্তিকামে সাধককে পৌঁছে দেন মুক্তির ঠিকানায়। আজকের এই পুণ্য তিথিতে তাঁর পায়ে শতকোটি প্রণাম।
বাহ!
থ্যাঙ্ক ইউ
খুব ভালো লেগেছে
ধন্যবাদ
যত্তসব বুজরুকি রটাচ্ছেন
বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর