পাইকপাড়া নামটি কবে থেকে এসেছে বা কবে থেকে মুদ্রিতভাবে এবং লোকমুখে প্রচারিত হয়েছে, তার কোনও সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। তা, না আছে আমাদের গবেষকদের কাছে, না আছে ব্রিটিশ তথ্যে।
পাইকপাড়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ (১৭৩৯-১৭৯৯)। তিনি থাকতেন জোড়াসাঁকোয়। সপ্তদশ শতকে পাইকপাড়া নামটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। ব্রিটিশরা আসার আগে এই অঞ্চলগুলি ছিল মোগল সম্রাটের অধীনে। হিন্দু রাজা তথা জমিদাররা কর আদায় করে মোগলসম্রাটকে দিত। এই পাইকপাড়ার বেশ কিছু অঞ্চল রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অধীনে ছিল (১৭১০-১৭৮৩)। তার আগে এইসব জমির মালিক ছিলেন ঐতিহাসিকদের মতে বারোভুঁইয়াদের অন্যতম মহারাজা প্রতাপাদিত্য রায় (১৫৬১–১৬১১ খ্রি)।
কিন্তু ব্রিটিশ তথ্য বা দলিলে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে দক্ষিণ পাইকপাড়া শব্দটি পাওয়া যায়। এই দক্ষিণ পাইকপাড়া বলতে বোঝানো হচ্ছে বেলগাছিয়া, বীরপাড়া ও রাজা মনীন্দ্র রোড রাস্তার অংশটি। যদিও তখন রাজা মনীন্দ্র রোড নামকরণ হয় নি। রাজা প্রতাপ চন্দ্রের সময়ে (১৮২৭-১৮৬৬) পাইকপাড়ার রমরমা ছিল। তিনি বিদ্যাসাগর মহাশয়কে চারটি পাইক দিয়েছিলেন আনুমানিক ১৮৫০ সালে। পাইক দেওয়ার কারণ কি? কারণ বিদ্যাসাগর মহাশয় যে কোনও সময়ে আক্রান্ত হতে পারতেন। এমন কী প্রাণহানিও ঘটতে পারত তাঁর। বিধবাবিবাহ প্রবর্তন করতে গিয়ে তিনি রক্ষণশীল সমাজের চক্ষুশূল হয়ে পড়েছিলেন।
প্রথম দিকে উনি তাঁর পিতার পাঠানো দুয়েকজন পালোয়ান নিয়ে ঘুরতেন কারণ বহুবিবাহ রদ এবং মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠায় উনি গোঁড়া হিন্দুদের চক্ষুশূল ছিলেন। তাই তাঁর পাইকের (সৈনিক বা বরকন্দাজ) দরকার ছিল। এরপরে বিদ্যাসাগর মহাশয় যেখানেই যেতেন ওই চারজন পাইক সবসময় তাঁর সঙ্গে থাকত।
তার মানে পাইকপাড়া নামটা অনেক আগেই ছিল। যখন বেলগাছিয়া নাট্যশালা তৈরি হলো তখন সবাই পাইকপাড়া রাজবাড়ী বলতো। যখন দ্বারকানাথ ঠাকুর বেলগাছিয়া ভিলা কিনলেন ১৮২৩ সাল নাগাদ, তখনও পাইকপাড়ার নামটি ছিল। সিরাজদৌল্লার কলকাতা আক্রমণের সময়ে (পর পর দু’বার) সেনা ছাউনি গড়ে উঠে এই সব অঞ্চলে এবং ব্রিটিশেরও সেনা ছাউনি গড়ে উঠে। সময়টা হলো ১৭৫০ থেকে ১৭৫৭। এই সময়ে প্রচুর পাইক ও বরকন্দাজ এই অঞ্চলে থাকতো। আর তখনই মুখে মুখে প্রচার শুরু হলো এটা পাইকদের পাড়া। কিন্তু ১৭৫০ এর আগে পাইকপাড়া নামের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগের কিছু আগে থেকে পাইকপাড়ার রাজাদের পাইক থাকতো এলাকা জুড়ে। তবে এই ব্যাপারে শেষ কথা বলবে ভারতের প্রত্নতত্ব বিভাগ। কারণ আমাদের ইতিহাস যে কতটা পুরোনো, এর পূর্ণাঙ্গ খবর কোথাও নেই। পাইকপাড়া নামটির ইতিহাস বেশ রহস্যাবৃত হলেও পাইকপাড়ার অঞ্চলগুলো কিন্তু আগে থেকেই ছিল। টালা শব্দটির নামকরণ কীভাবে হয়েছে, তাও অজ্ঞাত। বিশ্বকোষপ্রণেতা নগেন্দ্রনাথ বসু বলেছেন, Tulloh নামক সাহেবের নাম থেকেই নাকি টালার নামকরণ। আবার কেউ কেউ বলছেন টালা অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গার নাম। গবেষক দেবাশিষ বসু বলেছেন, এসব কোনও তথ্যই মানা যায় না।
তাঁর মতে, প্রাচীন পুঁথিতে তালা নামে অনেক গ্রাম আছে। তাই থেকেই টালার নাম। মানে প্রাচীন কলকাতায় তালগাছের আধিক্য ছিল। সেই কারণেই তালা। ইংরেজি হরফের পাল্লায় পড়ে তালাই ক্রমেক্রমে লোকমুখে টালা হয়ে গেল। আসলে নগেন্দ্রনাথ বসু ও দেবাশিষ বসু, দুজনেই অর্ধসত্য বলেছেন।
আমি যেটুকু বুঝেছি, সেটুকু বলি। হিন্দিতে ‘টালা’ শব্দটির একটি প্রধান অর্থ অর্ধেক বা আধখানা। পাইকপাড়ায় যেমন আসল পাইক বা সৈন্য থাকত, টালায় থাকত আধাপাইক বা আধাসেনা। তারা পাইকের কিছু কাজ করতে পারত, কিছু কিছু করার অধিকার বা দক্ষতা তাদের ছিল না। যেমন তারা লাঠি ঘোরাতে পারত কিন্তু বন্দুক চালাতে জানত না। তাই এই আধাপাইক বা আধাবরকন্দাজরা যে জায়গায় থাকত, সেই জায়গাটির নাম হয়ে গেল টালা। টালা আসলে হাফপ্যান্ট পাইকদের জায়গা। মোগল আমলের পাইকদের বংশধরদের মধ্যে অনেকেই ছিল হিন্দি ও উর্দুভাষী। তাই হিন্দি শব্দ থেকে স্থাননাম আসা এইসব অঞ্চলে বিচিত্র নয়।
পলাশি যুদ্ধের অব্যবহিত পর ব্রিটিশদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়তে লাগল। ব্যবসা-বাণিজ্য ফুলে ফেঁপে উঠতে শুরু করল। সঙ্গী হিসেবে বাঙালি, আর্মেনিয়ান, পার্সি, ইহুদি ও অন্যান্য জাতির লোকজন প্রচুর কাজকর্ম শুরু করলে গোটা অঞ্চলে কর্মসংস্থানের জোয়ার এল। মানুষ বাড়ায় স্থান সংকুলানের জন্য তাঁরা ছড়িয়ে গেলেন আশপাশের অন্যান্য গ্রামে। কোম্পানি মোট ৫৫টি গ্রামকে শহরতলির স্বীকৃতি দিল। নাম রাখল ‘এস্টেট অব পঞ্চান্ন গ্রাম’ বা ‘ডিহি পঞ্চান্ন গ্রাম’।
গোবিন্দপুর, কলকাতা ও সুতানুটি-এই তিনটি গ্রামকে বেড়ির মতো ঘিরে ছিল ওই ৫৫টি গ্রাম। উত্তরে গঙ্গার ধারে ডিহি সিঁথি থেকে শুরু করে চিৎপুর। তারপর পূর্ব দিকে এগিয়ে এবং দক্ষিণ দিকে ঘুরে বাগজোলা, দক্ষিণ পাইকপাড়া, উল্টোডাঙা, বাহির-সিমলা, শুঁড়া, কুলিয়া, শিয়ালদহ, এন্টালি, তপসিয়া, শ্রীরামপুর, চক্রবেড়িয়া, ভবানীপুর হয়ে মনোহরপুর তথা বর্তমান মনোহরপুকুর হয়ে আদিগঙ্গার ধারে এই ৫৫টি গ্রাম শেষ হয়েছে।
প্রাগুক্ত এলাকাগুলির ছিল এক একটা ডিহি, অর্থাৎ রাজস্ব সংগ্রহের কেন্দ্র। প্রত্যেকটি ডিহির অধীনে ছিল একাধিক গ্রাম। ডিহি চিৎপুরের মধ্যে ছিল চারটি গ্রাম — চিৎপুর, বীরপাড়া, টালা এবং কেলেদা। কেলেদার পরবর্তীকালের শোভনসুন্দর নাম হয় কালিন্দী। টালা কখনওই পুরনো কলকাতার অঙ্গ ছিল না। ছিল পুরনো কলকাতার শহরতলির সদস্য। ফলে টালা কখনওই বর্ধিষ্ণু ছিল না। কিন্তু এই টালায় আঠেরো শতকে বড় বড় জমিদার বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরাট বসতবাড়ি ও বাগানবাড়ি ছিল।তাঁদের বাড়িতে পাহারা দেওয়ার জন্যে দরকার হত প্রচুরসংখ্যক পাহারাদার ও লেঠেল। এরা পুরোপুরি পাইক-বরকন্দাজ নয়, আধাপাইক ধরনের সান্ত্রী। টালা ছিল বাড়িপাহারা দেওয়ার সান্ত্রীদের জায়গা।
টালার ট্যাঙ্কের জন্যে টালা সমধিক প্রসিদ্ধ হলেও টালায় কলকাতার রহিস আদমিদের বাস ছিল, সঙ্গে থাকত পাহারা দেওয়ার লোকলস্কর।
পলাশির যুদ্ধের পরই টালার নাম পাওয়া গিয়েছিল। যদিও আঠেরো শতকের গোড়ার দিকে টালার নাম শোনা গিয়েছ বলে কারও কারও দাবি। হিন্দি ও উর্দুভাষী পাইকদের মুখেই টালা নামটির উৎপত্তি।
হিন্দি বা উর্দু ভাষার কোন অভিধানে ‘টালা’ শব্দের অর্থ ‘আধা’ বা অর্ধেক, জানালে ভাল হয়।
ভার্গব আদর্শ হিন্দি শব্দকোষ। অনলাইনে পিডিএফও পাবেন।