বাসার অলিন্দ থেকে ওকাম্পোর সাথে মিলে নদী দেখতেন রবীন্দ্রনাথ, দেখতেন নদীর জলে রঙের পরিবর্তনের মায়াবী খেলা। কখনো বা বাসার পাশের তিপা গাছের নীচে চলতো তাঁদের অবিশ্রুত গুঞ্জন। রবিঠাকুর বাংলা কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন ওকাম্পোকে, ওকাম্পো মন্ত্রমুগ্ধের মতোন শুনতেন। ওকাম্পো তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ যখন বাংলায় কবিতা আবৃত্তি করতেন, সে আবৃত্তিই গান হয়ে উঠতো। শব্দগুলি উনি এমন বিশুদ্ধ স্পষ্টতার সাথে উচ্চারণ করতে পারতেন যে, আমি কিছু কিছু শব্দ স্মৃতিস্থ করে পুনরুচ্চারণ করতে পারতাম’। আর ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী’, নামের যে বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীতটি আমরা আজ অহরহ শুনি, সেটার কথা তো এখানে অবধারিতভাবে এসে পড়বে —
আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী।
তুমি থাক সিন্ধুপারে ওগো বিদেশিনী॥
তোমায় দেখেছি শারদপ্রাতে, তোমায় দেখেছি মাধবী রাতে,
তোমায় দেখেছি হৃদি-মাঝারে ওগো বিদেশিনী।
আমি আকাশে পাতিয়া কান শুনেছি শুনেছি তোমারি গান,
আমি তোমারে সঁপেছি প্রাণ ওগো বিদেশিনী।
ভুবন ভ্রমিয়া শেষে আমি এসেছি নূতন দেশে,
আমি অতিথি তোমারি দ্বারে ওগো বিদেশিনী॥
এ বিখ্যাত গানটির ইংরেজি অনুবাদ ওকাম্পোর হাতে তুলে দিয়েছিলেন রবিঠাকুর, আর্জেন্টিনা আসার কয়েকদিনের মধ্যেই। মূল গানটি গানটি কবি লিখেছিলেন শিলাইদহে বহুদিন আগে — সেই ১৮৯৫ সালে। গানটি রচনা করার ত্রিশ বছর পরে রবি ঠাকুর হয়তো ওকাম্পোর মধ্যেই আবিষ্কার করেছিলেন তাঁর পরম আরাধ্য সত্যিকার ‘বিদেশিনী’কে (১৭)। রবীন্দ্রনাথ যেমন ওকাম্পোকে বাংলা কবিতা আর গানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, ওকাম্পো আবার অন্যদিকে রবিঠাকুরকে আন্তর্জাতিক সাহিত্য ও সঙ্গীতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার চেষ্টা করতেন ক্লান্তিহীনভাবে। যেমন, তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আর্জেন্টিনীয় কবি রিকার্ডো গ্যিরালডেসের সাথে, কখনো নিয়ে যেতেন ‘ফাকুলতাদ দ্য ফিলসফিয়া ই লেত্রাসে’ কিংবা কখনো ‘চাপাড মালালে’ (১৮)। ওকাম্পো নিজেই বোদলেয়রের ‘পাপের পুষ্পগুচ্ছ’ কাব্যগ্রন্থ থেকে আবৃত্তি করে শোনাতেন (১৯); পাশাপাশি শোনানোর ব্যবস্থা করতেন দ্যুবসি, রাভেল কিংবা বোরোদিনের মায়াবী সঙ্গীতও। সব মিলিয়ে এ সময়টুকু ছিল রবীন্দ্রনাথের জন্য যেন এক ধরণের স্বপ্নের লগ্ন । আর্জেন্টিনা থেকে ফিরে বহু বছর পরেও রবিঠাকুর সান ইসিদ্রোর স্মৃতি রোমন্থন করতেন। শান্তিনিকেতন থেকে ওকাম্পোকে প্রায়ই লিখতেন (২০)—
‘আমার মন চলে যায় সান ইসিদ্রোর বারান্দাটিতে। স্পষ্ট এখনো মনে পড়ে সকালবেলা আলোয় ভরা বিচিত্র লাল নীল ফুলের উৎসব। আর বিরাট সেই নদীর উপর নিরন্তর রঙের খেলা, আমার নির্জন অলিন্দ থেকে অক্লান্ত সেই চেয়ে দেখা’।
ওকাম্পোর ওপর রবিঠাকুরের যেমন প্রভাব ছিল, রবিঠাকুরের সৃষ্টির পেছনেও ওকাম্পোর প্রভাব ছিল অসমান্য। তুলনামূলক বিচারে এই প্রভাব ওকাম্পোর উপর প্রভাবের চেয়ে কম ছিল না, বরং হয়তো ছিল খানিকটা বেশিই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতা ওকাম্পোকে মাথায় রেখেই লিখেছিলেন বলে অনুমিত হয় (২১)। পূরবীর প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৫ সালে। ১৯২৫ সালটিকে আজ ‘বাংলা কবিতার আধুনিকতার সূচনাকাল’ হিসেবে গণ্য করেন অনেক বিশেষজ্ঞ। আমরা জানি কবি বুদ্ধদেব বসু’র প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মর্মবাণী’ প্রকাশিত হয়েছিল ঐ বছর। শুধু তাই নয় কল্লোল, কালি-কলম, উত্তরা এবং প্রগতির মতো সাহিত্যপত্রের সূচনাও হয়েছিল সমসাময়িক কালেই। পাশ্চাত্যেও এ সময়ই প্রকাশিত হয় টি. এস. এলিয়টের ‘পোড়ো জমি’ (The Waste Land) কাব্যগ্রন্থ এবং নোবেল বিজয়ী কবি ইয়েটসের ‘ভিশন’। রুশ কবি সের্গেই ইয়েসেনিন সে বছরই তাঁর রক্তকে কালি বানিয়ে লিখেছিলেন তাঁর বিদায়ী কবিতা ‘গুড বাই মাই ফ্রেন্ড, গুড বাই’। এটি নিশ্চয় আজ আর কাউকে অবাক করে না যে, রবিঠাকুরও তাঁর এই কবিতার বইটিকে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিলেন ১৯২৫ সালেই। কিন্তু আমাদের কাছে যেটা গুরুত্বপূর্ণ: কাব্যগ্রন্থটি রবিঠাকুর উৎসর্গ করেছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে। বইটির উৎসর্গপত্রে লেখা আছে ‘বিজয়ার করকমলে’।
‘পূরবী’ কোন সাধারণ কাব্যগ্রন্থ ছিল না। রোমান্টিক কবি রবীন্দ্রনাথের প্রেমের বর্ণীল স্ফুরণ ছিল এই কাব্যগ্রন্থ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স ততোদিনে ষাট বছর অতিক্রম করে গেছে, কিন্তু তাঁর প্রেমের তৃষ্ণা মরেনি। ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো পড়লে মনে হয় যেন, চির তারুণ্যের কবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবন সায়াহ্নে এসেও প্রেম, সৌন্দর্য আর মাধুর্যের রসে একেবারে টইটম্বুর। এ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘তপোভঙ্গ’, ‘লীলাসঙ্গিনী’, ‘আহ্বান’, কিংবা ‘শেষ বসন্ত’ কবিতাগুলো পড়লে মনে হয় কবির জীবনে হঠাৎই যেন ‘চির বসন্তের’ আগমন ঘটেছিল সে সময়, আর যৌবনের ‘মানস সুন্দরী’ যেন বার্ধক্যে এসে ‘লীলাসঙ্গিনী’তে রূপায়িত। ১৯২১ সালে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই নবপ্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়ের প্রথম বই ছিল ‘পূরবী’। এ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের চোদ্দ বছর পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই একে তাঁর ‘অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা’ বলে আখ্যায়িত করে ওকাম্পোকে একটি চিঠিতে (১৯৩৯) বলেছিলেন —
‘…ইতোমধ্যেই তুমি জানো যে ভাস্বর সেই দিনগুলি আর তার কোমল শুশ্রূষার স্মৃতিপুঞ্জ ধরা আছে আমার কবিতাগুচ্ছে, হয়তো আমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা। পলাতক স্মৃতিগুলি আজ কথায় বন্দী। ভাষার অপরিচয়ে তুমি কোনদিন একে জানবে না, কিন্তু তোমাকে নিশ্চিত বলতে পারি যে, এ –কবিতা বেঁচে থাকবে অনেকদিন’।
রবিঠাকুর মিথ্যে বলেননি। পূরবী কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের প্রায় নব্বই বছর অতিক্রম করে গেছে, কিন্তু এর উজ্জ্বলতা ম্লান হয়নি এতোটুকুও। কবিতাগুলোতে রবীন্দ্রনাথ কোথাও সরাসরি ওকাম্পোর নামোল্লেখ করেননি, কিন্তু ‘বিদেশী ফুল’, ‘অতিথি’, ‘আশঙ্কা’, তপোভঙ্গ’, ‘আহ্বান’, ‘অন্তর্হিতা’, ‘মিলন’, ‘বদল’ কিংবা ‘শেষ বসন্ত’ সহ বহু কবিতায় ওকাম্পো যেন প্রবলভাবেই দীপ্যমান। ‘বৈতরণী’ কবিতাটি পড়লে মনে হয় কবি যেন মিরালরিওর বাড়ির অলিন্দে দাঁড়িয়ে তাঁর প্রেয়সীর সাথে মিলে রিও দে লা প্লাতা নদীর সৌন্দর্য উপভোগরত। যতদিন এই প্লাতা নদীর জল বইবে, যতদিন পূরবী কাব্যগ্রন্থ টিকে থাকবে, ততদিন মর্মর সুরে বইবে রবিঠাকুর আর তাঁর প্রেয়সী ওকাম্পোর রোমান্টিক অভিসারের অশ্রুত কলকাকলি। এই ‘প্লাতা নদীর ধারে’ বসে অনেক প্রেমময় কবিতা লিখেছিলেন কবি, কিছু লিখেছিলেন তাঁর বাড়ির অলিন্দে, কিছুবা লিখেছিলেন বাড়ির বাগানে ‘গাছের ছায়ায়’ বসে। ‘বীণাহারা’ নামের একটি কবিতাটির কিছু অংশ শোনা যাক —
“প্রবাসে বনের ছায়ে
সহসা আমার গায়ে
ফাল্গুনের ছোঁয়া লাগে একি?
এ পারের যত পাখি
সবাই কহিল ডাকি,
‘ও পারের গান গাও দেখি।’
ভাবিলাম মোর ছন্দে
মিলাব ফুলের গন্ধে
আনন্দের বসন্তবাহার।
খুঁজিয়া দেখিনু বুকে,
কহিলাম নতমুখে,
‘বীণা ফেলে এসেছি আমার’।”
কিংবা ‘অতিথি’ কবিতার খানিকটা —
প্রবাসের দিন মোর পরিপূর্ণ করি দিলে, নারী,
মাধুর্যসুধায়; কত সহজে করিলে আপনারই
দূরদেশী পথিকেরে; যেমন সহজে সন্ধ্যাকাশে
আমার অজানা তারা স্বর্গ হতে স্থির স্নিগ্ধ হাসে
আমারে করিল অভ্যর্থনা; নির্জন এ বাতায়নে
একেলা দাঁড়ায়ে যবে চাহিলাম দক্ষিণ-গগনে
ঊর্ধ্ব হতে একতানে এল প্রাণে আলোকেরই বাণী—
শুনিনু গম্ভীর স্বর, ‘তোমারে যে জানি মোরা জানি;
আঁধারের কোল হতে যেদিন কোলেতে নিল ক্ষিতি
মোদের অতিথি তুমি, চিরদিন আলোর অতিথি।’
শেষ পর্বে সমস্ত ফুট নোট দেওয়া রয়েছে।
(ক্রমশ)