হুতোম প্যাঁচার নকশায় আছে, ‘ব্যোম কালী, কলকাত্তাওয়ালী!’
বিভিন্ন কালীমন্দিরের অবস্থানের জন্য, বেহালা থেকে দক্ষিণেশ্বর পর্যন্ত বিস্তৃত স্থান, যার ওপর বর্তমান কলকাতা দাঁড়িয়ে আছে, তা কালীক্ষেত্র নামে অভিহিত ছিল। কলকাতা প্রাক্-ব্রিটিশ যুগ থেকে কালীক্ষেত্র৷ কেউ কেউ বলেন, ‘কালীক্ষেত্র’ থেকেই ‘কলিকাতা’ বা ‘কলকাতা’ হয়েছে৷
আবার কেউ কেউ বলেন, কালীঘাট-কালীঘাটা-কালীকোটা-কালীকর্তা-কালিকাত্তা থেকে কলিকাতা বা কলকাতা হয়েছে৷
রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতো বিদগ্ধ ইতিহাসবিদ লিখেছেন, চণ্ডীমঙ্গলের সময়কার কালীকোটা গ্রামই অপভ্রংশের ফলে কলিকাতা তথা কলকাতা হয়েছে। যদিও পরে দেখা গেছে, কালীকোটা নয়, গ্রামটির আদিনাম ছিল কালীকোটি।
বৌদ্ধ পরিব্রাজক কবিরামের গ্রন্থ ‘দিগ্বিজয়প্রকাশ’-এ ‘কিলকিলা’ নামক প্রদেশের উল্লেখ আছে৷ কবিরাম ছিলেন যশোরেশ্বর প্রতাপাদিত্যের সমসাময়িক৷ পাটুলিপুত্র থেকে তিনি যাত্রা শুরু করেন৷ মাহেশ, হরিপাল, সিঙ্গুর, ত্রিবেনী, চাকদা, ডুমুরদা, সপ্তগ্রাম, জগদ্দল, শিবপুর, বালি, ভদ্রেশ্বর, শ্রীরামপুর, বাঁশবেড়িয়া, খলিসানি, গোবিন্দপুর, ভাটপাড়া, শৃগালদহ প্রভৃতি স্থান কিলকিলা প্রদেশের অর্ন্তভুক্ত ছিল৷ সবসুদ্ধ তিন হাজার গ্রাম কিলকিলার অন্তর্গত ছিল৷
অনেকে অনুমান করেন, ‘কিলকিলা’ থেকে ‘কলকাতা’ নামটি এসেছে৷
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য অনুযায়ী কলিকাতায় আগে কলিচুন তৈরি হত শামুক ও ঝিনুক পুড়িয়ে। যে কলিচুন প্রস্তুত করা হত, তা মণ্ড বা ক্বাথ হিসেবে জমিয়ে রাখা হতো। তাই জায়গাটির নাম কলিকাতা হয়েছে৷ হাওড়া জেলার ‘কলিকাতা’ নামের গ্রামের প্রসঙ্গ তখন উঠেছিল৷ অবশ্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বহুকাল আগেই দুই লেখক পৃথকভাবে এই তত্ত্বের কথা জানিয়েছিলেন৷
এই তত্ত্বকে আক্রমণ করে মাইকেল মধুসূদন দত্তের বন্ধু ভাষাবিদ ও প্রাবন্ধিক গৌরদাস বসাক লিখেছিলেন, ‘এসব উষ্ণ মস্তিষ্কের প্রলাপ’।
এখন অনেকেই এই তত্ত্ব মানেন না৷
রাধাকান্ত দেবের মতে, ‘গলগথা’ থেকেই ‘কলকাতা’ এসেছে৷ ওলন্দাজরা কলকাতায় প্রথম পদার্পণ করে মড়ার খুলির স্তূপ (Golgotha) আবিষ্কার করেছিল বলে তারা জায়গাটিকে ‘কলকতা’ বলে ডেকেছিল৷ বাইবেলে মড়ার খুলিপূর্ণ স্থানকে Golgotha বলা হয়েছে। ওলন্দাজরা রোমান G অক্ষরকে K-এর মতো উচ্চারণ করে। তাই Golgotha-কে Kolkota বলেছিল। তা থেকেই নাকি কলকাতা।
একটি বইয়ে আছে, আর্মেনীয়রা সুতানুটির হাটে কার্পেট, কম্বল, সুজনি ইত্যাদি বিক্র করত৷ আর্মেনীয়রা কার্পেট বা কম্বলকে ‘কলি’ (Khali) বলত৷ তাই জায়গাটির নাম হল কলিকাতা তথা কলকাতা৷
সম্প্রতি কেউ কেউ কলি অর্থে বহেড়া গাছ ধরে কলিকাতা নামের ব্যাখ্য করেছেন। কিন্তু কলকাতার স্থাননামগুলিতে অসংখ্য গাছপালার উল্লেখ থাকলেও কোথাও বহেড়া গাছের উল্লেখ নেই।
তা বলে কি কলকাতা নামের ব্যুৎপত্তি নিয়ে গবেষণা থেমে থাকবে? এ নিয়ে নিরন্তর গবেষণা চলছে। আমিও চেষ্টায় ছিলাম নতুনতর ব্যাখ্যা দেওয়ার।
সম্প্রতি দেখলাম, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এ ‘কলি’ শব্দের একটি অর্থ দেওয়া হয়েছে, যুদ্ধ বা ‘কলহ’। কলি শব্দটি সংস্কৃত থেকে বাংলায় এসেছে, তাই তৎসম শব্দ এটি।
বিবাদপ্রিয় বা ঝগড়ুটে স্বভাবের জন্যে নারদমুনির আর এক নাম ‘কলিপ্রিয়’ (সূত্র-বঙ্গীয় শব্দকোষ)।
চৈতন্য ভাগবতে আছে, “ইহাতে অবুধগণ মহাকলি করে”।
‘কলিতলার ঝগড়া’ থেকেই কি কলতলার ঝগড়া?
কলিকাতা তথা কলকাতার পুরনো ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, মুঘল আমল থেকেই কলকাতার অধিকার নিয়ে বারো ভুঁইয়াদের অন্যতম যশোরেশ্বর প্রতাপাদিত্যের সঙ্গে আকবরের সেনাপতি মানসিংহের যুদ্ধ ও বিবাদ চলেছে। তারপর ইংরেজদের সঙ্গে মুঘল প্রশাসকদের বিবাদবিসংবাদ চলেছে। কখনও বা জমিদারদের মধ্যে কলহবিবাদ চলেছে কলকাতার অধিকার নিয়ে। ‘কাত’ শব্দটির অর্থ ফসলযোগ্য উর্বর জমি। কলকাতার তখন গ্রামীণ রূপ, শহরের পত্তন সবে শুরু হচ্ছে। কলহবিবাদ, যুদ্ধের আবহ তখন কলকাতার স্বত্ব নিয়ে। কলিকাতা নামটির সৃষ্টি হয়তো মুঘল আমলেই হয়েছে। কলিগ্রাম বলে একটি জায়গা আছে বর্ধমানে। হাওড়ার আমতায় আছে কলিকাতা (ছোট কলকাতা) বলে একটি জায়গা। বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জে কলিকাতা-ভোগদিয়া নামে একটি জায়গা আছে। কয়েক দশক আগে কলকাতার নামের ব্যুৎপত্তি নিয়ে রাধারমণ মিত্র-সুকুমার সেন-তারাপদ সাঁতরার পত্রযুদ্ধের সময় কলকাতা ভোগদিয়া গ্রামের নামও উঠে এসেছিল।
রামকমল সেনের A Dictionary in English and Bengalee’ অভিধানে (১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত) ভোগাদিয়া বা ভোগদিয়া শব্দটির অর্থ আছে ‘ঠকাইয়া বা প্রতারণপূর্বক’। কলিকাতা নামের নিহিতার্থ কলহ-বিবাদের সঙ্গে ভোগদিয়ার অন্তর্নিহিত ঠকানোর ব্যাপারটি বেশ সাযুজ্যপূর্ণ।
কলকাতা নামের ব্যুৎপত্তিতে কলহবিবাদ, ঠকানো-প্রতারণার সম্পর্ক যেন ঘনীভূত হয়েছে।
আচার্য সুনীতিকুমার,সুকুমার সেন,রাধারমণ মিত্রের পর অসিত বাবুর তত্ত্বের নতুনত্ব আছে।কলিকাতা নামের বুৎপত্তি অনুসন্ধানে একটি নতুন তত্ত্বের অবতারনা করলেন।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। লেখাটি পড়ে পাঠপ্রতিক্রিয়া জানানোর জন্যে।