রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ডাকতেন ‘বিজয়া’ নামে। কিন্তু বিজয়া তাঁর আসল নাম ছিল না। নাম ছিল তাঁর ভিক্টোরিয়া (১) । ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। আর্জেন্টিনার এক নারীবাদী লেখিকা এবং বিগত ত্রিশের দশক থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করা সুর (Sur) নামের এক প্রগতিশীল পত্রিকার সম্পাদিকা। ধারণা করা হয়, রবীন্দ্রনাথের সাথে এক ‘রহস্যময়’ প্লেটোনিক ধরণের রোমান্টিক সম্পর্ক ছিল তাঁর। রবিঠাকুরের একেবারে শেষ বয়সের প্রেম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স তখন ৬৩। আর ওকাম্পোর ৩৪।
১৯২৪ সালে পেরুর স্বাধীনতা সংগ্রামের শত বছরের বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যাবার জন্য জাহাজে উঠলেও মাঝপথে অসুস্থ হয়ে আর্জেন্টিনায় অবস্থান করতে হয় তাঁকে (২)। সেখানেই পরিচয় হয় ওকাম্পোর সাথে রবি ঠাকুরের। রবি ঠাকুর আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আইরেসের এক হোটেলে (প্লাসা হোটেল) ছিলেন তাঁর সহযাত্রী এবং কাজের সার্বক্ষণিক সঙ্গী লেনার্ড এলমহার্স্টের সাথে। সেখানেই একদিন হাজির হন ওকাম্পো। অবশ্য এমনি এমনি রবাহূত হয়ে রবীন্দ্রনাথের হোটেলে হানা দেননি তিনি। তাঁর রবীন্দ্র-দর্শনের ইচ্ছার পেছনে একটা ছোট্ট ইতিহাস আছে। আসলে প্রথম থেকেই রবীন্দ্র সাহিত্যের গুণমুগ্ধ পাঠিকা ছিলেন ওকাম্পো। রবীন্দ্রনাথ ততদিনে নোবেল পুরস্কার পেয়ে গেছেন। তাঁর ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থ বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। একাধিক ভাষায় লিখন এবং পঠনে পারদর্শী ওকাম্পো ইতোমধ্যেই গীতাঞ্জলি পড়ে ফেলেছেন ইংরেজি, স্প্যানিশ এবং ফরাসি ভাষায়। তার মধ্যে আঁদ্রে জিদের ফরাসি ভাষায় করা গীতাঞ্জলির অনুবাদটিই ছিল তাঁর প্রিয় (৩)। গীতাঞ্জলি পড়ে শিহরিত হন ওকাম্পো। তাঁর নিজের ভাষ্যেই (৪) —
‘[তখন] আমার গান শেখার সময়। মাদাম ‘র’ তখনো এসে পৌঁছাননি। ধূসর রেশমে আস্তীর্ণ স্বপ্নালোকিত একটি ঘরে পিয়ানোর গায়ে হেলান দিয়ে কবিতাগুলো পড়ছি। শীতকাল। বুয়েনোস আইরেসের রাস্তাঘাটের হট্টগোল আমাকে অনুসরণ করে এসেছে, আপাতত চাপা পড়ে গেছে বদ্ধ জানালা আর পর্দার আবরণে। পিয়ানোর পাশে দাঁড়িয়ে থর থর করে কাঁপছে আমার যৌবনও : —
আমার ঘরেতে আর নাই সে যে নাই-
যাই আর ফিরে আসি, খুঁজিয়া না পাই।
আমার ঘরেতে নাথ, এইটুকু স্থান-
সেথা হতে যা হারায় মেলে না সন্ধান।
অনন্ত তোমার গৃহ, বিশ্বময় ধাম,
হে নাথ, খুঁজিতে তারে সেথা আসিলাম।
দাঁড়ালেম তব সন্ধ্যা-গগনের তলে,
চাহিলাম তোমা-পানে নয়নের জলে।
কোনো মুখ, কোনো সুখ, আশাতৃষা কোনো
যেথা হতে হারাইতে পারে না কখনো,
সেথায় এনেছি মোর পীড়িত এ হিয়া-
দাও তারে, দাও তারে, দাও ডুবাইয়া।
ঘরে মোর নাহি আর যে অমৃতরস
বিশ্ব-মাঝে পাই সেই হারানো পরশ।
কাঁদতে লাগলাম। পড়তে লাগলাম। মাদাম ‘র’ এলেন এবং বিচলিত হয়ে শুধালেন: “কী হয়েছে?” কী করে বোঝাই, হয়নি যে কিছুই … অথচ …”
রবীন্দ্রনাথের কবিতার রীতিমত ভক্ত হয়ে ওঠেন তিনি। এই সময়টাতে ওকাম্পোর নিজের বৈবাহিক জীবনেও চলছিল নানা টানাপড়েন। তাঁর সদ্য বিবাহিত স্বামী মনেকো এস্ত্রাদার সাথে সম্পর্ক ভাঙ্গনের পথে, এর মধ্যে স্বামীর এক কাজিন জুলিয়েন মার্টিনেজের সাথে গড়ে উঠেছে ‘সমাজ অস্বীকৃত’ এক ধরণের অবৈধ প্রেমের এক সম্পর্ক। ঠিক এই সময়টাতেই [১৯১৪] রবীন্দ্রনাথ তাঁর গীতাঞ্জলি নিয়ে এলেন তাঁর জীবনে। হয়তো গীতাঞ্জলির আধ্যাত্মিক কবিতাগুলো তাঁর টালমাটাল জীবনে কিছুটা শান্তির পরশ বুলিয়ে যেতে পেরেছিল সে সময়। ওকাম্পো বুঁদ হয়ে রইলেন রবীন্দ্রনাথের লেখায় পরবর্তী কয়েক বছর। ফরাসী ঔপন্যাসিক প্রুস্তের রচনার সাথে তুলনামূলক আলোচনা করে একটি অসামান্য লেখাও তিনি লিখে ফেলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ পড়ার আনন্দ’ শিরোনামে (৫) ।
তারপর এলো সেই বহু প্রতীক্ষিত সাক্ষাতের কাল, সে প্রায় ‘গীতাঞ্জলির ধাক্কার’ বছর দশেক পরে। দিনটি ছিল ১৯২৪ সালের নভেম্বরের একটি দিন। পেরুর যাত্রাপথে রবীন্দ্রনাথ বুয়েনোস আইরেসের প্লাজা হোটেলে আছেন জেনে তাঁর ‘গুরুদেব’কে এক ঝলক দেখতে এসেছিলেন ওকাম্পো। হোটেলে এসেই সামনে পেলেন রবীন্দ্রনাথের সেক্রেটারি লেনার্ড এলমহার্স্টকে। ওকাম্পোর সাথে খানিকক্ষণ কথাবার্তা বলার পরে এলমহার্স্ট তাঁকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ করে দিয়ে চলে গেলেন। রবি ঠাকুরের সাথে প্রথম সাক্ষাতের মুহূর্তটি ভিক্টোরিয়ার লেখায় উঠে এসেছে ঠিক এভাবে (৬) –
‘… প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি এলেন; নীরব, সুদূর, তুলনাহীন বিনীত। ঘরে এসে দাঁড়ালেন, আবার এও সত্যি যে ঘরে যেন তিনি নেই। … তেষট্টি বছর, প্রায় আমার বাবার বয়সী, অথচ কপালে একটি রেখাও নেই, যেন কোন দায়িত্বভারই নষ্ট করতে পারে না তাঁর সোনালী শরীরের স্নিগ্ধতা। সুগোল সমর্থ গ্রীবা পর্যন্ত নেমে এসেছে উছলে-ওঠা ঢেউতোলা সাদা চুলের রাশি। শ্মশ্রুমণ্ডলে মুখের নীচের দিকটা আড়াল, আর তারই ফলে ওপরের অংশ হয়ে উঠেছে আরো দীপ্যমান। মসৃণ ত্বকের অন্তরালে তাঁর সমগ্র মুখাবয়বের গড়ন এক অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য রচনা করেছে, তেমনি সুন্দর তাঁর কালো চোখ, নিখুঁত টানা ভারী পল্লব। শুভ্র কেশদাম আর স্নিগ্ধ শ্মশ্রু, এর বৈপরীত্যে জ্বলে উঠছে তাঁর চোখের সজীবতা।…’।
এসেছিলেন কেবল এক ঝলক দেখবার জন্য; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ জেনে অনেকটা জোর করেই তাঁকে হোটেল থেকে তুলে নেন ওকাম্পো, থাকার বন্দোবস্ত করলেন তাঁর এক আত্মীয়ের (ভাড়া করা) বাসায়। বাড়িটির নাম ‘মিরালরিও’। সত্তরের দশকে জ্যোতির্ময় মৌলিক এ বাড়িটিকে নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকায় — ‘বিজয়ার করকমলে’। লেখাটিতে শ্রীমৌলিক ‘মিরালরিও’ শব্দটির অর্থ করেছিলেন ‘স্রোতস্বিনীকে দেখা’ (৭) : ‘একটি উঁচু মালভূমির উপর বাসাটি অবস্থিত। এর সামনে আর পেছনে বিশাল প্রাঙ্গণ। সবুজ ঘাসের গালিচা মোড়া এ প্রাঙ্গণটির সৌন্দর্য ছিল অবর্ণনীয়। বাড়ি থেকে উত্তর দিকে কয়েক পা অগ্রসর হলেই দেখতে পাওয়া যায় তটরেখা-বিহীন বিশাল নদী ‘প্লাতা’। প্লাতা শব্দটির অর্থ রূপা’। রবীন্দ্রনাথ সেই ‘প্লাতা নদীর ধারের’ বাসাটিতে কাটিয়েছিলেন ঘটনাবহুল প্রায় তিন মাস। রবীন্দ্রনাথ যেদিন (১২ই নভেম্বর [৮]) ওকাম্পোর সঙ্গে তাঁর জন্য নির্ধারিত বাসাটিতে পৌঁছান, সে দিনটি ছিল এমনিতেই একটু অন্যরকম। ওকাম্পোর ভাষ্যমতে (৯) –
‘সেই বিকেলে আকাশ ক্রমেই হলুদ হয়ে আসছিল, আর বিশাল ঘন কালো মেঘ। এমন ভয়ঙ্কর গুরু মেঘ, অথচ এমন তীব্র ভাস্বর – কখনো এমন দেখিনি। আকাশ কোথাও সীসার মতন ধূসর, কোথাও মুক্তার মতো, কোথাও বা গন্ধকের মতো হলুদ, আর এতেই আরো তীব্র হয়ে উঠেছে নদীতট, আর তরুশ্রেনীর সবুজ আভা। ঊর্ধ্ব আকাশে যা ঘটেছিল, জলের মধ্যে তাই ফলিয়ে তুলেছিল নদী। কবির ঘরের বারান্দা থেকে দেখছিলাম এই আকাশ, নদী, বসন্তের সাজে ভরা প্রান্তর। বালুচরের উইলো গাছগুলি খেলা করছিল ছোট ছোট হাজারো নম্র পাতায় ঘরে ঢুকতেই ওঁকে নিয়ে এলাম অলিন্দে, বললাম: নদীটি দেখতেই হবে। সমস্ত প্রকৃতি যেন আমার সঙ্গে ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে দৃশ্যটাকে করে তুলল পরম রমণীয়। আলোর পাড়ে বোনা প্রবল মেঘপুঞ্জের অন্তরালে কে যেন প্রতিফলক সাজিয়ে ধরেছে আকাশে’।
এই অলিন্দ যেন হয়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের নিজেরই অলিন্দ। নভেম্বর-ডিসেম্বর এবং জানুয়ারির কটি দিন জুড়ে সে অলিন্দে তিনি দেখেছিলেন ‘গোলাপি কুয়াশার আস্তরণে ঢাকা বিকেলগুলি’ আর ফিরে পেয়েছিলেন তাঁর প্রত্যাশিত ‘মন্থর মুহূর্তগুলো’ (১০) :
‘যেন আমি আলোকের নিঃশব্দ নির্ঝরে
মন্থর মুহূর্তগুলি ভাসায় দিতেছি লীলাভরে’।
বলতে দ্বিধা নেই, প্লাতা নদীর তীরে এ বিখ্যাত বাড়িতেই হয়তো রচিত হয়েছিল ওকাম্পো আর রবিঠাকুরের মাঝে সেই ‘রহস্যময় প্রেমের’ নান্দনিক উপাখ্যানগুলো। মিরালরিওর বাসায় যেদিন কবিগুরু পৌঁছিয়েছিলেন সেদিনই রচনা করছিলেন ‘পূরবী’র অন্তর্গত বিখ্যাত ‘বিদেশী ফুল’ কবিতাটি (১১) —
হে বিদেশী ফুল, যবে আমি পুছিলাম—
‘কী তোমার নাম’,
হাসিয়া দুলালে মাথা, বুঝিলাম তরে
নামেতে কী হবে।
আর কিছু নয়,
হাসিতে তোমার পরিচয়।
হে বিদেশী ফুল, যবে তোমারে বুকের কাছে ধরে
শুধালেম ‘বলো বলো মোরে
কোথা তুমি থাকো’,
হাসিয়া দুলালে মাথা, কহিলে ‘জানি না, জানি নাকো’।
বুঝিলাম তবে
শুনিয়া কী হবে
থাকো কোন্দেশে।
যে তোমারে বোঝে ভালোবেসে
তাহার হৃদয়ে তব ঠাঁই,
আর কোথা নাই।
…
হে বিদেশী ফুল, যবে তোমারে শুধাই ‘বলো দেখি
মোরে ভুলিবে কি’,
হাসিয়া দুলাও মাথা; জানি জানি মোরে ক্ষণে ক্ষণে
পড়িবে যে মনে।
দুই দিন পরে
চলে যাব দেশান্তরে,
তখন দূরের টানে স্বপ্নে আমি হব তব চেনা—
মোরে ভুলিবে না।
শেষ পর্বে সমস্ত ফুট নোট দেওয়া রয়েছে।
(ক্রমশ)