তিন.
ময়মনসিংহ জেলার কাপাসাটিয়া গ্রামে ১২৭৭ সনের ২৬ জ্যৈষ্ঠ মাতুলালয়ে লোকনাথ মজুমদারের ঔরসে জয়দুর্গাদেবীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন কেদারনাথ। মহাভারত রচয়িতা রামেশ্বর নন্দী তাঁর পূর্বপুরুষ।
কাপাসাটিয়া গ্রামের পাঠশালায় কেদারনাথের বাল্যশিক্ষা। তারপর তিনি চলে আসেন কৃষ্ণকুমারের বাসায়। কৃষ্ণকুমার ছিলেন তাঁর মাতুল। ভর্তি হলেন নাসিরাবাদ এন্ট্রান্স স্কুলে। এই স্কুলের হেডপণ্ডিত উমেশচন্দ্র বিদ্যারত্নের গভীর প্রভাব পড়েছিল তাঁর জীবনে। শাস্ত্রচর্চায় নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন উমেশচন্দ্র। ‘মানবের আদি জন্মভূমি’, ‘ঋগ্বেদের প্রকৃতার্থবাহী’, ‘জাতিতত্ত্ববারিধ’ প্রভৃতি গ্রন্থরচনা করেন তিনি। ‘মন্দারমালা’ নামক এক সংস্কৃত পত্রিকা প্রকাশ করতেন। পরে ‘আরতি’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। পুরাণ ও শাস্ত্র সম্পর্কে কেদারনাথের কৌতূহল জাগ্রত করেন তিনি এবং পত্রিকা প্রকাশের ব্যাপারে উৎসাহ দান করেন।
কেদারনাথ এরপরে কিছুদিন সিটি স্কুলে পড়াশুনো করেন, তারপরে ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। প্রথাগত লেখাপড়ায় তাঁর খুব উৎসাহ ছিল না। গৌরচন্দ্র নাথের লেখা থেকে জানা যায় যে স্কুলের পেছনের বেঞ্চিতে বসে তিনি ‘অপাঠ্য বই-এর পাতায়’ ডুবে থাকতেন। এমন কি এই পেছনের বেঞ্চিতে বসে তিনি লিখতে শুরু করেছিলেন তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘প্রফুল্ল’।
তাঁর সাহিত্য প্রীতিকে জাগিয়ে দিয়েছিল ‘মনোরঞ্জিকা ক্লাব’। ময়মনসিংহ জেলা স্কুলের এই ক্লাবটিতে প্রতি রবিবার বিকেলবেলায় বসতো সাহিত্যের আসর। শহরের লেখকরা আসতেন, স্কুলের ছেলেরাও যোগ দিত। এখানেই তিনি আনন্দমোহন বসু, বঙ্গচন্দ্র রায়, শ্রীনাথ চন্দের সংস্পর্শে আসেন। শ্রীনাথ চন্দ লিখেছেন —
‘ছাত্রজীবনেই এভাবে সাহিত্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ও নানাবিধ গ্রন্থপাঠ করতে করতে স্বাধীনভাবে জ্ঞানার্জনস্পৃহা তাঁর এতই বেড়ে গিয়েছিল যে স্কুলের গণ্ডিঘেরা জীবন তাঁর নিকট অসহ্য হয়ে উঠল। শেষ পর্যন্ত ১৮৮৯ সনে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়েই স্কুল ছেড়ে দিলেন, আর কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চৌকাঠ তিনি মাড়ান নি।’
কিন্তু শিক্ষা সম্পর্কে সহজাত অনুরাগ ছিল তাঁর। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় বিচিত্র বিষয়ে জ্ঞানলাভ করেন তিনি। তাঁর গ্রন্থাগার তার প্রমাণ। পারিবারিক সমস্যা, অর্থনৈতিক সংকট, যোগাযোগের অভাব — কিছুই তাঁর জ্ঞানস্পৃহাকে অবদমিত করতে পারে নি। গিরিশচন্দ্র সেনগুপ্ত লিখেছেন —
‘কেবল নিজের প্রতিভাবলে, নিজের অধ্যবসায়ে ঘরে বসিয়া নানা বিষয়ের রাশি রাশি গ্রন্থ আয়ত্ত করিয়াছিলেন। তাহার ফলেই তিনি বহুদর্শী ও সুলেখক। এইটুকুই তাঁহার বৈশিষ্ট্য। যাঁহারা প্রতিভাশালী তাঁহারা এইভাবেই নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করিয়া থাকেন। …
‘কেদারবাবু রুগ্ন শরীর নিয়া যেরূপ অসাধ্য সাধন করিয়াছেন, সুস্থ সবল দেহ মানবেও তাহা পারে কিনা সন্দেহ।
‘আমরা যখনই তাঁহার বাসায় গিয়াছি তখনই দেখিয়াছি তিনি বিপুল গ্রন্থরাশি মধ্যে বসিয়া ধ্যাননিমগ্ন যোগীর ন্যায় শাস্ত্র চিন্তায় নিমগ্ন রহিয়াছেন, প্রায় জীবন ব্যাপিয়া তাঁহার এই অবস্থা ছিল।’
চার.
সংবাদপত্রের সঙ্গে কেদারনাথের ছিল নিবিড় প্রেম। তিনি ‘কুমার’, ‘আরতি’ ও ‘সৌরভ’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। কন্যা আরতি ও পুত্র সৌরভের স্মৃতিতে ‘আরতি’ ও ‘সৌরভ’ প্রকাশিত হয়। কেদারনাথ সম্পাদিত পত্রিকাগুলি আলোচনার পূর্বে ময়মনসিংহের সংবাদপত্রের ইতিহাসে একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।
১৮৬৬ সালে ময়মনসিংহে প্রথম একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তার নাম ‘বিজ্ঞাপনী’। সম্পাদক জগন্নাথ অগ্নিহোত্রী। পত্রিকাটির অকালমৃত্যুর কারণ সম্পাদকের ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ। এতে তখনকার হিন্দুসমাজ বিরূপ হয়। কিন্তু এ কথা স্বীকার করতে হয়ে যে ব্রাহ্মরা নানা রকম প্রগতিশীল ভাবনা-চিন্তার সূত্রপাত করেছিলেন। ১৮৬৯ সালে প্রকাশিত হয় একটি পাক্ষিক পত্রিকা, নাম ‘অবলাবান্ধব’। এর সম্পাদক ছিলেন দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়। পত্রিকার নাম থেকেই বোঝা যায় যে নারীসমাজের উন্নতিবিধানের লক্ষ্য নিয়েই পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল।
ময়মনসিংহে ব্রাহ্মধর্মের প্রসারের গতি রোধ করার জন্য আসরে নামেন হিন্দুধর্মের নেতারা। তাঁরা যেমন গঠন করেন ‘হিন্দুধর্ম জ্ঞানপ্রদায়িনী সভা’, তেমনি ‘আর্যধর্ম প্রকাশিকা’ নামে তার একটু মুখপত্রও প্রকাশ করেন। ব্রাহ্মধর্মের প্রবক্তা শ্রীনাথ চন্দের সম্পাদনায়, কবি আনন্দচন্দ্র মিত্রের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৮৭৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘বাঙালী’। আর একজন ব্রাহ্মনেতা কালীনারায়ণ সান্যালের প্রচেষ্টায় ১৮৭৫ সালে প্রকাশিত হয় ‘ভারতমিহির’ পত্রিকা। পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন অনাথবন্ধু গুহ ও জানকীনাথ ঘটক। তখনকার রাজশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল বলে এই পত্রিকাটি সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
ময়মনসিংহে সাময়িকপত্রের যাত্রা শুরু হয় ১৮৬৫ সালে ‘বিদ্যোন্নতিসাধিনী’ পত্রিকা দিয়ে। তারপর ১৮৮১ সালে প্রকাশিত হয় ‘চারুবার্তা’ এবং ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত হয় ‘চারুমিহির’। পত্রিকা দুটির পেছনে ছিল শেরপুরের বিদ্যোৎসাহী জমিদার হরচন্দ্র চৌধুরীর সাহায্য।
যতীন সরকার লিখেছেন, “১৮৭৫ সালের ১৪ এপ্রিল সাপ্তাহিক ‘সুহৃদ’ এবং মাসিক ‘প্রমোদী’ এই দুটি পত্রিকা এবং ১৮৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ময়মনসিংহ শহর থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘রজনী’ সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য জানা যায় নি। ‘ল-রিপোর্ট’ ‘বাঙ্গালা ল-রিপোর্ট’ ও ‘নাজির দর্পণ’ — এই তিনটি আইন বিষয়ক সাময়িকী বের হয় যথাক্রমে ১৮৮০-র আগস্ট, ১৮৮১-র জুলাই ও ১৮৯১-এর জানুয়ারি মাসে।
“১৮৮১ সালের ডিসেম্বর মাসে ব্রাহ্ম আন্দোলনের নববিধানের প্রচারপত্ররূপে প্রকাশিত মাসিক ‘হরিভক্তি তরঙ্গিনী’ কিংবা ১৮৮২ সালের মাসিক ‘বঙ্গবিলাপ’ কিংবা ১৮৮৭ সালের মাসিক ‘বাসন্তী’ — এই সাময়িকীগুলোর সব তথ্যই বিস্মৃতির অতলে তলিয়া গেছে।
“এই প্রসঙ্গে ১৮৯৮ সালে প্রকাশিত ও রাজেন্দ্রনারায়ণ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত মাসিক ‘নির্ম্মাল্য’ বছর দুয়েক চালু ছিল। মুক্তাগাছার জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য ছিলেন তার পষ্ঠপোষক।”
কেদারনাথ মজুমদারের পত্রিকা প্রকাশের সূত্রপাত বাংলা ১২৯৪ সালে। প্রকাশিত হয় ‘কুমার’। এই পত্রিকা অবশ্য স্বল্পস্থায়ী হয়েছিল। এর পর ১৩০৭ সালে প্রকাশিত হয় ‘আরতি’। সম্পাদক ছিলেন উমেশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। তবে পত্রিকার কাজ করতেন কেদারনাথ। সম্পাদককে নিয়ে একটা বিভ্রাট ঘটে। উমেশচন্দ্র পত্রিকায় ‘বেদ অপৌরুষেয় নহে’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লেখেন। এতে হিন্দু সমাজের নেতারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। ফলে সম্পাদক পরিবর্তন করতে হয়।
শ্রীনাথ চন্দ, যতীন্দ্রনাথ মজুমদার, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, বিন্দুবাসিনী সরকার, গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী, হেমচন্দ্র চক্রবর্তী, আশালতা গুপ্তা, উপেন্দ্রচন্দ্র রায় প্রভৃতির কবিতা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। দুর্গাদাস রায়, গিরিশচন্দ্র কবিরত্ন, করুণানাথ ভট্টাচার্য, সৈয়দ নুরুল হোসেন, রেবতীমোহন গুহ, কামিনীকুমার সেন, কেদারনাথ মজুমদার প্রভৃতির উন্নতমানের প্রবন্ধ ছিল পত্রিকাটির গৌরব। (ক্রমশ)