স্বাধীন বাংলা বেতারে তখন ছিলেন কামাল লোহানী, আমরা পূর্বদেশ পত্রিকায় একসঙ্গে কাজ করেছি। এম আর আখতার মুকুলের ‘চরমপত্র’ ছিল খুবই জনপ্রিয়। মুকুল ভাই তাঁর অননুকরণীয় কণ্ঠে যখন কথিকাটি পড়তেন তখন সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনত। মানুষের মুখে মুখে তখন চরমপত্রের কথা। তখন থাকি অগিলভি হোস্টেলে। হেদুয়া পার্কের কাছাকাছি। হোস্টেলের সুপারেনটেন্ডেন্ট ছিলেন কবি তরুণ সান্যাল। তাঁর সঙ্গে কলেজ স্ট্রিটে ‘পরিচয়’ পত্রিকার অফিসে দেখা হয়। তখন পরিচয়-এর সম্পাদক দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। পরিচয় পত্রিকার অফিসেই সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে দেখি। এখানেই সুভাষদার সঙ্গে পরিচয় হয়। ‘কফি হাউস’-এ অমিতাভ দাশগুপ্তের সঙ্গে দেখা হলে তিনিই পরিচয় অফিসে নিয়ে যান। বিষ্ণু দে-র সঙ্গে দেখা করতে গেছি হাফিজ ভাইয়ের সঙ্গে। তাঁর যোগাযোগ ছিল বিষ্ণু দে-র সঙ্গে । বুদ্ধদেব বসু থাকতেন নাকতলায়। কমল সাহা এদিকেই থাকত, সে-ই বুদ্ধদেব বসুর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়নি। থাকি অগিলভি হোস্টেলে। এখানে নূর মোহাম্মদ মিয়া, সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায়, আতাউর রহমান ও বাংলাদেশের আরো কয়েকজন লেখক ও অধ্যাপক থাকতেন। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করি। কলকাতায় তখন যে বিদেশি সাংবাদিকরা ছিলেন তাঁদের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশে পাকিস্তানি গণহত্যা ও বর্বরতার বিবরণ জানাই। আমার হারিয়ে যাওয়া কবিতাগুলো উদ্ধারের জন্য কলকাতা ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকাগুলো অনুসন্ধানের চেষ্টা করি। ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে তখন ছিলেন নচিকেতা ভরদ্বাজ। কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে এসে বাংলাদেশের পুরনো পত্রিকার পাতা উল্টাই। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। ইয়াহিয়া তাঁকে ফাঁসি দেওয়ার পায়তারা করছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের কবি, লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা সক্রিয় সমর্থন জুগিয়েছেন। পাকিস্তানি বাহিনীর ববর্রতা ও গণহত্যার বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন তাঁরা। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, অন্নদাশঙ্কর রায়, মৈত্রয়ী দেবী প্রমুখ কবি-লেখকেরা বিশেষভাবে সোচ্চার ছিলেন। ভারতে তখন প্রায় এক কোটি শরণার্থী। ইন্দিরা গান্ধী স্বয়ং শরণার্থী শিবিরগুলোতে ঘুরে ঘুরে শরণার্থীদের দেখেছেন এবং খোঁজখবর নিয়েছেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যে সমর্থন ও সহযোগিতা জুগিয়েছে তার তুলনা হয় না। ফরাসি লেখক আঁদ্রে মারলো, মাদার তেরেসা, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, গিনসবার্গ, জর্জ হ্যারিসন, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, লতা মুঙ্গেশকর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দৃঢ় সমর্থন জানান। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর আক্রমণের খবর শুনে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ৮১ বছর বয়সে অসুস্থ শরীরে আর্জেন্টিনার রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ মিছিল করেছিলেন। বাংলাদেশের শিশুরা খাবার পাচ্ছে না জেনে লতা মুঙ্গেশকর তাত্ক্ষণিকভাবে এক লাখ রুপি দিয়েছিলেন তাদের জন্য। মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস তাঁর গানের আয় থেকেও একটি বড় অংশ বাংলাদেশের জন্য দিয়েছেন তিনি। ছবির সাইনিং মানি দিয়ে দিয়েছিলেন ওয়াহিদা রহমান। ‘জয়বাংলা’ অফিস থেকে খুব দূরে নয়, থাকেন আবু সায়ীদ আইয়ুব ও গৌরী আইয়ুব। মোহাম্মদ রফিক আর আমি অনেকদিন তাঁদের বাসায় চলে গেছি। আবু সায়ীদ আইয়ুবের মতো মনস্বী লেখক দুই তরুণকেও হাসিমুখে সময় দিয়েছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাঁর ছিল গভীর শ্রদ্ধা।
আগে পরে কিছুই খুব একটা ঠিক রাখতে পারছি না, যখন যার কথা মনে পড়ছে তখনই লেখার চেষ্টা করছি, যদি মনে করতে না পরি। এভাবেই লিখতে হবে। বঙ্গবন্ধুর ওপর চলছে পাকিস্তানি শাসকদের সীমাহীন নির্যাতন। পাকিস্তানের কারাগারে রাতের পর রাত তিনি না ঘুমিয়ে কাটান। তাঁর ওপর শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। এর মধ্যেই কলকাতায় অনেকদিন হয়ে গেল, মা-বাবা পড়ে আছে পশ্চিম দিনাজপুরে। সবসময় ঠিকমতো তাদের খবরও পাই না। বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের অত্যাচার আরো বাড়ছে। গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস করে দিচ্ছে তারা। আত্মীয়স্বজন কে কোথায় আছে তা-ও জানি না। ঢাকারও খবর জানি না কতদিন। কে কেমন আছে তা-ও জানি না। সেই গণহত্যা ও বর্বরতার মধ্যে কখন কার কী হয় কে জানে। মুক্তিবাহিনীর তরুণেরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। মাঝে মাঝে মন বড় অস্থির হয়ে ওঠে, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়পরিজন কে কেমন আছে কিছুই জানি না, কে বেঁচে আছে কে নেই, কে জানে, ‘সে এখন বেঁচে আছে কি না/ তা সুদ্ধ জানি না’ মন বড় বিচলিত হয়ে পড়ে। হেদুয়া পার্ক কিংবা মানিকতলা হয়ে অগিলভি হোস্টেল, স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্র, পত্রপত্রিকার অফিস, কলেজ স্ট্রিট, কফি হাউস এভাবে সময় কাটছে।
এরমধ্যেই একদিন চলে গেলাম ‘যুগান্তর’ অফিসে। যুগান্তরের বার্তা সম্পাদক তখন দক্ষিনারঞ্জন বসু। খুব সহূদয় মানুষ। যুগান্তরে তখন ছিলেন প্রফুল্ল রায়, খুবই স্নেহ করেন আমাকে। অনেকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। তখন যুগান্তরের সাহিত্য সম্পাদক কৃষ্ণ ধর। ‘অমৃত’ পত্রিকার সম্পাদক মনীন্দ্র রায়। যুগান্তরে কলাম লেখাও শুরু করি। শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে পরিচয় হয় আরো পরে, বোধহয় ‘পরিচয়’-এ এসেছিলেন। একদিন কফি হাউসে বেলাল চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হলো, কলকাতায় থাকেন। দেশ পত্রিকার অফিসেই একদিন তারাপদ রায়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। একদিন দেখা হলো সমরেশ সেনগুপ্তের সঙ্গে। আনন্দবাজার অফিসেই শরত্কুমার মুখোপাধ্যায় ও প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের সঙ্গেও দেখা হয়। কলকাতার সেই দিনগুলোতে মনে হয় যেন কবিতার মধ্যেই ডুবে আছি, প্রতিদিনই নতুন নতুন কবি-লেখকদের সঙ্গে দেখা। কত কথা ভুলেও গেছি, তবে একথাটি মনে আছে, সে ছিল কবিতার দিনরাত্রি। নতুন দেশের স্বপ্ন আর রাত জেগে নতুন কবিতা লেখা এই নিয়ে মগ্ন হয়েছিলাম। কত মানুষের সঙ্গে যে দেখা হয়েছে কলকাতায়, কবি, লেখক, শিল্পী, রাজনৈতিক কর্মী সবার মধ্যে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের জন্য বুকভরা ভালোবাসা। প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যা কাটে কফি হাউসে। সেখানে প্রতিদিনই কারো না কারো সঙ্গে পরিচয় হয়। শান্তনু দাশ ও ময়ূখ বসু সেসময় ‘গঙ্গোত্রী’ নামে একটি পত্রিকা বের করতেন। একদিন তাঁদের সঙ্গে পরিচয় হলো, জীবন সরকার ও রণজিত্ রায় চৌধুরীর সঙ্গেও দেখা হলো একদিন। এরমধ্যেই দেবারতি মিত্রের সঙ্গেও দেখা হয়েছে।
আমাদের সেই দুঃসহ দিনগুলোতে কলকাতায় যেখানে যার কাছেই গেছি মনে হয়েছে যেন কতদিনের চেনা। বাংলাদেশের মানুষের জন্য তাদের ভালোবাসার অন্ত ছিল না। বয়স তখন কম। আত্মীয়-পরিজনহীন এত বড় শহরে মাঝে মাঝে মন খুব খারাপ হয়ে যায়। ঢাকার বন্ধুদের কথা খুব মনে হতে থাকে। সারাদিন ট্রামে বাসে ছোটাছুটি, রাতে ঘরে ফিরে বড় ক্লান্ত হয়ে পড়ি। কোনো কোনোদিন একা একাই বারান্দায় বসে ভাবতে থাকি এই শহরে রবীন্দ্রনাথ জন্মেছেন, কত মনীষী, মহাপুরুষ, ক্ষণজন্মা মানুষের জন্ম এই শহরে, আমি একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের শরণার্থী, দেশের কোটি কোটি মানুষ পাকিস্তানি বর্বরতার নির্মম শিকার, কত মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসেছে, কত নারী-শিশু পাকিস্তানি বর্বরদের অকথ্য নির্যাতনের শিকার, বিছানায় শুয়েও ঘুম আসে না, বুকটা হাহাকার করে ওঠে। ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ‘ভয় নাই ওরে ভয় নাই—/ নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’ এত দুঃখের মধ্যেও একটি নতুন স্বাধীন দেশের স্বপ্নে আশায় বুক ভরে যায়, ঘুমের মধ্যেই শুনতে পাই হাজারো কণ্ঠের ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি। থিয়েটার রোড, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র, আকাশবাণী, পত্রপত্রিকার অফিস, কফি হাউস, সারাদিন ঘুরে ঘুরে দিন কাটে। থিয়েটার রোডে গিয়ে দেশের মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, বাংলাদেশের লেখক-শিল্পী, সাংবাদিক, মুকুল ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়। জয়বাংলা পত্রিকার অফিসে গাফ্ফার ভাই, রাজ্জাক ভাই, স্বাধীন বাংলা বেতারে লোহানী ভাই, জাস্টিস মাসুদ সাহেবের বাড়িতে শওকত ওসমান। কলাকাতার লেখকশিল্পী সংস্থাও গড়ে উঠেছে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির অফিসেও বাংলাদেশের শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা হয়। একদিন তখনকার তরুণ ন্যাপ নেতা মোনায়েম সরকারের সঙ্গে দেখা হলো। তখন বেশ শীতও পড়েছে। মোনায়েম সরকার আমাকে কয়েকটি কম্বল দিলেন। এগুলো শরণার্থীদের জন্য সাহায্যের কম্বল। রাজনৈতিক অফিস ও বিভিন্ন সংগঠনের কাছে দেওয়া হয়। কম্বলগুলো খুবই কাজে লাগে। অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম তখন লন্ডনে, পিএইচ ডি করতে গেছেন। সেখানে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কাজ করছেন, জনমত সংগঠিত করার কাজে বিশেষভাবে সক্রিয়। তিনি শুনেছেন আমি কলকাতায় আছি। লন্ডন থেকে কলকাতা যাত্রী একজন শিক্ষকের হাতে তিনি আমার জন্য কিছু অর্থও পাঠিয়ে দেন। সেসময়ের এই স্নেহ-ভালোবাসা ও সহমর্মিতার কোনো তুলনা হয় না। [ক্রমশ]
খুব সুন্দর লেখা।বাংলাদেশ গঠনের সময় কত অগনিত মানুষ এর জন্য আবেগে ভেসে গিয়েছিলেন বর্তমান সময়ে একথা গুলি জানা খুব জরুরী।রাষ্ট্রের গঠন কি করে হয় এ সম্পর্কেও জানাটা আমাদের খুব দরকার।এই লেখাটি চলুক।অনেক অকথিত ভাষ্য পাচ্ছি।লেখককে মুঠিবদ্ধ অভিনন্দন।