“মৎস্য ধরিব খাইব সুখে” — উত্তরাখান্ড (উত্তর অঞ্চল নামেও পরিচিত) হিমালয় আর শিবালিক পাহাড়ে ঘেরা প্রাকৃতির অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি। এখানে সৃষ্টি হয়েছে যমুনা গঙ্গা-সহ অজস্র নদী। বহু অখ্যাত বিখ্যাত হ্রদের উৎসস্থল এই রাজ্য। তেহরি গাড়ওয়াল হল ভারতের উত্তরাখণ্ড পার্বত্য রাজ্যের একটি জেলা। এটি পূর্বে রুদ্রপ্রয়াগ জেলা, পশ্চিমে দেরাদুন, উত্তরে উত্তরকাশী জেলা এবং দক্ষিণে পাউরি গাড়ওয়াল জেলা দ্বারা বেষ্টিত।
আজ আপনাদের এই এলাকার এক উৎসবের কথা বলব যেখানকার জনগোষ্ঠীর জীবনে মাছ কোন ভূমিকাই পালন করে না। তবুও এরা মাছের নামে উৎসর্গীকৃত এক অনুষ্ঠান করে প্রতিবছর। যেখানে আপনিও আমন্ত্রিত।
দক্ষিণ ভারত বা পশ্চিম ভারতের মতো এখানকার মানুষ কট্টরবাদী নয়। তাই ব্রাহ্মণ থেকে অব্রাহ্মণ সবাই সুযোগ-সুবিধা হলে আমিষ গ্রহণ করে। তবে শীতই-এর প্রধান কারণ।
“মৎস্য মারিব খাই সুখে”… এই আত্মবাক্যকে যেন বাস্তবায়িত করার জন্যই উত্তরাখণ্ডের মানুষজন মৌন মেলার আয়োজন করে। প্রত্যেক বছর জুন মাসের শেষ সপ্তাহে এই উৎসবের আয়োজন হয়।
ঐতিহাসিক রাজ মৌন মেলা উত্তরাখণ্ডের তেহরি গাড়োয়াল জেলার জৌনপুর ব্লকে প্রতি বছরই অত্যন্ত আড়ম্বর সহকারে পালিত হয়েছে। জৌনপুর, জৌনসার, উত্তরকাশী এবং মুসৌরি অঞ্চল-সহ প্রায় ১১৪টি গ্রামের মানুষ এই মেলায় অংশগ্রহণ করে।
মৌন শব্দটি মীন থেকে এসেছে, এই উৎসবের শুরু ঠিক কিভাবে বা কবে হয়েছে তা নিয়ে কোন ঐতিহাসিক নথি প্রমাণ কিছু নেই স্থানীয় মানুষের কথা অনুসারে এই মেলার বয়স ১০০ বছরেরও বেশি। প্রায় এক শতাব্দী আগে তেহরির শাসক রাজা সুদর্শন শাহ এটি শুরু করেছিলেন। সম্ভবত রাজা এবং তাঁর পারিষদবর্গরা নিছক শিকার প্রমোদের অঙ্গ হিসেবে এটি শুরু করেছিলেন, পরবর্তীকালে আমোদ প্রমোদের অঙ্গ হিসেবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এটি গ্রহণ করেছেন।
বিপুল সংখ্যক গ্রামবাসী বর্ষার শুরুতে, জুনের শেষ সপ্তাহে ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্রের সুরে আগলাদ নদীতে মাছ ধরে এবং আনন্দের সাথে উদযাপন করে এই মেলা। লোকজন প্রথমে আগলাদ নদীতে পূজা করেন এবং এরপর নদীতে মৌন ঢালার রীতি পালন করেন। এরপর বিপুল সংখ্যক শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এসে মাছ ধরতে নদীতে ঝাঁপ দেন।
মাছ ধরা হয় কিভাবে? বঁড়শি দিয়ে না জাল দিয়ে? এটাই মৌন মেলার সবচেয়ে বড় রহস্য। যেবার যে পট্টির মানুষজন মেলার দায়িত্ব নেয় তারা বেশ কিছুদিন ধরে টিমরু (Xanthoxylum armatum জ্যান্থোক্সিলাম আরমাটাম) বলে এক বিশেষ গাছের ছাল সংগ্রহ করে। হিমালয়ের জঙ্গলে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় টিমরু। এই গাছের কান্ডের ছাল, পাতা এবং বীজ ব্যবহার করে সংগ্রহ করে শুকিয়ে মর্টার বা মর্টারে ভালো করে পিষে গুঁড়া তৈরি করে। প্রায় ১০ টন মসলা তৈরি করা হয়। স্থানীয়রা এটিকে ‘মৌন পাউডার’ বলেন। এগুলোকে মেলার আগে নদীর ওপর ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
গ্রামবাসীরা এক মাস আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। গ্রামবাসীরা প্রাকৃতিক ভেষজ ও ঔষধি গুণে সমৃদ্ধ টিমরুর গুঁড়া নদীতে পড়ার পর মাছটি কিছু সময়ের জন্য অজ্ঞান হয়ে পড়ে। পাউডার থেকে মাছ মরে না।
স্থানীয় গ্রামবাসীরা জানান, গতবছর ঐতিহাসিক এই উৎসবে টিমরু পাউডার ঢালার দায়িত্ব ছিলো শিলওয়াড়, লালুর, আটজুলা ও ছজুলা পট্টির মানুষজন। এছাড়াও ছিলেন সাদাকসারি, মিরিয়াগাঁও, টিকরি, ছানি, ঢাকরোল ও সল্টওয়াড়ি গ্রামের মানুষ। মেলার আগে আগলাদ নদীর তিন কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে বাঁশ আর কাঠ দিয়ে তৈরি বানানো একটি অস্থায়ী বাঁধ তৈরি করে যাতে স্রোতকে কিছুটা স্থিতিশীল করা যায়। হাজার হাজার গ্রামবাসী তাদের কুন্দিয়াদা, ফতিয়াদা, জাল ও হাত দিয়ে মাছ ধরে। যেসব মাছ ধরা পড়ে না, সেগুলো পরে মিঠাজলে জীবিত হয়ে যায়।
মেলায় ২০,০০০ থেকে ২৫,০০০ কেজি মাছ ধরা হয়, যা গ্রামবাসীরা তাদের বাড়িতে প্রসাদ হিসেবে নিয়ে যায়, অতিথিদের পরিবেশন করে। নদীর ধারে অনেকেই ধরা মাছ পুড়িয়ে বা ভেজে লাল জল সহযোগে দিব্যি ভোজন সেরে নেয়। সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে মৌন মেলার সমাপ্তি।
উৎসবের সঙ্গে মৌন মেলায় ঐতিহ্যবাহী লোকনৃত্যও পরিবেশিত হয়। মৌন মেলায় বিদেশি পর্যটকরাও অংশ নেয়। এটি ভারতের একটি অনন্য এবং বিশেষ মেলা, যার উদ্দেশ্য হল পরিবেশ এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা। এর আরেকটি উদ্দেশ্য হলো নদী পরিষ্কার করা। যাতে মাছগুলোও প্রজননের জন্য বিশুদ্ধ জল পায়। এছাড়া নদীর স্রোতে হাজার হাজার মানুষ চলাচল করলে তলদেশে জমে থাকা শেওলা ও ময়লা পরিষ্কার হয়ে ভেসে যায়। মৌন মেলার পর আগলাদ নদী স্পষ্ট দেখা যায়।
তবে এই মেলা নিয়ে পরিবেশবিদ ও প্রাণীবিদরা যথেষ্ট চিন্তিত। শুধু চিন্তিতই নয় অনেকেই এই মেলা বন্ধের পরামর্শও দিয়েছেন। তাদের শঙ্কার কারণ দুটো — এক মেলার সময়, দুই মাছ ধরার জন্য ব্যবহৃত টিমরুর গুঁড়া।
এই সময় নদীতে যেসব মাছ ডিম পাড়তে আসে তাদের বেশিরভাগই বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ যেমন স্নো ট্রাউট, গোল্ডেন মহাশোর ইত্যাদি। ডিমওয়ালা এইসব মাছ যদি মেলায় মরে যায়, তাহলে এইসব মাছের বংশবৃদ্ধি হবে কিভাবে? বিশেষজ্ঞরা অনেকেই বলেছেন মেলাটি পিছিয়ে আগস্ট মাসের শেষের দিকে করতে। তাতে ডিমওয়ালা মাছ ধরা না পড়ে ডিম ছেড়ে দেওয়া ফিরতি মাছ ধরা পড়বে। এতে করে কিছু প্রজাতির মাছ একদম বিলুপ্তি হয়ে যাওয়া ঠেকানো যাবে।
টিমরুর গুঁড়ো ক্ষারধর্মী হওয়ায় শুধু মাছেরই ক্ষতি হচ্ছে তা নয় এই ক্রিয়ায় ফাইটোপ্লাংকটন, অ্যালগিসহ ব্যাঙাচি, প্রজাপতি লার্ভা, সাপ ইত্যাদিরও ক্ষতি হচ্ছে। এর ফলে ভেঙে পড়তে পারে নদীর খাদ্যশৃঙ্খলা। নদী নির্ভর পাখিদেরও সমস্যা তৈরি হতে পারে।
পজেটিভ কথা হল আগে যে মেলার বিস্তৃতি ১০ কিলোমিটার জুড়ে হতো বর্তমানে সেটি তিন কিলোমিটার পরিধির মধ্যে আটকানো গেছে। আর মেলার সময়, আশা করা যায় খুব শীঘ্রই হয়তো পরিবর্তন হয়ে যাবে।
আগলার নদী উপত্যকার বৈচিত্র্য বজায় রাখতে জনগণের অনুভূতিতে আঘাত না করে এই লোকজ উৎসবের আয়োজন করা জরুরি। বর্তমানে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা এবং সংবেদনশীলতা প্রোগ্রাম সংগঠিত করা হচ্ছে। এখন অব্দি গ্রামবাসীরা একদিনের জন্য হলেও মৎস্য মারিব খাইব সুখের নীতিতে উত্তাল হয়ে রয়েছে আর ‘মাচ্ছিখোর’ বাঙালি দূর থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে, এমন সুখ কি আমাদের কপালে জুটবে!! দিন দশেক আগে থেকে মেলার খবর দিলাম, যদি সম্ভব হয় তাহলে স্বচক্ষে এই মেলা দেখে আসতে পারেন।
প্রত্যেক উৎসবেরই ভালো মন্দ দুই দিকই থাকে মাছধরা উৎসবে ব্যবহৃত টিমরু
ব্যবহারের ক্ষতি অনেক,প্রকৃতি পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে এর অন্য কোনো বিকল্প ভাবা যেতে পারে।আনন্দ ভালোলাগা ভালোবাসার জন্ম দেয়।
মাছ ধরা আর তারপর আবার জলে ছেড়ে দেওয়ার রীতি রেওয়াজ আছে আবার
মাছ ধরে খাবার আনন্দটাও নজরান্দাজ করা যায় না।তার ওপর যদি তাতে ধর্মের
স্পর্শ থাকে তাহলে সেটা চিরন্তন চিরকালীন।মাছ ভাত বাঙ্গালীর উৎকৃষ্ট রুচির
একটা।এটা কোনো আদিখ্যেতা নয়। ভালো লেখা ভালোলাগা ভালোবাসা।
এত সুন্দর একটা কমেন্টের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই আপনাকে। ভালো থাকবেন।
বাঃ বেশ অদ্ভুত একটা লোকজ উৎসবের কথা জানলাম। কতো বৈচিত্র যে আমাদের এই প্রাচীন দেশের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে আছে।
একদম তাই❤️
।”বিশাল বিশ্বের আয়োজন;
মন মোর জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এক কোণ।”