তখন রাজশাহী শহরে একটি পার্কের নাম ছিল ভুবনমোহন পার্ক। জানি না পার্কটি এখন আছে কি না। এই পার্কের পাশ দিয়ে শহরের ভেতরে যেতাম। মতিহার থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস যেত শহরে। আমরা বাসেই যাতায়াত করতাম। যাঁরা শহরে থাকতেন তাঁরাও এই বাসেই আসতেন। মতিহার খুব সুন্দর এলাকা। গাছপালা আর সবুজে ছাওয়া। কোলাহল নেই, শব্দ নেই, লেখাপড়ার জন্য উত্তম পরিবেশ। এখানে এসে আমারও মন ভরে গেল। সামান্য দূরে পদ্মা। কোনো কোনোদিন বিকেলে চর পাড়ি দিয়ে পদ্মার তীরেও বেড়াতে যেতাম। সঙ্গে থাকত দেলোয়ার। আমাদের সঙ্গে বাংলা বিভাগেরই ছাত্র। আমরা একই হলে থাকতাম। এদিকে দিনদিনই দেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী শুরু হয় প্রবল গণঅভ্যুত্থান। রাজশাহী সবসময়ই প্রতিবাদের শহর। সেই ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিলই রাজশাহী জেলের সব খাপড়া ওয়ার্ডে চলে বেপরোয়া গুলিবর্ষণ। তখন কমিউনিস্ট পার্টি ছিল নিষিদ্ধ। দ্বিজাতিত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া পাকিস্তান রাষ্ট্রে শুরু থেকেই কমিউনিস্টরা ছিল শাসকগোষ্ঠীর চক্ষুশূল। ‘পঞ্চমবাহিনী ও দেশের শত্রু’, এই অপপ্রচার চালিয়ে পাকিস্তানি শাসকেরা বামপন্থি ও কমিউনিস্টদের ওপর যখন তখন নির্যাতন চালাত। বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানি শাসকদের বন্দুকের নল তাক করা ছিল এই রাষ্ট্রটির জন্মের পর থেকেই। পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর এই হত্যাকাণ্ডে শহিদ হয়েছিলেন দিনাজপুরের কৃষকনেতা কম্পরাম সিং, খুলনার দৌলতপুরের ছাত্রনেতা আনোয়ার হোসেন, ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামী সুধীন ধর, রেলশ্রমিক নেতা দেলোয়ার হোসেন, ময়মনসিংহের সুখেন ভট্টাচার্য, কুষ্টিয়ার হানিফ শেখ, আন্দামান ফেরত বিপ্লবী বিজন সেন। রাজশাহীতে যতই পাকিস্তানি শাসকদের নির্যাতন বাড়তে থাকত ততই এসব কথা ভাবতে থাকি, ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হলো বলিদান’।
১৯৬৬ সালের ৭ জুন ছয় দফার দাবিতে যখন হরতাল চলছিল তখন শ্রমিকদের একটি মিছিল যাচ্ছিল তেজগাঁও রেলগেটের ওপর দিয়ে, সেখানেই পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান শ্রমিকনেতা মনু মিয়া। মনু মিয়া কাজ করতেন সেভেন আপ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে। তাঁর মৃত্যু সারাদেশে দাবানল সৃষ্টি করে। ছয় দফার আন্দোলন ধীরে ধীরে রূপ নেয় স্বাধীনতার আন্দোলনে। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন, দিনটি ছিল ২১ ফেব্রুয়ারি। এর আগে ১৫ ফেব্রুয়ারি আটক অবস্থায় নিহত হন আগরতলা মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক। ১৮ ফেব্রুয়ারি সৈন্যদের গুলিতে নিহত হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা। এ সময় সামরিক সরকারের রোষানলে পড়ে ইত্তেফাক প্রকাশ হতে পারে না, প্রকাশনা নিষিদ্ধ করা হয়। দেশব্যাপী গণআন্দোলন, সংগ্রাম ও গণদাবির মধ্য দিয়ে ইত্তেফাক পুনঃপ্রকাশিত হয় ১৯ ফেব্রুয়ারি। এভাবে গণআন্দোলন এগিয়ে যেতে থাকে। প্রতিবাদ ও আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এই আন্দোলন দমন করার লক্ষ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ১৪৪ ধারা ও কারফিউ ঘোষণা করা হয়। সভা, মিছিল নিষিদ্ধ। সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘিরে রাখে আর্মি, ইপিআর, পুলিশ। ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটগুলো বন্ধ। পুলিশ ও সৈন্যরা মহাসড়কে আবিরাম টইল দিচ্ছে। উত্তেজনা ক্রমশই বাড়তে থাকে। মিছিল ও স্লোগান হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে।
দুপুরের দিকে উত্তেজনা চরম আকার ধারণ করে। গেটের বাইরে শত শত রাইফেল তাক করা। ছাত্ররা ১৪৪ ভঙ্গ করে করে মহাসড়কে যাবে। শিক্ষকেরাও এসে দাঁড়িয়েছেন ছাত্রদের পাশে, মিছিল গেট অতিক্রম করলে রক্তপাত শুরু হবে। জীবন বাজি রেখে গেটের দিকে এগিয়ে চলেছে মিছিল। স্লোগানে উত্তাল সারা এলাকা। ঠিক এই সময় মিছিলের পুরোভাগে এসে দাঁড়ালেন ড. জোহা। বারবার নিষেধ করছেন যেন গুলি না হয়। হঠাত্ বিনা উস্কানিতেই শুরু হলো গুলিবর্ষণ। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে ঢলে পড়লেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা। আমি ও রাজশাহী সিটি কলেজের ছাত্র সিকানদার আবু জাফর ড. জোহার ঠিক পেছনেই ছিলাম। রুহুল আমিন প্রামানিকও ছিল এখানেই। সে আহতও হয়েছিল। আহত হয়েছিলেন বাংলা বিভাগের শিক্ষক ড. আবদুল খালেক ও আরো কয়েকজন শিক্ষক। গুলি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা মাটিতে শুয়ে পড়ি। সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে। উত্তেজনা চলতেই থাকে। সারা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। শিক্ষক, ছাত্রসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার মানুষ শোকে স্তব্ধ। ড. জোহা সবারই খুব প্রিয়। খেলাধুলা করতেন, হাসিখুশি মানুষ। থাকতেন আমাদের হালের পাশাপাশি স্টাফ কোয়ার্টারে। কতদিন দেখেছি স্টাফ কোয়ার্টারের সামনে ব্যাডমিন্টন খেলছেন। এই হাসিখুশি প্রাণবন্ত মানুষটি সৈন্যদের গুলিতে প্রাণ দিলেন। সারা মতিহার শোকে স্তব্ধ। ড. জোহার এই আত্মদান ৬৯-এর গণআন্দোলনে আরো নতুন মাত্রা যোগ করল। দেশের মানুষ ক্ষোভে প্রতিবাদে ফেটে পড়ল।
কিছুক্ষণের জন্য ১৪৪ ধারা শিথিল করা হলেও সন্ধ্যার পরই ১৪৪ ধারা ও কারফিউ জোরদার করে মতিহার অঞ্চলটিকে আতঙ্কের এলাকায় পরিণত করা হলো। সারা এলাকা অন্ধকার। অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, জুলফিকার মতিন, মতিউর রহমান বাচ্চু ও আমি মিলে এসএম হল থেকে সেই অন্ধকারের মধ্যেই উপাচার্য ভবনের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। টেলিফোন লাইন কাটা, সারা মতিহার অন্ধকার, সে এক ভয়ঙ্কর রাত্রি। উপাচার্য ভবনে না গেলে ঢাকায় খবর পাঠানোর আর কোনো উপায় নেই। মতিউর রহমান বাচ্চু বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপোর্টার হিসেবে পত্রিকায় কাজ করে। আমরা এসএম হল থেকে উপাচার্য ভবনের দিকে যাচ্ছি। কলাভবনের কাছাকাছি আসতেই দেখতে পেলাম ইপিআর ও সৈন্যরা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ভেতরে ঢুকে পড়েছে। মুহূর্তের মধ্যে আমরা লাফিয়ে পাশের ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে পড়লাম। কে কিভাবে ছিলাম জানি না, সৈন্যরা সরে গেলে আমরা যার যার মতো উপাচার্য ভবনে গিয়ে পৌঁছালাম। সেখান থেকে মতিউর রহমান বাচ্চু ঢাকায় পত্রিকা অফিসে গুলি ও হত্যার খবর পাঠাল।
সেই অন্ধকার ও কারফিউয়ের মধ্যে হলে ফেরা সে ছিল এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। এইচ এম কামরুজ্জামান চার জাতীয় নেতার একজন, বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত। রাজশাহীতে সকলের হেনা ভাই। খুবই জনপ্রিয় তিনি। তাঁরই নেতৃত্বে রাজশাহীতে গণআন্দোলন ও সংগ্রাম পরিচালিত হচ্ছে। তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর সাথে পরিচিত হওয়ার। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও দেখা করেছি। তিনি ছিলেন সব রকম প্রলোভনের ঊর্ধ্বে আদর্শ রাজনৈতিক নেতা, দেশের জন্য নিবেদিতপ্রাণ, বঙ্গবন্ধুর অকুণ্ঠ সমর্থক, তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত। রাজশাহীর একটি এলাকার নাম ছিল সাহেব বাজার। সেই সাহেব বাজার দিয়ে কত যাতায়াত করেছি। এদিকে বোধহয় একটি বড় পুকুরও ছিল, স্পষ্ট মনে পড়ছে না, প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা।
এরই মধ্যে একদিন ‘কণ্ঠস্বর’-এর জন্য একটি কবিতা পাঠিয়ে দিলাম। ঢাকার অনেক পত্রিকায়ই তখন আমার লেখা বেরোয়। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই কণ্ঠস্বর সম্পাদক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের চিঠি পেলাম। একটি হলুদ কার্ডে লেখা চিঠিতে তিনি জানিয়েছেন, চলতি সংখ্যাতেই কবিতাটি ছাপা হচ্ছে। ‘নৈশচিন্তা’ নামের এই কবিতাটি আমি আমার কোনো কাব্যগ্রন্থে নিইনি, যদিও সায়ীদ ভাই তাঁর সম্পাদিত এক দশকের কবিতায় এই কবিতাটি ছেপেছেন। এভাবে কণ্ঠস্বরের সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম। ‘উত্তর অন্বেষা’ পত্রিকায়ও আমার হেমন্ত সিরিজের কবিতা ছাপা হয়েছে। কবিতা লিখছি, প্রবন্ধ লিখছি, গানও লিখছি বেতারের জন্য। পত্রপত্রিকা ও লেখালেখির মধ্যেই আছি। লিখি, প্রেসে যাই, বাকি সময় কাটে লাইব্রেরিতে। পরীক্ষা শেষ হলো, থিসিসের কাজ নিয়ে তখন বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। ঠিক এরকম কোনো একটি সময়ে ঢাকা থেকে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের চিঠি পেলাম। তিনি লিখেছেন, কণ্ঠস্বরের চতুর্থ বর্ষপূর্তিতে একটি সম্মেলন হচ্ছে। আমাকে এই সম্মেলনে একটি প্রবন্ধ পড়তে হবে। রাজি হয়ে গেলাম। রাজশাহী থেকে হাফিজ ভাই আর আমি যাব। এসে উঠলাম সায়ীদ ভাইয়ের গ্রিন রোডের স্টাফ কোয়ার্টারে। তোপখানা রোডে প্রেসক্লাবের উল্টোদিকে তত্কালীন পাকিস্তান কাউন্সিল হলে সম্মেলন। মুনীর চৌধুরী সভাপতি। এই আমার প্রথম কোনো সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দেওয়া। মনে মনে বেশ চিন্তাও হতে লাগল। আাামর প্রবন্ধটির নাম ছিল ‘অমিতাচারী কবিতা’। এই প্রবন্ধটিও পরে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত ‘এক দশকের প্রবন্ধ’ বইটিতে ছাপা হয়। [ক্রমশ]