এভাবেই আমার জীবনের একেকটি অধ্যায় চলে গেছে। এখান থেকে ওখানে, ওখান থেকে সেখানে, যেন পথে পথেই জীবন কাটল আমার। কোথায় থেকে না কোথায় গেলাম। গ্রাম ছেড়ে শহরে, শহর ছেড়ে আরেক শহরে, এক শহরেই কত জায়গায়, কত ঘাটে যে ভিড়ল আমার তরী, তারপর শহর ছেড়ে দেশ, এদেশ ছেড়ে সেদেশ, সেদেশ ছেড়ে অন্যদেশ, হেথা নয় হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে। এই কি আমার নিয়তি? তখন বুঝতে পারিনি। শুধু ছুটেছি। যাকগে সেসব। বগুড়া সরকারি কলেজে এসে ভর্তি হলাম, আজিজুল হক কলেজ। অধ্যক্ষ তখন ড. মুহম্মদ ইসহাক। ইতিহাসের অধ্যাপক। বাংলা বিভাগের প্রধান মহসীন আলী দেওয়ান। স্নেহপরায়ণ শিক্ষক। ছাত্রদের বাবা ছাড়া কথা বলেন না। সজ্জন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রিয় কবি। ছন্দ বিষয়ে তাঁর একটি মূল্যবান গ্রন্থ আছে। বগুড়া থেকে তিনি একটি পত্রিকাও বের করেন, ‘বগুড়া বুলেটিন’। তাঁর স্নেহ-ভালোবাসা ভোলা যায় না। তাঁর স্ত্রীও ছিলেন অসাধারণ মহিলা, কোনো ছাত্র বাসায় গেলে না খেয়ে ফিরতে পারত না। ছাত্রছাত্রীরা তাঁর কাছে ছিল নিজের সন্তানের মতো। তাঁদের সন্তানেরাও ছিল ছাত্রছাত্রীদের কাছে ভাইবোনদের মতোই আপন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এই ত্যাগী শিক্ষককে নির্দয়ভাবে হত্যা করে। কবি আতাউর রহমানও ছিলেন এই কলেজের বাংলার শিক্ষক, দার্শনিক স্বভাবের মানুষ। সুধীন্দ্রনাথের কবিতার অনুরাগী। তাঁর কাব্যগ্রন্থের নাম ‘দুই ঋতু’, পরের বইটি ‘একদিন প্রতিদিন’। নজরুলের কবিতা নিয়ে তিনি একটি মূল্যবান বইও লিখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় আমরা একসঙ্গে ‘অগিলভি’ হোস্টেলে থেকেছি। স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্রাবাস। তরুণ সান্ন্যাল এই কলেজ হোস্টেলের সুপারেনটেনডেন্ট। বগুড়া তখন ছোট শহর। সাতমাথাই ছিল শহরের কেন্দ্র। উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরিটি ছিল খুবই সমৃদ্ধ। বহু মূল্যবান বই ছিল সেখানে। রেল লাইনের পাশ দিয়ে হেঁটে বা রিকশায় কলেজে যেতে হতো। নতুন কলেজ ভবনটি খুবই সুন্দর। এই কলেজ থেকেই এইচএসসি পাস করি। বাংলা অনার্সেও ভর্তি হই। বগুড়া থেকে এই সময় আমরা কয়েকজন তরুণ মিলে ‘বিপ্রতীক’ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিনও বের করেছিলাম। ঢাকায়ও পত্রিকাটি বেশ সাড়া জাগায়। সাতমাথার কাছেই ‘বেনীপুর বুক হাউস’ নামে একটি বইয়ের দোকান। এখানে ঢাকা থেকে নতুন নতুন বই ও পত্রপত্রিকা আনা হতো। এখানেই আমি প্রথম ‘কণ্ঠস্বর’ পত্রিকাটি দেখি। একেবারে অন্যরকম পত্রিকা। লেখাও অন্যরকম। বেনীপুর বুক হাউস থেকেই প্রথম কণ্ঠস্বর পত্রিকাটি সংগ্রহ করি। বগুড়ায় তরুণ কবি তখন ফারুক সিদ্দিকী, মহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী রব, মনোজ দাশগুপ্ত—সবাই মিলে বিপ্রতীক বের করি। তখন দেশে আইয়ুব খানের দুঃশাসন, ‘বেসিক ডেমোক্রেসি বা মৌলিক গণতন্ত্র’। সরকারের পোষা ছাত্র সংগঠন এনএসএফ ক্রমেই প্রবল হচ্ছে। বগুড়া কলেজে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন খুবই শক্তিশালী। দেশব্যাপী তখন আইয়ুববিরোধী ছাত্র ও গণআন্দোলন তীব্রতর হয়ে উঠছে। আইয়ুব খানের অপশাসনের বিরুদ্ধে বগুড়ার ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বগুড়ার সংগ্রামী ছাত্ররা সেসময়ের ছাত্রআন্দোলনে সর্বদা সক্রিয় থেকে সোচ্চার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে অংশ নেয়। বগুড়া কলেজের প্রতিবাদী ছাত্রদের সংগ্রামী ভূমিকা অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল। কোনো নিপীড়ন নির্যাতনই তাদের আন্দোলন ও প্রতিরোধ থেকে পিছু হটাতে পারেনি। আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে তাদের এই ত্যাগ, সাহস ও সংগ্রামের কথা স্মরণ করি। যত সামান্যই হোক, আমি এই আন্দোলন ও সংগ্রামের সঙ্গে থাকতে পেরেছি, এ আমার গর্ব।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এলাম এমএ পড়তে। পদ্মার পাড়ে মতিহারের সবুজ চত্বরে এই ক্যাম্পাস। অত্যন্ত মনোরম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির কথাও ভেবেছিলাম, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় বদল করা অনেক ঝামেলা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ভর্তি হলাম। আমরা যে হলে থাকি তখন তার নাম ছিল জিন্নাহ হল। এই হলের এখন নতুন নাম হয়েছে, বড় সড়কের পাশেই বিশাল হল ভবন। তখন বোধহয় অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী এই হলের প্রোভোস্ট। বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান তখন ড. মযহারুল ইসলাম। অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলামও তখন বাংলা বিভাগের শিক্ষক। অল্পদিনের মধ্যেই তাঁদের স্নেহসান্নিধ্য লাভের সুযোগ পেলাম আমি। রাজশাহী থেকে তখন ‘পূর্বমেঘ’ নামে একটি বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা বের হয়। সম্পাদক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ও মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। ঠিক মনে নেই, হাসান আজিজুল হকের ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পটি বোধহয় পূর্বমেঘ পত্রিকাতেই ছাপা হয়। পূর্বমেঘে তাঁর অনেক লেখা ছাপা হয়েছে। পত্রিকাটি দেখাশোনা করেন বাংলা বিভাগের গবেষক অধ্যাপক আবদুল হাফিজ। রাজশাহী শহরের মডার্ন প্রেস থেকে ছাপা হয়। প্রেসটির মালিক আবদুর রশিদ খান সাহিত্য শিল্পের অনুরাগী। নিজেও কবিতা লেখেন। আমি এই পত্রিকাটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়লাম। প্রেসে যাই, সন্ধ্যার দিকে অনেকটা সময় কাটাই এই প্রেসে। আমার ‘আনন্দের মৃত্যু নেই’ প্রবন্ধটি পূর্বমেঘে ছাপা হয়। অধ্যাপক আলী আনোয়ার, সনত্ কুমার সাহা ও আরো বেশ কয়েকজন শিক্ষক পূর্বমেঘে প্রায় নিয়মিত লেখেন।
এরই মধ্যে ড. মযহারুল ইসলামের সম্পাদনায় ‘উত্তর অন্বেষা’ নামে আরেকটি উন্নতমানের সাহিত্য পত্রিকা বের হলো রাজশাহী থেকে। এই পত্রিকাটি দেখাশোনার দায়িত্ব হাফিজ সাহেবের। আমিও দুটি পত্রিকার কাজে মেতে উঠলাম। মতিহার থেকে প্রায় প্রতিদিন প্রেসে যাওয়া, অনেকটা রাত পর্যন্ত সেখানে সময় কাটানো একরকম নিয়মিত ব্যাপার হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে সাহিত্যের আড্ডাও জমে উঠল। প্রায় নিয়মিত আসেন শেখ আতাউর রহমান। মহসীন রেজা, সাইফুল ইসলামও আসে। রাজশাহী থেকে আরো দুটি ছোট কাগজ বের হয়, ‘সুনিকেত মল্লার’ নামে একটি পত্রিকা বের করে মহসীন রেজা, সাইফুল ইসলাম বের করে ‘বনানী’ নামে আরেকটি পত্রিকা। সাহিত্যের কাজকর্ম ও লেখালেখি বেশ জমে উঠল। বাংলা বিভাগের শিক্ষক তখন ড. আবুদল মান্নান, ড. আবদুল খালেক, ড. গোলাম সাকলায়েন, সুনীল মুখোপাধ্যায় ও খোন্দকার সিরাজুল হক। আবু হেনা মোস্তফা কামাল বিদেশে গেছেন, পিএইচ ডি করতে। ড. গোলাম মোরশেদ এসে যোগ দিলেন। সারোয়ার জাহানও ছিলেন বাংলা বিভাগের শিক্ষক। তিনি গান লিখতেন, গাইতেনও। সেলিনা হোসেন, জুলফিকার মতীন, ফজলুল হক—আমরা একসঙ্গে বাংলা বিভাগে পড়ি। লেখালেখি, পত্রিকা এসব নিয়ে চমত্কার সময় কাটছিল। এদিকে ছাত্রআন্দোলন ও বিক্ষোভ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ব্যাপক ছাত্রআন্দোলন আরো তীব্র হয়ে উঠতে থাকে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলো। ছাত্রছাত্রীরা আরো সক্রিয় হয়ে উঠল আন্দোলনে। সাহিত্যশিল্প, সরকারবিরোধী বিক্ষোভ, এসব মিলে সে এক আলাদা জীবন, সে হচ্ছে বাঙালির জেগে ওঠার সময়। এই ইতিহাসের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হতে পারা সে কি কম ভাগ্যের ব্যাপার! একে দুর্লভ ভাগ্য বলেই মানি আমি।
এই সবকিছুর মধ্যে জড়িয়ে পড়তে পেরে মনে সত্যি খুব আনন্দ বোধ করছি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়ে আবদুল লতিফ, পাশেই কাজলার দিকে বাড়ি। লতিফ ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী, আমারও খুব অনুরাগী হয়ে উঠল। আমার রুমমেট মোসাদ্দেক ও সগির আহমদ। দুজনই বিজ্ঞানের ছাত্র। কিন্তু আমার লেখার মনোযোগী পাঠক। সেসময় রাজশাহী বেতারের জন্য আমি কিছু গানও লিখেছিলাম। বাংলা বিভাগের ছাত্র সুকুমার বিশ্বাস সুর দিয়ে গানগুলো রেডিওতে গায়। রাজশাহীতে এভাবে আড্ডায়, লেখালেখিতে দিনগুলো ভালোই কাটছিল। এদিকে দিনদিনই দেশে উত্তেজনা বাড়ছে, আইয়ুবী দুঃশাসনে মানুষ অতিষ্ঠ, বিক্ষোভ ও গণআন্দোলন যতই জোরদার হচ্ছে, নিপীড়ন ও নির্যাতন ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু বাঙালি জাতি কঠিন সংগ্রামের শপথ নিয়ে আরো জেগে উঠছে। বুকে তার নতুন স্বপ্ন, এই যৌবনতরঙ্গ কে রোধ করে? সেই নবজাগরণের দিনগুলোর কথা যত ভাবি, গর্বে বুক ভরে ওঠে। [ক্রমশ]