কদিন পরেই আষাঢ় মাসে বর্ষা তথা উর্বরতার প্রতীক শাক্ত পার্বণ কামাক্ষ্যার অম্বুবাচী। সারা দেশ এই উৎসবে মাতলেও প্রায় অনেকেরই অজানা ওড়িশার রজ পরব। এবছর জুনের ১৪ তারিখ থেকে ১৬ তারিখ পর্যন্ত চলছে রজ পরব।
উৎসবের নাম ‘রজ পরব’। ‘রজ’ শব্দটি এসেছে রজস্বলা (পিরিয়ডস/মাসিক/মেনস্ট্রুয়েশন) থেকে।
আর সেই উপলক্ষ্যেই ওড়িশার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ উৎসবে মেতেছেন। ওড়িশায় মানুষদের ধর্মীয় বিশ্বাস যে এই সময় ঋতুমতী হন বসুন্ধরা বা জগন্নাথ দেবের স্ত্রী ভূদেবী। তিন দিন ধরে রজস্বলা দশা কাটিয়ে, চতুর্থ দিনে স্নান করে এই উৎসবের সমাপ্তি ঘোষণা হয়।
আষাঢ় মাসে সূর্য মিথুন রাশিতে প্রবেশ করলে ধরিত্রীমা বা ভূদেবী ঋতুমতী হয়ে ওঠেন। পুরান বলে কাশ্যপ প্রজাপতির কন্যা ভূদেবী।
ভূদেবী, শ্রী ও নীলা দেবী মহালক্ষ্মীর প্রকাশ। তিনি বিষ্ণুর অবতার বরাহর সহধর্মিনী, তাই কখনো তাঁকে বরাহী বলা হয়। তাঁকে নরকাসুর, মঙ্গলা এবং সীতার মা রূপেও উল্লেখ করা হয়েছে।
ভূদেবীকে বসুধা বা হিরন্ময় বা পৃথ্বীকে তামিল সাধু-কবি অন্ডালের রচনা অনুযায়ী দ্বাপর যুগে আবির্ভূত হয়েছেন শ্রীকৃষ্ণ স্ত্রী সত্যভামা রূপে। ওড়িশায় জগন্নাথের স্ত্রী হিসেবেই পূজিত হন ভূদেবী।
ভূদেবীর একটি হাতে ডালিম, একটি জলের পাত্র এবং বাটি বহন করেন যাতে ভেষজ এবং শাকসবজি থাকে বা কখনও কখনও তাকে রাতের পদ্ম উৎপলা বা কুমুদার সাথে চিত্রিত করা হয়। তিনি অপরূপা। তিনিই আমাদের খাবারের উৎস যা আমরা নিত্য গ্রহণ করি।
প্রতি বছর এটি জুনের মাঝামাঝি সময়ে পড়ে। উৎসবের আগের দিনটিকে সাজবাজা বা প্রস্তুতিমূলক দিন বলা হয় যে দিনটিতে ওড়িশার লোকেরা ঘর, রান্নাঘর সহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে। উৎসবের প্রথম দিনটিকে বলা হয় পহিলি রজ অর্থাৎ প্রথম ঋতুস্রাব। দ্বিতীয় দিনকে মিথুন সংক্রান্তি, কারণ এই দিন সূর্য মিথুন রাশিতে প্রবেশ করে। তৃতীয় দিনকে ভূদাহা বা বাসি রজ অর্থাৎ পার হয়ে যাওয়া ঋতু বলা হয়। শেষ অর্থাৎ চতুর্থ দিনটিকে বসুমতি স্নান বলা হয়। এদিন মনে করা হয়, কোথাও যেন ঋতু-যন্ত্রণা শেষে আরামের স্নান করেন মা।
চতুর্থ দিনে মহিলারা স্নান করে ভূমি দেবীর প্রতীক হিসেবে একটি শিলা (গ্রাইন্ডিং) পাথরকে জলে ধুয়ে ফুল, হলুদ, সিঁদুর ইত্যাদি দিয়ে পূজা করেন। সমস্ত ধরণের মরশুমি ফল মা ভূমিকে নিবেদন করা হয়।
ওড়িশার মানুষ মনে করেন পৃথিবী এই সময় পুনরুজ্জীবনের মধ্যে দিয়ে যায়। তাই তাঁর প্রয়োজন বিশ্রাম ও যত্নের । ভূদেবীর প্রতীক মহিলারা। সেই কারণেই এই তিন দিনে মহিলা এবং অবিবাহিত মেয়েরা কাজ থেকে বিশ্রাম নেয় এবং তারা নতুন শাড়ি, আলতা এবং অলঙ্কার পরে। এমনকি এই সময় স্কুল-কলেজ, অফিস ছুটির ঘোষণা করে।
আসন্ন বৃষ্টিতে পৃথিবী যেমন তৃষ্ণা মেটাতে নিজেকে প্রস্তুত করে তেমনি পরিবারের অবিবাহিত মেয়েরাও এই উৎসবের মাধ্যমে আসন্ন বিবাহের জন্য প্রস্তুত হয়। তারা এই তিন দিন আনন্দ-উৎসবের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করে এবং শুধুমাত্র রান্না না করা ও পুষ্টিকর বিশেষ খাবার খায়। এই সময় খালি পায়ে না হাঁটা এবং ভবিষ্যতে সুস্থ সন্তান জন্ম দেওয়ার শপথ নেওয়ার মতো রীতিনীতি পালন করে।
পোড়াপিঠে এই উৎসবের স্পেশাল খাবার। পোড়াপিঠে ধীরে ধীরে গাঁজানো চাল, কালো ছোলা (মাশ কালাই, উঝুনু পারিপ্পু , উলুন্ডু পারিপ্পু, উড্ডু ইত্যাদি নামে পরিচিত), নারকেল এবং গুড় দিয়ে সারারাত বেক করে তৈরি করা হয়। এই পিঠের উপরের অংশটা পোড়া হয় , ভিতর থাকে নরম ও সাদা। গুচিন্ডা মন্দির থেকে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে রথযাত্রা পর ফেরার পথে মৌসি মা মন্দিরে ভগবান জগন্নাথ এবং তার ভাইবোনেদের এই পিঠে পরিবেশন করা হয়।
‘রজ’র উচ্ছ্বাসের সবচেয়ে প্রাণবন্ত এবং আনন্দদায়ক স্মৃতি হল থরে থরে ফুল দিয়ে সাজানো বড় দোলনা বা বড় বটগাছের থেকে দড়ি ঝুলিয়ে দোলনায় দোল খাওয়া। এই দোলগুলি বিশেষভাবে সংগঠিত হয় কারণ মহিলা এবং মেয়েরা যারা দেবী, প্রধানত ভূদেবীর প্রতীক, তাদেরকে পৃথিবীতে পা রাখতে দেওয়া হয় না।
এই সময়ে লোকেরা মাটি খনন করে না বা কোনও কৃষি কাজ শুরু করে না কারণ দেবী মা বা ভুদেবী গভীর নিদ্রায় রয়েছেন এবং তাঁর শরীরে কোনও ক্ষতি করে তাঁর বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটানো অশুভ লক্ষণ।
দোলনাগুলি বিভিন্ন রকমের হয়, যেমন ‘রাম ডলি’, ‘চরকি ডলি’, ‘পাতা ডলি’, ‘ডান্ডি ডলি’ ইত্যাদি। এই উৎসবের জন্য বিশেষভাবে তৈরি গানগুলি প্রেম, স্নেহ, শ্রদ্ধা, সামাজিক আচরণ এবং সামাজিক সবকিছুর কথা বলে।
গ্রামের যুবকরা বিভিন্ন ধরণের দেশীয় খেলায় নিজেদের ব্যস্ত রাখে, এদের সবচেয়ে প্রিয় খেলা হলো ‘কাবাডি’। গ্রামের বিভিন্ন দলের মধ্যে প্রতিযোগিতাও হয়। সমস্ত রাত জুড়ে ‘যাত্রা’ বা ‘গোটিপুয়া’ নাচের আয়োজন করা হয়। গোটিপুয়া ওড়িশার একটি ঐতিহ্যবাহী নাচ ও ওড়িশি শাস্ত্রীয় নৃত্যের অগ্রদূত। বহু শতাব্দী ধরে ওড়িশায় অল্পবয়সী ছেলেরা জগন্নাথ দেব এবং কৃষ্ণের প্রশংসা করার জন্য নারীদের পোশাক পরে এটি পালন করে আসছে।
আজকের জেড যুগেও যেখানে পিরিয়ডস নিয়ে প্রচলিত ট্যাবু, কুসংস্কার বয়ে চলেছে গোটা দেশ, তার থেকে অনেকটাই উল্টো সুর বাজে ওড়িশার এই রজ উত্সবের মধ্যে। এই সময়টা মেয়েদের অচ্ছুত্ না রেখে স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়ার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া যে খুশি, আরামের প্রয়োজনের কথা চিকিত্সকরা বলে থাকেন উচিত, প্রাচীন এই রীতিকেই সম্মান জানিয়ে শুধু ঘর নয়, বিভিন্ন অফিস, কর্পোরেটেও মেয়েদের জন্য এই সময় বিশেষ ব্যবস্থা রাখা দরকার। কর্মরতা মেয়েদের মেনস্ট্রুয়াল পেইন, লিভ পাওয়া উচিত কি না তা নিয়ে সারা বিশ্বে গুরুত্ব দিয়ে ভাবার সময় এসেছে। আর তারই প্রতিফলন দেখা যায় ওড়িশার এই রজ উত্সবেই। পিরিয়ডস নিয়ে ট্যাবু ভাঙার এক অপূর্ব নিদর্শন রাখছে ওড়িশা। এখানেই উৎসবটির সার্থকতা।
ভূদেবীকে কর জোড়ে প্রনাম জানিয়ে লেখার ইতি টানি —
সমুদ্রসনে দেবী পর্বতস্থানমণ্ডলে।
বিষ্ণুপত্নী নমঃ-তুভ্যম্ পাদ-স্পর্শম্ ক্ষমস্বমে ।।
“ভুদেবী যার বস্ত্ররূপে সমুদ্র এবং তার বক্ষরূপে পর্বত, যিনি শ্রী বিষ্ণুর স্ত্রী, আমি তোমাকে প্রণাম করি, আমার পায়ে তোমাকে স্পর্শ করার জন্য আমাকে ক্ষমা করুন।”
কভারের ছবি ওড়িশা পটচিত্রে রজ পরব