এই আত্মকথা কোনো পূর্ণাঙ্গ জীবনকথা নয়, খণ্ডাংশ, সেইটুকু যা কবিতার জীবন। প্রকৃতপক্ষে তা-ই আমার জীবনী। সব জীবনীই মূলত খণ্ডিত, পূর্ণাঙ্গ নয়, পূর্ণাঙ্গ জীবনী হয় না। এই আত্মকথার মধ্যে নানা অসঙ্গতিও আছে, জোড়াতালি দিয়ে যা দাঁড়িয়েছে, তা-ই একই কথা একই বিষয় হয়তো একজায়গায় একভাবে বলেছি, এখন বলছি অন্যভাবে। এটাই স্বাভাবিক। আমি আত্মজীবনী শিখিনি ঠিকই, কিন্তু বিভিন্ন সাক্ষাত্কারে, অন্য কোনো কোনো রচনার মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে নিজের জীবনের নানা কথা বলেছি, সে সব আমার মনে নেই, কোথায় কী বলেছি কী লিখেছি ভুলে গেছি, স্মৃতি প্রতারক। ফলে একই ঘটনা অন্যরকম হতেই পারে, কিছু করার নেই। এ কোনো সুসংবদ্ধ আত্মজীবনী নয়, অনেকটাই এলোমেলো, অসংলগ্ন। আত্মকথা লেখার জন্য আমার কোনো প্রস্তুতি ছিল না, কোনো নোট রাখিনি, দিনলিপি বলে আমার কিছু নেই, স্মৃতিই নোটবুক, ‘স্মৃতি ছাড়া কোনো নোটবুক নাই’। তার ওপর নির্ভর করেই যখন যা মনে পড়েছে বলেছি বা লিখেছি, স্বাভাবিকভাবেই তাতে দুই রকম কথা কিংবা দুইর কম বিবরণ থাকতেই পারে। জীবনকথা কোনো যথার্থ ইতিহাস নয়, ইতিহাসও আছে, কাহিনিও আছে, খণ্ড খণ্ড স্মৃতি, এক অর্থে উপন্যাসও, গল্পও। সত্য আছে, অসত্যও আছে, তাকে নিখাদ সত্য বলার উপায় নেই। সে পারেন রুশো, তাঁর ‘কনফেশন’, যা জীবনীগ্রন্থের মহত্তম দৃষ্টান্ত, আত্মস্বীকৃতির মহাকাব্য। এমন জীবনী প্রায় দুর্লভ। বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, মানুষ যখন নিজের অপরাধের কথা বলে তখনো এমনভাবে বলে যাতে অন্যের মনে সহানুভূতির উদ্রেক হয়, মানুষ নিজেকে খারাপ বলেও ভালোই বলতে চায়। এই দুর্বলতা মানুষের সহজাত। মহত্ জীবনীগ্রন্থগুলোও সম্পূর্ণভাবে এই প্রবণতা থেকে মুক্ত নয়। কোন মানুষ না চায় অন্যের কাছে তার ভালো ভাবমূর্তি তুলে ধরতে, নিজেকে যে খারাপ বলে সেও তার কৌশল। আলবার্তো মোরাভিয়া বলেছিলেন, ভান না করাও একধরনের ভান। নিখুঁত সত্য মেলা দুষ্কর।
জীবনী মাত্রই অসম্পূর্ণ, তাকে জীবনসমগ্র বলার উপায় নেই। সেখানে সত্যমিথ্যার মিশ্রণও থাকে, অতিকথনও থাকে। ‘সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর’। অন্যের চোখে নিজেকে মহত্ করে তোলার, হিরো করে তোলার চেষ্টা কার না থাকে। স্বীকারোক্তিমূলক কবিতাও তো এই চিন্তা থেকেই লেখা, অন্তরালে থাকে এই মনোভাবই। মানুষ নিজেকে শুদ্ধ করার জন্যই আত্মঅপরাধের ক্ষমা চায়, নিজেকে দগ্ধ করে, রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘অন্য পথ নাহি’। মানুষ সম্পূর্ণ ভালোও নয়, সম্পূর্ণ মন্দও নয়; দোষগুণ ভালোমন্দ মিলিয়েই মানুষ, সংযতও, সে অসংযতও, কামনাতাড়িত, আবার সংযমী, দৃঢ়। এই দুই মানুষকে একইসঙ্গে চিত্রিত করা সহজ নয়, মানুষ নিজেও জানে না এক মানুষের মধ্যে এই যে বহু মানুষ, এত ভিন্ন ভিন্ন মানুষ। এক জীবনের মধ্যেই যে কত রকম জীবন মানুষ নিজেও তা জানে না। আত্মজীবনী রচনার ক্ষেত্রে আত্মআবিষ্কার নিঃসন্দেহেই কঠিন কাজ।
আত্মজীবনীকে আমি মনে করি ভুলসমগ্র, কবিতার জীবনও তো তা-ই। ধারাবাহিক সুবিন্যস্ত আত্মজীবনী নয়, কবিতার জীবন হচ্ছে ধারাবাহিকতার বাইরে পারম্পর্যহীন জীবন, অস্বাভাবিক, অসংলগ্ন। আমি কিছুই তো গড়তে পারিনি, শুধুই ভেবেছি, কোনো কীর্তি নেই আমার, কোনো প্রতিষ্ঠান, সমাজহিতৈষণা, কিছুই নেই, বলা যায়, অক্ষম মানুষ আমি, কাতর। জীবনী লেখার বড় সমস্যা নিজে ঘটনার মধ্যে থেকে তা নির্মোহভাবে দেখা। তরী থেকে তীর দেখা। তরীও দেখা। নির্মোহ হয়ে না দেখতে পারলে সে দেখা মোহমুক্ত হবে না। কিন্তু এ বড় কঠিন কাজ, কঠিন সাধনা। আমিত্ব ত্যাগ করা সহজ নয়, আমিত্ব বা সেলফ ত্যাগ করতে পারলে তো সমস্যাই থাকে না, তার জীবনী লেখারই বা প্রয়োজন কী? আমি কিছুই নই, যন্ত্রমাত্র, এখানে পৌঁছাতে পারলে আত্মকথা তো লেখারই প্রয়োজন হয় না। সব প্রশ্নের তো মীমাংসার উপায় নেই, তাই ‘উত্তরে রহিবে মৌন’। নিজের জীবনকে নির্মোহ দর্শকের দৃষ্টিতে ফুটিয়ে তোলা যায় কি, গেলেও কতটা যায়?
প্রতিদিনের যে জীবন তার সব তথ্য তো আর খুঁজে পাওয়া যাবে না, সময় তো গ্রাস করে ফেলেছে বহু কিছুই, তার মধ্যেও তো আছে কত ঘটনা, কত সামগ্রী, কত উপকরণ, কত নাম, একেকটি অধ্যায় কত বিচিত্র, কতদিনের হারানো স্মৃতি, কতকিছুই তো ভুলেও গেছি হারিয়েও ফেলেছি, সেই র্যালে সাইকেল, কলের গান, হারমোনিয়াম, পাশা খেলার গুটি, মার্বেল, গুলতি, লাটিম, কদমা, বাতাসা, মিছরি, পাটালি, গুড়, মুড়কি, ঝুরি, মুড়ির মোয়া, চিড়ার মোয়া, নারকেলের নাড়ু, তিলের নাড়ু, চালের নাড়ু, কত রকমের যে পিঠা, কুলফি পিঠা, পুয়া পিঠা, গোকুল পিঠা, হারানো জীবনের কত যে চিত্র, কত যে বিবরণ। সেই তো আমার জীবন, তা তো আর দেখানোর উপায় নেই, সেসব যে আমার মন ভরে আছে। তাকেই আমি মনে করি জীবনী, কেউ নাও করতে পারে। আমি নিরুপায়। কথায়, ব্যাখ্যায়, বিবরণে আমি বোঝাতে চেয়েছি জীবন কেমন, বিশেষভাবে কবির জীবন, পাকেচক্রে সেই আমার জীবন, দিনপঞ্জি নয়, সময়ের খণ্ড ক্ষুদ্র ছবি। কবির পক্ষে যা হওয়া সম্ভব, যেমন হওয়া সম্ভব, কত কিছুতে জড়িয়ে গেছি, আনন্দিত হয়েছি, বাসনাতাড়িত হয়েছি, দমন করা হয়নি; দ দ দ, দাম্যত, দত্ত, দয়াধ্যম্, আত্মদমন করো, দান করো, দয়া করো, এলিয়টের ওয়েস্ট ল্যান্ডেও এই তিন দ-এর প্রতিধ্বিনি শোনা যায়। শেক্সপিয়র তো প্রস্তরখণ্ডের মধ্যেও সদুপদেশ পেয়েছিলেন (Sermons in Stones), সবার হয় না। এমনি করেই ঘোরের মধ্যে দিন চলে গেছে, একেকটি ঘূর্ণিস্রোতে, একেকটি ঝাপটায় কোথা থেকে কোথায় চলে গেছি, সব ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে গেছে, কিছুই দাঁড়ায়নি, কতবার যে আমি স্রোতের মুখে পড়েছি, জ্ঞানবুদ্ধি লোপ পেয়েছে, স্বপ্নতাড়িত মানুষের মতো কোথায় যে চলে গেছি, ভাবলে কেঁপে উঠি, কাতর হয়ে পড়ি, দুঃস্বপ্ন বলে মনে হয়। কিন্তু কিছুই তো আর করার নেই, টাইম মেশিন নেই, কিছুই আর শোধরানো যায় না। নিজের জীবনকে কতবার দুর্যোগের মুখে ঠেলে দিয়েছি, আমিই জানি সে কী ভয়াবহ দুর্যোগ, কী বিষম আত্মক্ষয়, নিজেকে ধ্বংস করা; সেজন্যই এই ভয়াবহ জীবনকে বলেছি কবিতার জীবন, কবি ছাড়া এমন ধস্ত জীবন আর কারই বা হতে পারে? কবির জীবন বড় সুখের নয়, ঝরাতে ঝরাতে, ছড়াতে ছড়াতে একটা জীবন চলে যায়। এই ছোট্ট জীবনটা নিয়ে বড় বেশি পাগলামি। [ক্রমশ]