এই সাইকেডেলিক কালারের বিচিত্র মাত্রিক প্রকাশ ঘটেছে আলোচ্য উপন্যাসে। পিতৃমাতৃহীন শহুরে বাড়ির মালিক মধ্যবিত্ত লেখক জামেরী তার ভাড়াটিয়ার মেয়ে মিতুলের প্রণয়নের ভেতর দিয়ে যে অর্থময় জীবন প্রত্যাশা করেছে, তা মিতুলের পারিবারিক ক্ষেত্রে বাবার সঙ্গে মার বিচ্ছিন্নতা এবং এর ফলে মিতুলের মাতৃ অনুসন্ধান ও নিরন্তর পিতৃপৃহ বিষদগ্ধ হবার ফলে মানসিক অসুস্থতায় চেতনা লুপ্তিতে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে এবং অতলান্তিক শূন্যতা ও যন্ত্রণার অসীম হাহাকারে বেদনার্থ হয়েছে জামেরী।
মোট সাতটি পরিচ্ছেদে জামেরীর আত্মকথনে মিতুলের বিষণ্ণ জীবনের পরিচয় আভাসিত এবং বন্ধু রায়হানের ধ্বংসজনক ভালোবাসার পট নির্মিত হয়েছে।
জামেরী পিতার বহু কষ্টে নির্মিত বাড়িতে অবস্থান করে নির্দিষ্ট আয় নিয়ে। অর্থ আসে সংবাদপত্রে অফিসে কাজ করে এবং বাড়ি ভাড়া থেকে। সে স্বপ্ন দেখে প্রমিথিউসের জায়গায় নিজেকে, একটি ঈগল পাখি হৃৎপিণ্ড খাবলে খাচ্ছে। তার শ্রাবণের বৃষ্টিমুখর আকাশ ভাল লাগে। স্বপ্ন ভালো লাগে না। নিঃসঙ্গ পীড়াদায়ক হয়ে উঠলে মিতুলকে আঁকড়ে ধরতে চায়। কারণ, সে জানে মিতুল তাকে যতটুকু ভালবাসে তার চেয়ে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে। এ জন্য সে মিতুলের কষ্টের সঙ্গী হয়। কারণ, মিতুলের দু’বছর বয়সে মা, আর একজনের সঙ্গে চলে যায় ফলে পিতা অন্য একজনকে বিবাহ করে। বর্তমান মা তার কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করলেও পারিপার্শ্বিকতা তাকে বিষণ্ণ করে তোলে। কারণ তার পিতাকে সহ্য করতে পারে না সে। জামেরীর আত্মকথনে —
“আমি জানি মা কেন চলে গেছে? আমি ভেবে ভেবে খুঁজে বের করেছি। বাবার এই মেয়েলীপনার জন্যই মা বাবাকে ছেড়ে চলে গেছে। বল আমি ঠিক বলেছি কিনা জামী? ওর এসব কলা শুনলে আমার শরীরে একটা শিরশিরে অনুভূতি হয়। বুকটা খালি হয়ে যায়। মনে হয় মিতুল আমার কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে’’ (পৃ. ১৪)।
জামেরী একজন ঔপন্যাসিক। শিল্পের নির্মম জগত নিয়ে সে নিরন্তর দগ্ধ হয় স্বজনহীন এই শহরের বুকে সে শিল্পের গোলকধাঁধায় অনন্তকালের যাত্রার আয়োজন করেছে। স্বপ্নের শেষে সে উপন্যাসের প্লট পেয়ে যায়।
জামেরী সংবাদপত্র অফিসে কাজ করে। রাতে ফিরে জানালা দিয়ে ইউক্যালিপটাসের সৌন্দর্য দেখে, বালজাক পড়ে আর যে মিতুলের প্রত্যাশা করে সে ভোরে এসে জানায় —
“চল আমরা রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি। ঘুরে ঘুরে খুঁজে দেখি কোথায় মাকে পাওয়া যাবে। মা কিসের তাড়নায় বাবার কাছ থেকে দূরে চলে গেলো। আচ্ছা জামী, মা যখন চলে যায়, আমার কথা তার কি একবারও মনে হয়নি’’ (পৃ. ২১)।
এই মিতুল যেন ‘খুন ও ভালোবাসা’র কাহারী। যে কাহারী বেজন্মা শব্দটি শোনার পর অন্তর্দাহে দগ্ধ হয়েছে। এই মিতুলও মা’র ত্যাগ করে চলে যাওয়া মেনে নিতে না পেরে বিষণ্ণতা লেকে রহস্য উন্মোচনে পথে নেমেছে। মিতুলের এই আত্মক্ষরণ জামেরীর কাছ থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। জামেরী নিঃসঙ্গতায় আশ্রয় খোঁজে, হাসপাতালে যায় ডাক্তার বন্ধু রেজার কাছে রুগীর মাঝে ভিন্নতর অর্থ অন্বেষণ করতে। বন্ধু রায়হান, যে তার বন্ধু জামিলকে মত পার্থক্যের জন্যে খুন করেছে সে তার ঘরে এলে তার মাঝে উপন্যাসের উপাদান অন্বেষণ করে।
জামেরীর বন্ধু রায়হান সিদ্ধান্ত নিয়েছে “ছন্দা যে লোককে তুমি বিয়ে করবে তাকে আমি খুন করব।’’ জামেরী রায়হানকে দেখে, মিতুলকে দেখে। তার উপন্যাসের ছক মাথার ভিতর তৈরি হতে থাকে। রাতে ত্রিশ পৃষ্ঠা লেখার পর তার মনে হয় কিছুই হচ্ছেনা। তার বন্ধু শরাফীর কথা মনে হয়, যে কয়েক ঘন্টায় একটি গল্প দাঁড় করাতে পারে। কিন্তু জামেরী সমাজের কাছে কমিটেড। এজন্য জীবনকে পরিপূর্ণ উপলব্ধির মধ্য দিয়ে সাহিত্য গড়ে তুলতে চায়।
কিন্তু যখন তার উপন্যাসের চরিত্র রায়হান বর্তমানের আণবিক যুগে ‘আণবিক ভালোবাসা’ চায়, তখন তার ব্যর্থতাবোধ জেগে ওঠে কিছু না করতে পারার জন্য। রায়হান মিতুলের মা’র সংবাদ জামেরীকে দেয়। মিতুলও জামেরীর মতো প্রমিথিউসের অনুরূপ শাস্তির স্বপ্ন দেখে। তবে কি জামেরী মিতুল একই পরিণতির দিকে যাচ্ছে? হৃদয় খুঁড়ে খুঁড়ে যন্ত্রণার বহ্নি শিখা কি জ্বালিয়ে দিবে তারা এ উপন্যাস?
মিতুলের মা’র বাসা খুঁজতে বের হওয়া, জামেরী মিতুলকে সঙ্গে নিয়ে নাটক দেখতে গিয়ে মিতুলের অসুস্থ হওয়া, ছন্দার বিবাহ সম্পন্ন হওয়া, রায়হানের খুনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা, মিন্টুর জামেরীকে উপেক্ষা করা এবং মিতুলের মা’র সঙ্গে জামেরীর সাক্ষাৎ ও মিতুলের মা’র মিতুলকে সাক্ষাৎ দানে অপারগতা প্রকাশ–বহুমাত্রিক দ্বান্দ্বিক শব্দরূপ পরিগ্রহ করে। তবে মধ্যবিন্দুর মধ্যে জামেরীর নিঃসঙ্গত ও মর্মপীড়া তীব্রভাব প্রকাশ পেয়েছে একই সঙ্গে মিতুলেরও —
“এক মহিলা তার পঁচিশ বছর আগের ইতিহাস ঢেকে রেহেছে সঙ্গোপনে। সে জবিনের প্রতি তার কোন আকাক্সক্ষা আছে কি-না, আমি জানি না। আর একটি মেয়ে সে ইতিহাসের তৃষ্ণায় ব্যাকুল। শুধু ব্যাকুল নয়, সে তৃষ্ণা তার জীবন-মরণ সমস্যা’ (পৃ. ৬৭)।
অন্যদিকে রায়হানের ছন্দার স্বামীকে হত্যা এবং জামেরীর বাসায় আশ্রয় গ্রহণ, জামেরীর তৃতীয় উপন্যাসের প্রকাশ, শরাফীর ও অন্যান্যদের সৃজনশীল শিল্প সম্পর্কে আলোকপাত, রায়হানের সিজোফ্রেনিয়া রুমীতে পরিণত হওয়া, এবং রেজার কাছে নিয়ে যাওয়া, মিতুলের মা’র সঙ্গে সাক্ষাৎ, মিতুলকে জামেরীর বিবাহের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং মিতুলের মা’র মিতুলের সঙ্গে নিস্পৃহ ব্যবহার বিস্তৃত পটে শিল্পরূপ পেয়েছে। রায়হানের খুন পরবর্তী অপরাধবোধ তীব্র ভাষারূপ পেয়েছে এবং জামেরী যেন তার যন্ত্রণা এবং মিতুলের যন্ত্রণা ও ছন্দার যন্ত্রণার মহাকালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছে।
“আমি পাগলের মতো আমার ভালবাসা হাতড়ে বেড়াই। কোথাও কিছু নেই। সব ফাঁকা কামালপুরে বাংকারে বসে সমগ্র দেশটাকে যেমন বুকের মধ্যে পুরে রাখতাম, তেমন করে আর কিছুই পারছি না। এতক্ষণে নিজেকে একটা পুরোপুরি খুনী মনে হচ্ছে। শুধু ছন্দার নয়, এখন আমার বুকের বাংকারেও পড়ে আছে একটা লাশ। উঃ জামেরী, তোকে আমি বোঝাতে পারবো না এ যন্ত্রণার কথা’’ (পৃ. ১০৬)।
উপন্যাসে এম্বুলেন্সের তীব্র শব্দ গ্যালিলিওর আকাশে শাণিত রোদ্দুর, পীচ গলে যাবার ঘটনা জামেরীর অন্তর্বেদনাকে উন্মোচিত করার জন্যে ব্যবহৃত। জামেরী মিতুলকে বিবাহ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে তার মার সব সংবাদ জানালে মিতুল অন্যরকম হয়ে যায় যেন দূরে সরে যায়। তখন জামেরী দেখে নীলাভ ধোঁয়ায় রেজা, রায়হান, শরাফী, সাইকি, মিতুল সবাই ঢাকা পড়েছে। কাউকে সে খুঁজে পাচ্ছে না। জামেরীর আর্তনাদ —
“বুক ফেটে কান্না আসতে লাগলো। সে জনস্রোতের মাঝে দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করলাম, আমার চারপাশে কেউ নেই। আমার নিজস্ব কেউ নেই। যার ওপর আমার সব আবদার, সব অভিমান, সব অত্যাচার খাটবে। মিতুল ছিলো সেও এখন আমার কাছ থেকে অনেক দূরে। দৌড়ে গিয়ে কোলে মুখ গুজে শুয়ে থাকতে পারবো না। বলতে পারবো না, মিতুল, আমার ভারি ঘুম পাচ্ছে। আমি এহন কোলায় যাবো?’’ (পৃ. ১৪০)।
এই আশ্রয়চ্যুত, মানসিক জটিলতায় বিধ্বস্ত, জামেরী যেন শাহরিয়ারের অন্যরূপ। যার রাত কাটে প্রায় ঘুমহীন। দিন কাটে মিতুল রায়হানকে নিয়ে। এরই মাঝে মিতুল হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ্যাম্বুলেন্সির বিচিত্র শব্দ তখন জামেরীর কাছে অনন্তকালের পথে যাত্রার কথা মনে করিয়ে দেয়। সে জানে মিতুলের সে দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে তার “মগ্ন চৈতন্যে সমস্ত প্রাণ শিস’’ বাজাতো সেই মিতুল এখন অচেতন। তার চেতনায় কোন ভালোবাসার জল পড়ে না (পৃ. ১৪৪)।
যে মিতুলকে নিয়ে জামেরীর স্বপ্ন-কল্পনা ভালোবাসার জন্ম হয়েছিল তা যেন অসহ্য বেদনার দীর্ঘশ্বাসে পরিণত হয়। তার ডাক্তার বন্ধু রেজা তাকে সান্ত্বনা দেয়। অনেক শখ করে কেনা তার বিবাহের উপকরর এখন বেদনার উপকরর শুধু। আর রায়হানকে যখন পুলিশ ধরে নিয়ে গেল তখন —
“রায়হান শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমার কাছে থাকতে চেয়েছিলো। আমি রাখতে পারিনি। রায়হানকে ধরে রাখার ক্ষমতা আমার ছিলো না। মিতুল? মিতুলও তো আমার কাছেই থাকতে চেয়েছিলো। কৈ রাখতে তো পারলাম না। কাউকে ধরে রাখার আমার কোন ক্ষমতা নেই। দু’হাতে মাথাটা চেপে ধরলাম। কপালের শিরা দপদপ করছে। মনে হচ্ছে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ বিরাণ জনপদ। খাঁ খাঁ জনমানবহীন আমি একা একা পথ হাতড়ে চলি’’ (পৃ. ১৫৭)। [ক্রমশ]