বাংলা নববর্ষ ১৪৩১ বিশেষ সংখ্যার লেখা।
‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর / নদে এলো বাণ / শিব ঠাকুরের বিয়ে হবে / তিন কন্যে দান। / এক কন্যে রাঁধেন বাড়েন / এক কন্যে খান, / এক কন্যে রাগ করে / বাপের বাড়ি যান।’
এখানে নদে অর্থে নদিয়া বা নবদ্বীপকে বোঝানো হয়েছে। মধ্যযুগে নবদ্বীপের ঐশ্বর্য দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বাংলায়। অজস্রধারায় উৎসারিত জ্ঞানগরিমা, আধ্যাত্মিকতা, সারস্বত-সাধনা এবং উৎসর্জনায় যে সমৃদ্ধি ঘটেছিল নবদ্বীপে, তার তুলনা একমেবাদ্বিতীয়ম। সমাজের প্রচলন নির্ভরতার বিরুদ্ধে দ্রোহ, বর্ণভেদের কঠিন দুর্গে সঠিক বিস্ফোরণ এবং মুসলিম শাসকদের অনৈতিক নির্দেশ নামার প্রতিবাদে অহিংস মহামিছিলের পীঠস্থান এই নবদ্বীপ। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের লীলাভূমি — রঘুনন্দন, আগামবাগীশের জন্মভূমি এই নবদ্বীপ। বৌদ্ধ-শিব-শাক্ত সর্বোপরি বৈষ্ণবধাম এই নবদ্বীপ।
ভাগীরথী গর্ভোত্থিত নয়টি চর বা দিক নিয়ে গড়ে উঠেছিল নবদ্বীপ। অনেকেই বলেন ভাগীরথীর চরে নয়টি দীপ জ্বালিয়ে জনৈক তান্ত্রিক তন্ত্রসাধনা করতেন। লোকে তখন থেকে এটিকে নয়-দিয়ার চর বলতেন। কালক্রমে নয় দিয়ার চর থেকেই নদিয়া বা নবদ্বীপের উত্থান। নবদ্বীপে বৈষ্ণব ধর্মের প্রাধান্য থাকলেও শৈব ধর্মের ঘাঁটি ছিল একসময়।শৈব ধর্ম হলো একটি অবৈদিক বা বেদ পূর্ববর্তী যুগের সংস্কৃতি। নবদ্বীপে শিব গণমানুষের দেবতা।
নবদ্বীপের উত্তরের রয়েছে যোগনাথ মন্দির, দক্ষিণে আলোকনাথ, পূর্বে রয়েছে হংসবাহন, পশ্চিমে বুড়োশিব। এই চারটি প্রসিদ্ধশিব বর্তমানে নবদ্বীপের দিক দেবতায় পরিণত হয়েছেন।
বাংলায় প্রচলিত শৈব ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে গাজন, চরক, শিবরাত্রি শিবের বিয়ে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এদের মধ্যে শিবের বিয়ে নবদ্বীপের এক অভিনব লোক উৎসব। মূলত চার জায়গায় এই শিবের বিয়ে হয় — বুড়ো শিবতলা, যোগনাথতলা, চারিচরা পাড়া, বৌবাজারের বানেশ্বর। সত্তর দশকের পর থেকে অনেক জায়গাতেই এই উৎসবে কিছুটা ভাঁটা পড়লেও এখনও বিশেষ করে বুড়ো শিবতলায় শিবের বিয়ের অনুষ্ঠান জাঁকজমক সহকারে অনুষ্ঠিত হয়। নবদ্বীপের এই উৎসবের বয়স ৫০০ থেকে ৬০০ বছরেরও বেশি। তবে অতিরিক্ত বন্যা প্রবণ হওয়ার দরুন এই সত্যের পুঁথিপত্রের বহু প্রমাণই নষ্ট হয়ে গেছে।
আগে বাসন্তীপুজোর দশমীর ভোরে বুড়োশিব আর যোগনাথ শিবের জোড়া বিয়ের আয়োজন হতো। অষ্টাদশ শতকের নরহরি চক্রবর্তীর “ভক্তি রত্নাকর” গ্রন্থেও সেসময়কার নবদ্বীপের পাঁচটি শিবের কথা আছে।
নবদ্বীপে বুড়োশিবের মন্দিরটি শতাধিক প্রাচীন এবং শিবের মূর্তিটি আরও প্রাচীন। মনে করা হয় সপ্তদশ শতকে এই মূর্তিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে রচিত বিজয়রাম সেন বিশারদ প্রণীত তীর্থমঙ্গলে বুড়ো শিবের কথা উল্লেখ করেছেন— “নবদ্বীপে বুড়োশিব আর নিত্যানন্দে। / উদ্দিশে প্রণাম করি চলিলা আনন্দে।”
১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে বুড়োশিবের প্রাচীন মন্দিরটি নবদ্বীপ পৌরসভায় প্রথম কমিটির সদস্য কৃষ্ণকান্ত শিরোমনি প্রতিষ্ঠা করেন। পরে তারাপ্রসন্ন চূড়ামণির প্রচেষ্টায় বর্তমান নবরত্ন মন্দিরটি নির্মিত হয় ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে। মন্দিরে বুড়োশিবের মুর্তি ছাড়াও কষ্টিপাথর নির্মিত দশভূজা মহিষমর্দিনী, গণেশ মূর্তি, সূর্যের একটি ক্ষুদ্র স্ফটিক খন্ড এবং তামার মঙ্গলচন্ডী বিগ্রহ ছিল। ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে মহিষাসুরমর্দিনী বিগ্রহটি মন্দির থেকে অপহৃত হয়।
এই চার স্থানে শিবের মন্দির লাগোয়া মন্ডপে মহিষমর্দিনী দুর্গার মৃৎমূর্তি পূজিত হয় চৈত্র মাসের শুক্লাসপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এবং দশমী তিথিতে। এই দেবী বাসন্তী দুর্গা নামেও সুপরিচিত। বাসন্তী দুর্গার সঙ্গে শরৎ দুর্গার মত লক্ষ্মী সরস্বতী বা কার্তিক গণেশ থাকে না, তবে অসুর থাকে। দশমীর রাতে বাসন্তী দুর্গার ঘট বিসর্জন করার পর সংশ্লিষ্ট শিব বিয়ে করতে যান।
লৌকিক বিবাহ অনুষ্ঠানের মতই গায়ে হলুদ, জলসাধা, ছড়া কাটা, গান গাওয়া, বরাসন সাজানো, লুচিমিষ্টি বিতরণ, সাতপাক ঘোরা,মালাবদল সহযোগে সম্পন্ন হয় এই বিবাহ অনুষ্ঠান। আগে গ্যাসের আলো জ্বলতো, কদম গাছ ফাটতো, কোঁচা দুলিয়ে পটকা ফাটাতে ফাটাতে বরযাত্রীরা যেত সঙ্গে থাকতো ভস্ম মেখে নন্দী ভিঙ্গীর দল। পোড়ামাতলায় বসতো বাসর। সামিয়ানা খাটিয়ে লুচি মিষ্টি বিতরণ করা হতো, দান সামগ্রী সাজানো হতো। সব শিবের বিয়ের অনুষ্ঠান হতো এই পোড়ামাতলায়। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে আর এখানে আসর বসেনা।
বিয়েতে স্ত্রী আচার হিসেবে জলসাধতে বের হন পল্লীবধুরা এমনকি যাত্রা দলের সখীরাও পল্লীবধুর সাজে দল বেঁধে গান গাইতে গাইতে জলসাধতে বের হন। সখীর দল যখন কাঁখে কলসি নিয়ে গান গাইতে গাইতে জলসাধতে যেত, তখন শচীনন্দন গোস্বামী এবং বিজয়কৃষ্ণ রাঢ়ী গান রচনা করলেন –
‘তোরা চল সজনি, গুণমণি
জল ভরতে যায়,
জল সেধে এলে পরে বরের নাগাল পায়।’
তখন এই উৎসব লোকধর্মের মর্যাদায় উন্নীত হতো। বিজয়কৃষ্ণ রাঢ়ী রচিত সাতকড়ি রাঢ়ী সুরারোপিত এবং অধ্যাপক নিমাই বন্দ্যোপাধ্যায় সংগৃহীত শিবের বিয়ের একটি সঙ্গীত হলো—
এ মধু বসন্তে, আসিয়া লাবণী
উছলে নিখিল ভুবনে,
প্রকৃতি আজ মুক্ত দুয়ার শোভিছে উজল কিরণে
দখিনা পবন আজিকে মাতিছে,
সুরভি কুসুম ফুটিয়া উঠিছে
গন্ধে বরণে ধরণী সাজিছে
মত্ত বিহগ কুজনে।
ওই দেখো গৌরী, রূপের মাধুরী
হর গলে দিবে মালা,
তাই যে বিশ্ব মধুর সুষমায়
ভরিয়াছে ফুল ডালা।
বাজাও তোমার পিনাক যন্ত্র
দূরে থাক সব ভীতি ও দ্বন্দ্ব
হিংসা-বিদ্বেষ দূর কর আজি,
দোঁহার রুদ্র মধুর মিলনে।’
বিয়ের আসরে যথাসময়ে এসে উপস্থিত হন কনে বাসন্তী। বুড়ো বরকে দেখে দেবী নারাজ, তাই বারে বারে আসর ছেড়ে চলে যান।তখন দেবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় দান সামগ্রীর প্রতি। অনেক মান-অভিমান, দর-কষাকষির পর অবশেষে দেবী সম্মতি দেন বিয়ের। তখন উলুধ্বনিতে শঙ্খধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে মন্দির প্রাঙ্গণ। বেজে ওঠে ঢাকের বাদ্যি—বোল ওঠে ‘তা তেটে, তা তেটে, তেটে ধিন তেটে ধিন’। শুরু হয় মালা বদল, সন্তানেরা বাবার বিয়ে নিয়ে মেতে ওঠেন উৎসবে ।
বিয়েতে বরযাত্রী ও কনেযাত্রী হিসেবে অনেকেই নিমন্ত্রিত হন। বরযাত্রীরা আতর মেখে কোঁচায় ফুল তুলে পাম্পশু বগলে নিয়ে যাত্রা করেন। বরযাত্রীরা পাউডারের বদলে ভস্ম মেখে নন্দীভৃঙ্গী সেজে শিবকে সঙ্গে নিয়ে বের হন পথে। বেয়াড়াদের কাঁধে চড়ে বিয়ের মন্ডপে হাজির হন বাবা ভোলানাথ।নবদ্বীপের লোকেরা বলে ‘বাবার বিয়ে’। পুরোহিতের উপস্থিতিতে সাতপাকে ঘোরানো থেকে মালা বদল সব অনুষ্ঠানে সম্পন্ন হয়। এখানকার মানুষজন বিশ্বাস করেন শিব পার্বতীর এই বিয়ের মালা পড়লে অবিবাহিতদের বিয়ে নিশ্চিত সম্ভব,বহু অমঙ্গলও দূর হয়।
পঞ্জিকা মতে চৈত্র মাসে বিবাহ নিষিদ্ধ কিন্তু নবদ্বীপে চৈত্রের শুক্লা দশমীর সেই রাত শিবের বিয়ের নামেই খ্যাত।
বিবাহ বাসরের গোটা চত্বরটিকে আলোকমালায় সাজানো হয়, বাজি পড়ানো হয়।নবদ্বীপের বণিকরা কাঁসা পিতলের বাসন-কোসন থেকে শুরু করে কাপড়চোপড় এমন কি এসি ফ্রিজ,আলমারি, বাইক, সাইকেল, কম্পিউটার,বরের পাঞ্জাবি, কনের বেনারসিও দিয়ে যান। আবার বিয়ে হয়ে গেলে নিজেরাই নিয়ে যান। এটাই নবদ্বীপের রীতি। প্রথার আড়ালে এই অভিনব বিজ্ঞাপনের জন্য বিক্রি বাটাও ভালোই হয়। ইদানিং মূল্যবান স্বর্ণালংকার রাখার ব্যাপারে কোন কোন উৎসব কমিটি দ্বিধায় থাকেন।বিবাহের দিন প্রতিটি আসরে সশস্ত্র পুলিশ রাখার বন্দোবস্ত করা হয়।
শিবের বিয়ের উপলক্ষে নবদ্বীপের কুম্ভকাররা এক ধরনের মাটির তৈরি মুখোশ বানান। বেশ পুরুষালী মুখ—শিবের ঢুলু ঢুলু চোখ, কানে গোঁজা কল্কে ফুল, বাঁকানো গোঁফ,মাথায় সর্প মুকুট। কথিত আছে শিব নিজের বয়স ভাঁড়িয়ে এই মুখোশ পরে বাসন্তীকে বিয়ে করতে গিয়েছিলেন। সর্পফণাযুক্ত রঙিন শিবের মুখোশ নবদ্বীপের একটি প্রধান লোকশিল্প।এটিকে মুখোশ বলা হলেও আসলে এটি মাটি দিয়ে তৈরি মূর্তি।
বিয়ের খরচ জগতে উদ্যোক্তারা পাড়ায় পাড়ায় চাঁদা তোলেন। একে বলা হয় বৃত্তি সাধা। এছাড়াও বিয়ের পনেরো দিন আগে থেকেই কিশোর কিশোরীরা মুখোশ কিনে বাড়ি বাড়ি বৃত্তি তোলে।
দেবদেবীর সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে পৌরাণিক, তাত্ত্বিক তথা শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যার অভাব নেই। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে কোথাও যেন দেবতারা হয়ে উঠেছেন মর্ত্যের মানব মানবী। মানুষের মত নন কিন্তু সামাজিক ও মানবিক নিগড়ে বাধা পড়েছেন তাঁরা। তাইতোপুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মায়ের স্নেহের গোপাল রূপে কিম্বা অন্তরঙ্গ সখা হিসেবে, মাদূর্গা ঘরের মেয়ে উমা রূপে, নবদ্বীপের শচিনন্দন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব ভক্তদের চোখে রাধাকৃষ্ণের ‘যুগলতনু’র পূর্ণ অবতার হয়ে উঠলেন। হিংসা লোভ লালসার ক্রোধানলে তপ্ত পৃথিবীর বুকে নবদ্বীপ আজও কথা বলে প্রেম আর সুরের ভাষায়। সেই সুর যে একবার শুনেছে তার হৃদয় উদ্বেলিত হয়েছে প্রেম, ভক্তি, আনন্দের জোয়ারে। সেই জোয়ারে ভাসতে ঘুরে আসুন পুণ্যভূমি নবদ্বীপে।।
খুবই সুন্দর উপস্থাপনা।খুব ভালো।
ধন্যবাদ