জনমেজয় অতঃপর ব্যাসশিষ্য বৈশম্পায়নকে বললেন, হে ঋষিপ্রবর আপনি আমার কাছে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের চরিতকথা বর্ণনা করুন।
বৈশম্পায়ন হেসে বললেন, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মহান চরিতকথা বর্ণনার আগে আপনাকে বাংলার একটি লৌকিক ছড়ার কথা বলব। সেটি হল ‘ইকড়ি মিকড়ি চাম চিকড়ি চামেকাটা মজুমদার…।’ এটা প্রতিটি বাঙালিই জানেন। কিন্তু অনেকেই জানেন না, কে এই ‘চামেকাটা মজুমদার’! কয়েকটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ইনি হলেন ভবানন্দ মজুমদার। কোনও এক অজ্ঞাতপরিচয় ছড়াকার তাঁকে ব্যঙ্গ করে অসম্মানজনক ‘চামেকাটা’ নামে অভিহিত করেছিলেন। এর পিছনে একটি কারণও রয়েছে। সেই সময় আকবর বা জাহাঙ্গির বাংলার বারো ভুঁইয়াদের দাপটের সামনে এগতেই পারছিলেন না। তখন বারো ভুঁইয়াদের সর্বনাশ করতে এই বাংলায় খাল কেটে কুমির এনেছিলেন ভবানন্দ মজুমদার। ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাজা প্রতাপাদিত্যকে ধরার জন্য মুঘল সেনাপতি মানসিংহকে প্রচুর সাহায্য করেছিলেন। বাংলায় মুঘল আধিপত্য স্থাপনের জন্য ভবানন্দের উদ্যোগ জাহাঙ্গির ভোলেননি। ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি নদীয়া, মহৎপুর সহ ১৪টি পরগনা তাঁকে দান করেন। তাঁকে ‘মজুমদার’ উপাধি প্রদান করেন এবং প্রভূত অর্থ, মণিমাণিক্য উপহার দিয়েছিলেন।
ভবানন্দ মজুমদারের অষ্টম পুরুষ কৃষ্ণচন্দ্র রায়। ভবানন্দ থেকে শুরু করলে তৃতীয় পুরুষ রাঘব রেউইতে এসে বসবাস শুরু করেন। পরে তাঁর পুত্র রুদ্র রায় এই শহরের নামকরণ করেন কৃষ্ণনগর।
জনমেজয় বললেন, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে যে ‘নেমকহারাম’ বলা হয়, তার পিছনে কি যথার্থ কোনও কারণ আছে?
বৈশম্পায়ন বললেন, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ বা ‘নেমকহারামি’ নিয়ে যে বিতর্ক উঠেছে, তার শুরু কিন্তু ভবানন্দ থেকে। সুতরাং সনাতন ধর্ম প্রসঙ্গ উত্থাপন করে কলঙ্ক মোচনের যে চেষ্টা চলছে, ওসব বাতুলতা মাত্র। ভবানন্দ এবং কৃষ্ণচন্দ্র উভয়েই আপন স্বার্থ ছাড়া কিছুই দেখেননি। তবে কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন অত্যন্ত ধুরন্ধর প্রকৃতির মানুষ। সেই সময় সিরাজকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য যে গোপন মন্ত্রণা হয়েছিল, প্রথমে সেখানে কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন না। ছিলেন জগৎশেঠ, মিরজাফর, উমিচাঁদ, মহারাজা মহেন্দ্র, রাজা রামনারায়ণ, রাজা রাজবল্লভ, রাজা কৃষ্ণদাস, রায় দুর্লভ, ইয়ার লতিফ, খোজা ওয়াজিদ প্রমুখ। সেখানে জগৎশেঠই বলেন, এই গোপন মন্ত্রণায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে আহ্বান করা হোক।
সেই আহ্বান পেয়ে প্রথমেই পা বাড়াননি কৃষ্ণচন্দ্র। প্রাথমিকভাবে ব্যাপারটার তল মাপতে তিনি নিজে সেই মন্ত্রণায় না গিয়ে পাঠালেন তাঁরই বিশ্বস্ত মন্ত্রী কালীপ্রসাদ সিংহকে। তাঁকে বললেন, তুমি একবার হাওয়াটা বুঝে এসো।
কালীপ্রসাদ ব্যাপারটা বুঝে এসে কৃষ্ণচন্দ্রকে সব বললেন। সেইমতো এক গভীর রাতে জগৎশেঠের বাড়িতে শুরু হল সিরাজকে সরিয়ে দেওয়ার গোপন ষড়যন্ত্র। সেখানে কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে সিরাজকে অপসারণের কৌশল সম্পর্কে সকলে জিজ্ঞাসা করেন। কৃষ্ণচন্দ্র বললেন, সিরাজের মতো একজন যবনকে অবশ্যই দ্রুত সিংহাসন থেকে সরিয়ে দেওয়া দরকার। পরক্ষণেই সেই সভায় উপস্থিত মিরজাফরের দিকে তিনি তাকিয়ে বলেন, উনিও অবশ্য যবন। তখন অন্যান্যরা কৃষ্ণচন্দ্রকে বলেন, উনি যবন হতে পারেন, কিন্তু অতি উত্তম মানুষ।
কৃষ্ণচন্দ্র বললেন, সিরাজকে সরিয়ে যদি কোনও বিজাতীয় শক্তি ক্ষমতা দখল করেন, তাতে কারও আপত্তি আছে? জগৎশেঠ বললেন, আপনি একটু খুলে বলুন। কৃষ্ণচন্দ্র বললেন, ইংরেজরা যদি এদেশের রাজা হন, তাহলে সকল দিক দিয়েই মঙ্গল। তাহলে যবনদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার একটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হতে পারে। এতে আমাদেরও সুবিধা হবে।
কিন্তু ইংরেজদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন কে? কৃষ্ণচন্দ্র বললেন, সে দায়িত্ব আমার। আমি প্রায়ই কলকাতায় যাই। সেখানে গিয়ে কুঠির বড় সাহেবকে বুঝিয়ে ঠিক নিয়ে এসে সিরাজকে উৎখাত করব।
সকলে রাজি হতেই কৃষ্ণচন্দ্র কালীঘাটে মাকে দর্শন করার ছুতোয় কলকাতায় এসে রবার্ট ক্লাইভের কাছে সমস্ত ষড়যন্ত্রের কথা শোনালেন। ক্লাইভ যেন হাতে চাঁদ পেলেন। ইংরেজরা তখন সিরাজের উপর রাগে ফুঁসছে। কেননা কলকাতায় বেআইনি দুর্গ গড়ার চেষ্টা করেছিল ইংরেজরা। সেটা কলকাতা আক্রমণ করে সিরাজউদ্দৌলা গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমরা পলাশীর যুদ্ধে মিরজাফরের বেইমানি নিয়ে বারবার বলি। কিন্তু বলি না কতজন স্বার্থান্বেষী মিলে সেদিন দেশের স্বাধীনতাকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে কৃষ্ণচন্দ্রই ছিলেন এদেশে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার মূল পান্ডা।
মনে রাখা দরকার, সিরাজউদ্দৌলার সিংহাসনে বসেন ১৭৫৬ সালের ৯ এপ্রিল। তখন তাঁর বয়স ২৩ বছর। সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন পর্যন্ত। অর্থাৎ এক বছরের শাসনকালে কতটুকুই বা তিনি সুযোগ পেয়েছিলেন! বিহারিলাল সরকার লিখেছেন, এই একবছর তিনি নানা ধরনের যুদ্ধেই ব্যস্ত ছিলেন, ‘রাজশাসনযোগ্য রাজনীতি কুশলতার অভিজ্ঞতার পরিচয় দিবার অবসর পান নাই।’ সুতরাং ব্যর্থ শাসক হিসাবে তাঁকে দাগিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। আসলে অল্প বয়সি রাজাকে অমাত্যরা পুতুল বানাতে চেয়েছিলেন। সেটা না পারায় তাঁকে সরানোর ষড়যন্ত্র শুরু হয়।
ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায় লিখেছেন, ‘রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের এইরূপ কাপুরুষোচিত গুপ্ত মন্ত্রণায় যোগদানের জন্য রাণী ভবানী তাঁহাকে সদুপদেশ দানের ছলে শাঁখা-সিঁদুর পাঠাইয়াছিলেন।’ কার্তিকেয়চন্দ্র রায়ের লেখায় আছে, ‘রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এই রাজবিপ্লবের প্রবর্ত্তক, মন্ত্রী ও প্রধান উদ্যোগী ছিলেন। তিনি এই বিষয়ে বিশেষ যত্নবান ও উদ্যোগী ছিলেন বলিয়া এ প্রদেশস্থ প্রাচীন লোকেরা তাঁহাকে নেমকহারাম কহিত।’ রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় লিখেছেন মন্ত্রণাকক্ষে কৃষ্ণচন্দ্র ইংরেজদের প্রভূত গুণগান করেছিলেন। ইংরেজরা ‘বুদ্ধিতে বৃহস্পতির ন্যায়, ধনেতে কুবেরের তুল্য, পরম ধার্ম্মিক অর্জুনের ন্যায় পরাক্রম, প্রজাপালনে সাক্ষাৎ যুধিষ্ঠির।’ এরপর সকলেই একবাক্যে স্বীকার করে নেন এমন ‘ঈশ্বরতুল্য’ ইংরেজরা দেশাধিকারী না হলে যবনরা সবকিছু নষ্ট করে দেবে।
জনমেজয় বললেন, যবনজাতিকে তাড়িয়ে
সনাতন ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্যই যে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র
ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়েছিলেন, তা তো আজ স্বীকার করে নেওয়াই হয়েছে।
বৈশম্পায়ন বললেন, হ্যাঁ একথায় তো সিলমোহর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীও। অবশ্য যবন তাড়ানোর জন্য ইংরেজদের তোষামোদ করার কৌশল পরবর্তীকালে কোনও কোনও হিন্দুবাদী নেতা অবলম্বন করেছিলেন। যেমন সাভারকর কিংবা গোলওয়ালকর। তাঁরা কখনওই চাননি ভারত স্বাধীন হোক। তাঁরা চেয়েছিলেন, ইংরেজরা মুসলমানদের এদেশ থেকে তাড়িয়ে দিক। ইংরেজদের আনুকূল্যেই এদেশে হিন্দুরাষ্ট্র চালু করে মনুবাদী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হোক।
জনমেজয় প্রশ্ন করলেন, রাজা হিসাবে কৃষ্ণচন্দ্র কেমন ছিলেন?
বৈশম্পায়ন বললেন, প্রথমত তাঁর রাজা হওয়ার কথাই ছিল না। পিতা রঘুরাম মৃত্যুর পূর্বে কৃষ্ণচন্দ্রের বৈমাত্রেয় ভাই রামগোপালকে পরবর্তী রাজা হিসাবে মনোনীত করেন। কিন্তু চাতুরির সাহায্যে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ভাইকে সরিয়ে বাংলার তৎকালীন নবাব সুজাউদ্দিনের কাছ থেকে নিজে রাজসনদ আদায় করেন।
রাজা হিসাবে তিনি ছিলেন অনেকটাই বেহিসাবি। তার সঙ্গে মিশেছিল অমিতব্যয়িতা ও লাম্পট্য। রাজেন্দ্রলাল মিত্র তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, ‘তিনি সুচতুর ও সুপণ্ডিত ছিলেন ও তাঁহার নিকট গুণীগণের প্রচুর সমাদর ছিল। কিন্তু লাম্পট্যদোষে তাঁহার সেই সমুদয় গুণ-গরিমা কলুষিত হইয়াছিল।’ শুধু তাই নয়, অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে এবং ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলা সাহিত্য ও সমাজে যে রুচিবিকৃতির আমদানি হয়েছিল, তার কারণ হিসাবে কৃষ্ণচন্দ্রকেই চিহ্নিত করেছিলেন রাজেন্দ্রলাল।
বারবার দেখা গিয়েছে, তিনি রাজকর দিতে সমস্যায় পড়তেন। সেজন্য তাঁকে কারাবাসও করতে হয়েছে। বেশ কয়েকবার জাল পাট্টা তৈরি করে অন্যের জমি হাতিয়ে নিয়েছিলেন বলেও ইতিহাস বলছে। আবার দেখা যায়, একদিকে যখন দেশে বর্গির হানা, অন্যদিকে দুর্ভিক্ষ, সেই সময় প্রজাদের থেকে বলপূর্বক কর আদায় করে তিনি কৃষ্ণনগর থেকে গা ঢাকা দেন। বর্গির হানা থেকে বাঁচতে চূর্ণী নদীর তীরে জঙ্গলের ধারে শিবনিবাসে নির্মাণ করেন নতুন প্রাসাদ। অথচ সেদিন প্রজাদের পাশে তিনি দাঁড়াননি। ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’ তত্ত্বকে স্বীকার করে শিবনিবাসে পরিবার নিয়ে পালিয়ে যান।
জনমেজয় বললেন, হে যোগীবর, আমার মনে পড়ে যাচ্ছে কিছুদিন আগের কথা। যখন দেশের মানুষ মহামারীর আক্রমণে কাতর, দেশ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে ভেঙে পড়েছে, মানুষ কী করে অন্ন সংস্থান করবেন, তার ঠিক নেই, তখন দেশের রাজার কাছে প্রধান কাজ ছিল রামমন্দির নির্মাণ ও নতুন সংসদ ভবনের স্বপ্নে মশগুল থাকা। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে তিনশো বছরের সেই সংস্কৃতি একইভাবে বয়ে চলেছে, কোথাও তার কোনও পরিবর্তন হয়নি।
বৈশম্পায়ন বললেন, ঠিকই। এই দেশ যেন ক্রমেই অন্য মৌলবাদী দেশের অনুকরণে ধর্মতন্ত্রের গাড্ডায় পড়ে পিছনের দিকে এগিয়ে চলেছে। গত দশ বছরে দেশের প্রভূত ক্ষতি হয়েছে।
জনমেজয় বললেন, এর থেকে কি পরিত্রাণ নেই?
বৈশম্পায়ন বললেন, কৃষ্ণচন্দ্রের বুদ্ধিভ্রংশ দেখে একদিন তাঁর প্রিয়পাত্র গোপাল ভাঁড় প্রতিবাদ জানিয়ে তাঁর সংসর্গ ত্যাগ করেছিলেন। বর্তমান গণতন্ত্রেও সেই পদ্ধতি রয়েছে। সেই পদ্ধতি হল নির্বাচন। এখন তো আর সরে যাওয়া নয়, সরিয়ে দেওয়া।