মালেকাকে ওর স্বামী লতিফ গলা কেটে খুন করেছে। তারপর ওর দু’টুকরো দেহ বাকলজোড়া গ্রামের পাশের জাইলাবিলে ফেলে দেয়। ভুস্ করে ডুবে গিয়ে আবার ভেসে ওঠে মালেকার দেহ। দু’দিন পরে ওর শরীর পচতে শুরু করলে চিল-শকুন উড়ে আসে। কদিন পর ওর দু’ভাই এসে মালেকার পচা দেহ নৌকার সাথে বেঁধে জাইলাবিল থেকে দুর্গাপুর থানার ঘাটে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ততোদিনে দেহ এতোই পচে গেছে যে, সেটা আর দাফন করার অবস্থা নেই। তখন ভাইয়েরা মালেকার পচা দেহ সোমেশ্বরী নদীর স্রোতে ভাসিয়ে দেয়। খানিক বিষাদে দু’ভাই আক্রান্ত হয় কিছুক্ষণের জন্য। তারপর একরকম খুশি মনে বাড়ি ফেরে। শুধু পচা মাংসের ঘ্রাণ ওদের পিছু ছাড়ে না।
মুসলমানের মেয়ে জানাজা পেলো না, কবরও পেলো না। বাল্য বয়সে মৌলবী সাহেবের কাছে কোরান শরীফ পড়া শিখেছিলো। এতোটা বয়স পর্যন্ত প্রত্যেক রোজাতেই একবার করে খতম দিয়েছে কোরান শরীফ। রোজাও রেখেছে। ঈমানেরও কোনো ফাঁক ছিলো না। তাহলে মালেকা এখন যাবে কোথায়? নদীর পানির শীতল স্পর্শে ওর দিব্যদৃষ্টি খুলে যায়। ও অনুভব করে সামনে দোযখ নেই, বেহেশত নেই-ও ওর প্রিয় সোমেশ্বরী নদীর বুকে ভাসছে। ওর শরীরের পচা মাংস টুপটাপ খেয়ে ফেলছে মাছেরা। চারদিকে ছোট বড় নানারকমের মাছ ওকে ঘিরে আছে। মালেকা নিজেকেই বলে, তাহলে কি পৃথিবীতেই থেকে গেলাম আমি? তাহলে আমার শরীরটা গেলো কোথায়? যেটাকে নিয়ে এতো কুৎসিত, কদর্য রটনা?
ও স্বামীর বাড়ির কাছে এসে দাঁড়ায়।
তখন সন্ধ্যা। চুলোয় আঁচ দিয়েছে লতিফের বড়ো বউ। ভাত ফুটছে। বারান্দায় বসে হুকো টানছে লতিফ। ভাত হলেই গরম গরম ভাত খাবে। ওর সবকিছু গরম চাই। কোনো খাবার জুড়িয়ে গেলে ও খায় না। মালেকা খুন হওয়ার পর থেকে বড়ো বউ মানসিকভাবে খুব বিপর্যস্ত। স্বামীর দিকে ভালো করে তাকাতে পারে না। তাকালেই মনে হয় লতিফের ঘাড়ের ওপর মাথা নেই। লতিফ মুণ্ডুহীন মানুষ। একদিকে ভয়, অন্যদিকে কষ্ট। তাই কারণে-অকারণে বড়ো বউর চোখে পানি এসে যায়। কিন্তু কিছু বলার উপায় নেই। রাতদিন বুকের ভেতর গুমরে মরে যাতনা। মেয়েটাকে মারা হলো, অথচ পুলিশ হলো না, থানা হলো না এটাও ভাবতে পারে না। প্রথম কদিন তো বাড়িতে কখন পুলিশ এসে যায় এ ভয়ে অস্থির ছিলো। এখন সে ভয় কেটেছে। কিন্তু নিজের মনের ভয় কাটাবে কি করে? রাতের বেলা একা কোথাও যেতে পারে না বড়ো বউ।
সে সন্ধ্যায় ভাত গালারা পর ফেনের গামলা নিয়ে গোয়ালের দিকে যেতেই আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে। পায়ের ওপর পড়ে যায় গরম ফেনের গামলা। ওর চিৎকারে ছুটে আসে বাড়ির লোকজন।
— কি হয়েছে? কি হয়েছে?
বড়ো বউ চেঁচাতে চেঁচাতে বলে, মালেকা! মালেকা! গলা কাটা মালেকা!
ধমক দিয়ে ওঠে লতিফ, খামোশ! চুপ করো।
অন্যরা চেঁচায়, কোথায়? কোথায়?
ঐতো-ঐতো-ঐখানে-ঐখানে….
লতিফ লাফ দিয়ে গিয়ে চুলের মুঠি ধরে। ধমাধম কিল-চড় লাগায়। মাটিতে গড়িয়ে পড়ে বড়ো বৌ। জ্ঞান নেই।
অনেক রাতে বরান্দায় বসে থাকে লতিফ। শুনতে পায় কেমন একটা ফিসফিস কন্ঠ, আপনের কাছে কি আমার অপরাধ ছিলো?
উহ্, মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। উঠতে গিয়ে মাথাটা বারান্দার খুঁটিতে ঠোক্কর খায়, চমকে ওঠে লতিফ, সেই কথাগুলো যেন আরো স্পষ্ট হয়ে কানে বাজছে। তোলপাড় করছে চারদিক। তখন ও নিজের অজান্তেই বলে, মাইনকা তোমার দিকে হাত বাড়াইছিলো ক্যান? তুমি ভাবছিলে আমার বয়স বেশি। বুড়া হয়ে গেছি? না?
— না, আমি তা ভাববো ক্যান? আপনের জন্য তো বয়স বেশি না, আমার জন্য বেশি। আপনের সাথে আমার বয়সের বত্রিশ বছরের তফাৎ।
— বেটা মানুষের আবার বয়স কি?
বাতাসে হাসির হল্লা শোনা যায়। লতিফ দ্রুতপায়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। ওর গা ছামছম করে। মনে হয় উঠোনে কেমন একটা ছায়া নড়ছিলো। ও বুকে থুতু দেয়। আসলে সব মনের ভুল। হারামজাদি বেঁচে থাকতে একটা নষ্ট মেয়ে ছিলো, মরেও নষ্টই থেকে গেলো।
মালেকা সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। রাত-দুপুর। চারদিকে চাঁদের আলো। জীবনকালে এতো রাতে এমন চাদের আলো ও দেখেনি। ওহ্ কি সুন্দর এই দুনিয়া। ওর দীর্ঘশ্বাস ছুটে যায় চারদিকে। তারপর মাঠের মাঝখানের তালগাছের নিচে বসে পড়ে ও। কতোদিন এই গাছটির দিকে তাকিয়ে ভেবেছিলো এখানে এসে দুদণ্ড দাঁড়াবে। দেখবে গাছটা কতো উঁচু? দেখবে আকাশ কতো বড়ো? কিন্তু বাড়ি থেকে বেরুবার জো ছিলো না। শোবার ঘর, রান্নাঘর, গোয়ালঘর, পুকুরঘাট-এই তো ছিলো ওর প্রতিদিনের দুনিয়া। এখন ওর চারদিক কেমন ফকফকে-তুলোট মেঘের মতো ছেঁড়াছেঁড়া, অনায়াসে লুকোচুরি খেলা যায়। ও বালিকার মতো গোল্লা ছুট খেলায় মেতে উঠতে চায়। পারে না। মন খারাপ হয়ে থাকে।
এখান থেকে খানিকটা তফাতে গাছপালার আড়ালে মাইনকার বাড়ি। মাইনকাকে আমি ভালোবাসতে চেয়েছিলাম। শুধু একটু ভালোবাসা-প্রাণে উথালপাতাল টান। মাইনকা মন বুঝতো না, বুঝতো শরীর। মাইনকা চেয়েছিলো আমার শরীর। আমি রাজি হইনি। ভালোবাসা ছাড়া আবার শরীর কি? শরীরটা কি এতোই সহজ? মালেকা তাল গাছের ছায়ায় নিজেকে দেখে। উঁহু, সহজ না। ওর কাছে ভালোবাসা ছাড়া শরীরের সম্পর্ক পাপ। তবু মাইনকা ওকে পছন্দ করবে কেন এটাই ছিলো ওর অপরাধ। এটুকুই ছিলো ওর পাপ? লতিফের সহ্য হয়নি। ও রটিয়েছে মালেকা চরিত্রহীন, মালেকা ভ্রষ্টা।
পাপ কি? পুণ্য কি? ইহলোক কি? পরকাল কি?
মালেকা কিছুই বুঝতে পারেনি। এখনও পারছে না। শুধু ওর ছাব্বিশ বছর বয়সটা প্রশ্ন হয়েই থাকে। যে লোক চারজন স্ত্রী নিয়ে এক বাড়িতে বাস করে সে চরিত্রবান, সে ভ্রষ্ট নয়। এতে নাকি সম্মান বাড়ে, বংশের ইজ্জত। যে নারী শুধুই ভালোবাসার কাঙাল হয়-জীবনকে অন্যরকম করে সাজাতে চায়, চারজন স্ত্রীর একজন হতে চায় না, সব অপরাধ তার? সে বংশের ইজ্জত নষ্ট করে, তাই তাকে মরতে হবে।
মালেকা তালগাছের মাথায় উঠে বসে। দু’চোখ ভরে নিজের গ্রামটা দেখে, আরো দূরের গাঁ এবং দেশটা দেখে। ভাবে, মানুষ কই? দু’চোখ ভরে মানুষ দেখতে চাই। মানুষ দেখতে কোথায় যাবে ও? একজন স্কুলের মাস্টার আছে। তাকে? যে ভাইয়ের সংসার থেকে ওকে উদ্ধার করে লতিফের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো। না থাক মাস্টার, সে মানুষটি তো ওর ভালোই চেয়েছিলো। ভালো করতে পারেনি। কিন্তু ওর ভাইয়েরা?
ও তালগাছের উঁচু থেকে বড়োকুঠুরি গ্রামের দিকে তাকায়। এক সময় ঐ গ্রামে ওর বাবার কিছু জমিজমা ছিলো। এখন কিছু নেই। এখন ওর দুই ভাই ক্ষেত মজুর। বাবা মরে গেছে বছর পাঁচেক আগে। মা বছর দুই ধরে পাগল। ঘরে থাকে না। পথেঘাটে ঘোরে। কোথায় থাকে কি খায় ঠিক নেই। দিনমজুর দু’ ভাইয়ের সংসারে ভাতের হাঁড়িতে ঠনঠন। সেখানে মালেকা ছিল বাড়তি ঝামেলা। এতোকিছুর পরও এককালে বাপের কিছু জমিজমা ছিলো সে বোধটি দুই ভাইয়ের মগজে বিঁধে আছে। মনে করে ওরা না হয় গরিব হয়েছে, কিন্তু বাপ-দাদার বংশের তো ইজ্জত ছিলো। তাই চরিত্রহীন বোনের লাশ দাফন করতে ওদের আগ্রহ ছিলো না। বোনের শরীর শিয়াল-শকুনে খেলে কতোটা উজ্জত বাড়ে সেটা ওরা বোঝে না; ধর্মমাফিক দাফন না হলে কতোটা ইজ্জত বাড়ে সেটাও ওরা বোঝে না। বোঝে মেয়েমানুষের মিথ্যে অপবাদ।
মালেকার দীর্ঘশ্বাস আবার বাতাসে ছড়িয়ে যায়।
মালেকা তালগাছের মাথা থেকে নেমে আসে। ভোর হয়েছে। কিন্তু সূর্য ওঠেনি। ও ভাইয়ের বাড়ির কাছে এসে দাঁড়ায়। গোয়ালঘরের পাশে বড়ো ভাইয়ের বউ বাসি ফেন ফেলে গেছে। ওর পাগল মা, যার পরনে এক টুকরো চট-শরীর উদোম, মাথার চুল জটা পাকিয়ে আছে, সে ওখানে বসে ফেনের ভেতর থেকে ভাত খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। মুরগিটা গোটা দশের বাচ্চা নিয়ে তার পাশে ঘুরঘুর করছে। মুরগিটা ওর মাকে ভয় পায় না। বরং ওর মা যখন হাত দিয়ে বাচ্চাগুলো তাড়াতে যায় তখন রুখে ওঠে। মুরগি রুখে উঠলে ওর মা কুকড়ি মেরে সরে যায়। তখন মুরগি ওর বাচ্চাগুলো নিয়ে ফেনের ভেতর পড়ে যাওয়া ভাতগুলো খেতে থাকে। মালেকা দেখে ওর মা কেমন অসহায়ভাবে বসে থাকে। ওর মা মুরগির সঙ্গেও পেরে ওঠে না। মালেকার বুক ভেঙে যায়। মা আর মুরগি — মুরগি আর মা। এই মায়ের ছেলেরা বংশের ইজ্জত নিয়ে মাথা ঘামায়। মালেকা হা হা করে হেসে উঠতে চায়। পারে না।
দেখে ছোট ভাই আর তার বউ বারান্দায় বসে আছে। দুজনে মালেকার কথা বলছে। ছোট ভাইয়ের বউ রহিমা সুন্দরী। রূপের দেমাগ আছে। মালেকা এই সংসারে থাকার সময় খুব খারাপ ব্যবহার করতো। সহ্যই করতে পারতো না ওকে। আজও মুখ বাঁকিয়ে বলে, মরেছে ভালো হয়েছে। উচিত শাস্তি পেয়েছে।
আবদুল জব্বার সরোষে বলে, মরেছে বেঁচে গেছি আমরা। কিন্তু বংশের মুখে যে চুলকালি দিয়ে মরলো এটাই জ্বালা। গাঁয়ে হাঁটা যায় না। মানুষে কতো কথা বলো।
— রাখো তোমার গাঁয়ের মানুষ। বাপের বাড়িতে যে কীভাবে মুখ দেখাবো আমি ভাবতে পারি না।
তখন আচমকা উঠোনে একটা ছায়া দেখে, ও মাগো, বলে চেঁচিয়ে ওঠে রহিমা।
— কি হয়েছে? কি হয়েছে?
আব্দুল জব্বার জিজ্ঞেস করে।
রহিমা চেঁচাতে চেঁচাতে বলে, মালেকা, মালেকা। গলাকাটা মালেকা।
— কি বলছো যা তা? তাই কি হয় নাকি?
— ঐতো, ঐতো। ঐখানে, ঐখানে।
সেই চিৎকার শুনে গোয়ালঘরের ওপাশ থেকে ছুটে আসে আব্দুল জব্বারের মা। উঠোনের মাঝ বরাবর কাঁচা গোবরের ওপর পা পিছলে উল্টে পড়ে যায়। গোঁ-গোঁ করতে করতে চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসে। গোঙানির শব্দে কাঁদতে কাঁদতে বলে, মালেকা, আমার মালেকারে।
অল্পক্ষণে মারা যায় মুরগির চেয়ে অসহায় আব্দুল জব্বারের মা। অন্যান্য ঘরে থেকে বেরিয়ে আসে অনেকে। মায়ের মুখে পানি দেয়ার চেষ্টা করে। সে পানি ঠোঁটের কোণা বেয়ে গড়িয়ে পড়ে যায়।
নিথর দাঁড়িয়ে থেকে এইসব দৃশ্য দেখে মালেকা। তারপর ওর অসহায় মা মরে গিয়ে বেঁচে গেছে বলে খুশি হয়। খুশিতে উড়তে উড়তে গনু মাষ্টারের বাড়িতে আসে। চারদিকে গাছ-গাছালি ভরা স্নিগ্ধ বাড়ি। ও গোয়লঘরের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। রাখাল ছেলে গরুগুলো বাইরে নিয়ে গেছে। বারান্দায় পাটি বিছিয়ে মাষ্টার ভাত খাচ্ছে। স্কুলে যাবে। আটজন ছেলেমেয়ে সঙ্গে বসেছে। একজন বাদে বাকিরাও স্কুলে যাবে। তারপর আলিমুন খালি বাড়িতে সারাদিন ঘুরে ঘুরে কাজ করবে। সংসারের কাজের কি শেষ আছে? আলিমুন ভারী ভালো মানুষ। গাঁয়ের কোনো কোনো মেয়ের মতো বলে না, ‘নষ্টা বলেই তো মরেছে? নইলে শুরু শুধু কি কেউ কাউকে খুন করে?’ নিজে নিজে ফোঁস করে ওঠে আলিমুন, যদি নষ্টাই হয় হোক, সেটাও ওর খুশি। তাই বলে খুন করতে হবে কেন? মালেকার কথা ভেবে আলিমুন কষ্ট পায়। স্বামীর সঙ্গে ওকে নিয়ে আলোচনা হয়। মাস্টার বলে, আইন তো কেউ নিজের হাতে উঠিয়ে নিতে পারে না। পছন্দ না হলে ছেড়ে দাও। ও নিজের পথ দেখবে। কাউকে ভালোবাসলে তার কাছে যাবে। তাই বলে খুন করতে হবে?
মাস্টারের গালাগাল শুনেই তো দুই ভাই লাশ আনতে গিয়েছিলো। নইলে খবরটা শুনে ওরা উত্তেজিত হয়নি, রাগও করেনি। ড্যাবডেবে চোখে তাকিয়ে শোনে, তারপর একটা ভঙ্গি করে ভাবে, মানুষ, মানুষকে এতো সহজে খুন করে কীভাবে?
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হানিফ শেখ দাঁত খিঁচিয়ে বলে, ছাগল একটা। মানুষ হলি না। গরুই থাকলি।
ছাগল থেকে গরু হয়ে যাওয়ায় আব্দুল জব্বার পুলকিত হয়। মনে করে এতে ওর ইজ্জত বেড়েছে।
মাস্টার ওদের বলেছিলো, গরিবের ইজ্জত একটাই। দু’বেলা পেট পুরে পুষ্টিকর ভালো খাবার খেতে পারাটা গরিবের ইজ্জত। উপোস দিয়ে কচু-ঘেচু খেয়ে কি ইজ্জত হয়? গরিবের পেটই ইজ্জত। সে পুরুষ বা নারী যেই হোক না কেন। ইজ্জত আর কিছুতেই নাই। চরিত্র মেয়েমানুষের থাকতে হবে, পুরুষমানুষেরও থাকতে হবে।
আব্দুল জব্বাররা এসব কথা বুঝতে পারে না। বুঝতে চায়ও না। তাই ওদের দল ভারী। মাস্টার একা। মাস্টারের কথা ক’জনেই বা শোনে। তবু মাস্টার যেখানে যাকে পায় বক্তৃতার ঢঙে এসব কথা বলেই যায়।
তখন শিউরে ওঠে মালেকা। যাদের হাতে দা-কুড়াল আছে তারা তো এসব কথার জন্য খুন করে ফেলবে মাস্টারকে। খুন? খুন? শব্দটা তোলপাড় করে ওঠে বাড়ি জুড়ে। ও আলিমুনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আলিমুন যেখানে যায় ও পিছু ছাড়ে না। কিন্তু আলিমুন আপন মনে কাজ করে। ও মালেকার কোনো ছায়া দেখতে পায় না। চিৎকারও করে না। মালেকা অনেকক্ষণ ধরে ঘুরে ফিরে সেই শান্তিময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে।
বাজারে এসে দাঁড়ায়। কালু মোলার চায়ের দোকানের পাশে। দোকানে তখন জোর আড্ডা চলছে। আব্দুল জব্বারের মা মারা গেছে তারপর সেটা হয়ে যায় যে পাগলীটা মরেছে। কথার ওপর কথা গড়াতে থাকে। গড়াতে গড়াতে তা আবার মালেকাকেন্দ্রিক হয়ে যায়।
ছুটিতে বাড়ি এসেছে দুর্গাপুর থানার পুলিশ মোসলেম হওলাদার। তার কন্ঠই বেশি উঁচু। সে ইজ্জতের একজন বড়ো রক্ষক। বলে, আপনারা তো জানেন এক সময় দুর্গাপুর থানায় ঘটেছিলো একটা ঘটনা। একবার একজন লোক তার বড়ো ভাইয়ের বিধবা বৌয়ের কাটা মাথা নিয়ে থানায় চলে আসে। বলে, বংশের ইজ্জত রক্ষার জন্য চরিত্রহীন এই মেয়েমানুষটাকে আমি হত্যা করেছি। ভেবে দেখেন আপনারা কতো বড়ো ঈমানদার লোক।
পেছন থেকে একজন বলে, ঐ লম্পট লোকের গল্প আর বলবেন না। ওতো বড়ো ভাইয়ের বউয়ের ইজ্জত নষ্ট করতে চেয়েছিল। ভাবী রাজি হয়নি বলেই তো রেগে খুন করেছে।
মোসলেম হাওলাদার চটে উঠে বলে, পুরুষ মানুষ তো একটু আধটু করবেই। ইজ্জত রক্ষার দায়িত্ব…
কথা শেষ হয় না, আর একজন লুফে নিয়ে বলে, বংশের ইজ্জতের কথা ভেবেই তো সেই লোকটি এই কাজটি করেছিলো। পেছন থেকে একজন বলে, সেই লোকটার বিচার হয়েছিলো। ফাঁসি হয়েছিলো।
মোসলেম হাওলাদার উত্তেজিত হয়ে বলে, হবেই তো। আমরা যে বৃটিশ আইনে চলি। ইংরেজরা যে এই দেশটার কতো রকম সর্বনাশ করে গেছে তার কি শেষ আছে। বৃটিশ আইন তো বংশের ইজ্জত রক্ষা করার মতো অবস্থায় ওঠেনি।
হে হে করে সাড়া দেয় অনেকে। মোসলেম হাওলাদারের উত্তেজনা কমে না। লোকে ওর কথার প্রতিবাদ করবে এটাও ভাবতে ও পারে না। আরো কিছু বলতে যাবে এমন সময় দোকানের সামনে একটি ছায়া দেখে চিৎকার করে ওঠে। বেঞ্চের ওপর বসে পড়ে টেবিলের ওপর মাথা ঝুঁকিয়ে গোঁ-গোঁ করতে থাকে।
— কি হয়েছে! কি হয়েছে!
সমবেত কন্ঠ।
— মালেকা, মালেকা। গলাকাটা মালেকা।
— কোথায় মালেকা? কোথায়?
— ঐতো, ঐতো-ঐখানে, ঐখানে।
কেউ কেউ হি-হি করে হেসে ওঠে। আস্তে আস্তে দোকানের ভেতর হাসির রোল ওঠে। কেউ বাঁকা মন্তব্য ছোঁড়ে, পুলিশের ভূত দেখার অভ্যাস হয়েছে।
মোসলেম হাওলাদার মানসিকভাবে অত্যন্ত বিধ্বস্ত বোধ করে। কারো কারো কথার জবাব দিতে পারে না। নিজের মনের দিকে ফিরে তাকায়। ও কি সত্যি বলেছে কথাটা? নাকি শুধুই মেয়েমানুষের ইজ্জতের ব্যাপরাটি মেনে নেওয়া উচিত? ক্ষণিকের জন্য প্রচণ্ড দ্বিধা ওকে তাড়িত করে। ও পুলিশী সাহস নিয়ে সামনের প্রাঙ্গণের দিকে তাকাতে পারে না। যদি ঐ ছায়াটি আর একবার কেঁপে ওঠে?
মালেকার ক্রোধ হয়। ও ছুটে বেড়ায় সারা গাঁ। বাকলজোড়া গ্রাম ওর জন্মভূমি। প্রিয় আবাস। ও এখান থেকে কোথাও যাবে না। শুধু প্রচণ্ড তীব্রতায় অনুভব করে যদি আর একবার বেঁচে উঠতে পারতো?
ঐ ইজ্জতের পাছায় লাত্থি মারার জন্য ও আর একবার বাকলজোড়া গ্রামে ফিরে আসতে চায়।