লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে গ্রেফতার হলেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। তাঁকে আবগারি দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার করেছে দেশের ইনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট। তিনি দেশের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী, যিনি পদে থাকাকালীন গ্রেফতার হয়েছেন। তাঁর আগে বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদব পশু খাদ্য কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন, কিন্তু তার একদিন আগে তিনি নিজে পদত্যাগ করে স্ত্রী রাবড়ি দেবীকে মুখ্যমন্ত্রী করেছিলেন। কিছুদিন আগে ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনকেও কেন্দ্রীয় এজেন্সি গ্রেপ্তার করে। কিন্তু তার আগেই তিনি রাজ্যপালের হাতে পদত্যাগপত্র জমা দেন। কিন্তু দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী গ্রেফতার হওয়ার পরেও তার দল আপ জানিয়েছে যে অরবিন্দ কেজরিওয়াল দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। কেজরিওয়াল গ্রেফতার হওয়ায় প্রায় সব-অ-বিজেপি দলই প্রতিবাদ জানিয়েছে। তাদের প্রত্যেকেরই বক্তব্য লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে একজন বিজেপি বিরোধী মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার আসলে বিজেপি তথা মোদী সরকারের রাজনৈতিক চক্রান্ত। তারা লোকসভা ভোটের লড়াইতে বিরোধীদের চাপে রাখতেই ইডি ও সিবিআই দিয়ে বিরোধীদের ঘায়েল করতে চাইছে।
লোকসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হবে ১৯শে এপ্রিল থেকে ১ জুন পর্যন্ত। এই নির্বাচনে তৃতীয়বার সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে জিতে ফের ক্ষমতায় ফিরে আসতে মোদী সরকার মরিয়া হয়ে উঠেছে। শুরু থেকেই তারা বিরোধী শিবিরকে সবদিক থেকে পর্যুদস্ত করতে নানা ধরণের আক্রমণ চালাচ্ছে। যে কারণে নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী এবং মোদীর অন্যতম কট্টর সমালোচক অরবিন্দ কেজরিওয়ালের গ্রেফতারের ঘটনাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই মনে হচ্ছে। আবগারি মামলায় ইডি কেজরিওয়ালকে ন’বার সমন পাঠিয়েছিল। আটবারই তিনি হাজিরা এড়িয়ে গিয়েছিলেন। শেষবার ইডি-র পাঠানো সমনে তাঁর ইডি দফতরে হাজিরা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রত্যেকবারের মতো দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেন। ইডি দফতরে হাজিরা না দিয়ে তিনি নিরাপত্তা চেয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন। যদিও হাইকোর্ট কোনও সুরক্ষা তাঁকে দিতে পারেনি। সবশেষে তিনি সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা ইডি-র এ ধরণের সক্রিয়তাকে মোদী সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ বলেই মনে করছেন। কারণ, দেখা যাচ্ছে যেসব রাজ্যে মোদী সরকারের প্রভাব কম সেই সব রাজ্যেই ইডি ও সিবিআই সক্রিয়তা বেশি। কিছুদিন আগেই ইডি দুর্নীতির অভিযোগে হেমন্ত সোরেনকে গ্রেফতার করেছিল। তার আগেই অবশ্য ঝাড়খণ্ড রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। হেমন্ত সোরেনের দল ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চাও বিজেপি বিরোধী দল এবং বিরোধী জোটের অংশ। তারাও আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইতে সামিল। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, কেজরিওয়ালের গ্রেফতারের ঘটনাটিও মোদী এবং বিজেপির জন্য রাজনৈতিকভাবে ঘুরপথেচলে যেতে পারে। কেননা, এইভাবে সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু করা নেতা মন্ত্রীদের প্রতি জনগণের সহানুভূতি তৈরি হয়ে যায়। এমনকি এ ধরণের ঘটনায় ঐক্যবদ্ধ নয় এমন অবস্থা থেকেও বিরোধীরা বৃহত্তর কারণে ঐক্য গঠনও করতে পারে। দেখা যাচ্ছে কেজরিয়ালের গ্রেফতারের ঘটনায় যারা প্রতিবাদ জানিয়েছে তাদের মধ্যে ইন্ডিয়া জোটে নেই অথবা সরে গিয়েছে এমন অনেকেও নিন্দা জানিয়েছে। তাই এমন সম্ভবনাকে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা একেবারে উড়িয়ে না দিয়ে বলছেন, কেজরিওয়ালের গ্রেফতার নিয়ে ভারতের বিরোধীরা ফের ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। কারণ, কেজরিওয়ালকে গ্রেফতারের ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাপক না হলেও একটা আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। কেননা একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর গ্রেফতার দেশের গণতন্ত্রের জন্য যতটা শোচনীয় পরিস্থিতি, তেমনি একজন মুখ্যমন্ত্রীকে জনসম্মুখে হয়রান ও নির্যাতন করাটাও স্বৈরাচার।
কিন্তু প্রশ্ন, কেজরিওয়ালের গ্রেফতার নিয়ে যে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি বিক্ষোভের বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন তারা কি আসন্ন নির্বাচনে মোদীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জোরদার লড়াইতে সামিল হবেন? কোনো রাজ্যেই বিরোধীরা এখনো জোটবদ্ধ হতে পারেনি। বরং জোটের বদলে আসন রফা হয়েছে। যেখানে জোট হওয়াটা সবদিক থেকে নিশ্চিত সেখানেও আলাপ আলোচনা চলছে, বিতর্ক থেকে তিক্ততা তৈরি হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কেজরিওয়াল গ্রেফতার হওয়ায় বিরোধীদের স্বর অজান্তেই যেন এককাট্টা হয়ে মোদী সরকারের চক্রান্তের বিরুদ্ধে বিক্ষভে পরিনত হয়েছে। আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি কেজরিওয়াল গ্রেফতার হওয়ার পরেই রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, অখিলেশ যাদব, উদ্ধব ঠাকরে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন তেমনি বাম নেতৃত্বও মোদী সরকারের তীব্র সমালোচনায় মুখর। বিজেপি সরকারও যে কিছুটা চাপে সেকথা বলাই যায় কিন্তু প্রবল চাপের জন্য বিরোধীরাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়াটা জরুরি, লাগাতার চাপ সৃষ্টি করে যাওয়াটাও প্রয়োজন। কিন্তু তা কি হবে? তবেই না কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে প্রবল ভাবে অভিঘাত সৃষ্টি হবে। বিজেপির দাবি ইডি স্বশাসিত সংস্থা কিন্তু এমনটা ভেবে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। বিজেপির ইশারা ছাড়া কেজরিওয়ালের গ্রেফতার সম্ভব নয়। কিন্তু তার থেকেও বড় প্রশ্ন আজ বিরোধীরা যেভাবে প্রতিবাদে গর্জে উঠছে সেই ফ্যাক্টর একাধিক রাজ্যে বিজেপির কাছে বিপদ হয়ে উঠবে কি না?