বিল পাশের চার বছর পর (২০১৯ সালের ডিসেম্বর) লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে দেশজুড়ে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা সিএএ কার্যকর হল। ১৯৪৮ সালে স্বাধীন দেশের ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে বসবাসকারী সমস্ত জনসাধারণকে ভারতের নাগরিক হিসাবে গণ্য করা হয়। ১৯৫৫ সালে প্রথম নাগরিকত্ব আইন রচিত হয়। এরপর পাঁচ বার নাগরিকত্ব আইন সংশোধন হয়েছে। প্রথমবার জন্মসূত্রে, উত্তরাধিকার সূত্রে এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভারতীয় নাগরিকত্বের কথা বলা হয়। এরপর ১৯৮৬ সালের সংশোধনী অনুযায়ী ১৯৮৭-এর জুলাই থেকে ২০০৪-এর নভেম্বর পর্যন্ত যারা জন্মেছেন তাদের বাবা কিংবা মা ভারতীয় নাগরিক হলেই তাঁরা জন্মেসূত্রে ভারতীয় নাগরিক। এরপর ২০০৩ সালের সংশোধনীতে বলা হল ২০০৪-এর ডিসেম্বরের পরে যারা জন্মেছেন তাঁদের বাবা-মা ভারতীয় নাগরিক হলেই তাঁরা ভারতীয়। উত্তরাধিকার সূত্রে নাগরিক মানে যারা ১৯৫০-এর জানুয়ারি থেকে ১৯৯২-এর নভেম্বর পর্যন্ত যারা অন্য দেশে জন্মেছেন তাদের বাবাকে ভারতীয় নাগরিক হতে হবে এবং যারা ডিসেম্বর ১৯৯২-এর পরে জন্মেছেন তাদের বাবা-মার মধ্যে একজনকে ভারতীয় নাগরিক হতে হবে। আর যিনি ১১ বছর এবং একটানা শেষ ১২ মাস ভারতে বসবাস করছেন তিনি ভারতীয় নাগরিকত্ব পেতে পারেন। উল্লেখ্য, ২০০৩-এর সংশোধনীতে বলা হয় অবৈধ্য অভিবাসী (Illegal Migrant)-দের সন্তানরা ভারতে জন্মালেও ভারতের নাগরিকত্ব পাবে না।
এবার দেখা যাক গত ১১ মার্চ ২০২৪; কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক নাগরিকত্ব আইন সংশোধনীতে কি বলছে। সংশোধিত এই আইনে তাদের নাগরিকত্ব দেয়ার কথা বলা হয়েছে যারা ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে ভারতে এসেছেন। আর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নাগরিকত্ব পেতে হলে আবেদকারীকে ভারতে টানা ১২ মাস এবং শেষ ৫ বছর বসবাস করতে হবে। গোটা দেশে এই আইন লাগু হলেও উত্তরপূর্ব ভারত অর্থাৎ অরুণাচল, নাগাল্যাণ্ড, মিজোরামের ইনারলাইন পারমিট এলাকা এবং আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরায় ষষ্ট তফসিলে গঠিত জেলা পরিষদ ও স্বশাসিত এলাকায় এই আইন কার্যকর হবে না। সংশোধিত আইনে দেখা যাচ্ছে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ থেকে হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, পার্সি এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নাগরিকত্বের কথা বলা হলেও মুসলমান সম্প্রদায়ের উল্লেখ নেই। তার মানে কি মুসলমানরা এই আইনে নাগরিকত্ব পাওয়ার উপযোগী নয়? দ্বিতীয়ত, ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনে বলা হয়েছিল, নাগরিকত্ব পেতে টানা এক বছর ভারতে থাকতে হবে। এ ছাড়াও বিগত ১৪ বছরের মধ্যে ১১ বছর ভারতে থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু সংশোধিত আইনে সেই ১১ বছরের সময় কমিয়ে পাঁচ বছর করা হয়েছে। অথচ সংবিধানের ১৪ নং ধারায় সকলের সমতার অধিকার এবং ১৫ নং ধারায় ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ ইত্যাদির কারণে কোনও নাগরিকের প্রতি বৈষম্য না করার কথাই বলা হয়েছে। তাহলে সংশোধিত এই নাগরিকত্ব আইনটি কি বৈষম্যমূলক বলে ধরে নেব। সংশোধিত আইনে নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমারের মতো দেশগুলি থেকে আসা শরণার্থীদের উল্লেখ নেই।
সংসদের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করার অধিকার সংবিধানের ১১ নং ধারাতে বলা আছে ঠিকই কিন্তু সেই আইন কি সংবিধানের সারমর্মকে লঙ্ঘন করতে পারে? কেশবানন্দ ভারতী মামলা (১৯৭৩) এবং এসআর বোম্বাই বনাম ভারত সরকারের মামলা (১৯৯৪)-য় দেশের সর্বোচ্চ আদালত জানিয়েছিল, সংবিধানের কিছু বৈশিষ্ট্য যা সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে পরিবর্তন করা যায় না। কারণ, সেগুলি দেশের গণতান্ত্রিক ও প্রজাতান্ত্রিক চরিত্র এবং ধর্ম নিরপেক্ষ ও যুক্তরাষ্ট্রীয় বৈশিষ্ট্য। অন্যদিকে সংশোধধিত আইনে পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান থেকে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আসার কথা বলা হলেও সরাসরি নাগরিকত্ব দেওয়া হবে তা কিন্তু বলা হয়নি। বলা হয়েছে তাদের ওপর থেকে অবৈধ্য অনুপ্রবেশকারীর তকমা তুলে নেওয়া হবে। তাছাড়া কে কবে এসেছেন তার প্রমাণ হবে কিভাবে আর ধর্মীয় নিপীড়নের যে কথা বলা হচ্ছে সেটাই বা কে কিভাবে দেখাবে? এর পরের সমস্যা, বলা হয়েছে নাগরিকত্ব পেতে চাইলে ৫ বছর টানা এদেশে বাস করতে হবে। তবে কি এই ৫ বছর তারা রাষ্ট্রহীন হয়ে থাকবে? নাকি সন্দেহভাজন নাগরিক বা ডি ভোটার হবেন? পূর্ব্ববঙ্গ থেকে অনেকেই ১৯৪৭ এবং ১৯৭১ সালে এসে রয়েছে, তাদের ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, রেশন কার্ড সবই আছে, অনেকে এখানে পড়াশুনা করে, সরকারি চাকরি করছে। তারা কি দিয়ে ধর্মীয় নির্যাতনের কারণ প্রমাণ করবে? কোথায় পাবে বাপ ঠাকুরদার জন্মনথি কিংবা পুরানো জমি বাড়ির দলিল। তাহলে কি এই বিশাল সংখ্যায় বাঙালি উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব জলাঞ্জলি যাবে?
প্রথম সিএএ নিয়ে আপত্তি উঠেছিল উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে। কারণ, আশঙ্কা ছিল, সিএএ চালু হলে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে শরণার্থীদের ভিড় বাড়বে। তাতে ভাষাগত এবং সংস্কৃতিগত সমস্যা তৈরি হতে পারে। ভাষা এবং সংস্কৃতি রক্ষার কারণে অনেকে বিরোধী আন্দোলনে নেমেছিলেন। আইনে মুসলিমদের বাদ দেওয়া নিয়েও অনেকে প্রতিবাদ করেন। একই সঙ্গে সিএএ-র ৬এ ধারায় বলা হয়েছিল, ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারির পর এবং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে যাঁরা অসমে এসেছেন এবং থেকে গিয়েছেন তাঁদের সকলকেই নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। অসমের আদি বাসিন্দারা এতে আপত্তি তোলে। দেশ জুড়ে বিক্ষোভ আন্দোলনে ৮৩ জনের মৃত্যু হয়। দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, অসমে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে। যদিও মোদী সরকার সব প্রশ্ন উড়িয়ে দিয়ে দাবি করছে, এই আইন ভারতের কোনও নাগরিকের উপর প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু তা কি সত্যি?