বলা হয় ক্রীড়া মানুষের ক্ষেত্রে চিরন্তন। যুগ যুগ ধরে খেলাধুলোর অভ্যেস মানুষ এর মধ্যে রয়ে এসেছে। সেই প্রাচীন গ্রিস থেকে আজ অব্দি। খেলা মানুষ এর শক্তি, মানসিক বল এবং পারদর্শিতা দেখানোর এক উত্তম মঞ্চ। এ রসে মানুষ এখনো অব্দি বঞ্চিত হতে পারেনি। মনে হয়না ভবিষ্যতেও কোনোদিন পারবে। কিন্তু ডারউইন এর বিবর্তন এর মতবাদ মেনেই খেলার মধ্যেও বিবর্তন এসেছে। যেমন যেমন মানুষ এর পছন্দ পাল্টেছে এক ই সঙ্গে পাল্টেছে খেলার ধরণ ও। বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি আর সমাজ, ক্রীড়ার চার স্তম্ভ বলা হয়। পৃথিবী বা দেশ এর যে আর্থসামাজিক অবস্থা তখনকার মতো উপস্থিত, সেটাই নির্ধারণ করে সেই সময় খেলার মধ্যে নিয়মগত ও রণকৌশল গত কি কি পরিবর্তন আসবে। ইহাই পরম সত্য।
রণকৌশল এর কথা উঠলো যখন তখন ভূমিকা থাক। আজকের পৃথিবী প্রযুক্তির পৃথিবী। ক্রীড়া অর্থনীতি র দুনিয়া কে ওলটপালট করে দিয়েছে ‘টিভি রাইটস’ এর মিলিয়ন ডলার ডিল এ যা বিক্রি করার জন্য পরিচিত ক্রীড়া দুনিয়াতে এখন কড়া টক্কর, চলছে এক ঠান্ডা যুদ্ধ। কখনো ক্রিকেট এ ঝড় আনছে ফ্র্যাঞ্চাইজি লীগ তো কখনো ফুটবলের চায়ের কাপে তুফান তুলছে সুপার লীগ। সবকিছুর মধ্যে তাই এই কথাটা মানতে কোনো দ্বিধা নেই যে প্রতিযোগিতার মান এখন ভীষণ ভাবে ঊর্ধমুখী। যেকোনো ভাবেই সবাই সামনে এগিয়ে যেতে চাই আর এই খেলা পাল্টে দেয়ার মূল তুরুপের তাস একটাই, প্রযুক্তি আর প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগ।
প্রযুক্তি ভারতীয় দর্শক দের সাধের একটি খেলা ক্রিকেট-এ কি বদল আনলো? কিভাবে এলো সবুজ ঘাসের গালিচায় রোমাঞ্চকর স্বপ্ন দেখানো ব্যাট-বলের লড়াইতে প্রযুক্তির বাস্তববাদী আলোড়ন? কেই বা আনলো? দেখে নেয়া যাক।
ডেটাএ্যানালিসিস বা তথ্য বিশ্লেষণ। আই টি সেক্টর-এর যুগে অত্যন্ত পরিচিত নাম। কিন্তু ক্রীড়াক্ষেত্রে এর প্রয়োগ অত্যন্ত সুনিপুণ ভাবে করা গেলে অত্যন্ত প্রভাব রাখার ক্ষমতা রাখে। আজকের দিনে যা অত্যন্ত সাধারণ ব্যাপার তা আজ থেকে কুড়ি পঁচিশ বছর আগে স্বপ্নের এক কোনায় অবস্থান করতো।
এখন এ্যালগোরিদম মুহূর্তের মধ্যে বলে দিতে পারে কোন ব্যাটার আর বোলার এর কোনটা শক্তি আর কোনটা দুর্বলতা। কারা কারা দ্রুতগতির বোলিং খেলতে পারে আর কারা পারেনা। মাউস এর একটা ক্লিক বলে দিতে পারে একটা মাঠ এর দৈর্ঘ্য প্রস্থ ব্যাস অনুযায়ী জেতার মতো স্কোর কি হতে পারে। আর এই সমস্ত তথ্য বিশ্লেষণ করার জন্য এখন প্রতিটা টিম এর থাকে একজন তথ্য বিশ্লেষক বা ডেটা এনালিস্ট।
ক্রিকেট এ ডেটা এনালিস্ট দের নিয়ে কথা বললে যার কথা না বললেই নয়, তিনি হলেন নাথান লিমন। কেমব্রিজ এর একজন ম্যাথস গ্র্যাজুয়েট। ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে। অথচ তিনি হয়ে উঠলেন ‘কিং মেকার’। ইংল্যান্ড এর কোচ অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, যিনি নিজে ডেটা আর স্ট্যাট এর বড় ভক্ত, তিনি নিয়ে আসেন লিমন-কে টিমে এবং তার পর থেকে ইংল্যান্ড-এর টেস্টে সফলতার পিছনে একটা বড় ভূমিকা নেন এই লিমন। ২০১১-এ ভারত যখন ইংল্যান্ড সফর করতে যায় তখন সচিন তেন্ডুলকার-এর বিরুদ্ধে দুরন্ত এক রণকৌশল বানিয়ে তাকে রান করা থেকে বিরত করেছিলেন এই লিমন। লিমন তার অ্যালগোরিদম চালিয়ে দেখেন যে সম্প্রতি সচিন তার বেশিরভাগ রান করছেন অনসাইডে। তার প্ররোচনায় পরিকল্পনা হয় সচিন-কে অফস্টাম্পে টেনে আনার। সেই সিরিজে সচিন ধারাবাহিক ভাবে ব্যর্থ হন, ভারত সিরিজ হরে ৪-০ ব্যবধানে। টিম-এর অধিনায়ক এন্ড্রু স্ট্রস অবসর-এর পর যখন টিম ডাইরেক্টর হন তখন লিমন কে দেন এক গুরুদায়িত্ব। লিমন বার করেন কিভাবে আগের বিশ্বকাপ জয়ীরা বিশ্বকাপ জিতেছিল। কি কি পদ্ধতি তারা অবলম্বন করেছিল জয়-এর জন্য। তারপর ইয়ং মর্গ্যান-এর হাত ধরে ইংল্যান্ড টিম-এর হেড ডেটা অ্যানালিস্ট হয়া এবং তারপর একসাথে বিশ্বকাপ জয়। মর্গ্যান চলে গেলেও লিমন রয়ে গেলেন ইসিবি-র স্ট্র্যাটেজি হেড হিসেবে এবং ইংল্যান্ড-এর ২০২২ টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয় এও ওনার ভূমিকা অনস্বীকার্য।
নাথান লিমন
শুধু বিদেশী নয়, ঘরের কাছেও এরকম একজন ব্যক্তি ছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত তিনি ভারতীয় দলের সাথে কোনো কাজ করেননি। লিমন এর ও আগে দক্ষিণ আফ্রিকা দলের ভিডিও অ্যানালিস্ট ছিলেন তামিল যুবক প্রসন্ন আগোরাম। এগারো বছর ধরে দক্ষিণ আফ্রিকা টিম-এর সাথে থেকে উনি কাজ করেছেন এবং তৈরী করেছেন বিভিন্ন রণকৌশল যা এনে দিয়েছে সাফল্য। কেমন? জানবো।
দু হাজার দশে ভারত যখন দক্ষিণ আফ্রিকা সফর করছে, তখন বীরেন্দ্র সেহওয়াগ নিজের সেরা ফর্মে। দুনিয়ার তাবড় বোলারকে বিধ্বংসী মেজাজে রীতিমতো উড়িয়ে দিয়ে হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে উনি এসে পৌঁছেছেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। ডেল স্টেইন-এর মতো বোলার, যে কিনা তখন বিশ্বব্যাপী ব্যাটার দের ত্রাস, তিনি অব্দি বেশ চিন্তিত কিভাবে সেহওয়াগ কে কম রান এর মধ্যে আটকে রাখা যায়, এটা ভেবে।
এমন সময় প্রসন্ন তার কাছে নিয়ে আসেন এক সমাধান। সেহওয়াগ এর স্বভাব ছিল, আউটসাইড অফস্টাম্প-এর বলে সজোরে কাট বা স্ল্যাশ করা, এই বলে অনেক সময়, বল-এর টাইমিং ঠিক না হলে, বল কানায় লেগে থার্ড ম্যান এর দিকে উড়ে যেত। যেহেতু টেস্ট ম্যাচ এ প্রথম দিকের ওভারে থার্ড ম্যান ডিপ রাখা অত্যন্ত রক্ষণাত্মক অধিনায়কত্ব মানা হতো, তাই ঐ জায়গাটা খালিই থাকতো। প্রসন্ন স্টেইন-কে বলেন ওখানে একজন ফিল্ডার রাখতে। আক্রমণাত্মক স্টেইন এই ধরনের ফিল্ড রেখে বোলিং করতে শুরুতে রাজি ছিলেন না, কিন্তু প্রসন্নর বারংবার অনুরোধে তিনি নিমরাজি হন। এবং আশ্চর্যজনক ভাবে প্রথম ওভারেই সেহওয়াগ ওই শটটা খেলেন আর অব্যার্থ ভাবে ডিপ থার্ড ম্যানে ক্যাচ দিয়ে আউট হন। প্রসন্ন সেদিন দেখিয়ে দিয়েছিলেন হাজার হাজার বল-এর তথ্য এবং ভিডিও অ্যানালিসিস এর ক্ষমতা কিভাবে ম্যাচ-এর মোড় পাল্টে দিতে পারে।
প্রসন্ন আগোরাম
এমন উদাহরণ আরো আছে। গৌরব সুন্দরারমন, ইএসপিএনক্রিকইনফো র প্রাক্তন এডিটর এবং বর্তমানে সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদে কর্মরত তথ্যপ্রযুক্তি কর্মচারী। এক সময় ক্যারাবিয়ান প্রিমিয়ার লীগ-এর ডেটা কনসালটেন্ট ছিলেন, টিমদের নিজের ইনপুট দিয়ে সাহায্য করতেন। এই সময় তিনি নজরে পারেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ-এর প্রবাদ প্রতিম ওপেনার ডেসমন্ড হেইন্স-এর। হেইন্স তখন ছিলেন বার্বাডোস ট্রাইডেন্টস এর কোচ। তথ্য প্রযুক্তির ওপর বিশেষ বিশ্বাস রাখা হেইন্স গৌরব এর মাধ্যমে জানতে পারেন সেন্ট কিটস-এর বাউন্ডারি এক দিকে ছোটো হওয়ার জন্য এবং হাওয়া একদিক থেকে বওয়ার জন্য সব ছয় একদিকেই হয় এবং তাই স্পিনার কে একটা দিকেই বোলিং করালে তার ক্ষেত্রে রান আটকানো সুবিধে হবে। এই তথ্য ব্যাবহার করে ট্রাইডেন্টস সেবারে ফাইনাল খেলে।
এখানেই শেষ নয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজ কোচ ফিল সিমন্স-এর এবারে নজরে পরে গৌরব-এর ওপর। তিনি গৌরব কে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল-এর সাথে যুক্ত করেন। গৌরব ২০১৬ টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল-এর এনালিস্ট হিসেবে যুক্ত হয় এবং বিভিন্ন দলের শক্তি-দুর্বলতা খুঁজে বার করে। কোন ব্যাটার এর বিরুদ্ধে কোন বোলার সবথেকে কার্যকরী কিংবা একটা কোনো মাঠে শিশির এবং পিচ অনুযায়ী পার স্কোর কি হতে পারে, এরকম গুরুত্বপূর্ণ তথ্য খুঁজে বার করায় সে বড় ভূমিকা নেয়।
এর সর্ব বৃহৎ উদাহরণ দেখা যায় ভারতের সাথে সেমিফাইনাল-এ। যখন ভারত ওয়াংখেড়ে-র ব্যাটিং পিচ-এ শিশির-এর কথা না মনে রেখে ১৯০ কে জেতার মতো স্কোর ভাবে। ওই ম্যাচ-এ বিরাট কোহলি এবং এমএস ধোনি বাউন্ডারি কম মেরে দু রান বেশি নেন, কিন্তু পরের ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ঠিক তার উল্টোটা (ডট বল বেশি খেলে কিন্তু বেশি বাউন্ডারি মেরে ) ম্যাচ জিতে নেয় এবং পরের ম্যাচ ফাইনাল-এ ইংল্যান্ড-কে হারিয়ে হয় দ্বিতীয় বারের মতো টি টোয়েন্টি বিশ্বজয়ী।
গৌরব সুন্দরারমন
তথ্য বিশ্লেষণ ঠিক কি করে? আমাদের খালি চোখে আমরা একটা খেলার অনেক কিছুই নজর করতে পারিনা বা মস্তিষ্কের কোনো গহন কোণে স্মৃতি হিসেবে জমিয়ে রাখতে পারি না। যেটা একটা কম্পিউটার পারে। তাই ক্যামেরা আর ডেটা রেকর্ডিং টেকনোলজি র সাহায্যে কম্পিউটার নিজের মেমারি তে তুলে রাখে অনেক তথ্য, এবং সেই তথ্য দিয়ে বানানো এলগোরিদম ভবিষ্যতে বিভিন্ন সিদ্ধান্ততে উপনীত হওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করে।
উদাহরণ, ক্যাপ্টেন একটা ব্যাটার-এর ক্ষেত্রে লক্ষ করেছেন, একে রান না দিলে, এ একটা সময় অধৈর্য্য হয়ে স্টেপ আউট করবেই, তখন একে আউট করা যেতে পারে। ডেটা ঠিক এই জিনিসটাকেই অভ্রান্ত ভাবে তুলে আনবে। এর সাথে এটাও বলে দেবে এভারেজ কটা বলের ব্যবধানে বা কত ঘনঘন সেই ব্যাটার এই কাজটা করে।
কোনো বোলার এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যাটার এর স্ট্রাইক রেট বা এ্যাভারেজ ভালো। কোন ব্যাটার পুল শট ভালো মারেন না। কোন ব্যাটার বাঁ হাতি হওয়া সত্ত্বেও ভালো অফ স্পিন খেলেন। সবই নখদর্পনে আছে অ্যানালিস্ট-এর এ্যালগোরিদম-এর।
কিছু ক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন ভীষণ ভাবে তথ্য নির্ভর হয়ে পড়লে সেটা ভালোর জায়গায় খারাপ হয়ে দাঁড়ায়, তখন ক্যাপ্টেন্সির মতো একটা বুদ্ধিদ্বীপ্ত ব্যাপার হয়ে ওঠে অত্যন্ত যান্ত্রিক এবং বিপক্ষ সেই সুযোগ ছাড়েনা, তাই তথ্যের ব্যবহার করার সময় ক্যাপ্টেন কে হতে হবে সাবধান, যেমন এক পাকা রাঁধুনি ঠিক করে রান্নায় ঠিক কতটা চিনি বা নুন দিতে হবে।
ক্রিকেট ইতিহাস নির্ভর খেলা। একশো বছর-এর ওপর সময় ধরে চলে আসা এবং মান্য করা স্ট্র্যাটেজির দেয়ালকে হঠাৎ একধাক্কায় গুঁড়িয়ে দেওয়া যায়না। তার জন্য লাগে সাহস এবং সেই ঝুঁকিপূর্ণ বদলকে ভিত্তি দেওয়ার জন্য সাফল্য। জন বুকানন এই দুটোই এনেছিলেন একসাথে। হ্যাঁ সেই জন বুকানন যার অস্ট্রেলীয় টিম নব্বই দশক এবং তার পর দুহাজার এর প্রথম দশকে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল। বুকানন প্রথম ডেটা অ্যানালিসিস আনেন ১৯৯৫-এ। যখন তিনি প্রথম কুইন্সল্যান্ড-এর কোচ হলেন এবং তাদের বিরানব্বই বছর পর শেফিল্ড শিল্ড জিততে সাহায্য করলেন। প্রবাদপ্রতিম অ্যালেন বর্ডার ও তার অধীনে এই সিজনে খেলার সুযোগ পান। ভবিষ্যতে বুকানন বহু কোচ কে ডেটা এ্যানালিসিস কে মূলস্রোতে নিয়মিত ভাবে ব্যবহার করা শিখিয়েছেন। শুরুটা তাই তার হাত ধরে।
জন বুকানন
শুরু টা আমরা জানি, কিন্তু শেষ এর আপাতত বহু দেরি। আপাতত ডেটা এ্যানালিসিস তার মধ্য গগনে আর এ. আই বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর আগমনে এর যাত্রা আগামী দিনে হতে চলেছে আরো ঊর্ধমুখী। কে জানে হয়তো আগামী দিনে এ প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যাবহার ক্রিকেট কে আবার নতুন ভাবে তুলে ধরবে বিশ্বের সামনে এবং দর্শক দের সামনে থাকবে নতুন ভাবে ক্রিকেট রোমাঞ্চ উপভোগ করার এক চমকপ্রদ সুযোগ।
ভাল লাগল।