প্রেম এই শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে একবিস্ময়কর মহিমা। নর-নারী, শিশু, বৃদ্ধ থেকে শুরু করে পশুপাখিরা এমন কি গাছপালা ও নরম ফুলগুলিও প্রতিক্ষণে প্রকৃত ভালবাসা চায়। সাধারণ নরনারীদের মতো স্বর্গের দেবদেবীরাও প্রেম চান। তাঁরা প্রেমে পড়তে চান শুধু নয় প্রেমাস্পদকে পাওয়ার জন্য আকুল হয়ে ওঠেন।
দক্ষযজ্ঞে পরম প্রেমিকা সতীকে হারিয়ে শিব প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তিনি আর বিয়ে করবেন না। কিন্তু সতী হিমালয়ের দুহিতা পার্বতী রূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং মনে মনে শিবকে বরণ করেছিলেন স্বামীরূপে। শিবকে পাওয়ার জন্য কঠোর তপস্যাও শুরু করেছিলেন পার্বতী। কিন্তু শিবের মন কি এত সহজে পাওয়া যায়!! শেষ পর্যন্ত কিভাবে শিবের হৃদয় হরণ করলেন হিমালয় কন্যা পার্বতী? তা নিয়ে এবার প্রচ্ছদ।
শিব বিরোধী দক্ষ একবার শিবহীন যজ্ঞের আয়োজন করলেন। সেখানে সতীর উপস্থিতিতে শিবের নিন্দা শুরু হলো।পতিদেবতার নিন্দা সহ্য করতে না পেরে যজ্ঞকুন্ডে আত্মহতি দিলেন সতী। দক্ষযজ্ঞ লন্ডভন্ড করে সতীর মৃতদেহ কাঁধে চাপিয়ে প্রলয় নাচনে মেতে উঠলেন স্বামী শিব। বিষ্ণুপ্রমাদ গুনলেন। এই বুঝি রসাতলে যায় বিশ্ব সংসার। দেবতাদের অনুরোধে সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দিলেন ভারতের নানান স্থানে। এরপর মহাদেব আবার গভীর ধ্যানে মগ্ন হয়ে গেলেন।
এদিকে শিবশক্তি নির্লিপ্ত অবস্থায় স্বর্গে মর্ত্যে তারক নামের অসুর প্রবল অত্যাচার শুরু করলেন। ইন্দ্র-অগ্নি-বরুণ কেউই তাকে পরাস্ত করতে পারলেন না। সকল দেবতারা ছুটে গেলেন ব্রহ্মার কাছে। ব্রহ্মা তখন বিষ্ণুর সঙ্গে শলাপরামর্শ করে বললেন, ‘এই মহা বিপদ থেকে একমাত্র রক্ষা করতে পারে শিবের ঔরসজাত কোন বীর সন্তান।’
কিন্তু সতীর আত্মাহুতির পর শিব প্রতিজ্ঞা করেছেন তিনি কোন নারীর পানিগ্রহণ করবেন না।
এই অবস্থায় পুত্র জন্মাবে কী ভাবে?
ব্রহ্মা ঈষৎ হেসে বললেন, ‘সতী দেহত্যাগের পর হিমালয় কন্যা পার্বতী রূপে জন্মগ্রহণ করেছেন। পূর্বসংস্কারবশত তিনি সর্বদা ‘শিব শিব’ করছেন। সকলে চেষ্টা করে গিরিরাজকে তার কন্যার সঙ্গে ত্রিলোচনের বিয়ে দিতে সম্মত করাও।’
ব্রহ্মার আদেশে নারদ গেলেন গিরিরাজ হিমালয়ের গৃহে এবং মহাদেবের হৃদয়ে প্রেম উৎপন্ন করতে কামদেব মদনকে পাঠালেন শিবের কাছে।ভগবান শিব প্রতিকূল হলে নিজের অমঙ্গল হবে জেনেও জগতের কল্যাণে ক্ষণমাত্র বিলম্ব না করে সহধর্মিনী রতিকে সঙ্গে নিয়ে মদন গেলেন মহাদেবের সমাধিভঙ্গ করতে।
অবশেষে এলো সেই শুভ মুহূর্ত। বসন্ত ঋতুর সমাগমে অরণ্যভূমি আজ মুখরিত। এমন সময় আমগাছের ডালে বসে পুষ্পধনু থেকে কামদেব নিক্ষেপ করলেন পঞ্চবান শিবের হৃদয়ে। সমাধিভঙ্গ শিব চারিদিকে তাকিয়ে অপূর্ব সুন্দরী তন্বী পার্বতীকে দেখে মোহিত হয়ে গেলেন। অনুভব করলেন প্রাণপ্রিয়া এই সুন্দরীর অপূর্ব চরণবিন্যাস যেন বুকে আঘাত করছে।
সংযমের দেবতা পরম যোগী শিব। তিনটি নয়ন দিয়ে ত্রিকাল দর্শন করেন তিনি। হঠাৎ জ্ঞাননেত্র দিয়ে পার্বতীর সুন্দর মুখমন্ডলের প্রতি তাঁর গভীর আকর্ষণের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দৃষ্টি পড়লো কামদেবের উপর। কামদেবের এহেন আস্পর্ধা দেখে শিব ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে গেলেন। মুহূর্তে তার তৃতীয় নয়ন থেকে বিদ্যুৎ বেগে আগুনের হলকা দিয়ে মদনকে পুড়ে ছাই করে দিলেন। স্বামীর এই দুর্দশা দেখে স্ত্রী রতি শিবের কাছে প্রার্থনা করলেন।ভোলানাথ প্রসন্ন হয়ে কামদেবকে অনঙ্গ করে দিলেন। মহাদেব পুনরায় ধ্যানমগ্ন হলেন।
দেবী পার্বতী মনের দুঃখে পুনরায় তপস্যায় বসলেন। হিমালয়ের এক মনোরম স্থানে দিনরাত বর্ষ ব্যাপী ‘ওম নমঃ শিবায়’ মন্ত্র জপ করতে থাকলেন। স্বর্গে দেবতারা পার্বতীর এই কঠিন তপস্যা দেখে চিন্তিত হলেন। অবশেষে নারদ করজোড়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে রুদ্রের স্তবস্তুতি শুরু করলেন। ‘হে পরমেশ্বর তুমি সাক্ষাৎ কল্যাণময় ঈশ্বর। তুমি সত্যস্বরূপ পবিত্রময় পরমপ্রেমিক আনন্দময়। হে রুদ্র তুমি জাগ্রত হও।’
ধ্যান ভাঙলে শিব নারদ কে জিজ্ঞাসা করলেন এই স্তবস্তুতি কারণ। তখন নারদ বললেন, ‘হে প্রভু আপনি অন্তর্যামী দয়ালু। গিরিরাজকন্যা পার্বতী আপনার তপস্যায় প্রাণত্যাগ করতে উদ্যত হয়েছেন।’
শিব নারদের কথায় সরাসরি উত্তর না দিয়ে বললেন, ‘দেবর্ষি আর যাতে কষ্ট না পায় তারই ব্যবস্থা করেছি, তুমি নিশ্চিন্তে যাও’। অবশেষে শিব পার্বতীকে বিবাহ করতে সম্মত হলেন।
হর-পার্বতীর বিবাহের দিন কিন্নর, গন্ধর্বরা গান ধরলেন, অপ্সরারা নৃত্য করলেন। বরযাত্রী হওয়ার জন্য দেবতা ও মুনি-ঋষিরা হাজির হলেন কৈলাসশিখরে। হাঁসে চড়ে ব্রহ্মা এলেন, গরুড় চড়ে বিষ্ণু। ইন্দ্র, বরুণ, অগ্নি, সূর্য, যম, চন্দ্রদেব কুবের — কেউ আসতে বাকি রইলেন না। তারপর সবাইকে নিয়ে ভেরি ও ডমরুর শব্দে মহাদেব রওনা দিলেন শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশে।
কিন্তু পরমেশ্বরকে ষাঁড়ের পিঠে চড়ে, সারা অঙ্গে ছাই ভস্ম মেখে, জটাধারী জামাইকে ভূতপ্রেতের সঙ্গে দেখে মেনকা মূর্ছিত হলেন। তিনি হিমালয়, পার্বতী ও নারদকে তিরস্কার করে বললেন কিছুতেই তিনি মেনকার সাথে শিবের বিয়ে দেবেন না। শাশুড়িকে শান্ত করতে নবরূপ ধারণ করলেন ভোলানাথ। শিবের এই নবরূপ দেখে সবাই মোহিত হলেন–এমনকী মেনকাও।
পবিত্র যজ্ঞাগ্নিকে সাক্ষী রেখে হর-গৌরীর বিবাহ সম্পন্ন হল। স্বর্গ থেকে পুষ্প বৃষ্টি ঝরতে লাগলো, ইন্দ্র বাঁশি বাজিয়ে, ব্রহ্মা হাততালি দিয়ে কমলা গান করে, বিষ্ণু ঘন ঘন মৃদঙ্গ বাজিয়ে বিবাহ বাসর জমাতে লাগলেন। সকলেই “হর হর ব্যোম ব্যোম” ধ্বনি তুলে মধুর বিবাহ উৎসবের পরিবেশকে মাতিয়ে তুললেন। বিচ্ছেদ-বিরহ-তপস্যা-দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে জন্মান্তরে ঘটল ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’।
শিবপুরাণ, পদ্মপুরাণ, স্কন্দপুরাণে, মহাকাব্যে, প্রাচীন সাহিত্যে শিবের গার্হস্থ্য জীবনের কথা বর্ণিত রয়েছে। প্রথমে জানতে হবে শিব পার্বতীর বিয়ে হয়েছিল ঠিক কোথায় এবং কবে?
যদিও বা এ নিয়ে বহু মুনির বহুমত। পুরান অনুসারে হর-গৌরীর বিবাহ হয়েছিল শিবরাত্রির পুণ্যলগ্নে। প্রতি কৃষ্ণপদের চৌদ্দতম রাত্রি হল শিব ও মাঘ মাসের কৃষ্ণপক্ষের চৌদ্দতম রাত্রি হল মহাশিবরাত্রি। এটি বছরের সবচেয়ে অন্ধকার রাত বলেই হয়তো এই রাতেই মহাদেব পানিগ্রহণ করেছিলেন পার্বতীর। মিলন হয়েছিল শিবশক্তি এই বিবাহ দিনটিকে স্মরণ করি ভারতবর্ষের বহু শিব মন্দিরে হরগৌরীর বিবাহের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। যেমন উত্তরাখণ্ডের ত্রিযুগ নারায়ণ মন্দিরে, বাবা বৈদ্যনাথ ধামে, বীরভূমের মহম্মদবাজার ব্লকের অন্তর্গত ছোট্ট গ্রাম রায়পুরের বুড়োনাথ শিবের মন্দিরে।
ত্রিযুগীনারায়ণ মন্দির : উত্তরাখণ্ডের রুদ্রপ্রয়াগ জেলার ছোট্ট একটি গ্রাম ত্রিযুগ নারায়ণ। স্থানটি বৌদ্ধধর্মের অন্যতম পিঠস্থান। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ছয় হাজার ফিট উচ্চতায় হিমালয়ের কোলে চিরসবুজ পাইনে ঢাকা মনোমুগ্ধকর পরিবেশে অবস্থিত এই গ্রাম। কথিত আছে সত্যযুগে
মহাদেব গৌরীকে বিবাহ করেছেন মন্দাকিনী এবং শোনগঙ্গার এই সঙ্গমস্থল থেকে ৫কিলোমিটার দূরে। কেদারনাথ মন্দির মত এই মন্দিরের দৃষ্টি নন্দর স্থাপত্যকে পর্যটকদের মনোমুগ্ধ করে। এখানে পবিত্র চারটি কুণ্ড রয়েছে রুদ্রকুন্ড, ব্রহ্মাকুন্ড, সরস্বতীকুণ্ড ও গৌরীকুণ্ড। গৌরীকুণ্ড কেদারনাথের বেসক্যাম্প ও এখানে দেবী পার্বতী কঠোর তপস্যা করে শিবকে জয় করেছিলেন ।
কিংবদন্তি অনুসারে সরস্বতীকুণ্ড বিষ্ণুর নাভি থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। তাই এই কুণ্ডের জল বন্ধ্যাত্ব নিরাময়কারী বলে মনে করা হয়।
ত্রিযুগীনারায়ণকে গিরিরাজ হিমালয়ের রাজধানী বলে মনে করা হয়। মন্দিরের প্রকোষ্ঠে চারকোণা অনির্বাণ যজ্ঞকুণ্ডে আগুন জ্বলছে শিব-পার্বতীর বিবাহের দিন থেকেই। হর-পার্বতীর বিবাহের দিন থেকে সত্য-ত্রেতা- দ্বাপর এই ‘ত্রি’যুগ পেরিয়ে কলিকালেও অনির্বাণ সেই হবনকুণ্ডের অগ্নি, তাই মন্দিরটি ‘অখণ্ড ধুনি মন্দির’ নামেও পরিচিত। মন্দিরের মূলউপাস্য দেবতা বিষ্ণু। হরগৌরীর বিবাহে বিষ্ণু পার্বতীর ভাই হিসেবে এবং ব্রহ্মা পুরোহিত হিসেবে ছিলেন।মন্দিরের সামনে ব্রহ্ম শিলা নামক একটি পাথর দ্বারা বিবাহের সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করা রয়েছে।
তীর্থযাত্রীরা যারা এই মন্দিরে যান তারা তাঁদের মনোবাঞ্ছা জানিয়ে এক টুকরো কাঠ পবিত্র হবনকুণ্ডের আগুনে অর্পণ করেন এবং সেই আগুনের ছাইকে তাদের সাথে নিয়ে যান। এটাও বিশ্বাস করা হয় যে এই আগুনের ছাই দাম্পত্য সুখকে উন্নীত করায়।
অনেকেই মনে করেন মন্দিরটি আদি শঙ্করাচার্যের দ্বারা নির্মিত। মন্দিরের ভিতরে বিষ্ণুর দু-ফুট উচ্চতার একটি রুপোর মূর্তি, সঙ্গে রয়েছে ধনের দেবী লক্ষী এবং দেবী সরস্বতীর একটি মূর্তি। বছরের তিন মাস বরফে ঢাকা থাকে এলাকাটি।
কভারের ছবি ত্রিযুগনারায়ণের শিব-পার্বতী
খুব ভালো লেখা।
থ্যাঙ্ক ইউ।
খুব ভালো লাগলো লেখাটা। কিন্ত
“ত্রিযুগীনারায়ণ বৌদ্ধধর্মের পীঠস্থান” – এই কথাটা ঠিক বুঝলাম না।
প্রথমেই ধন্যবাদ জানাই।
প্রথমেই ধন্যবাদ জানাই আপনাকে।
উত্তরাখণ্ডের ত্রিযুগীনারায়ণ মন্দির দর্শনের পর ভক্তরা বুদ্ধ মদমহেশ্বরের (Buddha Madmasheshwar temple) মন্দিরে মহাদেবের দর্শনে যান।শীতের মাসগুলিতে ভগবান শিব এই সময়ে বুদ্ধ মদমহেশ্বরে “বুদ্ধ” বা “বৃদ্ধ” রূপ ধারণ করেন। সম্ভবত ‘বুদ্ধ’ বা “বৃদ্ধ”শব্দটি অপভ্রংশ হয়ে বৌদ্ধদের তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে।