গিরিশচন্দ্র ঘোষ নাট্য জগতের এক বিরল ব্যক্তিত্ব। সংগীতেও তাঁর যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিলো, একথা কটা লোক জানে? আধুনিক বাংলা নাটক এবং নাটকের গান রচনা করে তিনি বাংলার রঙ্গালয়ের সংগীত জগৎকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে গিয়েছিলেন।
গিরিশচন্দ্র ঘোষ প্রথমে অবৈতনিক অভিনেতা রূপে সাধারণ রঙ্গমঞ্চে যোগদান করেছিলেন। তিনি উপলব্ধি করতেন সমাজের সাধারণ মানুষের চাহিদা। এই উপলব্ধিই তাঁকে নাট্যকার রূপে পরিচয় প্রদান করে। এরপর তিনি নাটক রচনা শুরু করলেন। নাট্যকার ও অভিনেতা হিসেবে গিরিশচন্দ্রের খ্যাতি সেইযুগে এতটাই ছড়িয়ে পড়ে, যে অনেকেই তাকে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত অভিনেতা গ্যারিকের সাথে তুলনা করতেন। তার অসাধারণ নাট্য প্রতিভা দেখে অক্ষয়চন্দ্র সরকার তাকে ‘বঙ্গের গ্যারিক’ উপাধি দেন।
রাজেশ্বর মিত্রের লেখা থেকে জানা যায় গিরিশচন্দ্র যখন কিশোর তখন তিনি ঈশ্বর গুপ্তর বিরাট প্রতিভা দেখে ‘হাফ আখড়াই’এর গান লিখতে প্রলুব্ধ হন। অনেক গানও তিনি রচনা করেছিলেন কিন্তু দুঃখের বিষয় সেগুলি রক্ষিত হয়নি। গান-বাজনা বড় ভালো বুঝতেন গিরিশ চন্দ্র, তিনি নিজে গানের সুর দিতেন না তবে কোন গানই তার অনুমোদন ছাড়া মঞ্চস্থ হতো না।
গিরিশচন্দ্রের বয়স যখন সতেরো বা আঠারো তখন মাইকেল মধুসূদন দত্তের শর্মিষ্ঠা নাটকের জন্য কতগুলি গানের প্রয়োজন হয়েছিল। তখনকার দিনে সংগীত রচয়িতা হিসেবে জনৈক প্রিয়নাথ মল্লিক বিখ্যাত ছিলেন। গিরিশচন্দ্র অনেক পীড়াপীড়ি করেও তাকে একখানা গানও লেখাতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেই রচনার ভার নিলেন। এই নাটকে তাঁর নৃত্য ও গীতের সংযোজনা পরিচিত নাটকটিকে অন্য এক রূপ এনে দিয়েছিলো।
‘বুদ্ধদেব চরিত’ নাটকের বিখ্যাত গান ‘জুড়াইতে চাই কোথায় জুড়াই’, একতালে গাওয়া গানটি সে যুগের তুলনায় বিশিষ্ট পর্যায়ের কাব্যসংগীত। এই গানটি কে স্বামী বিবেকানন্দ বিশেষ সম্মান প্রদান করে গিয়েছেন ব্রহ্মসঙ্গীত ধারায়,এই ধরনের গান সেই সময় রচিত করেছিলেন গিরিশ চন্দ্র। এই গানের গভীরতা পরমহংস রামকৃষ্ণদেবের হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল। প্রায় সময় ঠাকুর অনুরাগীদের এই গানটি গাওয়ার কথা বলতেন।
গিরিশচন্দ্রের বহু গানে একসময় ওস্তাদেরা গাইতেন যেমন ‘রাঙা জবা কে দিল তোর পায়ে’ (গানটির কথা ও সুর গিরিশচন্দ্র ঘোষ),
দিলীপ কুমার রায় বা মুঙ্গেরের সুরেন মজুমদার সারা বাংলায় বহুলভাবে প্রচারিত করে গিয়েছিলেন গিরিশ ঘোষের গান। লালচাঁদ বড়ালও গিরিশচন্দ্র ঘোষের একাধিক গান গাইতেন। দুঃখের বিষয় হচ্ছে গিরিশচন্দ্রের অল্প কয়েকটি গান ছাড়া আর সব গানের সুর আজ বিলুপ্ত।
গিরিশচন্দ্র ঘোষের নাট্যাভিনায় ও গানের ক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে শেক্সপিয়ারের আঙ্গিকের আধারে বাংলার যাত্রা স্বভাবতই নাট্যচেতনাকে মুক্তি দান করেছেন। তার নাটকগুলিতে তিনি ভাঙ্গা অমৃতাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেছেন তার নাটকে ছন্দের সংলাপ ও সংঘাত অন্যদিকে সংগীতের আবেগ এই দুইয়ের মিলিত রূপ সেদিনের বাঙালিকে মুগ্ধ করেছিলো। নতুন এই ছন্দের নাম দেন ‘গৈরিশ ছন্দ’।
‘ওমা কেমন করে পরের ঘরে, ছিলি উমা বল মা তাই।
কত লোকে কত বলে শুনে ভেবে মরে যাই।’
১৮৭৭ সালে ২০ শে সেপ্টেম্বর, ন্যাশনাল থিয়েটারে আগমনী নাটকের অভিনয় এক ভিক্ষুকের চরিত্রের মুখে এই গানটি গাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত শ্রোতারা স্তদ্ধ হয়ে শুনলো। সেদিন এই একটি সঙ্গীত বাঙালির দর্শকদের হৃদয় জয় করে নিলো।
গিরিশচন্দ্রের নাটকগুলির মধ্যে ভ্রান্তি নাটকটিকে গানের খনি বলা হয়। নাটকীয় ঘটনা যত অগ্রসর হয়েছে ততই গান মধুর থেকে মধুরতর হয়ে উঠেছে। ‘সাধ করে সে ডাকে আদরে তারে আদর করি’, ‘লাল বৃন্দাবন নিধুবন লালি’, ‘চমকি চমকি রহে বিজুরি’, ‘এত নয়ন জল ঢালি কই সরস হয় কলি’, ইত্যাদি মোট ১৩টি গান এই নাটকে সন্নিবেশিত হয়েছে। নাটকে ভাব প্রকাশের জন্য তিনি সংগীতের অবতারণা তো করেইছেন তত্ত্বকথাও এই সংগীতের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।
তার ‘বুদ্ধদেব চরিত’(১৮৯২) নাটকে দেব বালকদের গান ‘আমার এ সাধের বীণ’ এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।
‘বিল্বমঙ্গল ঠাকুর’ নাটকে গিরিশচন্দ্র যে গানগুলি রচনা করেছিলেন সেগুলি সংগীত জগতে স্থায়ী আসন লাভ করেছে, ‘ছাড়ো যদি দাগাবাজি কৃষ্ণ পেলেও পেতে পারি’, ‘আমি বৃন্দাবনে বনে বনে ধেনু চড়াবো’,’সাধে কিগো শ্মশানবাসিনী’ ইত্যাদি গান ভক্তি রস ও প্রেমরসে সমৃদ্ধ। নাটকের ভাব প্রকাশের জন্য তিনি সংগীতের রচনাতো করেই ছিলেন উপরন্তু তত্ব কথাও প্রকাশ পেয়েছে তাঁর গানের মাধ্যমে।
তবে তার পূর্ণচন্দ্র নাটকের সংগীতে নতুন নতুন ভাবের ইঙ্গিত রয়েছে। তার পৌরানিক নাটক ‘নসিরাম’ এর সংগীতে একদিকে যেমন অপূর্ব শ্যামা সংগীত অন্যদিকে তেমনি মধুর প্রণয় সংগীত। গিরিশ চন্দ্রের ‘বলিদান’ নাটক খানি সংগীত সম্পদের সমৃদ্ধ। এর প্রত্যেকটি গান নির্যাতিত বাঙালি বধুর মর্মস্থল নিগড়ে রসসিক্ত করা হয়েছে। এছাড়াও ‘হরগৌরী’ নাটকে অনেকগুলি আগমনী গান আছে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে শুধু একশ্রেণীর সঙ্গীতে নয় বিভিন্ন শ্রেণীর সঙ্গীতের সম্ভারে গিরিশচন্দ্র তার নাটকগুলি সজ্জিত করেছেন। নাটকের প্রয়োজনে গিরিশচন্দ্র গান রচনা করেন। গীতি বহুল যাত্রার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য সে যুগে নাটকে অনেক গান সন্নিবেশিত করতে হতো। নাটকের বিষয় অনুযায়ী প্রেম ভক্তি বীর রসাত্মক প্রভৃতি গান তো তাকে লিখতে হয়েছে উপরন্ত নাটকের প্রয়োজন নিয়ে তিনি তার পাঁচমিশালী রংতামাশার জন্য হাসি ও ব্যঙ্গাত্মক গানও রচনা করেছেন। এই গানগুলি স্বভাবতই চটুল তবে বেশ উপভোগ্য। গিরিশচন্দ্রের এমনকি নাটকের জন্য হিন্দি ও পূর্ব বঙ্গীয় ভাষায়ও গান লিখেছেন।
অমরেন্দ্রনাথ রায় লিখিত গিরিশ নাট্য সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য গ্রন্থ থেকে জানা যায় সর্বমোট ১৩৭০টি নাটকের গান রচনা করেছিলেন এই গানগুলি সবই নাটকের প্রয়োজনে রচিত হয়েছিল।
৬৮ বৎসরের জীবিত কালে ৪০ বছরের অধিককাল নিরন্তর গান লিখে গিয়েছেন। দু-চারজন ছাড়া এসব গানের স্বরলিপি রাখার দায়িত্ব গ্রহণ করেননি কেউই। অথচ গীতিকার গিরিশচন্দ্রকে নাট্যকার গিরিশচন্দ্র অপেক্ষা কোন অংশেই ছোট করা যায় না। গতকাল ৮ই ফেব্রুয়ারি ছিল এই মহান সংগীতস্রষ্টা, কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যপরিচালক ও নটের প্রয়াণ দিবস। বাংলা থিয়েটারের স্বর্ণযুগ মূলত তারই অবদান। সংগীত জগতে গিরিশচন্দ্রের অমূল্য অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায়, গানের ভুবনে।
তথ্যঋণ : সংগীত সাধনায় বিবেকানন্দ ও সংগীত কল্পতরু-দিলীপ মুখোপাধ্যায়, গিরিশ রচনাবলী (২য় খন্ড) এবং অন্যান্য।