ধনী পরিবারের উচ্চ শিক্ষিতা মেয়ে শান্তা। সে অন্তর্মুখী স্বভাবের। সামাজিক ক্রিয়াকর্মে সে সক্রিয় নয়। সে বই পড়তে ও তার পোষা কুকুর মন্টুর সাথে খেলা করতে ভালোবাসে।
এক সময় বাবা-মা শান্তার জন্য পাত্র দেখার সিদ্ধান্ত নেন। তারা একটা ভালো প্রস্তাব পেয়ে ছেলেটির বাবা-মা সাথে যোগাযোগ করে। তারা শান্তাকে দেখে তার শান্ত স্বভাব ও হাসিখুশি মুখটা দেখে তাদের ছেলে শচীনের বউ করতে শান্তাকে পছন্দ করে।
উভয় পক্ষ তাদের বিয়ের দিনতারিখ স্থির করে। যথা সময়ে শান্তা ও শচীনের বিয়ে সুসম্পন্ন হয়। বিয়ের পর শান্তা স্বামীর ঘরের সব কাজ করে। সে কখনই বিশ্রামের সময় পায় না কারণ তার শাশুড়ি একটি স্বনামধন্য স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা, তার শ্বশুর একটি সরকারি সেক্টরে চাকরি করেন। তিনি পিডবলু বিভাগের ইঞ্জিনিয়ার। অন্যদিকে,তার স্বামী শচীন একজন আইটি ইঞ্জিনিয়ার। সে অন্য শহরে কর্মরত। তার প্রকল্প শেষ হলে কোম্পানি তাকে অন্য শহরে স্থানান্তর করবে। আজ যদি সে কোচিতে কাজ করে, তারপরের মাসেই তার প্রজেক্ট শেষ হলে, হয়তো সে ত্রিবান্দ্রমে বদলি হয়ে যাবে। এইভাবে কোম্পানি তাকে ব্যবহার করে। শচীন সপ্তাহে একবার বাড়িতে আসে। সপ্তাহে একদিনই শান্তা স্বামী সাথে কাটানোর যা সময় পায়।
একদিন শান্তা তার মাকে ফোন করে জানায় সে কয়েকদিনের জন্য তাদের বাড়ি আসছে। সে তার ব্যাগ গুছিয়ে বাসে উঠে বসে।
শান্তার মা তার পছন্দের সব রকমের সুস্বাদু খাবার রান্না করে মেয়েকে খাওয়ান।
শান্তা শ্বশুর বাড়ি ফিরে যাওয়া সময় মা আচার, জ্যাম, মিষ্টি, আলুর চিপস প্যাক করে তার সাথে দেন। তিনি ফ্রিজে রাখার জন্য রান্না করা তরকারি ও মাছও দেন যাতে বাড়িতে পৌঁছে সেগুলি সে সবাই মিলে খেতে পারে।
দিন-মাস কেটে গেল, শান্তা একটা চাকরি খুঁজতে থাকে আর একদিন খুব কাছের শহরের একটা নামী কোম্পানি থেকে ফোন পায়।
কোম্পানিতে যোগদানের জন্য নিয়োগপত্র পাওয়ার পর সে তার শ্বশুরবাড়ির অনুমতি চায়। তার শাশুড়ি রাজি হন না। শাশুড়ি তাকে বলেন যে তার ছেলে চাকরি করছে সেটাই যথেষ্ট ।
“এই বাড়ির দেখভাল কে করবে শান্তা!” শুনে শান্তার মন খারাপ হয়ে যায়। শান্তার শাশুড়ি আরো বলেন, “তাছাড়া, শচীন এখানে না থাকলে কাজ করা তোমার পক্ষে নিরাপদ নয়। সে কেবল সপ্তাহান্তে আসে। তাই দয়া করে এখন চাকরির কথা ভাববে না।” শান্তার শাশুড়ি আরো বলেন, “আমি তোমাকে এ বাড়িতে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়েছি।”
শাশুড়ির কথা শুনে শান্তার মন খারাপ হয়ে যায়। সে ভাবে, তার মা তার পাশে বসে তাকে সব বিষয়ে পড়াতেন। যদি সে একটি বিষয়ে ভাল না করলে তাকে তিরস্কার করতেন। তার লেখাপড়া শিখে লাভ কি! সে মনে মনে ভাবে,সন্ধ্যার মধ্যে তাকে রান্না শেষ করতে হয়। ঘরদুয়ারও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে হয়। শান্তার আত্মীয়রা তাকে দেখে ঈর্ষান্বিত হত এই ভেবে যে তার একটি ধনী পরিবারে বিয়ে হয়েছে তাই তাকে কোন চাকরি করতে হবে না। কিন্তু বাস্তবটা তারা জানতো না।
শাশুড়ির কথায় তার শ্বশুর সবসময় উঠতেন বসতেন। সুতরাং, শান্তার ইচ্ছা শোনার কেউ ছিল না।
খুব শীঘ্রই শান্তা বুঝতে পারল যে সে একজন শাশুড়ি পেয়েছে যিনি একজন অবিচল মহিলা। এমনকি শান্তার স্বামীও তার মায়ের কথা মানত। ফলস্বরূপ, তার নিজের মতামতের কোন মূল্য ছিল না।
শান্তার ভাল একাডেমিক রেকর্ড থাকলেও সে তার প্রতিভাকে এতদিন বিকশিত করতে পারেননি।
তার নাচ, গান ও খেলাধুলার প্রতিভাও ছিল।
বিয়ের পর শান্তার মা-বাবা তার অবস্থা দেখে আঁতকে ওঠেন। শান্তার মা লক্ষ্য করলেন তার হাতদুটো ছিল পালকের মত নরম, এখন পাথরের মত শক্ত। দিনরাত হাত দিয়ে কাপড় ধুতে হয়। কোন ওয়াশিং মেশিন নেই। সে সব সময় বিষণ্ন থাকে। তার ওজনও কমে গেছে,কারণ তাকে রাতদিন উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হয়। শুধুমাত্র সপ্তাহান্তে তার শাশুড়ি তাকে রান্নাঘরে সাহায্য করে। বাকি দিনগুলো শান্তাকেই রান্নাবান্না করতে হয়। তার শাশুড়ি টাটকা খাবার পছন্দ করেন। শান্তাকে তার ঘরে যাওয়ার আগে রান্নাঘর পরিষ্কার করেছে কিনা তা নিশ্চিত করতে হয়। রান্নাঘর পরিষ্কার রাখার ব্যাপারে তার শাশুড়ি খুবই কঠোর। শান্তা বাধ্য হয়ে উচ্ছিষ্ট খেয়ে ফেলে। উচ্ছিষ্ট রাখলে শাশুড়ি রাগ করবে। সকালের ব্রেকফাস্ট খেয়ে তার শাশুড়ি কাজে চলে যেতেন। শান্তার মনে হল সে শচীনের বাড়ির চাকরানী।
বেশির ভাগ দিনই শান্তা বাইরে গেলে বাসে যাতায়াত করত, আর বাইরে থেকে খেয়ে আসত। কোনো কোনো দিন সে চাটনি বা আচার দিয়ে শুধু চাপাতি বা দোশা রান্না করত।
একদিন সে তার স্কুলের বান্ধবীর সাথে দর্জির দোকানে দেখা করে। তার বান্ধবী তাকে দেখে খুব খুশি হয়। তারা দুজনেই তাদের শৈশবের স্মৃতি রোমন্থন করে।
তার বান্ধবী তার করুণ অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারে। সে তাকে বললে, “চিন্তা করো না, আমি একদিন তোমার বাসায় যাব।”
তার বান্ধবী শান্তার বাড়িতে গিয়ে লক্ষ্য করল, সকালটা শান্তার জন্য বিরক্তিকর সময়। তার বান্ধবী তাকে একটি স্মার্ট ফোন উপহার দেয়। সে শান্তাকে ইউটিউবে রান্না শিখতে বলে। শান্তা আস্তে আস্তে রান্না শিখতে থাকে। শান্তা ভারতীয় রান্না শিখেছে। সে নন-ভেজ খাবারও রান্না করতে শিখেছে।
তার বান্ধবী কয়েকবার দেখা করার পর রান্না সম্বন্ধে ধারণা দেয়। “তুমি সুস্বাদু বিরিয়ানি রান্না করো; আমি মনে করি তোমার ক্যাটারিং ব্যবসা শুরু করা উচিত”। চিন্তা করবে না আমি তোমাকে সেগুলি বিক্রি করতে সাহায্য করব,” তার বন্ধু শান্তাকে আরো বললো যে এইভাবে সে তার শ্বশুরবাড়ির অজান্তেই সাইড ইনকাম করতে পারে।
কয়েকদিন ভালোই চলছিল। কিন্তু ফ্রিজ খুলতেই শান্তার শাশুড়ির সন্দেহ হয়। সে তার শাশুড়িকে জানায় যে তার বাবা-মা তাকে দেখতে আসছেন, তাই এগুলো সে তৈরি করেছে।
দিন-মাস কেটে গেল, একদিন তার স্বামী রেস্টুরেন্টে গেল। দুপুরের খাবারের জন্য বিরিয়ানির অর্ডার দিল। সে বিরিয়ানি পছন্দ করত। সে প্রায় প্রতি দিন একই বিরিয়ানির অর্ডার দিত।
একদিন শান্তা বিরিয়ানি রান্না করে পরিবেশন করল। তার স্বামী অবাক হয়ে লক্ষ্য করল যে তার স্ত্রী শান্তার রান্নার স্বাদ সে রেস্তোরাঁয় যে স্বাদ পেয়েছিল ঠিক তেমনই।
ধীরে ধীরে সে তার স্বামীকে সত্যিটা বলল। সে পরিবারের আয়ের পরিপূরক হতে চায়। শচীন হতবাক। সে তাকে উৎসাহিত করল। তার তৈরি খাবারগুলি পছন্দ করতে শুরু করল।
শান্তার বান্ধবীও ক্যাটারিং ব্যবসা শুরু করে। প্রধান খাবার বিরিয়ানি। সে শান্তার সাথে দেখা করে তাকে বলে যে খুব শীঘ্রই তার বিরিয়ানি বিখ্যাত হয়ে যাবে।
অর্ডারগুলি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, কয়েক বছরের মধ্যে শান্তা তার নিজের ক্যাটারিং ব্যবসা শুরু করে এবং পরিচালনা করার জন্য তার কয়েকজন সাহায্যকারী ছিল।
শান্তা আর হতভাগা গৃহিণী থাকল না। সে তার দুটি সন্তান আর স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি নিয়ে সুখে শান্তিতে সংসার চালায়। আজ শান্তার বিরিয়ানি শহরে খুবই বিখ্যাত।
লেখক পরিচিতি : ইরিন পল ভারতের কেরালার কোট্টায়ামের একজন নবীন লেখিকা। লেখা তার নেশা। তিনি তার শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, চিন্তাভাবনা ও ধারণাগুলি ভাগ করে নিতে পছন্দ করেন। মধ্যপ্রাচ্যে ১২ বছরের লজিস্টিক ক্যারিয়ারের পরে ইরিন বাড়িতেই থেকে লেখালেখি করেন। তিনি শিশুদের ম্যাগাজিন ও বড়দের সাময়িকীতে লেখালেখি করে অবদান রেখেছেন। এছাড়াও ভারতের বৃহত্তম নারী ক্ষমতায়ন প্ল্যাটফর্মে নিয়মিত লেখালেখি করেন। ইরেজি ভাষায় তার লেখা Shanta’s Biryani গল্পটিকে বঙ্গানুবাদ করা হল।
মনোজিৎকুমার দাস, অনুবাদক, লাঙ্গলবাঁধ, মাগুরা ।