তখন সত্তর দশক! এক উত্তাল সময়। একদিকে পূর্ব ভারত বিশেষ করে পশ্চিমবাংলা সশস্ত্র নকশাল আন্দোলনের ফলে আতংকিত ও রক্তাক্ত। বিভ্রান্ত যুব এবং ছাত্র সমাজ! খবরের কাগজ খুললেই শুধু খুন, জখম আর পুলিশের গুলিতে তরতাজা প্রাণের বলি হওয়ার খবর। আর একদিকে চলছে যেনতেন প্রকারেণ অত্যাচারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা অধুনা স্বাধীন বাংলাদেশ দখল করার ঘৃণ্য প্রয়াস। শান্তিপ্রিয় মানুষ যখন বীতশ্রদ্ধ, ঠিক তখন মাঝারি উচ্চতার, সাধারণ চেহারার কিন্তু আরবান স্মার্টনেসের চূড়ান্ত নিদর্শন এক যুবক হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মতো ভারতীয় সিনেমার পর্দায় উদয় হয়ে এক অন্যরকম ঝড় বইয়ে দিলেন। মুক্তি পেল শক্তি সামন্ত পরিচালিত “আরাধনা”। কেঁপে উঠল আসমুদ্র হিমাচল, তবে আতংকে নয় — রোমান্সে, প্রেমে এবং গানে গানে। মশগুল গ্রাম, শহর, রাজ্য এবং দেশ। অননুকরণীয় ম্যানারিজম, সিডিউসিং চোখের ঝিলিক, হাত নাড়ানো, ডায়লগ থ্রো ততদিনে আপামর তরুণী, যুবতীদের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। রাজেশ খন্না নামের যাদুতে মেয়েদের উন্মাদের মতো আচরণ বহু কথিত, লিখিত এবং পঠিত। শুধু কি মেয়েরা? যুব সমাজ তখন রাজেশ খন্না ক্যারিশমায় মন্ত্রমুগ্ধ। চুলের স্টাইল, গুরু পাঞ্জাবি, কথা বলা এবং হাঁটার ভঙ্গিমা নকল করে নিজেকে রাজেশ খন্নায় রুপান্তিরত করার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা যদি পাড়ার লিপিকা, সীমা, রমা, নিতা, শর্মিলাদের অন্তরে ছাপ ফেলা যায়।
বর্মণ পিতা পুত্রের কালজয়ী সুরে কিশোরকুমারের গানে রাজেশের লিপ সিঙ্কিং এমন এক কিংবদন্তী পর্যায়ে উন্নিত হয়েছে যে কয়েক দশক পরে এখনও সেসব গান সমান জনপ্রিয়। যদিও মহম্মদ রফি, মুকেশ, মান্না দের মতো অন্যান্য কিংবদন্তী গায়করাও ওঁর জন্য গেয়েছেন, কিশোরকুমারের গান ওঁর লিপে এমন ভাবে ম্যাচ করে গিয়েছিল যে সিনেমার পর্দায় মনে হত ওইসব গান কিশোরকুমার নয়, রাজেশ খন্না গাইছেন। কেউ কেউ বলতে পারেন দেবানন্দের মুখেও কিশোরকুমারের গান কি কম ম্যাচ করত? উত্তর হল করত কিন্তু এরকম নিখুঁত নয়। বন্ধুর মৃত্যুতে শোকাহত রাজেশ নিজেও বলেছেন, “কিশোরকুমার ছিলেন আমার আত্মা আর আমি ওঁর দেহ”। একটানা ১৭টা ছায়াছবি, যেগুলোতে উনি একা হিরো, সুপার ডুপার হিট দিয়ে যে রেকর্ড গড়ে রেখেছেন পরবর্তী প্রজন্মের শাহরুখ, আমীর, সলমন, অক্ষয়রা তো নয়ই এমনকি খোদ অমিতাভ বচ্চন পর্যন্ত সেই রেকর্ড ভাঙতে পারেননি। ওঁর কৃতিত্বকে ছোট না করেও নিঃসন্দেহে বলা যায় ওঁর লিপে কিশোরকুমারের গান না থাকলে এই সাফল্য পেতেন কিনা তর্কের অবকাশ থেকে যায়। বাস্তবিক রাহুলদেব বর্মণ, কিশোরকুমার আর আনন্দ বক্সীর ত্রয়ী রাজেশ খন্নাকে ভারতীয় ছায়াছবির প্রথম সুপারস্টার তকমা পেতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
বাংলায় উত্তমকুমারকে যেমন কম বয়েসি মেয়েরা প্রেমিক অথবা স্বামী অথবা দেওর, মায়ের বয়েসিরা পুত্র হিসেবে কামনা করতেন, অগুনতি অসংখ্য সিনেমাপ্রেমী দর্শকদের কাছেও রাজেশ খন্নার ইমেজ অনেকটা সেরকমই, “বয় নেক্সট ডোর”। উত্তমকুমারের অভিনয়ের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা এবং সম্ভ্রম ছিল। নিজ মুখেই বলেছেন অমর প্রেমে অভিনয় করার আগে ১৬ বার বাংলা ভার্সন নিশিপদ্ম দেখেছেন শুধু উত্তমকুমারের অভিনয় দেখার জন্য। দুটি ভার্সনের তুলনা প্রসঙ্গে টাইমস অফ ইন্ডিয়ার ১৯শে জুলাই, ২০১২ সালের ক্যালকাটা টাইমসে ঋতুপর্ণ ঘোষ তাঁর স্মৃতি চারণায় লিখেছেন, “I personally think that he and Rinkudi (Sharmila) gave a more nuanced portrayal of forbidden love in “Amar Prem” than Uttam Kumar and Sabritri Chatterjee in the Bengali original “Nishipadma”. কলকাতা এলে উত্তম সুপ্রিয়ার ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে আসতেন এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলত পানাহার আর আড্ডা। “বাংলা, বাঙালি এবং কলকাতার সাথে এক ঘনিষ্ঠ আত্মিক সম্পর্ক ছিল রাজেশের। তাই বাংলা ছায়াছবির হিন্দি রিমেক ‘সফর’, ‘অনুরোধ’, ‘বাওয়ারচি’ বা ‘অমর প্রেম’ করার সময় পরিচালকদের বারবারই তাঁর কথা মনে পড়েছে”, বলেছেন পরিচালক অনীক দত্ত ১৯শে জুলাই, ২০১২ সালের আনন্দবাজার পত্রিকার কলকাতা পেজে।
সমসাময়িক হিরোদের মতো অ্যাকশান, নাচ গান পটু ছিলেন না। অথচ এসব খামতি স্বতেও রাজেশ ঝড়ে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে আগের এবং সমসাময়িক স্টার অভিনেতাদের দুর্গ। এমনই শক্তিশালী ছিল তাঁর স্টারডমের প্রভাব যে বিবিসির মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সংবাদ মাধ্যমের ব্রিটিশ সাংবাদিককে মাসের পর মাস দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ধাওয়া করে তবে ওঁর ইন্টারভিউর তারিখ এবং সময় পেতে হয়েছে। তৎকালীন সময়ে বোম্বে ইউনিভারসিটির ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের এক টেক্সট বুকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল রাজেশ খন্নার জীবন, উত্থান নিয়ে একটা চ্যাপ্টার। নিবন্ধের শুরুতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষায় ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধের কথা উল্লেখ করেছি। এই যুদ্ধের প্রেক্ষাপটেও ভারতের প্রথম সুপারস্টারের নাম পরোক্ষে জড়িয়ে আছে। ২০১৮ সালের ২১শে ডিসেম্বর ইকোনমিক টাইমসের অন লাইন সংস্করণে কথাকলি নন্দী তাঁর নিবন্ধে লিখেছেন যে ১৯৭১ এর বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে শহিদ হওয়া ১২জন ভারতীয় সৈনিকের পরিবারকে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বীরত্বের জন্য মরণোত্তর সম্মাননা প্রদর্শনের এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ডেলিগেশন টিমের সদস্য এবং প্রাক্তন মুক্তিযোদ্ধা ‘দা ডেইলি স্টার’ পত্রিকার সম্পাদক এবং প্রকাশক মেহফুজ আনম যুদ্ধের সময়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেছেন, “I was 20, studying in Dhaka University, when the war broke out. I joined the Liberation Army from Agartala in India, it was hard to deal with the strong religious sentiment of the people and we devised a strategy to cash in on the hit screen pair of Rajesh Khanna-Sharmila Tagore. We would screen Khanna’s films for the locals and use the intervals to tell the audience about our fight for freedom and the significance of our movement. We knew people would be forced to listen to us because the rest of the film was yet to be screened”।
সম্প্রতি অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহ রাজেশ খন্নার অভিনয় মান অত্যন্ত সাধারণ বলে মন্তব্য করে প্রবল বিতর্কের সৃষ্টি করেছিলেন। প্রতিবাদের ঝড় ওঠায় পরে শাহ তাঁর মন্তব্যের জন্য মাফ চেয়ে নেন। বাস্তবিকই নিজস্ব ম্যানারিজম বজায় রেখে বেশির ভাগ ছায়াছবিতে একই ধরণের অভিনয় করে গেছেন। যদিও হিন্দি সিনেমা জগতে প্রবেশ অল ইন্ডিয়া ট্যালেন্ট কম্পিটিশনের মাধ্যমে যেখানে ১০,০০০ প্রতিযোগীকে হারিয়ে বিজয়ী হয়ে বেশ কিছু নামী প্রযোজক সংস্থার সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। তাছাড়াও ছিল থিয়েটারে অভিনয়ের স্টেজ ব্যাকগ্রাউন্ড। আনন্দ, আবিষ্কার, সচ্চা ঝুটা, আপ কি কসম, দাগ, সফর, খামোশী, দুশমন, বাওয়ারচি, নমক হারাম, অমর প্রেম, অবতার প্রভৃতি ছবিতে অসাধারণ অভিনয়ের সাক্ষর রেখে গেছেন। আনন্দ ছবিতে অভিনয়ের জন্য পেয়েছিলেন শ্রেষ্ঠ অভিনেতার রাষ্ট্রপতি পুরস্কার। রাজেশের মৃত্যুর পরে মৃণাল সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষের মতো পরিচালকেরা তাঁদের শ্রদ্ধাঞ্জলিতে জানিয়েছেন যে ওনারা ওঁকে নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী ছিলেন কিন্তু যে কোন কারণে হোক হয়ে ওঠেনি।
কোন কিছুই স্থায়ী নয়। স্থায়ী হয়নি রাজেশ খন্নার অবিসংবাদিত স্টারডম এবং জনপ্রিয়তা। সাফল্য এলেই তো হল না, সেই সাফল্যকে ধরে রাখতে হবে নিয়মানুবর্তিতা, নিষ্ঠা, কৌশল দিয়ে। জানতেন না শাহরুখ, আমীর, অক্ষয়দের মতো হিসেবী পাবলিক রিলেশন কোশেন্ট। আকাশচুম্বী সাফল্য ততদিনে জন্ম দিয়েছে অহংভাব এবং নিজের ওপর মাত্রাতিরিক্ত আস্থা। দিনের পর দিন দেরী করে শুটিঙে আসতেন। সময়ে আসবেন কী করে? অনেক রাত্রি পর্যন্ত স্তাবক পরিবেষ্টিত রোম্যান্সের রাজকুমার তো দামী সুরাপানে মত্ত। স্তাবকদের চোখে সব কিছু দেখতে শুরু করলেন স্বভাবে অন্তর্মুখী মানুষটি। নিজের রোম্যান্টিক ইমেজ এবং সুপার–স্টারডমে এমনই মশগুল ছিলেন যে প্রতিভা থাকা সত্তেও অন্যধরণের চরিত্রে অভিনয়ের পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেন না। সময় একরকম থাকে না। ইন্ডাস্ট্রির পরিবর্তনের দিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখে নিজেকে বদলে ফেলা উচিত ছিল। ততদিনে পরিচালক হৃষীকেশ মুখার্জী, শক্তি সামন্ত, যশ চোপরারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। দীর্ঘদিনের প্রেমিকা অঞ্জু মহেন্দ্রকে ছেড়ে বয়েসে অনেকটা ছোট ডিম্পল কাপাডিয়াকে বিয়ের চট জলদি সিদ্ধান্তও পরবর্তী জীবনে চরম ভুল প্রমাণিত হয়েছিল। বিয়ে ভেঙ্গে যায়। নিজেও অন্য অভিনেত্রীর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। তাই অমিতাভ বচ্চনের উত্থান এবং মাল্টি–স্টারার অ্যাকশন ছায়াছবির দাপট রাজেশ খন্নার জনপ্রিয়তা এবং সুপার–স্টারডমের পতনের একমাত্র কারণ নয়।
২০১২ সালের ১৮ই জুলাই দুরারোগ্য কর্কট রোগের কাছে হার মানেন ভারতীয় সিনেমার প্রথম সুপারস্টার এবং এক বর্ণময় চরিত্র রাজেশ খন্না। চিরঘুমে যাবার আগেও আনন্দের আনন্দ সেগাল তথা রাজেশ নাটকীয় ভাবে বলেছেন, “টাইম আপ! প্যাক আপ!”। প্রিয় অভিনেতার মৃত্যু সংবাদে বিশ্বজুড়ে অগুনতি শোকাহত ভক্তকুল অমান্য করেছে সেই বিখ্যাত ডায়লগ “পুষ্পা, আই হেইট টিয়ারস”।
উদ্ধৃতি ঋণ : আনন্দবাজার পত্রিকা, টাইমস অব ইন্ডিয়া এবং ইকোনমিক টাইমসের অন লাইন সংস্করণ
Excellent article, hope to see more such quality articles from you
Thank you so much, Friend.
I will try my level best.😊
অনাবশ্যক সুদীর্ঘ নয়, যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই,নির্মেদ ঋজু নিবন্ধ। আকর্ষণীয় চিত্তাকর্ষক।
ভালোলাগা রেখে গেলাম একরাশ। ভালো থাকবেন প্রিয় কবি ও সাহিত্যিক।
আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই আপনাকে।
Khub Khushi holam apnar sundar comment peye. Asesh shuva kamana janai. Valo thakben priyo lekhak, bandhu.