গত দেড়-দু’দশকের মধ্যে গোটা হিমালয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং তার ভয়াবহতা বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। পাহাড় কেটে রাস্তা, বন জঙ্গল সাফ, পাহাড়ের ঢালে বড় বড় বাড়ি, নদীতে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ প্রকল্প… এই অতিরিক্ত চাপ সহনশীলতার মাত্রাকে অনেক দিন আগেই অতিক্রম করেছে, নষ্ট করেছে ভারসাম্য। যে কারণে যোশীমঠ, কেদারনাথ, হিমাচল প্রদেশ কিংবা সাম্প্রতিক সিকিমের ঘটনা। আপাত বিচ্ছিন্ন হলেও সবকটি বিপর্যয় একসুতোয় বাঁধা। একদিকে প্রতিটি ঘটনার জন্য যেমন প্রাকৃতিক কারণ দায়ী, অন্যদিকে মানুষ সেই প্রকৃতিকে পোষ মানাতে আগ্রাসী পদক্ষেপ নিয়েই চলেছে। আর প্রকৃতিও প্রতিশোধ আকারেই ফিরিয়ে দিচ্ছে একের পর এক ধ্বস, মেঘভাঙা বৃষ্টি, হ্রদ ভাঙা বন্যা। তথাকথিত উন্নয়নের ধাক্কায় নদী উপত্যকার এলাকা ক্রমাগত বসে যাচ্ছে, মাটির তলা দিয়ে জলের স্রোত বইছে, সংলগ্ন পাহাড়ি ঢালে চিড় ও ফাটল ধরছে, মাটিপাথর সরছে, কিন্তু তার তোয়াক্কা না করেই প্রকল্প গড়ে উঠেছে, আরও প্রকল্পের কাজ শুরু হচ্ছে।
উন্নয়ন কথাটি যেমন বড় সত্য, তেমনই নির্মম তার পক্ষের যুক্তি। রাজনীতিক থেকে সাধারণ মানুষ সবাই বলবেন, উন্নয়ন না হলে বিদ্যুৎ মিলবে কিভাবে, রাস্তাঘাট না হলে যোগাযোগ ঘটবে কিভাবে? নদীর উপরে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে না উঠলে সিকিম বা কালিম্পঙের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ যে বিদ্যুৎহীন গ্রামেই থাকবেন। পাহাড় ভেঙে, জঙ্গল সাফ করে রাস্তা না বানালে যে পাহাড়ের মানুষ স্কুল-কলেজ, হাসপাতালে পৌঁছাতে পারবেন না। তাই বাঁধ আর বিদ্যুৎ প্রকল্প দুই হয়েছে। স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল ছাড়াও বিশাল আকারের বহু হোটেল হয়েছে। প্রতিরক্ষার স্বার্থে সেবক থেকে রংপো রেলপথ — সেবক স্টেশন দিয়ে ডুয়ার্স অপূর্ব সে যাত্রাপথ। সিকিমের রংপো পর্যন্ত এই পথের অনেক অংশই হচ্ছে সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে। সেই সুড়ঙ্গ করতে গিয়ে ইতিমধ্যে বহু জায়গায় ধস নেমেছে। কিন্তু উন্নয়নের যুক্তি, রেল যোগাযোগ তৈরি হলে সিকিমের অনেক এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হবে। কেন্দ্র সরকারের যে মন্ত্রকগুলি এই তথাকথিত উন্নয়নের ছাড়পত্র দেয়, রাজ্য সরকারের যে দফতর থেকে পাহাড়ে চার-পাঁচ তলা বাড়ি তৈরির সিলমোহর মেলে, তারা সবাই জানে, হিমালয়ের এই অঞ্চলটি ভূমিকম্পপ্রবণ এবং অত্যন্ত স্পর্শকাতর। গত ৩ অক্টোবরের ঘটনাটিও সেই উন্নয়নেরই সুফল। সিকিম এবং এই বঙ্গের উত্তর ভাগ মিলিয়ে তিস্তা নদীর চলাচল পথ প্রায় ৩০৫ কিমি। আর এই পথে গড়ে উঠেছে বহু বিদ্যুৎ প্রকল্প। তার জন্য নির্বিচারে ভাঙা হয়েছে পাহাড়, কাটা হয়েছে জঙ্গল। এমনকি বদল করা হয়েছে নদীর গতিপথও। এই কাজ শুধু যে সিকিমে হয়েছে, সেটা ঠিক নয়, পশ্চিমবঙ্গেও কালীঝোরা এবং রিয়াঙে বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বাঁধ দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রকের সুপারিশ অনুযায়ী, এমন আরও বেশ কিছু প্রকল্পের সুযোগ এখনও রয়েছে। কারণ, বিগত দু-দশক আগে থেকে সিকিম ও বাংলার বিভিন্ন নদীর পথ আটকে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় এবং এখনও চলছে।
এমনিতেই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হিমালয়ে বর্ষার গতিপ্রকৃতির দ্রুত বদল ঘটেছে। এরপরও তিস্তা নদীর উজানে কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা এনএইচপিসি-র (দু’টি প্রকল্প ও আরও তিনটি প্রস্তাবিত) জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ও গজলডোবার সেচবাঁধ তৈরি হওয়ার আগেও কালিম্পং-সিকিম যাওয়ার রাস্তার আশেপাশের পাহাড় ছিল ভঙ্গুর। বহু জায়গায় বর্ষায় ধস ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। পাহাড় ফাটিয়ে বাঁধের কাজ শুরুর পর থেকেই, ধসের ঘটনা আরও বেড়েছে। একাধিক জায়গায়, পুরো পাহাড় ধসে পড়ছে, পাথরের দেওয়াল তুলে কোনওক্রমে তা ঠেকানোর চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু বাঁধের আশেপাশের খাড়া পাহাড়ে যে গ্রামগুলো, যথা ২৭ মাইলের উপরে দেওরালি, কী কালিঝোরার উপরে কারমাট, সেখানেও বাঁধ বানানো আর রাস্তা চওড়া করার জন্য ডিনামাইট ফাটানোর কারণে নতুন করে ফাটল ধরছে। অন্যদিকে ২৭ মাইল থেকে তিস্তা নিচু বাঁধ প্রকল্প-৩-এর জন্য অবরুদ্ধ তিস্তায় প্রতি বৃষ্টিতেই জলাধারে জলের পরিমাণ বাড়ছে। ২৯ মাইল বস্তির নীচেও ধাক্কা মারছে জল, যা পরিস্থিতি তাতে যে কোনও দিন ২৯ মাইল, গেইলখোলা বস্তি-সহ ৩১ নং জাতীয় সড়ক ইতিমধ্যেই নদীতে চলে গিয়েছে। অন্যদিকে ২৭ মাইল থেকে তিস্তাবাজার পর্যন্ত রাস্তায় বাস করছেন প্রায় সাড়ে তিনশো পরিবার, ২৭ মাইল বাঁধের নীচে রিয়াং বস্তিতে আছেন ৮০টি পরিবার, সেভক থেকে কালিঝোরা হয়ে তিস্তাবাজার মল্লি রংপো পর্যন্ত রাস্তার ধার থেকে দুপাশের পাহাড়ে আছেন কয়েক হাজার পরিবার। বেশি বৃষ্টি হলে, ২৭ মাইল এবং কালিঝোরা জলাধারে জল বাড়লে মানুষেরা পাহাড়চাপা পড়ে মরবেন, বা ভেসে যাবেন।
জাতীয় হাইড্রোপাওয়ার কর্পোরেশন ২০০৮ সালে বাঁধটি তৈরির সময় থেকেই একাধিক গণ সংগঠন ও সংস্থা প্রতিবাদ জানিয়েছিল। কিন্তু সেসব কথায় কান দেওয়া হয়নি। ন্যাশনাল রিমোট সেন্সিং সেন্টারের ২০১৩ সালের রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হয়েছিল, লোনাক হিমবাহ গত চল্লিশ বছরে কতটা পরিমাণ গলেছে এবং হ্রদের আকার কত দ্রুত বেড়ে চলেছে। অর্থাৎ, যার স্বাভাবিক পরিণতি ঘটবে মেঘভাঙা বৃষ্টি। চলতি বছরে সংসদেও হিমালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি রিপোর্ট পেশ হয়। কিন্তু সেই উন্নয়নের যুক্তি, যে উন্নয়ন পাহাড়ি ঢালগুলোতে সুড়ঙ্গ খোঁড়া, রাস্তা চওড়া করা, ভূমি ও বন-জঙ্গলের ক্ষতি করা, নদীর গতিপথকে আটকে বাঁধ দেওয়া…। তাহলে এই উন্নয়ন কার সবার্থে?