হুগলী জেলার চুঁচুড়ার খাদিনামোড় ও তালডাঙার মাঝে জিটি রোডের ধারে সাদা ধবধবে নিঃসঙ্গ একাকী দাঁড়িয়ে থাকা নিওক্লাসিক্যাল বারোক সৌধটির নাম সাত সাহেবের বিবির কবর। ছোটবেলায় যখন বাসে করে এই রাস্তার ধার দিয়ে যেতাম, দেখেছি স্মৃতিসৌধটি বনজঙ্গলে ঘেরা থাকতো। ইদানিং প্রত্নতত্ব সর্বেক্ষণ দপ্তর চারপাশটা পরিষ্কার করে একটা বোর্ড লাগিয়ে দিয়েছেন। স্মৃতি সৌধটি জনৈক সুসান্না অ্যানা মারিয়া নামে এক ডাচ রমণীর।
সুসান্না অ্যানা মারিয়া ভারকার্ক, হ্যাঁ এটাই তার আসল নাম। তিনি জন্মসূত্রে ছিলেন ডাচ। ঐতিহাসিক প্রমাণ বলতে, সমাধিসৌধের গম্বুজের বেষ্টনীতে লেখা আছে “Susanna Anna Maria Yeats Reboore Verkerk OBILT 12 May Anno 1809” রিবুর ভার্কার্ক অর্থাৎ জন্মসূত্রে পদবী ভার্কার্ক।
ইতিহাস বলে ১৭৪৩ সালে নেদারল্যান্ডের তিয়েল নামে এক ছোট্ট শহরে জন্ম হয় সুসান্নার। তবে তিনি নেদারল্যান্ড থেকে কিভাবে চুঁচুড়ার ডাচ উপনিবেশে এসেছিলেন সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। সে যাই হোক ১৭৫৯ সালের সুসান্নার বিয়ে হয় প্রভাবশালী ওলন্দাজ ব্যবসায়ী পিটার ব্রুইসের সঙ্গে। পিটার ব্রুইস ছিলেন চুঁচুড়ার ওলন্দাজ কুটির চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। ১৭৫৯ সালে ইংরেজদের হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় ওলান্দাজরা। পলাশীর যুদ্ধের সাফল্যের পর চুঁচুড়ার ওলন্দাজ কর্তৃপক্ষ ইংরেজদের অভিনন্দন জানালেও তারা সুখী ছিলেন না। আবার ইংরেজরা তাদের শত্রু ডাচ-দের চুঁচুড়া থেকে তাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ১৭৫৯ সালে ২০ নভেম্বর কর্নেল ফোর্ড বরাহনগরের ডাচকুঠি দখল করেন এবং ২৪ নভেম্বর চুঁচুড়ায় সশরীরে আসেন। ২৫ নভেম্বর চন্দননগরের বেদারা বা বাজরা নামে সরস্বতীর পূর্ব তীরে এক গ্রামে আধা ঘন্টার যুদ্ধে ডাচরা পরাজিত হয়। ইংরেজরা বাংলার নবাব কে দিয়ে বাঁচাতে বাণিজ্য ক্ষমতা খর্ব করে। ফলে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধ হলেও, বাণিজ্য ক্ষেত্রে ডাচেরা দুর্বল হয়ে পড়ে।
চুঁচুড়ার টালমাটাল এই পরিস্থিতিতে ১৭৮৩ সালে পিটারের মৃত্যু হয়। তাকে চুঁচুড়ার মিয়ার বেড়ের ওলন্দাজ কবরখানায় সমাধিস্থ করা হয়।
এরপর ১৭৯৫ সালে সুসান্নার আবার বিয়ে হয় ধনী প্রতিষ্ঠিত ইংরেজ ব্যবসায়ী থমাস ইয়েটস এর সাথে। কিন্তু দুর্ভাগ্য সুসান্নাকে ছাড়ে না। সে বিবাহও দীর্ঘস্থায়ী হলো না। কিছুদিনের মধ্যেই থমাসের মৃত্যু হয়।
চুঁচুড়া তালডাঙ্গায় প্রায় ৬০ বিঘা জমির উপর ছিল সুসান্নার বিরাট প্রাসাদ–আয়েশবাগ। ১৮০৯ সালে সুসান্নার মৃত্যু হল তার ইচ্ছা অনুসারে এখানেই তৈরি হয় তার সমাধিসৌধ। চারদিক থেকে সিঁড়ি উঠে গিয়েছে সৌধটিকে ঘিরে। স্মৃতিসৌধটির মাথায় ইউরোপীয় ধাঁচের এক অর্ধগোলাকৃতি গম্বুজ ও তার মাথায় একটি চূড়া রয়েছে। স্মৃতিসৌধের ভিতরে অগোছালো ভাবে উত্তর-পশ্চিম কোণে সুসান্নার সমাধি রয়েছে।
মুর্শিদাবাদের কাশিমবাজারে সমাধিক্ষেত্রে এই সৌধটিরই একটি হুবহু প্রতিকৃতি পাওয়া যায় এবং অনেকে মনে করেন যে এই সৌধটির অনুকরণেই সুসান্নার সমাধিসৌধটি নির্মাণ করা হয়। কাশিমবাজারের সমাধিটি জনৈক ওলন্দাজ তামেরাস ক্যান্টার ভিশেরের (Tammerus Canter Visscher)।
জীবদ্দশায় সুসান্নার কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে খুব একটা বেশি জানা না গেলও, জনশ্রুতি আছে বিরাট জমিদারি আর বিপুল ধনরাশির জন্য তিনি সাধারণ মানুষের কাছে রানীমা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। চুঁচুড়া শহরের ও তার অধিবাসীর প্রতি সুসান্না আন্না মারিয়ার যে ভালোবাসার দরদ ছিল তা বোঝা যায় তার ১৮০৯ সালের একটি ইচ্ছা পত্রে। এই ইচ্ছা পত্রে তিনি বলেন যে তার প্রতিষ্ঠিত ট্রাস্টের উদ্বৃত্ত অর্থ যেন চুঁচুড়ার poor Fund এ যায়। তিনি এও ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন যে চুঁচুড়ার তোলা ফটো, তালডাঙ্গা রোডে অবস্থিত তার ৬০ বিঘা জমিতে একটি বাড়ি ও ডাচ ইংরেজদের সমাধি যেন করা হয়। এই ইচ্ছা অবশ্য বাস্তবায়িত হয়নি। যদিও বাগান থেকে আয়ের একটি অংশ চুঁচুড়া রোগাক্রান্ত অসুস্থদের সেবায় চার্চের সহায়তার জন্য দান করা হয়। ডাচ সমাধিস্থলের বাইরে চুঁচুড়া তোলাফটক তালডাঙ্গা রোডের পাশে আইসবাগ না মাঙ্কি তো সেই জমিতে সুসান্নার বৈশিষ্ট্যময় সমাধিতে আজও উজ্জ্বলভাবে অবস্থিত।
ইতিহাস যাই বলুক, সুসান্নার চরিত্র রহস্যময় হয়ে উঠেছে তাকে ঘিরে নানা লোককথায়। বলা হয়, সুসান্না নাকি ৭ বার বিয়ে করেছিলেন আর বিয়ের পরে প্রতিবার তার স্বামীরা রহস্যজনকভাবে মারা গিয়েছেন। সুসান্নাকে তার স্বামীদের হত্যাকারি বলে কয়েকবার সন্দেহ করা হলেও তার বিরুদ্ধে কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সুসান্না যথেষ্ট ধনী আর প্রতিপত্তিশালী ছিলেন, নিজের মৃত্যুর আগে উইল বানিয়ে পুত্র লুইস আড্রিয়ান ডি ব্রুয়েক্সস (প্রথম পক্ষ) কে সবকিছু দিয়ে যান। উইল অনুযায়ী তাঁর যাবতীয় সম্পত্তি (ছ’টি ঘোড়া, একটি পুরনো আমলের ঘোড়ার গাড়ি এবং একটি বাড়ি) তিনি দান করেন তাঁর ছেলে ল্যুইকে।
জনশ্রুতি আছে সুসান্নার বিপুল ধন-সম্পদ সৌধের ভেতর লুকানো আছে আর তার পোষা কেউটে সাপগুলো বংশ পরম্পরায় সেই সম্পদগুলি রক্ষা করে চলেছে।
রহস্যময়ী সুসান্নার চরিত্রের উপর ভিত্তি করে সাহিত্যিক রাস্কিন বন্ড লিখেছিলেন “সুসান্নাস সেভেন হাসবেন্ডস”। আর সেই কাহিনী অবলম্বনে ২০১১ সালে বিশাল ভরদ্বাজ “সাত খুন মাফ” ছবিটি তৈরি করেন।
সুসান্নার চরিত্রে ছিলেন প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, এছাড়াও সিনেমায় অভিনয় করেন ইরফান, নীল নিতিন মুকেশ প্রমুখ।
ইতিহাস বলে সুসান্নার দুবার বিয়ে হয়েছিল কিন্তু জনশ্রুতি বলে সুসান্নার সাতবার বিয়ে হয় এবং প্রতিবারই স্বামীদের রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয়। পরস্পর বিরোধী এই তথ্য বিরোধের প্রশ্নের কারণ কি?
সপ্তদশ অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিভিন্ন রোগব্যাধি উপশমের জন্য ও মঙ্গল কামনায় বনদেবীর পূজা করা হতো। সম্ভবত হিন্দু-তন্ত্রের সপ্তমাতৃকার ধারণা থেকেই এই লৌকিক উপদেবতার সৃষ্টি।
বনদেবীর বিভিন্ন রূপেকে একত্রে সাতবোন বা সাতবউনি হিসেবে কল্পনা করা হতো।
আজও দক্ষিণ ২৪ পরগণা ও সুন্দরবনের অরণ্য সংলগ্ন অঞ্চলে এঁদের পুজো হয়। এককালে চুঁচুড়ায় মুসলিম প্রভাবে এঁরাই হয়তো সাতবিবি নামে পূজিত হতেন। যেমন ধরুন হিন্দু ওলাইচণ্ডী দেবী ওলাবিবি নামে কলেরা উপসমকারী দেবী নামে পরিচিত হয়েছে। এছাড়া ঝোলাবিবি, মড়িবিবি, আসানবিবি ইত্যাদিও রয়েছেন।
সাত বিবির কবরের কিছু দূরেই রয়েছে বুনোকালী মাতার প্রাচীন মন্দির, কোন এক কালে বন-জঙ্গলে ঢাকা এইসব অঞ্চল তারই সাক্ষ্য বহন করে। তাই হয়তো লোকমানসের স্মৃতি-বিস্মৃতির ষটচক্রে এই সাতবিবি আর সুসান্না মারিয়ার চরিত্র একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে তৈরি হয়েছে এই লোককাহিনী।।
Creative
Dhonyobad
Read the book and seen the film. But, the historical facts were not known to me till now. Thanks, Rinki, for such a good post.
Thank you so much for your wonderful words. Means a lot to be reckoned.