নীনার সঙ্গে পরিচয় মুম্বাইয়ের বান্দ্রা স্টেশনে। ‘কচ্ছের রণে’র ভ্রমণসঙ্গীদের মধ্যে নীনা সব থেকে আগে উষ্ণতার হাত বাড়িয়ে আমার সঙ্গে পরিচয় করল।
হৃষ্টপুষ্ট, হাসিখুশি মধ্যবয়সিনী নীনার সঙ্গে ছিল মেয়ে জেনী বা জেনিথ। সবুজরঙা চুলের বছর তিরিশের মেয়েটি স্বভাবে, চেহারায় মায়েরই মত।
এর আগে আমাদের সামান্য পরিচয় হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে। নীনার ডিপিতে দেখেছি দুটি অচেনা শব্দ। রোমান হরফে লেখা। গুগল করতেই ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেওয়ার কথা এল। হিব্রু ভাষায়। তখনো তলিয়ে দেখিনি। নীনা ধর্মবর্ণজাতি নির্বিশেষে যেকোনো মেয়েরই নাম হতে পারে, তবে পদবির শেষে ‘কর” দেখে ভেবেছিলাম মারাঠি কন্যা।
নীনা আদতে ইহুদী। এর আগে আমার কোনো ইহুদীর সঙ্গে পরিচয় হয় নি। ইতিহাসের পাতায় গোটা পৃথিবী জুড়ে ইহুদীদের উত্থান, পতন এবং তাদের ওপর অত্যাচারের কাহিনী পড়ে এই সম্প্রদায়ের মানুষদের সম্পর্কে কৌতুহল কম ছিল না।
প্রায় দু’হাজার বছর আগে নীনার পূর্বপুরুষরা ভারতে এসেছিলেন। ব্যবসাবাণিজ্যের খাতিরে। একেশ্বরবাদী ইহুদীরা ভারতে সিনাগগ বা উপাসনাগৃহ তৈরি করেছিলেন। স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নীনা আমেদাবাদে বড় হয়েছে। বিবাহসূত্রে মুম্বইবাসী। হিন্দি, ইংরিজি ছাড়াও গুজরাটি, মারাঠিতে স্বচ্ছন্দ। পরিবারের সকলের সঙ্গে মারাঠিতেই কথা বলে। ডায়াবেটিক হওয়া সত্ত্বেও সব গুজরাটি মিষ্টি খাবার তাড়িয়ে তাড়িয়ে খায়। সামনের চুল পাতলা হয়ে গেছে বলে মাথায় স্কার্ফ জড়িয়ে হেসে বলে, “ইয়ে মেরা আপনা স্টাইল হ্যায়”। প্রথম আলাপেই আমি তার কাছে শর্মিলা ট্যাগোর(!?!?)হয়ে গেলাম।
তাকে বললাম, কোলকাতায় দেড়শ বছরের পুরনো ম্যাগেন ডেভিডের সিনাগগটি দেখেছি। সেই সুন্দর উপাসনাগৃহের চোখধাঁধানো স্তম্ভ, ঘষা কাচ, দেওয়ালের কারুকাজ, ঝাড়লণ্ঠনের কথা বিস্তারিত ভাবে বলতেই নীনা যেন আরো খানিকটা ঘনিষ্ঠ হয়ে গেল আমার সঙ্গে।
কোলকাতার ব্রাবোর্ণ রোড আর ক্যানিং স্ট্রিটের সংযোগ স্থলে মাগেন ডেভিড সিনাগগ। ইহুদীদের উপাসনালয়। এশিয়ার বৃহত্তম এবং সুন্দরতম সিনাগগটি দেখার জন্যে পায়ে হেঁটে ঝাঁকামুটেওলা, ঠেলাওয়ালা, গিজগিজে মানুষের ভীড় ঠেলতে ঠেলতে সেখানে পৌঁছতে হবে। যে কোনো কাজের দিনে সেখানে রাস্তা, ফুটপাথ, গাড়ি, মানুষ সব মিলেমিশে একাকার। সরীসৃপের মত নিজের শরীরটাকে এঁকিয়ে বেঁকিয়ে চলতে হবে তাদের সঙ্গে। কাঁধের পর্দায় উচ্চস্বরে আঘাত করবে হিন্দি, বাংলা, উড়িয়া আরো না জানি কত ভাষার শব্দবাণ। তবে এই ঠেলাঠেলি, গিজগিজে ভীড়ের মধ্যেই যেন বিবিধের মাঝে মিলন মহান। ঐ চত্বরের রাস্তার এপারে ওপারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সহাবস্থানে আছে নাখোদা মসজিদ, আর্মেনিয়ান চার্চ, সিনাগগ, অগ্নি উপাসক পারসীদের উপাসনালয়।
আমাদের সেদিনের হেরিটেজ পদযাত্রাটি ছিল বিপ্লবী রাসবিহারী রোডের মাগেন ডেভিড সিনাগগের উদ্দেশ্যে।।ক্যানিং স্ট্রিট আর ব্রাবোর্ন রোডের ক্রশিংয়ে একটু মাথা উঁচু করে তাকালে দূর থেকে এই ইহুদীদের লাল রঙের মন্দিরটির গথিক স্টাইলের মিনার দেখা যাবে। এটি ১৮৮৪ তে তৈরী কোলকাতার দ্বিতীয় সিনাগগ বা ইহুদীদের উপাসনা মন্দির।
ঐ ঘিঞ্জি গলিতে, হট্টগোল আর ভিড়ের মধ্যে ঐ রকম সুন্দর যে একটি ইতালীয় রেনেসাঁস স্থাপত্যের নিদর্শন থাকতে পারে, সেটা বাইরে থেকে অবিশ্বাস্য মনে হয়। মন্দিরের ভেতরের পরিবেশ ও অত্যন্ত শান্ত, গম্ভীর। প্রাচীনত্ব, আভিজাত্য এবং সমাহিত ভাবের যেন এক সংমিশ্রণ।
একেশ্বরবাদী ইহুদীদের জনসংখ্যা গোটা পৃথিবীতে ১ কোটির বেশি নয়। তবে মেধার দিক দিয়ে তো বটেই, ইঞ্জিনিয়ারিং, সংগীত, জ্ঞান-বিজ্ঞান-সহ জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই অন্যদের থেকে অনেক অনেক এগিয়ে এবং বিশেষ করে ব্যবসার ক্ষেত্রে। প্রসাধনী, খাদ্য, অস্ত্র, ফ্যাশন, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ইত্যাদি সহ (হলিউড) পৃথিবীর প্রায় ৭০% এর কাছাকাছি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এদের দখলে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নাগাদ বহু ইহুদি ছিলেন কলকাতায়। তবে শুধু এসেছিলেন বলাটা বোধহয় ভুল হবে। এঁরা এসেছিলেন এবং জয় করেছিলেন। রিয়াল এস্টেট, চলচ্চিত্র আর গ্ল্যামারের দুনিয়া ঝলমলে হয়ে ওঠে এঁদের উজ্জ্বল উপস্থিতিতে। শিক্ষা বা নারীদের প্রগতিশীলতাতেও এঁদের অবদান কম ছিল না। কোলকাতায় বিখ্যাত নাহুমের কেকও ইহুদিদেরই অবদান। স্বাধীন ইজরায়েল গঠন এবং আরও নানা কারণে একসময় দলে দলে ইহুদি ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যেতে থাকেন। একসময় পাঁচ হাজারেরও বেশি ইহুদি ছিলেন কলকাতায়। রিয়েল এস্টেট এবং কিছু কিছু ব্যবসায় ইহুদি এজরাদের সেই সময় একচেটিয়া প্রতিপত্তি ছিল। এলিয়াস ডেভিড এজরা তাঁর বাবা জোসেফ এজরার স্মৃতিতে ১৮৮৪-তে প্রায় লক্ষাধিক টাকায় তৈরি করেন মাগেন ডেভিড সিনাগগ।
উঁচু জানলা আর ছাদে লাগানো বহু রংয়ের কাচের টুকরো থেকে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে সিনাগগের থামগুলি ঝিলমিল করে ওঠে এখনো। বিরাট হলের মাঝখানে মঞ্চের মতো উঁচু জায়গা। এখানে রাবাই, অর্থাৎ ইহুদি পুরোহিতরা বিশিষ্টদের নিয়ে দাঁড়াতেন প্রার্থনার সময়। হলের শেষ প্রান্তে গ্যালারির মতো একটি জায়গা রয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয় এখানে। সিনাগগগুলির এই জায়গাটি সব থেকে সুন্দর। কারুকার্যময় কাঠের রেলিং দিয়ে ঘেরা। এখানে রয়েছে তিনটি দরজা। এর ভিতরে রক্ষিত রয়েছে ইহুদিদের পবিত্র গ্রন্থ তোরা। ইহুদিদের ধর্মশাস্ত্রের প্রথম পাঁচটি গ্রন্থের সমাহার ‘তোরা’। গ্যালারিতে ওঠা গেলেও এই ঘরে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয় না। এর ওপরে রয়েছে একটি হাফ ডোম বা অর্ধ গম্বুজ। ঘন নীল দেওয়ালে সাদা সোনালী তারাগুলি ভারি সুন্দর। মাঝের দরজার উপর রয়েছে ইহুদি ধর্মের প্রতীক মেনোরা বা বাতিদান আর মাগেন ডেভিড। বিরাট হলঘরে দেখার মতো সুন্দর ঝাড়লণ্ঠন। মাগেন ডেভিডের মতোই সিঁড়ি দেওয়া মঞ্চ রাবাইদের দাঁড়ানোর জন্য। একই রকম ওপরে ব্যালকনি ঘেরা জায়গা মেয়েদের প্রার্থনা করার
মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদি আর মুসলমানদের সম্পর্কে টানাপড়েন থাকলেও তার বিন্দুমাত্র ছাপ কোনওদিন কলকাতায় পড়েনি। এখানে সব ক’টি সিনাগগ দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন মুসলমানরা।
এই ধর্মীয় সমন্বয় এবং কোলকাতায় ইহুদিদের শেষ প্রতিভূ হয়ে এখনো কিছু মানুষ সিনাগগে আসেন। শনিবার প্রার্থনায় বসেন এবং শুক্রবার তাঁদের ধর্মীয় প্রথা অনুসারে জলে ভাসমান মোমবাতি জ্বালিয়ে দেন।
কোলকাতার মত গোটা পৃথিবীতেই এখন ইহুদীদের অস্তিত্ব মোমবাতির আলোর মতই টিমটিমে। কচ্ছের মান্ডবী সমুদ্রতীরের সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে নীনা ভাববিভোর হয়ে গেল। সেই অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পঞ্চাশোর্দ্ধ নীনা আমাকে তার পরিবারের কথা, তাদের জাতির সংখ্যালঘুত্বের কথা, অস্তিত্বের সংকটের কথা আমাকে বলতে লাগল।
ইস্রাইল ইহুদীরাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত হবার পর অধিকাংশ ইহুদী সেখানে চলে গেছে। নীনার আত্মীয়স্বজনরাও ফিরে গেছে সেখানে। নীনাও তার ছেলে এবং মেয়ে জেনিথকেও সেখানে পাঠিয়েছে। আজন্ম মুম্বইয়ে বড় হওয়া ছেলে-মেয়েদুটিকে সেখানে গিয়ে হিব্রু শিখতে হয়েছে। ছেলেটি ইউক্রেনের ইহুদী মেয়েকে বিয়ে করেছে, কিন্তু বিয়ের আসরে নীনা ঘাঘরা পরে নেচেছে, “মেরে হাথো পে ন’ ন’ চুড়িয়া হ্যায়।”
নীনার মেয়ে জেনিথ চারবছর হল ইস্রাইলে গেছে, কিন্তু তার এখনো কাউকে মনে ধরেনি। সে বাড়িতে রান্না করে ভারতীয় খাবারই খায়। সেখানকার খাবারদাবারে তার অরুচি। আপাততঃ তার বাড়ি থেকে কাজ বলে মা-বাবার কাছে মুম্বইতে।
নীনার দুঃখ তার মেয়ে যদি ইহুদী সমাজের বাইরে কাউকে বিয়ে করে তাহলে তাদের সমাজচ্যুত হতে হবে। তার মন এত বিধিনিষেধ মানতে চায় না, আবার সে আত্মীয়স্বজনকেও হারাতে চায়না। ইস্রায়েলে গিয়ে পাকাপাকি থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার নেই। নীনার আজন্মলালিত ভারতীয় মনে এদেশের মানুষ, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, ভাষা ওতপ্রতোভাবে জড়িয়ে গেছে। সে কোথায় যাবে এসব ছেড়ে? মুম্বইয়ের চৌপট্টিতে দাঁড়িয়ে বড়াপাও খেতে, মারাঠি-গুজরাটি-বাঙালি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারতে, হিন্দি সিনেমা দেখতে যে তার খুব ভালো লাগে! একথা বলতে বলতে তার বড়বড় দুই চোখে জলের ধারা। আমি তাকে কোনো সান্ত্বনা দিতে পারলাম না। সন্ধ্যের আলো-আঁধারের মত তার এই দোটানা মনকে অনুভব করার চেষ্টা করলাম।
অসাধারণ লেখা। প্রায় ই এই উপাসনালয় এর পাশ দিয়ে যাতায়াত করি, কোনদিন ভেতরে ঢোকার কথা মনে হয়নি, তোমার লেখা পড়ে দেখার ইচ্ছে জাগলো। ধন্যবাদ নন্দিনী।
হাজার বার সামনে দিযে গেলেও ,মন দিযে দেখা হযে নি।আপনার তথ্য সমৃদ্ধ লেখা র জন্য ধন্যবাদ ।এবার সত্যিই গিযে দেখতে হবে।
অবশ্য দ্রষ্টব্য
নাহ। সিনাগগ টা সত্যিই দেখতে হবে এবার।
হ্যাঁ অসাধারণ লাগলো লেখাটি পড়ে।
ধন্যবাদ। অবশ্যই দেখবেন।