ট্রেড এন্ড কমার্সিয়াল অর্গানিজেশন ইন বেঙ্গল ১৬৫০-১৭২০, উইথ স্পেশাল রেফারেন্স টু দ্য ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
সপ্তম অধ্যায়
বাঙলার ব্যবসা জগতে কোম্পানি
বাংলায় আমদানি
রপ্তানি বাণিজ্যের যেমন সব থেকে বড় শহর ছিল কাশিমবাজার, তেমনি আমদানি করা পণ্যও সবার আগে এখানেই আসত। কোম্পানি সম্পদ এবং পণ্যের সব থেকে বড় অংশ কাশিমবাজার কুঠিতেই পাঠাত। সপ্তদশ শতাব্দের আশি দশক অবদি, কাশিমবাজারের পরে দামি ধাতু আর আমদানি করা পণ্য বিতরণের সব থেকে বড় বাজার ছিল বালেশ্বর। কোম্পানি কোন কোন অঞ্চলের কোন কোন কুঠিতে কি কি অংশিদারে সম্পদ এবং পণ্য পাঠাত সেটা আমরা নিচের তালিকায় দেখে নিতে পারি। ১৬৮২-তে মোট স্টক হিসেবে বাংলায় পাঠানো হয়েছিল ১,৩৪,০৫০ পাউণ্ড যার মধ্যে ১,২০,৮৪০ পাউন্ড দামি ধাতু এবং ১৩,২১০ ইওরোপিয় পণ্য। কোন কোন কুঠিতে কত গিয়েছে তার হিসেব এই তালিকায় আমরা দেখব (ফ্যাক্ট্রি রেকর্ডস, হুগলী, খণ্ড ৩, অংশ ২, ৮৭। আমি ভগ্নাংশ বাদ দিয়েছি)
কুঠি দামি ধাতু (পাউন্ডে) পণ্যের পরিমান (পাউণ্ডে)
কাশিমবাজার ৭৩,৩৯৫ ৭,৯৬৪
পাটনা ৭,৬০১ ৮২৪
মালদা ৭,৮৬৩ ৯৫৩
বালেশ্বর ১৬,৭৭৬ ১,৮২০
ঢাকা ৮,৬৫২ ৯৩৮
হুগলী ৬,৫৩৩ ৭১১
মোট ১,২০,৮৪০ ১৩,২১০
তবে আমাদের আলোচ্য সময়ের বাংলায় আমদানির সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিল আমদানি করা পণ্যগুলিতে আপেক্ষাকৃত বেশি পরিমানে স্ট্যাগনেশন দেখা যেত। সারা ভারতের আমদানির ক্ষেত্রেও যদিও একই কথা বলা যেত, কিন্তু অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বাংলায় স্ট্যাগফ্লেশন যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানোর মত ছিল। কোম্পানির ব্যবসা জালে জড়িয়ে থাকা অন্য এলাকার তুলনায় বাংলায় কোম্পানির দামিধাতু ছাড়া অন্য পণ্যের খাতক কম ছিল। এটা পরিষ্কার হয় ১৭০০ সালে পূর্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বাণিজ্য কেন্দ্রে জাহাজের সংখ্যার প্রস্তাব, টনেজ এবং মোট রপ্তানি হওয়া পণ্যের মূল্যমানের তালিকা থেকে (রওল, ড, ৭৪৭, ২৫৬)
ওপরের তালিকা থেকে স্পষ্ট যে মোট রপ্তানির অংশেদারিতে অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বাংলায় অনেক কম পণ্য পাঠানো হত।
স্পষ্ট যে বাঙলার রপ্তানি বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ পরিমান বৃদ্ধি সত্ত্বেও আমদানি বাণিজ্যে ভোগ্য পণ্য এবং কাঁচামালের বাজারের বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায় নি। অতএব, বাড়তে থাকা রপ্তানির সঙ্গে সঙ্গে সব থেকে বেশি আমদানি ঘটতে থাকে দামি ধাতু এবং মশলার। তবে এই সম্পদ আমদানির অংশ — হয়ত একটা বড় অংশ ব্যবহৃত হত সঞ্চয়ে এবং ধনীদের ব্যবহারে। আমদানি হওয়া সম্পদের সামান্য প্রভাব পড়ত উতপাদকদের এবং উতপাদনের ব্যবস্থাপনায়। রপ্তানি বাণিজ্যের লভ্যাংশ চলে যেত বিদেশি কোম্পানিগুলি আর ব্যবসায়ী-মধ্যশ্রেণীর সিন্দুকে এবং কিছু ভগ্নাংশ এসে পৌঁছত প্রাথমিক উতপাদকেদের ট্যাঁকে। এর প্রভাবে আমদানি করা পণ্যের বাজার তুলনামূলকভাবে নিশ্চল এবং সীমাবদ্ধ ছিল আমাদের আলোচ্য সময়ে।
কোম্পানি ও দেশিয় ব্যবসা (কান্ট্রি ট্রেড)
ভারতের এক বন্দর থেকে অন্য বন্দরের মধ্যে পণ্য আদান-প্রদানের সম্ভাব্য ব্যবসা, কোম্পানির খাতায় যার নাম কান্ট্রি ট্রেড, সেটির দিকে কোম্পানির নজর পড়েছিল ১৬৫৪ সালেই। এদেশের কোম্পানি ব্যবস্থাপকেরা লন্ডনের কর্তাদের লিখলেন, … আপনাদের (কোম্পানির) ইওরোপের পানে পাঠানো জাহাজের পরিকল্পনার পাশাপাশি, আরও যথেষ্ট জাহাজ পারস্য, লোহির সাগর, অচিন, পেগু, টেনাসরিম এবং শ্রীলঙ্কায় ব্যবসার কাজে লাগানো যেতে পারে, এই ব্যবসায় ভাল লাভ হয় এবং আমরা এই মনসুনেই এই কাজটা শুরু করতে পারি (ওসি, ২৮ ডিসেম্বর, ১৬৫৪, ২৪৩৫, ২৪ খণ্ড; ইএফআই, ১৬৫১-৫৪, ৩০৪)।
কুঠিয়ালদের যুক্তি ছিল, এই বাণিজ্যের উদ্দেশ্য শুধুই বাঙলার কুঠির খরচ তোলাই নয়, এই ব্যবসায় কোম্পানির কর্তাদের ইওরোপিয় পণ্য কিনতে সাহায্য করবে। আমরা আগেই দেখেছি, কোম্পানির এক বন্দর থেকে আরেক বন্দরের ব্যবসায় দুটি উদ্দেশ্য ছিল, প্রথমত ভারতে পণ্য নিয়ে আসা জাহাজগুলিকে বন্দরে দাঁড় করিয়ে রেখে ক্ষতি থেকে বাঁচানো, দ্বিতীয়ত এই ব্যবসার লাভ্যাংশ থেকে অর্থ নিয়ে ভারতে ব্যবসার পুঁজির ঘাটতি মেটানো। বাংলায় ব্যবসা শুরু করার প্রথম সময় থেকেই, কোম্পানি সুরাট থেকে পারস্য যাতায়াতের আন্তঃএশিয় ব্যবসায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিল, যদিও উপকূল বাণিজ্যে সে খুব নিয়মিত নিজেদের নিয়োজিত করত না। সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে কোম্পানি এক বন্দর থেকে অন্য বন্দরে পণয় পাঠিয়ে বাণিজ্যের সম্ভাবনা সম্বন্ধে ক্রমশ বুঝে উঠতে শুরু করেছে। ১৭০৩ সালে কোর্ট অব ডিরেক্টর বাঙলা কুঠিকে লিখল, এটা আমাদের কাজ হিসেবে ধরে নিতে হবে। ইংলন্ড জাতির সমৃদ্ধি এবং ভারতে ইংলণ্ডের বাণিজ্য সম্ভাবনা বৃদ্ধি ঘটতে পারে বন্দর থেকে বন্দরে বাণিজ্যে যোগদান করার মধ্যে দিয়েই… (ডিবি, ২ মার্চ, ১৭০৩, ৯৫ খণ্ড, ৬৩)।
পারস্যে ব্রিটিশ কোম্পানি, ডাচ এবং দেশিয় বণিকেরা মূলত চিনি এবং নানান ধরণের ক্যালিকো রপ্তানি করত আর ফেরত জাহাজে আসত মূলত মুদ্রা, বিশেষত রূপো যার নাম আব্বাসি এবং সোনা ডুকাট, আর শিরাজি মদ্য, গোলাপ জল, শুকনো ফল, হিং, মুক্তো ইত্যাদি দামি ভোগ্যপণ্য। পারস্য ব্যবসায় লভ্যাংশ প্রচুর ছিল এবং পরিমানটা ৫০-৬০ শতাংশ অবদি হত (ওসি, ১৬ মে, ১৬৮২, ৪৮২০, খণ্ড ৪২; বিএম, এডি ম্যানু, ২২,৮৪২, ৭এ)। কোম্পানি পারস্য ব্যবসায় এতই উতসাহী ছিল যে ১৬৮১তে তারা বাংলা থেকে সুরাটের দিকে আট থেকে ১২ হাজার পাউণ্ডের সামগ্রী নিয়ে পাঠাবার পরিকল্পনা করে ফেলেছিল। এবং এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের জন্যে বরাদ্দও করে ১/৮ ভাগ পাবে বাঙলার এজেন্ট, ১/৮ ভাগ পাবে বেয়ার্ড (বাংলায় দ্বিতীয় কুঠিয়াল) ১/১৬ ভাগ পাবে পারস্যে কোম্পানির এজেন্ট(ডিবি, ২৮ ডিসে, ১৬৮১, ৮৯ খণ্ড, ৪৩৬)। এত বিশদে পরিকল্পনা করা সত্ত্বেও আমাদের মনে হয় কোম্পানি বাংলা থেকে নিয়মিত পারস্যে জাহাজ পাঠাতে পারে নি। বাংলা সুরাট ব্যবসার মূল নিয়ন্ত্রণ ছিল কিন্তু সুরাটি ব্যবসায়িদের হাতে। এই ব্যবসার লাভের পণ্য ছিল চিনি, কোরা রেশম আর ক্যালিকো আর ফিরিতি জাহাজে আসত মূলত তুলো, তামাক, আর পারস্য থেকে আসা নানান পণ্য।
কোম্পানি বাংলা থেকে সরাসরি চিন, জাপান, আচিন এবং ইস্ট ইন্ডিজ (দক্ষিণপূর্ব এশিয়া) অন্যান্য অঞ্চলের ব্যবসায় নিজেকে জড়াত না, যদিও কোম্পানির কুঠিয়ালেরা, আমলারা এই সব উচ্চলাভের ব্যবসায় সরাসরি নিজেদের জড়িয়ে রাখত। তবে ১৬৭১ সাল থেকে কোম্পানি জাপান ব্যবসায় প্রবেশ করতে থাকে। সেই বছর জুন মাসে কোম্পানি ৫ হাজার পাউন্ডের কোরা রেশম হয়ে জাপানের উদ্দেশ্যে পাঠানোর জন্যে কোস্টকে পাঠায় (ডিবি, ২৩ জুন ১৬৭১, ৮৭ খণ্ড, ৪৬৪)। পরের বছর মে মাসে কাশিমবাজারের কুঠিয়ালেরা মোটামুটি তৈরি হয়েগিয়েছিলেন জাপানের রেশম ব্যবসায় বিনিয়োগের জন্যে (ফ্যাক্ট্রি রেকর্ডস, হুগলী, ৭ খণ্ড, অংশ ১, ৬৪)। ব্রিটিশরা, ডাচেদের দেখাদেখি উচ্চলাভের জাপান এবং ওইসব অঞ্চলে ব্যবসায় নিজেদের নিয়োজিত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। ১৬৭২ সালে ব্রিটিশ কুঠিয়ালেরা লিখলেন — ডাচেরা স্বীকার করেছে জাপান ব্যবসা এই অঞ্চলের সব থেকে আকর্ষণীয় ব্যবসাগুলির মধ্যে শীর্ষে থাকবে … রেশম ছাড়াও ডাচেরা জাপানে পাঁচটি বিভিন্ন রকমের nilles পাঠায়, আমাদের জানানো হয়েছে যে, যেগুলি সেখানে উচ্চদামে বিক্রি হয়, এবং তারা ফেরার সময় জাপানের সোনা আর তামা বাটাভিয়ায় উচ্চদামে বিক্রি করে (ফ্যাক্ট্রি রেকর্ডস, হুগলী, ৪ খণ্ড, ১১)। (চলবে)