“হায়, বাঙালি! হায়! পেরিয়ে গেল আরেকটি ২৯ আগস্ট। কিন্তু আমরা ঘুমিয়েই থাকলাম। আর বিদ্রোহী কবি যেন ব্রাত্যই থেকে গেলেন।”— আজ থেকে চার বছর আগে খুব আক্ষেপের সঙ্গে এই কথাগুলি লিখেছিলাম। কেন লিখেছিলাম, সে কথাটি প্রথমে বলে নিই। তারপর পাঠকেরাই বিচার করবেন — কথাগুলি আদেও সঠিক কিনা! ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দে (ইং ২৯ আগষ্ট ১৯৭৬) বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু তিনি রেখে গিয়েছেন এক বিপুল সাহিত্য সম্ভার। তাঁর আবির্ভাব বাংলা সাহিত্যকে নতুন আলোর দিকে ধাবিত করেছিল। নজরুলের প্রভাবে বাংলা সাহিত্যের ধারা নতুন খাতে প্রবাহিত হয়েছিল। বাংলা সাহিত্যের বিবর্তনে নজরুলের অবদান তাই অপরিসীম। এহেন নজরুলের প্রতি আমরা বাঙালিরা যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করতে পারলাম কী?
দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়কাল। বিদ্রোহী কবি কৃষ্ণনগরে বসে লিখলেন — “কাণ্ডারী তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর / বাঙ্গালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খনজর।” সেটা ১৯২৬ সাল। সেবছরই কবি তাঁর বিপ্লবী বন্ধু হেমন্তকুমার সরকারের ব্যবস্থাপনায় সপরিবার কৃষ্ণনগরে আসেন। তারপর প্রায় তিন বছর ছিল কবির জীবনের কৃষ্ণনগর পর্ব। প্রথম কয়েক মাস কৃষ্ণনগরের গোলাপট্টি এলাকায় এবং তারপর প্রায় আড়াই বছর গ্রেস কটেজে। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একজন সমাজ সচেতন ও ইতিহাস সচেতন মানুষ। তাঁর রচনায় বারংবার অতীত ঐতিহ্য, ইতিহাসের নানা ঘটনা স্থান পেয়েছে। তাঁর রচনায় বিদ্রোহের সুর ও বাণী শোনা গেছে। সেই বিদ্রোহ ছিল অন্যায়, অত্যাচার, নিপীড়ন, শোষণ ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। একাধারে তিনি কবি, গীতিকার, সুরকার, বাদক, গায়ক, গাল্পিক, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার ও অভিনেতা ছিলেন। তিনি বাংলা ও ইংরাজি ভাষা ছাড়াও আর্বি, ফার্সি, উর্দু, হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষাও রপ্ত করেছিলেন।
বাংলা সাহিত্যে নজরুল ইসলামই রাজনৈতিক ও সামাজিক চেতনামূলক রচনার প্রধান স্রষ্টা (ইসলামীয় বিশ্বকোষ ১৩শ খণ্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, বাংলাদেশ, ১৯৯২, পৃ. ৬১৫)। তিনি ছিলেন সাম্যের কবি, মানবতার কবি, বিপ্লবের কবি এবং সর্বোপরি বাংলার স্বাধীনতার কবি। নজরুলের সাহিত্য সাধনায় তাঁর স্বপ্নের সমাজ গড়ার বাসনা লক্ষণীয়। আর তাই তিনি তাঁর সাহিত্য রচনায় সেই সমাজের অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সঞ্জীবনী হিসেবে কাজে লাগাবার প্রয়াস পেয়েছিলেন।
নজরুল ইসলামের আবির্ভাব এমন এক সময়ে যখন পেশোয়ার থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের হাত থেকে মুক্তিলাভের জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। সত্যি কথা বলতে তখন ব্রিটিশ সূর্য আর মধ্যগগনে ছিল না, অস্তাচলের দিকে ঢলে পড়েছিল। সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতি— সব ক্ষেত্রে পরিবর্তনের আলোক আভা ক্রমশ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এমন এক সময়ে ব্রিটিশ শাসিত বাংলার এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে নজরুল ইসলামের জন্ম হয়। দারিদ্রের কারণে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি। কিন্তু পারিবারিক ও জাতীয় ঐতিহ্য, দেশ-বিদেশে পর্যটন, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগ তাঁকে অত্যন্ত সচেতন করে তোলে। পরাধীনতার গ্লানি তাঁকে সবথেকে বেশি পীড়া দেয়। তাই স্বাধীনতার বাণী নিয়ে তিনি সাহিত্য জগতে আবির্ভূত হন। তিনি জানতেন যে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও তা অর্জন একটি জাতির ইতিহাসের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
আবার চার বছর আগের কথায় ফিরে আসি। ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৬ (ইং ২৬ মে ২০১৯) বিদ্রোহী কবির জন্মজয়ন্তী ছিল। সেবছর আমার মনে হয়েছিল যেন খুবই ম্রিয়মাণভাবে নজরুলকে স্মরণ করা হল। মনে প্রশ্ন জাগে— কতজন বাঙালি ফি-বছর নজরুল স্মরণের সঙ্গে যুক্ত থাকেন? যদিও নিভৃতে কিছু সংস্থা নজরুলকে স্মরণ করে থাকে। কিন্তু সেই সংখ্যাটা নেহাতই কম। প্রশ্ন হল নজরুলের মতো কবির কী এইটুকু সম্মানই প্রাপ্য ছিল? তবে নজরুলকে ধারণ করেই জন্ম নিয়েছে এমন সংস্থাও আমাদের আশেপাশে রয়েছে। এরকমই একটি সংস্থা হল ‘সোনডাঙ্গা নজরুল সংঘ’ (নদিয়া), যাদের জন্ম আজ থেকে প্রায় চুয়াল্লিশ বছর আগে— ১৯৭৯ সালে। প্রতি বছর নজরুলের জন্মজয়ন্তী ও প্রয়াণ দিবসে তারা নজরুলকে বিশেষভাবে স্মরণ করেন।
উল্লেখ্য, বিদ্রোহী কবিকে নিয়মিত স্মরণ করার ক্ষেত্রে নদিয়া জেলার অন্যতম অগ্রগণ্য প্রতিষ্ঠান হল কৃষ্ণনগরের ‘সুজন পাঠাগার ও নজরুল গবেষণা কেন্দ্র’। যাদের ঠিকানা হল কাজী নজরুল ইসলামের কৃষ্ণনগরে বসবাসের (১৯২৬-২৮খ্রি.) স্মৃতিধন্য গ্রেস কটেজ। জীবিতকালে নজরুলকে অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে চলতে হয়েছিল। কিছুদিনের জন্য তাঁর আশ্রয় হয়েছিল নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগর শহর। ঋণগ্রস্থ হতশ্রী নজরুলের পাশে তখন কৃষ্ণনগরের কিছু সুধীজন দাঁড়িয়ে ছিলেন। যাঁদের মধ্যে অবশ্যই অগ্রগণ্য ছিলেন বিপ্লবী হেমন্তকুমার সরকার। এছাড়াও ছিলেন হেমচন্দ্র দত্তগুপ্ত, আকবর উদ্দিনের মতো মানুষ। কৃষ্ণনগর তথা নদিয়া জেলার সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। নজরুল গবেষকদের সমীক্ষার ভিত্তিতে বলা যায় ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের ৩ জানুয়ারি থেকে ১৯২৮ সালের একেবারে শেষ পর্যন্ত কাজী নজরুল ইসলাম কৃষ্ণনগরে ছিলেন।
নজরুল স্মৃতিধন্য কৃষ্ণনগরের ঐতিহ্যমন্ডিত ভবন গ্রেস কটেজে বিগত বছরগুলির ন্যায় এবছরও ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০ (শুক্রবার) সুজন পাঠাগার ও নজরুল গবেষণা কেন্দ্রের আয়োজনে নজরুলজয়ন্তী পালন করার প্রস্তুতি চলছে। ২০২৩ সালের মে মাস— গ্রেস কটেজের দ্বিতীয় পর্যায়ের সংস্কারকার্য প্রায় শেষ বলাই চলে। নজরুল স্মৃতিধন্য এই হেরিটেজ ভবন নতুন রূপে সেজে উঠেছে। কৃষ্ণনগরের সুজন পরিবারও নজরুলকে নিয়ে নতুন উন্মাদনায় মেতে উঠেছে। সংস্কার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কাকতালীয়ভাবে নজরুল জন্মজয়ন্তীও এসে উপস্থিত। ‘সুজন-বাসর’ কর্তৃপক্ষ প্রতিবছরের ন্যায় এবছরও দিনটি বিশেষভাবে উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর এবছর আরেকটি বড় পাওনা গ্রেস কটেজের সংস্কার। গ্রেস কটেজ যেহেতু নতুন রূপে প্রস্তুত, সে কারণে একই দিনে দুটি কর্ম সম্পাদনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০, শুক্রবার (ইং ২৬ মে, ২০২৩) কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মদিবস উদযাপন এবং নবরূপে সজ্জিত কবির বসবাসের স্মৃতিধন্য হেরিটেজ ভবন গ্রেস কটেজের শুভ দ্বারোদ্ঘাটন অনুষ্ঠান হওয়ার কথা। প্রচলিত রীতি মেনে সকাল ন’টায় গ্রেস কটেজ থেকে প্রতীকী পথপরিক্রমা শুরু হবে। গ্রেস কটেজের পার্শ্ববর্তী আমরা সবাই ক্লাব প্রাঙ্গণে স্থাপিত রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মূর্তিতে মাল্য অর্পণ করে গ্রেস কটেজের বাগানে স্থাপিত নজরুল মূর্তিতে মাল্য নিবেদন করা হবে। তারপর হবে গ্রেস কটেজের দ্বারোদ্ঘাটন। নদিয়া জেলা পরিষদের সম্মাননীয়া সভাধিপতি রিক্তা কুণ্ডু গ্রেস কটেজের দ্বারোদ্ঘাটন করবেন বলে স্থির হয়েছে। গ্রেস কটেজের দ্বারোদ্ঘাটনের পর হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এবছর গ্রেস কটেজে নজরুল জয়ন্তীর অনুষ্ঠান দুটি পর্যায়ে ভাঙা হয়েছে। সকালের অনুষ্ঠানের পর আবার বিকেল পাঁচটায় কাজী নজরুল ইসলামের উপর একটি তথ্যচিত্র দেখানো হবে। যেটি নির্মাণ করেছেন মুজিবর রহমান।
সুজন-বাসরের পক্ষ থেকে এই অনুষ্ঠানের জন্য যে বিশেষ আমন্ত্রণপত্রটি করা হয়েছে, সেখানে আমন্ত্রিত সন্মাননীয় অতিথিবৃন্দরা হলেন— পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের সভাপতি আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় (আই.এ.এস.), নদিয়া জেলার অতিরিক্ত জেলাশাসক শ্রীনিবাস ভেঙ্কটরাও পাতিল (আই.এ.এস.), পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের সচিব অম্লানজ্যোতি সাহা, নদিয়া জেলা পরিষদের সচিব সৌমেন দত্ত, কৃষ্ণনগর সদর মহকুমাশাসক চিত্রদীপ সেন, কৃষ্ণনগর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানীর আঞ্চলিক প্রবন্ধক সুকান্ত মণ্ডল, নদিয়া জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান শিবনাথ চৌধুরী, নদিয়া জেলার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট (পর্যটন বিভাগ) শৈলশিখর সরকার, পি.ডব্লিউ.ডি.-র সহকারী ইঞ্জিনিয়ার নেধুরাম বিশ্বাস, চিত্র-নির্মাতা মুজিবর রহমান (কলকাতা) প্রমুখ। এদিনের অনুষ্ঠানে আগ্রহী সকল সুধীজনকে স্বাগত জানাই। সভা পৌরহিত্য করবেন সুজন-বাসরের সভাপতি দীপঙ্কর দাস। সুজন-বাসরের সভাপতি, সম্পাদক ইনাস উদ্দীন, সহ-সম্পাদক রতনকুমার নাথ-সহ সকল সুজনকে আমার প্রণাম। নজরুলকে প্রকৃত অর্থে স্মরণের জন্য গ্রেস কটেজ এবং ‘সুজন বাসর’-এর মতো প্রতিষ্ঠান এখনো রয়েছে। কিন্তু তবুও এই নিবন্ধের পাঠকদের জন্য প্রশ্ন রইল— আমরা কি বিদ্রোহী কবিকে তাঁর প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে পেরেছি?
লেখক: আঞ্চলিক ইতিহাস লেখক, নদিয়া।