রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিশ্বে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর ‘জুলিও-কুরি’ শান্তি পদক প্রাপ্তির সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করছি আমরা। কারণ যুদ্ধের বিশ্বে শান্তির ললিত বাণী মানুষকে আতঙ্ক থেকে রক্ষার জন্য খুব বেশি কাজে লাগতে পারে।যুদ্ধজনিত সংকট থেকে সমগ্র মানবসমাজকে রক্ষার জন্য দেশে দেশে মহাঐক্য তৈরির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধ হচ্ছে।ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে আরেক রাষ্ট্রকে, মানুষের জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে আরেক মানুষকে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সম্মিলিতভাবে আতঙ্ক মোকাবেলার প্রত্যয় ঘোষণা জরুরি হয়ে পড়েছে — যেখানে দুর্দশায় পতিত মানবজাতিকে উদ্ধারের জন্য নিজের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ব্যবহার করা দরকার মনে করছেন সকলেই — এসবই ছিল বঙ্গবন্ধুর মধ্যে। এজন্যই বিশ্ব শান্তি পরিষদ বিশ্বের নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জুলিও-কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করে ‘বিশ্ববন্ধু’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পর বিশ্বশান্তি পরিষদের সর্বোচ্চ পুরস্কার এই জুলিও-কুরি শান্তিপদক। সাম্য-মৈত্রী, গণতন্ত্র রক্ষায় অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ জীবদ্দশাতেই বিশ্ব শান্তি পরিষদের পক্ষ থেকে পাওয়া এই পুরস্কার বঙ্গবন্ধু উৎসর্গ করেছিলেন বাংলাদেশ তথা তৃতীয় বিশ্বের অসহায় মানুষদের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই শান্তি পদক সম্পর্কে বলেছেন — ‘বঙ্গবন্ধুর ‘জুলিও-কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত হওয়া ছিল বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। বাংলাদেশের জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মান।’
দুই.
১০ অক্টোবর ১৯৭২ সালে বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রেসিডেন্সিয়াল কমিটির সভায় পৃথিবীর ১৪০টি দেশের এই পরিষদের ২০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুকে জুলিও-কুরি শান্তি পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। শোষিত ও বঞ্চিত জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তথা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বিশ্বশান্তি পরিষদের সর্বোচ্চ সম্মান ‘জুলিও-কুরি’ পুরস্কারে ভূষিত করা ছিল তৎকালীন বিশ্ব পরিস্থিতিতে অসামান্য একটি ঘটনা। পরের বছর ১৯৭৩ সালের ২৩ মে বিশ্বশান্তি পরিষদের উদ্যোগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশীয় শান্তি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও-কুরি’ পদক প্রদান করেন ওই পরিষদের সেক্রেটারি-জেনারেল রমেশ চন্দ্র। সেসময় এশিয়ান পিস এন্ড সিকিউরিটি কনফারেন্স অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিশ্ব শান্তি পরিষদ ঢাকায় দুই দিনব্যাপী এক সম্মেলনের আয়োজন করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বিশ্ব শান্তি পরিষদের শাখাগুলোর নেতৃবর্গ এই সভায় মিলিত হন। বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও আপসো, পিএলও, এএমসি সোয়াপো ইত্যাদি সংস্থার অনেক প্রতিনিধি সেসময় উপস্থিত হয়েছিল। অনুষ্ঠানে ভারতের ৩৫ জন প্রতিনিধির নেতা কৃষ্ণমেনেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শান্তি আন্দোলনের প্রখ্যাত নেতা জন রিড উপস্থিত ছিলেন। সেদিন ঢাকায় অনুষ্ঠিত ওই এশীয় শান্তি সম্মেলনের ঘোষণায় উপমহাদেশে শান্তি ও প্রগতির শক্তিগুলোর অগ্রগতি নিশ্চিত করে।
অধিবেশনের দ্বিতীয় দিন ২৩ মে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের উত্তর প্লাজায় উন্মুক্ত চত্বরে সুসজ্জিত প্যান্ডেলে বিশ্ব শান্তি পরিষদ আয়োজিত অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের বিশাল সমাবেশে বিশ্ব শান্তি পরিষদের তৎকালীন মহাসচিব রমেশ চন্দ্র বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি শান্তি পদক পরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে।’ এ সম্মান পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এ সম্মান কোন ব্যক্তি বিশেষের জন্য নয়। এ সম্মান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদানকারী শহিদদের, স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানীদের। ‘জুলিও-কুরি’ শান্তিপদক সমগ্র বাঙালি জাতির।’
আগেই বলেছি, বিশ্বশান্তি পরিষদের এ পদক ছিল জাতির পিতার কর্মের স্বীকৃতি এবং বাংলাদেশের জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মান। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত বিশ্ববিখ্যাত ফরাসি বিজ্ঞানী ম্যারি কুরি ও পিয়েরে কুরি দম্পতি বিশ্ব শান্তির সংগ্রামে যে অবদান রেখেছেন, তা স্মরণীয় করে রাখতে ‘বিশ্ব শান্তি পরিষদ’ ১৯৫০ সাল থেকে ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে, মানবতার কল্যাণে, শান্তির সপক্ষে বিশেষ অবদানের জন্য বরণীয় ব্যক্তি ও সংগঠনকে ‘জুলিও-কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করে আসছে। উল্লেখ্য, জঁ ফ্রেদেরিক জুলিও-কুরি (১৯০০-১৯৫৮) এবং স্ত্রী ইরেন জুলিও-কুরি (১৮৯৭-১৯৫৬) অদ্যাবধি সফল বিজ্ঞানী দম্পতি হিসেবে চিহ্নিত। ফিদেল ক্যাস্ট্রো, হো চি মিন, ইয়াসির আরাফাত, সালভেদর আলেন্দে, নেলসন ম্যান্ডেলা, ইন্দিরা গান্ধী, মাদার তেরেসা, কবি ও রাজনীতিবিদ পাবলো নেরুদা, জওহরলাল নেহেরু, মার্টিন লুথার কিং, লিওনিদ ব্রেজনেভ প্রমুখ বিশ্ব নেতারা এই পদকে ভূষিত হয়েছেন। সেসময় ‘জুলিও-কুরি’ শান্তি পুরস্কারের মর্যাদা শান্তিতে নোবেলের চাইতে অনেক বেশি ছিল। অতীতে পুরস্কারপ্রাপ্ত মহান ব্যক্তিদের মতই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশ্বের মুক্তিকামী, নিপীড়িত, মেহনতি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। শান্তি, সাম্য, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। জেল, জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করেছেন। তাঁর অতুলনীয় সাংগঠনিক ক্ষমতা, রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা, মানবিক মূল্যবোধ, ঐন্দ্রজালিক ব্যক্তিত্ব বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ করে। তাঁর নির্দেশে বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়।
তিন.
স্বাধীনতার আগে থেকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধুর দীপ্ত পদচারণা শুরু হয়। স্বৈর শাসক পাকিস্তানি জান্তাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ সারা বিশ্বকে বাংলাদেশের দিকে চোখ ফেরাতে বাধ্য করে। আর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর এদেশকে বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আমাদের স্বাধীনতাকে আন্তর্জাতিক পরিম-লে পরিচিত করে তোলে। একসময় ঢাকার ছিলেন মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড। বঙ্গবন্ধুর অনুরক্ত এই ব্যক্তির ‘দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ’বইয়ে স্মৃতিচারণ রয়েছে। ১৯৭০-এর অক্টোবরে, আর্চার ব্লাডকে বঙ্গবন্ধু তাঁর বিদেশনীতি প্রশ্নে বলেছিলেন, ‘আমি ভারতপন্থী নই, আমেরিকাপন্থী বা চীনপন্থী নই; আমি আমার জনগণপন্থী।’স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করে পররাষ্ট্রনীতির নতুন দিকনির্দেশনা দেন তিনি। ঘোষণা করেন — ‘বাংলাদেশ হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড’। আর এজন্য জাতির পিতা ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বৈরিতা নয়’ এবং ‘সকল বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান’কে পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭২ সালেই বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতি উত্তরণে তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন করেই থেমে থাকেননি। ১৯৭২ থেকে ৭৫ সালের এই সাড়ে তিন বছর, স্বাধীন বাংলার স্বীকৃতি আদায় ও দেশের অর্থনীতি পুনর্গঠনে বিদেশি সহায়তা লাভে, প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে যেতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। আর তৃতীয় বিশ্বের অবিসংবাদিত এক কণ্ঠস্বর ছিলেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুর জীবনী ও বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি, ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রথম মুখপাত্র হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতি একটি স্মরণীয় ঘটনা। সর্বোচ্চ বিশ্ব ফোরামে তিনিই প্রথম উচ্চারণ করেন, বাংলাদেশের নাম। স্বাধীন দেশের অভ্যুদয়ের ফলে গোটা বিশ্বে বঙ্গবন্ধু অর্জন করেছিলেন বিশ্বনেতার সম্মান। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে ভারতীয় সৈন্য ফেরত পাঠিয়ে তিনি প্রতিবেশি ভারতের সাথে ২৫ বছর মেয়াদি মৈত্রী চুক্তি সাক্ষর করেন। অর্থনৈতিক ও মানবসম্পদ উন্নয়নে নয়াদিল্লির সহায়তা চান জাতির পিতা। সোভিয়েত ইউনিয়ন স্বাধীনতা সংগ্রামে জুগিয়েছিল অকুণ্ঠ সমর্থন। বঙ্গবন্ধু সোভিয়েত নেতা ব্রেজনেভের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে সহায়তার জন্য সোভিয়েত জনগণকে ধন্যবাদ জানান। বঙ্গবন্ধু যোগ দেন কমনওয়েলথে। সেখানে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে শান্তি-সৌহার্দ্য নিয়ে মতবিনিময় করেন। সৌদি বাদশাহ ফয়সালের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন তিনি। রিয়াদের পক্ষ থেকে সদ্য স্বাধীন দেশটির জন্য সম্ভাব্য সহায়তার আশ্বাস দেয়া হয়। আলজেরিয়ায় জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন, মানবতার বিরুদ্ধে ঘৃণ্যতম লড়াইয়ে বাংলাদেশের কণ্ঠ সবসময়ই সোচ্চার থাকবে। তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর আত্মনির্ভরতা এবং অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সেই জোটকে কার্যকর করতে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। সেসময় জোট নিরপেক্ষ নেতা যুগস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোর সঙ্গে মতবিনিময় করেন তিনি। মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, বঙ্গবন্ধুকে মানবতার অন্যতম পথিকৃত হিসেবে অভিহিত করেন। কিউবা বিপ্লবের জনক ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন বঙ্গবন্ধু। ফিদেল বলেছিলেন, আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। উন্নয়নশীল দেশগুলোকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার প্রস্তাবে সায় দেন ফিদেল। লিবিয় নেতা মুয়াম্মার আল গাদ্দাফিও সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রনেতার সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ দেখান। তৎকালীন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আসাদের সঙ্গে, পারস্পারিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট আদম মালিকের সঙ্গেও বঙ্গবন্ধুর আন্তরিক আলোচনা হয়। ১৯৭৩ সালের ১৭ অক্টোবর, প্রথম জাপান সফরে যান বঙ্গবন্ধু। টোকিওতে প্রথম সফরেই যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণে জাপানের সহায়তা চান জাতির পিতা।
চার.
বাংলাদেশ সংবিধানের ২৫নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু গৃহীত পররাষ্ট্রনীতিসমূহ যা তাঁকে শান্তির দিশারি হিসেবে গণ্য করে দেয়। যেমন — জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অপর রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা — এ সকল নীতিই রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি। বাংলাদেশ রাষ্ট্র সর্বদা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তিপ্রয়োগ থেকে বিরত থাকা এবং সাধারণ ও পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য চেষ্টা করবে; প্রত্যেক জাতির স্বাধীন অভিপ্রায় অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করবে; এবং সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন করবে। সংবিধানের ৬৩ অনুচ্ছেদে যুদ্ধ ঘোষণা সংক্রান্ত নীতি উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে সংসদের সম্মতি ব্যতীত যুদ্ধ ঘোষণা করা যাবে না, কিংবা প্রজাতন্ত্র কোনো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে না।
সংবিধানে উপস্থাপিত বৈদেশিকনীতির বিধি মেনেই বঙ্গবন্ধু তাঁর রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগদান করেন তিনি। ওই সফরে বঙ্গবন্ধু অনেকগুলো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তাছাড়া ওই সম্মেলনেই ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত পৃথিবী গড়তে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। সম্মেলন শেষে ঘোষণাপত্রে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলো তাদের সমর্থন দেয়। আলজিয়ার্সের জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান এবং এশিয়া, আফ্রিকা ও আরব দেশের নেতাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তি পর্যায়ে বৈঠক ও আলাপ-আলোচনার ফলে এক দিনে প্রায় ১৬টি আরব ও আফ্রিকান দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ওই সম্মেলনে ৮ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু বলেন — ‘আমি শুরুতেই জাতীয়তাবাদী মুক্তি আন্দোলনে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের যেসব গণমানুষ শহীদ হয়েছে তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম আজও অব্যাহত ভিয়েতনাম, অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক, নামিবিয়া, গিনি বিসাউসহ লাতিন আমেরিকা ও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। তাই একটি বৈষম্যহীন পৃথিবী গড়তে আমাদের সবাইকে এক হয়ে শোষিতের পক্ষে দাঁড়াতে হবে।’ পরদিন ৯ সেপ্টেম্বর বিদায়ী ভাষণেও বঙ্গবন্ধু বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা ও পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন — ‘উপমহাদেশকে শান্তিপূর্ণ রাখতে হলে, যে কোনো সমস্যার মানবিক সমাধান খুঁজতে হবে। একটি সমৃদ্ধ বিশ্বের জন্য আমাদের পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের ওপর জোর দিতে হবে। আমি আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাই এখানে এক হওয়ার জন্য। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সদস্য দেশগুলোর পরস্পরের প্রতি সহযোগিতার প্রত্যয় দেশগুলোর সামাজিক সমৃদ্ধি আনতে পারে।’
অন্যদিকে পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মুসলিম দেশগুলোর জোট ওআইসির সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন এবং বাংলাদেশকে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্য করতে পিছু হটেননি বঙ্গবন্ধু। তিনি লাহোরে গিয়ে ওআইসি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন পাকিস্তানের প্রতি বিদ্বেষশূন্য মন নিয়ে কিন্তু নির্ভীকভাবে। সেখানে তিনি বলেছিলেন — ‘আমি বলতে চাই, সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায় উন্মোচিত হয়েছে। আমরা এই উপমহাদেশে এবং বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে যুগপৎ অবদান রাখার পথ উন্মুক্ত করেছি।’
১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু বিশ্বের অধিকারহারা শোষিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মূল্যবান ভাষণ দেন। ভাষণটি ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি বলিষ্ঠ উচ্চারণ ও সাহসী পদক্ষেপের স্তম্ভ। ১৯৭৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সর্বসম্মত অনুমোদনক্রমে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। এর কয়েক দিন পর ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে প্রথমবারের মতো বক্তৃতা করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও শান্তি স্থাপনে বঙ্গবন্ধুর অভিমতসমূহের কিছু অংশ নিম্নরূপ —
ক) ‘বাংলাদেশ প্রথম হইতেই শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান ও সকলের প্রতি বন্ধুত্ব — এই নীতিমালার উপর ভিত্তি করিয়া জোটনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করিয়াছে। কেবলমাত্র শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই কষ্টলব্ধ জাতীয় স্বাধীনতার ফল ভোগ করিতে আমাদেরকে সক্ষম করিয়া তুলিবে এবং সক্ষম করিয়া তুলিবে দারিদ্র্য, ক্ষুধা, রোগ, অশিক্ষা ও বেকারের বিরুদ্ধে লড়াই করিবার জন্য আমাদের সকল শক্তি ও সম্পদকে সমাবেশ ও কেন্দ্রীভূত করিতে। এই ধারণা হইতে জন্ম নিয়াছে শান্তির প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতি। এই জন্য সমঝোতার অগ্রগতি, উত্তেজনা প্রশমন, অস্ত্র সীমিতকরণ এবং শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান নীতির সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা — বিশ্বের যে কোন অংশে যে কোন প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হউক না কেন, আমরা তাহাকে স্বাগত জানাই। এই নীতির প্রতি অবিচল থাকিয়া আমরা ভারত মহাসাগরীয় এলাকা সম্পর্কে শান্তি এলাকার ধারণা, যাহা এই পরিষদ অনুমোদন করিয়াছে, তাহাকে সমর্থন করি। আমরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে শান্তি, স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ এলাকায় পরিণত করার প্রতিও সমর্থন জানাই।’
খ) ‘বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদের অঙ্গীকার প্রমাণের জন্য উপমহাদেশে আপস-মীমাংসার পদ্ধতিকে আমরা জোরদার করিয়াছি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশের অভ্যুদয় বস্তুতপক্ষে এই উপমহাদেশে শান্তি কাঠামো এবং স্থায়িত্ব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অবদান সৃষ্টি করিবে। ইহাছাড়া আমাদের জনগণের মঙ্গলের স্বার্থেই অতীতের সংঘর্ষ ও বিরোধিতার পরিবর্তে মৈত্রী ও সহযোগিতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে।’
গ) ‘শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং অন্যের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রতিবেশী সকল দেশের সাথে সৎপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক বজায় রাখিবে। আমাদের অঞ্চলে এবং বিশ্বশান্তির অন্বেষার সকল উদ্যোগের প্রতি আমাদের সমর্থন অব্যাহত থাকিবে।’
পাঁচ.
বঙ্গবন্ধুকে কেন ‘জুলিও-কুরি’ শান্তি পুরস্কার প্রদান করা হয়েছিল তার ব্যাখ্যা দেবার জন্য উপরের বিবরণ প্রয়োজন ছিল। কারণ এই শান্তি পদক এক অসামান্য কীর্তির স্মারক, মর্যাদা ও বিশ্ব শান্তির প্রতীক। মূলত বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ছিল জোট-নিরপেক্ষ নীতি এবং শান্তি ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ। তিনি বলেছিলেন — ‘পৃথিবীর বৃহত্তম শক্তি যে অর্থ ব্যয় করে মানুষ মারার অস্ত্র তৈরি করছে, সেই অর্থ গরিব দেশগুলোকে সাহায্য দিলে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে।’ বঙ্গবন্ধু ছিলেন আফ্রো-এশিয়া-ল্যাটিন আমেরিকার মুক্তিকামী মানুষের মহান নেতা এবং গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও শান্তি আন্দোলনের পুরোধা। ১৯৭১-এর পর গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে একটি নতুন দর্শন প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের পাশাপাশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংঘাতময় পরিস্থিতির অবসানে তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পৃথিবীব্যাপী হত্যাযজ্ঞের অভিজ্ঞতা থেকে প্রবর্তিত এই ‘জুলিও-কুরি’ পদক শান্তি প্রতিষ্ঠায় উৎসর্গিত হয়েছিল; পারমাণবিক বোমা আর মারণাস্ত্রের মহড়া থেকে রাষ্ট্রগুলোকে দূরে রাখার জন্যও। যারা পুরস্কৃত হয়েছিলেন তারা কেউ-ই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর তাবেদার ছিলেন না। হিংস্র কিংবা আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাষ্ট্রকে পরিচালিত করেননি ওই ব্যক্তিবর্গ। বরং আজীবন তাঁরা মানবিক বিশ্ব গড়ার চেষ্টা চালিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর ‘জুলিও-কুরি’ শান্তি পদকপ্রাপ্তির সুবর্ণ জয়ন্তীর এই দিন স্মরণের মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মকে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক এবং প্রগতিশীল আদর্শের শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। বিশ্ব শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় জাতির পিতার অবদানকে সামলে আনলে যে কোনো সংকট মোকাবেলায় ভবিষ্যতেও আমরা সক্ষম হবো। শেখ হাসিনা সরকার বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় সবসময় জাতির পিতার নীতি ও আদর্শকে অনুসরণ করছে- শান্তির জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু গবেষক, বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম এবং অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email-writermiltonbiswas@gmail.com