তিনি হলেন সকলের চাচা। আসল নাম জানা যায় না। তাই চাচা ফকির নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। নদিয়া জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম পাথরঘাটার পরিচিতি চাচা ফকিরের নামেই। সদ্য পাথরঘাটায় সেই চাচা ফকিরের মেলা হয়ে গেল। প্রতিবছর ফাল্গুন মাসের সূচনায় চাচা ফকিরের মেলাকে ঘিরে নদিয়ার সীমান্তবর্তী পাথরঘাটা গ্রাম যেন মেতে ওঠে। এই মেলা ঘিরে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল মানুষের উৎসাহ থাকে চোখে পড়ার মতো। হবে নাই বা কেন? নিকটবর্তী এলাকার মধ্যে চাচা ফকিরের মেলা হলো একটি অন্যতম বড় মেলা। আর চাচা ফকিরের দরগা এলাকার মানুষের কাছে তো বটেই, বাইরের অনেক পর্যটকদের কাছেও খুবই জনপ্রিয়। চাচা ফকিরের মেলা দেখতে তাই প্রতিবছর দূরদূরান্ত থেকে বহু মানুষ সীমান্তবর্তী এই পাথরঘাটা গ্রামে ভিড় করেন। চাচা ফকিরের ভক্তরাও অধীর আগ্রহে প্রতিবছর ফাল্গুন মাসের অপেক্ষায় থাকে।
চাচা ফকিরের দরগা থেকেই সীমান্তের কাঁটাতার দেখতে পাওয়া যায়। সন্ধ্যা নামলে সীমান্তে সারিবদ্ধ ভাবে দণ্ডায়মান ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলো দৃশ্যমান হয়। কাঁটাতার পেরোলেই বাংলাদেশ। সম্পূর্ণ এক ভিন্ন রাষ্ট্র। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে নদিয়ার পাথরঘাটা গ্রামে চাচা ফকিরের দরগার তাই অবস্থানগত একটি গুরুত্ব রয়েছে। দরগার গা ঘেঁষে বর্ডার রোড চলে গিয়েছে। দরগায় সীমান্তরক্ষীদের আনাগোনা লেগেই রয়েছে। চাচা ফকিরের এই দরগাকে ঘিরে বহু কিংবদন্তি রয়েছে। সীমান্তরক্ষীরাও সেখানে একটি প্রধান চরিত্র। চাচা ফকিরের এই দরগার পাশেই রয়েছে সরস্বতী খাল। সেই খালের উপর দিয়ে নাকি মাঝে মধ্যে সাদা পোশাক পরিহিত একজনকে হেঁটে চলে যেতে দেখেছেন সীমান্তরক্ষীরা। গ্রামের মানুষ এবং সীমান্তরক্ষীদের অনুমান তিনিই হলেন চাচা ফকির। রাত্রিতে তিনি নাকি এই এলাকা পাহারা দেন। প্রচলিত মতে চাচা ফকিরের এমনই মাহাত্ম্য যে, কাক-পক্ষী, কুকুর-শেয়ালেও তার দরগা সংলগ্ন এলাকায় কুকর্ম করে না।
আগে প্রতিবছর ফাল্গুন মাসে ওপার বাংলা এবং এপার বাংলার মানুষেরা চাচা ফকিরের দরগায় বাৎসরিক অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে একত্রিত হতে পারতেন। স্বাধীনতার পরেও বহুকাল এমনটি হয়েছে। কারণ দীর্ঘদিন সীমান্তের এই অংশে কাঁটাতার ছিল না। কিন্তু এখন সেখানে কাঁটাতার বসানো হয়েছে। যদিও এই কাঁটাতার চাচা ফকিরের মাহাত্ম্যকে নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পারেনি। সীমান্তের ওপারে চাচা ফকিরের বহু ভক্ত এখনো রয়েছে। দেশের সীমানা অতিক্রম করে, সাম্প্রদায়িক বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে চাচা ফকিরের অনুগামীর সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েছে।
১৯৪৭-এর আগে ওপার বাংলার চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও কুষ্টিয়া অবিভক্ত নদিয়া জেলারই অন্তর্গত ছিল, এখন যা অতীত। দেশ আলাদা হয়েছে, কিন্তু চাচা ফকিরকে নিয়ে মানুষের আবেগ একই রয়েছে। চাচা ফকিরের এমনই মহিমা যে, হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ চাচা ফকিরের ভক্ত। বছরভর প্রতি বৃহস্পতিবার চাচা ফকিরের দরগায় হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মানুষেরা হাজত দিতে আসেন। কেউ চাচা ফকিরকে প্রণাম করে পুজো দেন, কেউ বা করেন সেলাম। তিনি তো সকলের চাচা। তার কাছে সবাই সমান। কৃষিপ্রধান পাথরঘাটা গ্রামে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের বসবাস রয়েছে। উভয় সম্প্রদায়ের মানুষেরা যৌথভাবে চাচা ফকিরের দরগা দেখভাল করেন। চাচা ফকিরের দরগাটি একেবারে সীমান্ত এলাকায় হওয়ায় সন্ধ্যা ছয়টার পর সেখানে সাধারণ মানুষের থাকার অনুমতি নেই। শুধুমাত্র ব্যতিক্রম ঘটে ফাগুন মাসের দুই, তিন ও চার তারিখে, চাচা ফকিরের দরগায় বাৎসরিক অনুষ্ঠানের সময়। সেই কটি দিন রাত পর্যন্ত মানুষ চাচা ফকিরের মেলায় আনন্দ উপভোগ করতে পারেন। চাচা ফকিরের মেলার জন্য এই স্পেশাল পারমিশন দেওয়া হয়। পাথরঘাটা গ্রামের বহু কৃষককে প্রতিদিন কাঁটাতার পেরিয়ে দুই দেশের সীমান্তের মধ্যবর্তী নো ম্যান্স ল্যান্ডে গিয়ে চাষ করতে হয়, আবার সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে এপারে ফিরে আসতে হয়। এমন ভাবেই পাথরঘাটার মানুষদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। সেখানে তিনদিনের চাচা ফকিরের মেলা যেন মরুদ্দ্যান স্বরূপ।
পাথরঘাটার জনগণ মিলিত হয়ে কয়েক বছর আগে ‘চাচা ফকির স্মৃতিরক্ষা কমিটি’ গড়ে তুলেছেন। সেখানে হিন্দু- মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা রয়েছেন। এই কমিটি চাচা ফকিরের দরগা দেখভাল করে এবং প্রতি বছর ফাগুন মাসে তিনদিন ধরে মেলার আয়োজন করে। সেখানে বাউল, ফকিরি গানের আসর বসে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য নজির সৃষ্টি করেছে পাথরঘাটার চাচা ফকিরের দরগা। এমনকি সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনীর বহু সৈনিকও চাচা ফকিরের ভক্তে পরিণত হয়েছে।
আজ যেখানে ভারতের অনেক জায়গায় সাম্প্রদায়িক হিংসার চূড়ান্ত নিদর্শন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে নদিয়া জেলার সীমান্তবর্তী একটি ছোট গ্রাম পাথরঘাটায় চাচা ফকিরের দরগাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য নজির সৃষ্টি হয়েছে। এই গ্রাম দেখিয়ে দিয়েছে যে, কিভাবে সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে কোনও উৎসবে যৌথভাবে শামিল হওয়া যায়। এর থেকে অনেক কিছু শিক্ষনীয় রয়েছে। ভিন্ন ধর্মের মানুষের প্রতি অসহিষ্ণুতা দেখানো কি কোনও শিক্ষিত, নৈতিক ভাবে চলা মানুষের কাজ? ইতিহাস বলছে বিভিন্ন যুগে কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ এধরনের কুকর্মের সাথে জড়িত হয়েছেন এবং সমগ্র জাতিকে তার খেসারত দিতে হয়েছে। বর্তমান সমাজেও সেই প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সচেতন নাগরিকদের সেই প্রবণতা দমনে সোচ্চার হতে হবে। আমি মনে করি সাম্প্রদায়িক বিভিন্নতার মনোভাব এক মানসিক ব্যাধি। যারা মানুষে মানুষে ধর্মীয় বিভাজনকে প্রকট করে দেখেন, তারা যেমন আত্মকেন্দ্রিক তেমনি রোগগ্রস্তও বটে। ভারতের এক প্রান্তিক গ্রাম পাথরঘাটার মানুষ যদি সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামির উর্ধ্বে উঠে চাচা ফকিরের দরগাকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখতে পারে, আমরা তবে কেন তা পারবে না? এই উত্তরটা আমাদের সকলকেই খুঁজতে হবে।
লেখক: আঞ্চলিক ইতিহাস লেখক, নদিয়া।
স্যার সত্যিই আপনার লেখাটা অসাধারণ লাগলো।
ধন্যবাদ তোমায়। ভালো থেকো।
তোমার লেখা পড়ে এক অজানা বিষয় জানতে পারলাম। লেখাটিও খুব ভাল হয়েছে।
অনেক ধন্যবাদ ম্যাডাম। আপনার ভালো লেগেছে এ আমার পরম প্রাপ্তি।
নতুন কিছু জানতে পারলাম। ভালো লাগলো। লেখার গুণে আরও সুন্দর লাগল।