এ আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি, একটি প্রেমের প্রতি।
ধামদাহা-হাটের ‘চকাচকী’। চকাচকী নামটি আমারই দেওয়া—যদিও সে নাম পরে জেলাসুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রথম দর্শনেই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল কথাটি। ঠাট্টা করে নয়; ভালবেসে। হয়তো একটু ঈর্ষাও মেশানো ছিল ঐ নামকরণের সঙ্গে। অদ্ভুত অবস্থায়, তাদের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ।
আমার সহকর্মী কানা মুসাফিরলালের সঙ্গে তখন আমি গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াই রাজনীতিক কাজের সূত্রে। মুসাফিরলালই আমাকে নিয়ে গিয়েছিল ধামদাহাহাটের দুবে-দুবেনীর কুটিরে। তখন সেখানে ঘোড়ার দড়ি নিয়ে, হাসি চেঁচামেচির মধ্যে, পুরোদমে টাগ-অব-ওয়র খেলা চলছে। দড়ির একদিকে দুবেজী, অন্যদিকে দুবেনী আর অবাধ্য ঘোড়াটি। হেঁইও জোয়ান! —বলেই দুবেজী হঠাৎ দড়ি ছেড়ে দিল। দুবেনী একেবারে চিৎপাত। তবু হাসি থামে না।
দুবেজী নির্দোষিতার ভান করে। —‘জানোয়ারেরা সুদ্ধ তোর দিকে, তোর সঙ্গে কি আমি পারি। তাই হার মেনে ছেড়ে দিলাম।…
‘দাঁড়াও না! তোমার জানোয়ারগিরি বার করছি!
এর জের আরও চলত কিনা জানি না। আমরা গিয়ে পড়ায় তখনকার মতো বন্ধ হয়ে গেল। ছারপোকাভরা দড়ির খাটিয়াটি, আমাদের জন্য বার করতে ছোটে তারা দুজনে।…
দুবেনীর বয়স তখনই বছর ষাটেক। তবু কী সুন্দর দেবীপ্রতিমার মতো চেহারা! যেমন রূপ, তেমনি, গায়ের রঙ।…আর কী আপন করে নেওয়া ব্যবহার! আমার সবচেয়ে অবাক লেগেছিল বিয়ের পঞ্চাশ বছর পরও এই দম্পতি, বিয়ের সময়ের মনের উপছে-পড়া ভাব বজায় রেখেছে দেখে।
তাই নাম দিয়েছিলাম চকাচকী।
বিশ্বনিন্দুক মুসাফিরলালের পছন্দ হয়নি নামটি। কুটিলতায় ভরা তার ভাল চোখটি একটু টিপে, ঠোঁটের কোণে একটা ইঙ্গিতের ছাপ ফুটিয়ে তুলে সে বলেছিল, ‘চকাচকী না বলে, চড়ুই-চড়ুইনী বলুন এদের। তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে বুড়ির, এখনও কী ঠমক! ছেঁদো কথার কী বাঁধুনি। দেখেন না নেচে চলে! ফুড়ুৎ-ফুড়ুৎ করে উড়ে বেড়াতে চায় চড়ুইপাখির মতো! এ গাঁয়ের বুড়োদের কাছ থেকে শোনা যে একটা লোটা আর এই দুবেনীকে সম্বল করে চল্লিশ বছর আগে, দুবেজী যখন এখানে প্রথম এসেছিল রোজগারের ধান্দায়, তখন এই হাটের মালিক বিনা সেলামীতে বাজারের মধ্যে ঘর তুলবার জন্য জমি দিয়েছিল—শুধু দুবেনীর কোমরের লচক দেখে। সে বয়সে দুবেনী…’
মুসাফিরলালকে থামিয়ে দিই। জানি তো তাকে। দুবেনীর সম্বন্ধে ও সুরে কথা বলা আমার খারাপ লাগছিল। সব জিনিসে সে খারাপের গন্ধ পায়!…
এর পর কতবার যে তাদের বাড়িতে গিয়েছি তার ঠিক নেই। না গিয়ে কি নিস্তার ছিল? ওদিকে গিয়েও তাদের বাড়িতে যাইনি জানতে পারলে চকাচকী দুঃখিত হত। শুধু আমি নই, এ অঞ্চলের প্রত্যেক রাজনীতিক কর্মীর বেলায়ই ঐ এক নিয়ম। দল-নিরপেক্ষভাবে। তার কুঁড়েতে যা জুটবে চারটি না খেলে রক্ষা নেই। না-খাওয়ার রকম-সকম দেখলে, অতিথির কাপড়-গামছার ঝুলিটি ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে গিয়ে দুবেনী রাখবে রান্নাঘরে। যদি কোনোদিন বলেছি, অমুক গ্রাম থেকে এখনই খেয়ে আসছি-আজ আর খাব না, অমনি দুবেজী অভিমান করে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে থাকবে। কিন্তু দুবেনী চুপ করে থাকবার পাত্রী নয়। বেতো টাট্টু ঘোড়াটার পিঠ থেকে চটের বোরাটা সে নেয় বা হাতে; আর ডান হাত দিয়ে আমাকে ধরে টানতে টানতে উঠোনের মধ্যে নিয়ে গিয়ে হুকুম করে, ‘বোসো এই বোরাটার উপর। বসে বসে দেখো, আমি কেমন করে রুটি সেঁকি’। তারপর দুবেজীকে লক্ষ্য করে বলে, ‘মরদ দেখো! মান করে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে রইলেন! থাকো! সবাই কি আর দুবেনী, যে তোমার মানের কদর দেবে!’
কতক্ষণ আর কথা না বলে থাকে দুবেজী। রাঁধবার সময় মেলা বকিস না, বুঝলি! মুখের থুতু ছিটকে অতিথের রুটির উপর পড়বে।’
‘থামো থামো! অত আর থুতু ছিটকোয় না! এ কি তোমাদের মতো খয়নিগোঁজা মুখ, যে কথা বললে থুতুর ভয়ে বাঘ পালাবে। বুঝলে বাবুজী, আমি এক-এক সময় বুড়োকে বলি যে, আমার সুমুখে বসে বাজে বকবক না করে যদি সে হাটের মালিকের তরকারি ক্ষেতে বসে আকাশের সঙ্গে কথা বলে তাহলে শাকসবজির পোকামাকড় দু-চারটে মরে তামাক-গোলা থুতুতে। তা কি শুনবে। যত গল্প ওর আমারই কাছে।’
নিজেরা না খেয়ে আমাদের খাওয়াতে দেখে একদিন আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেন তারা এত কষ্ট স্বীকার করে আমাদের জন্য?
জবাব দিয়েছিল—আপনাদের সেবা করলে রামজী খুশী হবেন। তাকে খুশী করতে না পারলে আমাদের পাপ খন্ডন হবে কী করে?
এমন সরল নিষ্পাপ পাপের ভয়ে আকুল! তাই রাজনীতি নিয়ে মাথা না ঘামিয়েও রাজনীতিক কর্মীদের জন্য নিজেদের যথাসর্বস্ব খরচ করে দেয়! শুনে আমার আশ্চর্য লেগেছিল।
কিন্তু বিস্ময়ের অবধি রইল না, যখন চকাচকী জেলে যাবার হুজুগ তুলল। তখন একটি রাজনীতিক আন্দোলনে জেলে যাবার হিড়িক উঠেছে দেশে। ঠাট্টা করে তাদের বলি, ‘ভেবেছ যে জেলে গিয়েও তোমরা একসঙ্গে থাকবে? সে গুড়ে বালি। দুবেনীকে যে পাঠিয়ে দেবে মতিহারীর মেয়েদের জেলে’!
‘রামজীর মনে যা আছে, তা তো হবেই।’-একগাল হেসে জবাব দিয়েছিল দুবেজী।
রামজীর মনে কী ছিল তিনিই জানেন; হিসাব গুলিয়ে দিল থানার দারোগা। দুবেনীকে যথাসময়ে পুলিশ জেলে ধরে নিয়ে গেল; কিন্তু বাহাত্তুরে বুড়ো বলে দুবেকে গ্রেপ্তার করতে বারণ করলেন দারোগাসাহেব। সে পরিচিত প্রত্যেকের দুয়োরে গিয়ে মাথা কোটে, দারোগাসাহেবের কাছে একটু তদবির করে, তাকে গ্রেপ্তার করিয়ে দেবার জন্য।
কিছুতেই কিছু হল না।
দিনকয়েক পর দেখা গেল দুবেনী গভর্ণমেন্টের কাছে মাফ চেয়ে মুচলেকা লিখে দিয়ে বেরিয়ে এসেছে।
এ নিয়ে একেবারে ঢিঢিক্কার পড়ে গেল। চড়ুইনীর বেহায়াপনায় সবচেয়ে মর্মাহত হল কানা মুসাফিরলাল। তার বিশ্বাস দুবেনী দুবেজীকে ছেড়ে না থাকতে পেরেই বেরিয়ে এসেছে। —এই পঁয়ষট্টি বছর বয়সেও?
দুবেনী কারও ঠাট্টা-বিদ্রুপের একটি কথারও জবাব দেয়নি। শুধু তার দৈনিক রামজীর পূজো আগের চেয়ে ঘণ্টা দুয়েক বাড়িয়ে দিয়েছিল। আর দুবেজী ছেড়ে দিল লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা।
আমার সঙ্গে দুবেজীর অন্তরঙ্গতা ছিল সবচেয়ে বেশি। ‘নিমিখে মানয়ে যুগ, কোরে দূর মানি’—বাঙালী কবির এই পদটির মানে তাকে বুঝিয়ে হেসে জিজ্ঞাসা করি, ‘দুবেনীরও কি তাই?
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সে পালটা প্রশ্ন করে —‘রামজীরও কি সীতাজীর জন্য এমনি হত নাকি’?
‘সে কথা তো বলতে পারি না। তবে শ্রীকৃষ্ণের হত রাধিকার জন্য।
‘আরে কিষুণজী-ভগবানও যা, রামজীও তাই।’
আমি নাছোড়বান্দা! আবারও জিজ্ঞাসা করলাম-জেলে এঁটোকাঁটার বাছবিচার নেই বলেই কি দুবেনী থাকতে পারল না সেখানে?’
এত অপ্রতিভ দুবেজীকে এর আগে কখনও হতে দেখিনি। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে কাঁচুমাচু মুখে উত্তর দেয়-‘আপনার কাছে বলেই বলছি আসল কথাটা। জেলে গেলে পাপ-মোচন হয় রামজীর চোখে। সেই জন্যই আমাদের জেলে যাবার এত আকাক্ষা।
দুবেনী বলে যে, জেলে গিয়ে পাপ খণ্ডন করতে হত আমাদের দুজনকেই; কিন্তু তোমার কপালে যে রামজী তা লেখেননি। আমাদের জীবন যখন একসঙ্গে গাঁথা, তখন আমার একার পাপ-মোচনের চেষ্টায় কী হবে? তাই দুবেনী মাপ চেয়ে বেরিয়ে এসেছে।
দুবেজীর চোখ ছলছল করছে! হতাশার ছাপ চোখেমুখে সুস্পষ্ট! যেন একেবারে ভেঙে পড়েছে। গলার স্বর অন্য রকম হয়ে গিয়েছে। — রামচন্দ্রজী যে কিছুতেই তাদের দোষ ক্ষমা করবেন না!
তাদের মনের এক অজ্ঞাত দুয়ার খুলে গেল আমার কাছে। পূণ্য সঞ্চয়ের ইচ্ছা নেই অথচ রামচন্দ্রজীকে খুশী করে পাপমুক্তির আকাঙ্ক্ষা প্রবল। —আবার পাপমোচনের অনুষ্ঠানটি হওয়া চাই দুজনের একসঙ্গে; একার চেষ্টা নিষ্ফল হবে! অদ্ভুত! আমাদের জটিল মন দিয়ে স্পষ্ট বোঝা যায় না তাদের সরল মনের যুক্তির ধারা। তবে তার বৈশিষ্ট্য স্বীকার না করে উপায় নেই।
দুবেজীর মনমরা ভাব দিন দিনই বেড়ে চলে এর পর থেকে। বয়সের জন্য শরীর ভেঙে পড়তে আরম্ভ করেছিল আগে থেকেই। এখন যেন আরও তাড়াতাড়ি খারাপ হতে লাগল। রোজগারের কাজে কোনোদিনই বিশেষ মন ছিল না। তার পেটচালানোর জন্য যেটুকুনি ছাড়া। বেতো টাট্টু ঘোড়াটার পিঠে চড়ে কাছাকাছি গ্রামের চাষাদের কাছ থেকে ভ্যারেণ্ডার বিচি, ছোলা, তামাক, সরষে কিনে এনে হাটের গোলাদারের কাছে বিক্রি করা, এই ছিল তার এতকাল পেশা। এখন সে বাড়ি থেকে বার হওয়া বন্ধ করে দেয়। গোলাদারকে বলে দিল যে, এই বয়সে ঘোড়ায় চড়ে বেরুনো আমার সামর্থ্যে কুলোয় না। গোলাদার জিজ্ঞাসা করে-“তবে খাবে কী?’
দুবেজী উত্তর দেয় না। নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে দূরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
মুশকিল হল দুবেনীরই। দুটি পেটের অন্ন যোগানো সোজা নয়। সে দূর গ্রাম থেকে মধ্যে মধ্যে ছুটে ছুটে আসে, আমাদের কাছে দু-চারটে টাকার জন্য। আমরা সাধ্যমতো দিই। যখন নিজেদের সাধ্যে কুলোয় না, তখন চকচকীর জন্য অন্য লোকের কাছেও হাত পাতি। আমাদের জন্য তারা অনেক করেছে এক সময়ে, তাদের অসময়ে একটুও করব না?’
কিন্তু এ মনের ভাব বেশিদিন রাখা গেল না- তাদের উপর আন্তরিক কৃতজ্ঞতা সত্ত্বেও। পরের জন্য লোকের কাছে হাত পাততে কতদিন আর ভাল লাগে। কিছুদিন পর এমন হল যে, দুবেনীকে দূর থেকে দেখলেই আমরা পাশ কাটাবার চেষ্টা করি। কানা মুসাফিরলাল একদিন বলেই ফেলল তাকে— ‘এখানে কি টাকার গাছ আছে? আমরা নিজেরাই বলে চেয়েচিন্তে কোনোরকমে কাজ চালাই-তোমাদের দেশ কোন্ জেলায়? কখন বলো বালিয়া, কখন বলো সারন, কখনও বলল ভোজপুর! কিছু বুঝেও তো পাই না। নিজেদের দেশে চিঠি লেখ না কেন টাকার জন্য? তিনকুলে কেউ নেই, এমন লোকও হয় নাকি পৃথিবীতে?’
দুবেনী শুনেও শোনে না মুসাফিরলালের কথা। আমাকে বলে— ‘আপনাদের দুবেজী কী মানুষ ছিল, কী হয়ে গিয়েছে। আমার কথারও জবাব দেয় না আজ ক’দিন থেকে। কী সব বিড়বিড় করে বকে। মাঝে মাঝে টিনের চালের উপর উঠে বসে থাকে হাতুড়ি পেরেক নিয়ে। বলে, বর্ষা আসছে। চাল মেরামত করছি।’
দুবের চেয়ে দুবেনীর কথাই আমার বেশি মনে হয়, তার বিষাদে ভরা মুখখানি দেখে।
তাকানো আর যায় না সেদিকে! বাহাত্তুরে-ধরা বুড়োর জন্য দুটো টাকা দিয়ে তখনকার মতো নিষ্কৃতি পাই।
তারপর মাসখানেক আর দেখা নেই দুবেনীর। টাকা নিতে আসে না দেখে অস্বস্তিই লাগে। প্রত্যাশিত বিপদ না ঘটতে দেখলে হয় না একরকম। মুসাফিরলাল সন্দেহ করল যে, হাটের বুড়ো জমিদারবাবু নিশ্চয়ই টাকা দিচ্ছে ওকে— পুরনো দিনের কথা মনে করে। ভাল চোখটি কৌতুকে ভরা। তোমরা শুধু দেশ দেশ করেই মরলে-আশপাশে দুনিয়ার পুরনো ইতিহাসের কতটুকু খবর রাখ।
একদিন দুবেনী এল, চোখে জল নিয়ে।
দুবেজীর খুব অসুখ। কিছুদিন আগে হঠাৎ তার খেয়াল হয় যে, দুবেনী বড়ো রোগা হয়ে গিয়েছে।..তাকিয়ে তাকিয়ে অনেকক্ষণ ধরে দেখল। তারপর উঠে এসে এই কবজিটি আঙুলের বেড় দিয়ে মেপে বলল— তুই দেড় আঙুল রোগা হয়ে গিয়েছিস! দাঁড়া, দেখিয়ে দিচ্ছি পয়সা রোজগার করতে পারি কি না।..ঘোড়ার পিঠে বোরা চাপিয়ে গেল। কত মানা করলাম। মাথা কুটলাম পায়ে। শুনল না। সে বুঝ কি এখন আর আছে?…বেশি দূর যেতে হয়নি। পারবে কেন। ঘোড়াটাকে সন্ধ্যার সময় খালিপিঠে ঠুকঠুক করে ফিরে আসতে দেখেই আমার বুক কেঁপে উঠেছে। গোলাদারের কাছে কেঁদে পড়ি। সে লোক পাঠাল চারিদিকে। কিছুক্ষণ পরেই পুরানদাহার লোকেরা গোরুর গাড়িতে করে দুবেজীকে পৌছে দিয়ে গেল আমার কাছে। তখন বেহুঁশ একেবারে! ঘোড়া থেকে পড়ে, মাথায় চোট লেগে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। আমার ইচ্ছা তখনই আপনাদের এখানে নিয়ে আসি। কিন্তু গোলাদার বিসারিয়ার ডাক্তারকে ডেকে পাঠালে। ডাক্তারবাবু বললেন, এখন নড়াচড়া করলে রুগী বাঁচবে না।…তারপর থেকে তো চলছেই। চোখ খুলল তিন দিন পরে। জ্ঞানও তেমনি জ্ঞান। ঐ এক রকমের জবুথবু অবস্থা! না পারে লোক চিনতে, না পারে কিছু বলতে। শুধু তাকায়। আমার দিকে তাকায় কিন্তু আমাকেও চিনতে পারে না। মুখে দুধ দিলে বেশ ঢুকঢুক করে খায়। …ডাক্তার বলেছে খাওয়াতে বেশি করে। ঘোড়াটাকে বিক্রি করে তো এতদিন ওষুধপথ্য চলল। …আপনাদের কাছে আসবার ফুরসতই পাই না রুগী ফেলে।-আজ মুদীর ছেলেটাকে বাবাবাছা বলে বসিয়ে এসেছি। কে জানে থাকবে কিনা এতক্ষণ। —সেইজন্যই বাস-এ এলাম এক টাকা খরচ করে।
দুবেনীর দুঃখের কাহিনী আর শেষ হয় না। বুঝলাম এখন দরকার টাকার। বেশি টাকার। মেয়েমানুষের চোখে জল দেখলেই আমি কী রকম অভিভূত গোছের যেন হয়ে যাই। দুঃস্থ রাজনীতিক কর্মীদের সাহায্যের জন্য আমার কাছে একটি ‘ফান্ড’ ছিল। তার থেকে দুশ টাকা আমি দুবেনীকে দিলাম। তাকে বাস-এ চড়িয়ে দিয়ে যখন ফিরে এলাম, তখন মুসাফিরলাল সাঙ্গোপাঙ্গোদের নিয়ে আমার বিরুদ্দে ঘোঁট পাকাচ্ছে। পাবলিকের টাকা এরকম না-হক খরচ করা, আর যে-কেউ বরদাস্ত করুক, সে করবে না। দুবে জেলে যায়নি, তার স্ত্রী মাপ চেয়ে বেরিয়েছে জেল থেকে-ওরা আবার রাজনীতিক কর্মী হল কবে থেকে?
মুসাফিরলাল আমায় শাসিয়ে দিল যে, আসছে মিটিঙে সে এর একটা হেস্তনেস্ত না করে ছাড়বে না।
দিন দুই-তিন পরে দুবেজীকে দেখতে গেলাম তাদের বাড়িতে। বাড়ি মানে তো একখানি ঘর — ঘরের দেওয়াল, চাল সব কেরোসিন তেলের টিন কেটে, দুবেদুবেনীর নিজ হাতে তৈরি করা। দোকান বলো, শোবার ঘর বলো, অতিথিশালা, ঠাকুরের বলো, সব এরই মধ্যে। সেই ঘরখানিকে ঘিরে কুতুহলী দর্শকের ভিড় জমেছে। ভিড় ঠেলে ভিতরে গিয়ে দেখি, ঘরের যে কোণায় রঙিন কাগজের রথের মধ্যে রাজমীর মূর্তি আছে, তারই সম্মুখে একটি গোরু দাঁড়িয়ে। সুন্দর নধর গাইটি। ঘরের মধ্যে খাটিয়ার দুবেজী শুয়ে। চোখ বোঁজা। দুবেনী খাটিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে বাঁ হাত দিয়ে দুবের একখান হাত ছুঁয়ে রয়েছে; ডান হাত গোরুটির গায়ে। পুরুত মন্ত্র পড়ছে। গোদান করছে দুবেনী। দুবেজীকে ছুঁয়ে থেকে রামচন্দ্রজীকে বুঝোবার প্রয়াস পাচ্ছে যে, গোদান করছে তারা দুজনে মিলে।
পুরুত চলে গেলে দুবেনীর কথা বলবার সময় হল।
—‘দুবেজীর আজ দুদিন থেকে কোনো সাড়া নেই। বহুদিনের আকাঙ্খা আমাদের গোদান করবার। তাই আপনার দেওয়া দুশ টাকা দিয়ে গোরু কিনেছিলাম। জানি না এতেও রামজী আমাদের মতো পাপীদের উপর কৃপাদৃষ্টি করবেন কিনা। ওই মুখে আগেও যেমন হাসি দেখেছি, এখনও তেমনি। মুচকে হাসছেন। ও হাসি দেখলেই আমার ভয়-ভয় করে-বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে। আমাদের দুজনের পাপমোচনের দরখাস্ত উনি নামঞ্জুর করেছে বলেই বোধ হয় এই দুষ্টুমির হাসি মুখে! বলছেন—পাপীর মুক্তি কি অত সোজা!’
দুবেনীরও কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? পাপমোচনের চেষ্টা এদের একটা বাতিকের মতো দাঁড়িয়ে গিয়েছে। টাকা দিলাম ওষুধ-পথ্যর জন্য, খরচ করে দিল গোদানে। আমারই ভুল। নগদ টাকা না দিয়ে ওষুধ-পথ্য কিনে দেওয়া উচিত ছিল। এদের মনের নাগাল পাওয়া দায়!
দুবেজীকে ঐ অবস্থায় ফেলে চলে আসতে মন সরল না। থেকে গেলাম সেখানে সেদিন। বুঝলাম যে, দুবেজীর আর দেরি নেই।
সে রাত্রে আমি দুবেজীর মাথার কাছে পাখা হাতে বসে ঢুলছি। আমি থাকায় দুবেনী একটু মনে বল পেয়েছে। সে হাত জোড় করে বসে আছে রামজীর রথের সম্মুখে। ধ্যান করছে চোখ বুজে পাপীদের দরখাস্ত-নামঞ্জুর-করা হাসিটি পাছে চোখে পড়বে ভেবে, চোখ খুলতে সাহস পায় না। নিশুতি রাতের নিস্তব্ধতা হঠাৎ ভঙ্গ হল, কেরোসিন টিন দিয়ে তৈরি ছাপ্পরের উপর বৃষ্টি পড়ার শব্দতে। রামজীকে প্রণাম করে দুবেনী উঠে এল, খাটিয়ার উপর জল পড়ছে কিনা দেখতে।- বৃষ্টি পড়বার সময় খাটিয়া মধ্যে মধ্যে সরাতে হয়। এখন বাবুজী আছে। দুজন-লোক না হলে খাটিয়া সরানো যায় না। তখন মাটির ভাঁড় রাখতে হয় খাটিয়ার উপর। ভাগ্যিস ও পাগল কদিন থেকে বেহুঁশ হয়ে আছে, নইলে এই রাত দুপুরুইে হয়তো বাতিক উঠত, হাতুড়ি, পেরেক নিয়ে চালের উপর উঠবার!
খাটিয়া সরানো হল। কুপীর মৃদু আলোতেও বোঝা গেল দুবেনী কাঁদছে।
‘বাবুজী, বিপদের সময় তুমি যা করেছ, সে ঋণ আমাদের গায়ের চামড়া দিয়ে তোমার পায়ের জুতো তয়ের করে দিলেও শোধ হবার নয়।’
আমচকা এই অলংকারবহুল কৃতজ্ঞতা নিবেদনে অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। এ তো দুবেনীর স্বাভাবিক ভাষা নয়। অথচ কান্নার ফাঁক দিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে আসা কথা এতক্ষণ ধরে জপে বসেও সে নিজের মনকে শান্ত করতে পারেনি। ঝড় বয়ে চলেছে মনের মধ্যে তার। ‘আমাদের গায়ের চামড়া’ — ‘আমাদের পাপ’! —’আমার’ না বলে।
‘আমাদের বলা তাদের চিরকালের অভ্যাস। এখনকার এই বিহুলতার মধ্যেও সে অভ্যাসের ব্যতিক্রম হয়নি।—খাটিয়ার ওদিক থেকে আমারই দিকে আসছে দুবেনী! শঙ্কা, দ্বিধা চোখের জলেও ঢাকা পড়েনি। আমার চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে।—দ্বিধা কাটিয়ে, চোখের জল ছাপিয়ে, আকুল মিনতি ফুটে উঠল সে চাউনিতে!—বলতে চায় কিছু – অনুরোধ জানাতে চায়।
বলো, বলো, ভয় কী।
আশ্বাসের ইঙ্গিত জানাই। তবু বলতে কি পারে! সব কথা কি বলা যায় সকলকে! অচৈতন্য দুবের দিকে আবার একবার দেখে নিল দুবেনী- কে জানে যদি তার কথা বুঝতে পারে!-পাখাসুদ্ধ আমার হাতখানি সে নিজের মুঠোর মধ্যে চেপে ধরেছে।
‘এ কি কাউকে বলবার কথা। তবু বলছি। তোমাকে ছাড়া আর তো কাউকে দেখি না বলবার মতো। একজন কাউকে যে বলতেই হবে। চল্লিশ বছর ধরে চেপে চেপে কথাটা একেবারে জমে পাথর হয়ে উঠেছে বুকের মধ্যে। তবু রামজী ক্ষমা করেননি আমাদের।—ডাক্তারবাবু পরিষ্কার না বললেও ঘুরিয়ে বলেছেন যে, রুগী আর দু-চার দিনের বেশি বাঁচবে না। আমিও সে কথা বুঝতে পেরেছি। সেইজন্য একটা কথা বলার দরকার হয়েছে তোমার কাছে। শুনে আমাদের কী মনে করবে তাও জানি। তবু বলছি। আমার কথা রাখতে হবে একটা? আগে কথা দাও, তবে বলব।’
কথা দিলাম।
‘শোনো তবে বলি। যে কথা বলিনি চল্লিশ বছর থেকে। পোড়া মুখ। আমি দুবেজীর নিকট-আত্মীয়া। দুবেজীর বউ ছিল, ছেলে ছিল, সব ছিল। তারা আমারও আপনার লোক। ফিরবার পথ জন্মের মতো বন্ধ হয়ে গেল জেনেও এসেছিলাম। যাক, সেসব ছেড়ে এসেছিলাম বলে দুঃখ নেই। আমার কথা বাদ দাও! কিন্তু নিজের ছেলে থাকতে তার হাতের জল না পেয়ে দুবেজী চলে যাবে, তা কি হয়? মুখে আগুনটুকু পাবে না? তবে আর লোকের ছেলে হয় কিসের জন্য? ছেলের হাতের জল পেলে সে পাপ থেকে মুক্তি পেয়ে স্বর্গে যেতে পারে। আমার মন যে তাই বলছে। নিজের জন্য ভাবি না; আমার বরাতে যা লেখা আছে তাই হবে। কিন্তু ওর যে রাস্তা রয়েছে পাপ খন্ডাবার। তুমি বাবুজী, ওর ছেলেকে যেমন করে হোক নিয়ে এস বাড়ি থেকে। সাহাবাদ জেলা, সাসারাম থানা-হরকতমাহী গ্রামের পচ্ছিমটোলা। চিঠি দিলে আসবে না। ধরে আনতে হবে। আমি আছি জানলে আসবে না। বলে দিও মরে গিয়েছে; তাহলে এক যদি আসে!…না কোরো বাবুজী। আমাকে কথা দিয়েছ!…
সাংসারিক জীবনের সাতেও থাকি না, পাঁচেও থাকি না। তবু জড়িয়ে পড়লাম এদের নিভৃত পারিবারিক জীবনের সঙ্গে। দিন তিনেক পর সাহাবাদ জেলার এক গ্রামে গিয়ে দুবেজীর ছেলের সঙ্গে দেখা করলাম। নাতিপুতিওয়ালা ঘোর সংসারী লোক। বাবা মৃত্যুশয্যায় শুনেও আমলই দিতে চায় না প্রথমটায়। রুক্ষ মেজাজ। তার মা বেঁচে আছেন কি না, জিজ্ঞেস করায় রুক্ষ স্বরে জানিয়ে দিল যে, তিনি পঁয়ত্রিশ বছর আগে স্বর্গে গিয়েছেন। স্পষ্ট বুঝিয়ে দিল যে, তাদের বাড়ির জেনানাদের সম্বন্ধে বাইরের লোকের কৌতুহল সে পছন্দ করে না। বাবার কথা তার মনে নেই, তাই তাকে নিয়েও মাথা ঘামাতে চায় না। বুঝলাম যে, এতদিনকার ভুলে-যাওয়া পারিবারিক কলঙ্কটাকে নিয়ে সে আর ঘাঁটাঘাঁটি করতে চাচ্ছে না। তাদের এই আত্মীয়টি মারা গিয়েছে, এই মিথ্যা সংবাদটি পেয়েও তার মন ভিজল না। তখন আমি অন্য রাস্তা নিলাম। দুবেজী সেখানে একজন মস্ত লীডার, এ খবর শুনে একটু যেন তার উদাসীনতা কাটল। তখন ছাড়লাম ব্রহ্মাস্ত্র।‘দুবেজী সেখানে বাড়িঘরদোর করেছে। বাজারের উপর দোকান। তুমি না গেলে সেসব সাতভূতে লুটেপুটে খাবে। সেগুলো বিক্রি করে আসবার জন্যও তো তোমার যাওয়া দরকার।
‘বাড়ি কি খাপরার?”
‘না। টিনের’।
মিথ্যা বলিনি। বাড়ি সে কেরোসিনের টিন দিয়ে তৈরি, শুধু সেই কথাটি খুলে বললাম। এই ওষুধেই কাজ হল।
তাকে সঙ্গে নিয়ে এক সন্ধ্যায় যখন ধামদাহা-হাটে পৌঁছলাম, তখন দুবেজীর শবদেহ বার হচ্ছে। কানা মুসাফিরলালের ব্যবস্থা ত্রুটিহীন। আসপাশের গ্রামের রাজনৈতিক কর্মীদের সে ডাকিয়ে এনেছে। বিস্তর লোক জমেছে। নিশান, শোভাযাত্রা, অ্যাসিটিলিন আলো,-যেমন হওয়া উচিত, তার চেয়েও অনেক বেশি।
আমাদের দেখেই মুসাফিরলাল এগিয়ে এল। তাকে আলাদা দূরে নিয়ে গিয়ে বলে দিলাম যে, এ হচ্ছে দুবেজীর ছেলে, — তাকে যেন কিছু গোলমেলে কথা না জিজ্ঞাসা করা হয়।
‘ছেলে’?
মুসাফিরলাল অবাক হয়ে গেল। তারপর চাপা গলায় আমাকে শোনাল দুবেজীর মৃত্যুর চেয়েও চাঞ্চল্যকর খবর!
‘দুবেনী পালিয়েছে। আমি এখানে এসেছিলাম পরশু রাতে, তোমার খোঁজে। তখনও দুবেনী ছিল। আমাকে রুগীর কাছে বসিয়ে সে একটা ছুতো করে বাইরে যায়। আর ফেরেনি।
বুঝলে ব্যাপারটা?
বিদেশে এক কানাকড়িও না নিয়ে যে রোজগারের ধান্দায় আসে, সে কি কখনও বউকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে প্রথমেই?
এসে, মাথা গুজবার মতো একটা জায়গা করে নিয়ে তবে না লোকে বউ আনে? আমি চিরকাল বলেছি’
তার কথা শেষ পর্যন্ত শোনবার উৎসাহ তখন আমার নেই। বুঝলাম যে, মুসাফিরলাল এখানে আসায় দুবেনী হাতে স্বর্গ পেয়েছিল; সে না এলে রুগীকে একেবারে একা ফেলে বোধ হয় দুবেনী পালাতে পারত না। মুসাফিরলাল এখনও বোধ হয় ভাবছে যে, সে পালিয়েছে রুগীর সেবা করতে করতে বিরক্ত হয়ে। কিন্তু আমি তো জানি! দুবেকে মৃত্যুশয্যায় ফেলে চলে যাবার সময় তার বুক ফেটে গিয়েছে। তবু নিজেকে নিশ্চিহ্ন করে মুছে ফেলে দিয়ে, সে দুবের একার পাপমোচনের ব্যবস্থা করে গিয়েছে!
একটি ছোট্ট নদীর ধারে শ্মশানঘাট। ভাদ্র মাস। শ্মশানঘাটের কাছটুকু ছাড়া প্রায় সর্বত্রই জলে ভরা। যেখানে জল নেই, সেখানে কাশের বন। চিতা জ্বলছে। আলো পড়ে ওপারের অন্ধকারের বুকে কাশফুলের চুনকাম বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দুবেজীর ছেলে একটিও কথা বলেনি এখন পর্যন্ত; বোধ হয় বাড়ি দেখে হতাশ হয়েছে। সকলেই চুপচাপ। হঠাৎ ওপারের কাশবন নড়ে উঠল— চুনকামের মধ্যে যেন একটু ফাঁক-স্পষ্ট দেখা যায় না কিছুই- কাশের সমুদ্রের মধ্যে খসখসানির ঢেউটা মিলিয়ে গেল।
বুঝলাম। হয়তো আমার সন্দেহ মাত্র! ভুলও হতে পারে! কে জানে।
সকলেই সেই দিকে তাকিয়ে। দুবের ছেলেও।
মুসাফিরলাল বলে ‘শিয়াল-টিয়াল হবে বোধ হয়’। তাকিয়ে দেখি তার ভাল চোখটির উপর চিতার আলো পড়েছে! দরদে ভরা! তার পরিচিত কুটিল দৃষ্টি গেল কোথায়?
সেও বুঝেছে, আমি যা বুঝেছি। শিয়ালের কথা তুলেছে, যাতে বাকি সকলে আর ও নিয়ে মাথা না ঘামায়-ওদিকে আর না তাকায়।
এই প্রথম কানা মুসাফিরলালকে খুব ভাল লাগল; তার ভাল চোখের চাউনিটিকেও।
গল্পটি খুব সুন্দর। মর্মস্পর্শী।